ভুবন জোড়া মায়া (পর্ব-বারো ও তেরো)

সুরভী হাসনীন
উত্তর পীরেরবাগ, ঢাকা।

ভুতনগরঃ ভুবন জোড়া মায়া (পর্ব -বারো ও তেরো)

একটানা মিহি সুরে তেলাওয়াত শেষে থামে কুসুম। আজ তিন দিন হল খোদেজা বুবু মারা গেছেন। কি বীভৎস মৃত্যু। গলায় ফাঁস লাগা, জিহ্বা কাটা ঝুলছে মুখের বাইরে। বিস্ফারিত চোখগুলো যেন কোন পাপ স্বীকারে ব্যস্ত।

দম বন্ধ লাগে কুসুমের। আজ কয়েক সপ্তাহ, নতুন এক মহিলা এসেছেন মাদ্রাসায়। তিনিই নাকি মালিক। মাছুম হুজুর, হুজুর বলেই তৌবা কাটে কুসুম।

-হারামজাদা, কিসের হুজুর। যে ওমন পাপ কাজ করে সে কেম্নে হুজুর হয়?

ভাবতে থাকে কুসুম। রুকসানা বু, সিতারা বু সবার আজকের এই জীবনের জন্য ঐ হারামজাদাটা দায়ী। সে নিজে কতবার ভেবেছে মরে যাবে। কিন্তু বেলায়েত, এই ছেলেটা আর নূর! সেই অদৃশ্য বন্ধু যে সুমধুর সুরের তিলাওয়াতে, তর্জমায় শুনিয়েছে খোদার বিধান। তাদের জন্যই আজ সে বেঁচে আছে। 

নতুন আপা মানুষটা ভালো। আদর করে। দেখা হলে মাথায় হাত বুলিয়ে কথা বলে। মাদ্রাসার পরিবেশ শান্ত। ভালো একটা অনুভূতিতে মন ভালো হয়ে ওঠে কুসুমের।

– মরিয়ম, এই তোমার দুমাসের অগ্রিম বেতন। বিকেলের মধ্যে মাদ্রাসা ছাড়বা। তোমার স্বামীসহ। লোকমান আর তোমারে এই মাদ্রাসার সীমানায় যানি না দেহি।

দিলারা এত জোর দিয়ে শেষের কথাগুলো বলে, কেঁপে ওঠে লোকমান। সেদিনের বাসের ঘটনার পর সংগাহীন লোকমানকে রাস্তা থেকে মাদ্রাসায় এনে দিয়েছিল তারই পুরনো কজন ছাত্র। গভীর রাতে লোকমান আর মরিয়মকে এক ঘরে দেখেই বিয়ে পড়ানোর ব্যবস্থা করে দিলারা।  

চোখ মুছে মাপ চায় লোকমান। বেলায়েতের কাছে মাপ চায় বেশি। সুলেমানের হাত চেপে ধরে বিদায় নিতে গিয়ে কেঁদে দেয় সে। লোকমান আর মরিয়ম বেরিয়ে গেলে, নিজের হাতে তালা লাগায় দিলারা। মাদ্রাসায় একজন পুরুষ সুপার দরকার। সুলেমানকে দায়িত্ব বোঝায় দিলারা। কিছুটা নিশ্চিন্তে ঘরের দিকে হাঁটে সে। আজ খুব ঘুম পাচ্ছে। খুব ঘুম। যেন স্বপ্ন তাকে ডাকছে ঘুমের দেশে।

অন্ধকার ঘরে একটা ছোট আলো জ্বলে নেভে। পাটি পেতে দিলারা নামাজ শেষে মুনাজাত ধরে। নাসিমা পাশে বসে। যেন তার হাত দুটো ধরে বলে

-সই , তারে নিয়া আয় একবার। একবার নিয়া আয়।

ছাতি ফাঁটা পিপাসায় ঘুম ভাঙে দিলারার। নাসিমা কাকে চাইল। কে সে? কাকে আনবে দিলারা? কার খোঁজে নাসিমা ঘুরছে এতটা বছর? লোকমান? নাকি সেই লজিং মাস্টার, যাকে প্রেম পত্র দিয়েছিল নাসিমা, নাকি বড় হুজুর? কে?

লম্বা গড়নের রহমত আলি বাংলা পড়াত। মাদ্রাসায় লজিং থেকে পড়াশোনা। বাংলায় বিএ পড়ত ছাত্র -ছাত্রীদের পড়ানোর বিনিময়ে খাওয়া পরা জুটত। সেই ছেলেক প্রেমপত্র দিয়ে বসল নাসিমা। লুকিয়ে একদিন সিনেমা দেখতে গেল।
ফিরে এসে দুজনের কি হাসি। মাসুম হারামজাদাটা দেখে ফেলল। আর পরের দিন থেকে রহমতের ছাত্রী মহলে বাংলা পড়ানো বন্ধ হয়ে গেল। একমাস পর ছেলেটাই কোথায় যেন চলে গেল। দিলারা এখনো ভাবে, নাসিমা তিন মাসের পোয়াতি থাকলে তার বাপ কে? কোন পুরুষ এমন বাপ, যে বাচ্চা রাইখা যায় গা?

দিলারা ঘুমায়। নামাজের পর শান্তির ঘুমের অতল সমুদ্রে যেন ডুব দেয় দিলারা।

পর্ব-তেরো

একটা তীব্র অন্ধকার ছায়া ঘরের চারপাশে ঘুরছে। চেষ্টা করছে ঘরের ভেতর যাবার কিন্তু কিছুতেই পারছে না। তীব্র ক্ষোভে ছায়া বৃথা আস্ফালন করে।

দিলারা সকালে মাদ্রাসার মেয়েদের জন্য কাপড় বানাতে যাবে, খবরটা লোকমান জানতে পারে এক ছাত্রের কাছে। মাছুম হুজুর এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। দিলারা বেরিয়ে যেতেই খালি মাদ্রাসায় এসে হাজির হয়েছে। আর তলব করেছে কুসুমকে। 

নিজের ঘরে দরজা আটকে বসে আছে কুসুম। দরজার বাইরে বেলায়েত দাঁড়ান। আজ পুরো মাদ্রাসার পরিবেশ থমথম করছে। ছেলে মহলের ছেলেগুলোও যেন কিসের আলামতে ক্ষেপে আছে সকাল থেকে।

কাল রাতে বেলায়েত নিজের দায়িত্বে সবাইকে জড়ো করেছিল। এতদিন ধরে মেয়ে মহলে, ছোট ছোট এই নাজুক বোনগুলোর ওপর চলে আসা অত্যাচারের কথা সে বলে দিয়েছে সবাইকে। আজকে যখন মাছুম হুজুর আসল, ছাত্ররা আগুন চোখে তাকিয়েছিল তার দিকে। হুজুর মাদ্রাসায় ঢুকেই বড় ঘরের খাস কামরায় চলে গেছেন। দুজন খাদেম দরজার বাইরে দাঁড়ান। 

মাছুম খুব দ্রুত ছক কষে। দিলারার এত দিন পর ফিরে আসার পেছনে কারণ সে খুঁজে পায় না। অস্বাভাবিক মৃত্যুগুলো তাকে অস্থির করে তুলেছে। প্রথমে ছাত্র তিনজন চলে গেল বীভৎস খুনে। তারপর খোদেজা। লোকমান ও বিতাড়িত। কে এই খুনি? 

খুনগুলো কোন মানুষের নয় দেখলেই বোঝা যায়। নাসিমার অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর শ্বশুর আব্বা নিজ হাতে মাদ্রাসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। স্নানঘরের পাশের দেয়ালে পোতা তাবিজের জায়গাটা খালি ছিল, রোকনের লাশ নামানোর সময় দেখেছিল লোকমান। কোথায় সেই তাবিজ। কে তুলল? কার এত সাহস হলো? 

রুকসানা আজ অনেক দিন পর ভাত খেয়েছে। এবরসনের পর নিজেকে সামলে নিতে তার সময় লেগেছে অনেক। কুসুম মেয়েটা না থাকলে সে মরেই যেত। সিতারাকে বাড়ি নিয়ে গেছে। সে কোথায় যাবে? একটা মা মরা, বাপ তাড়ানো মেয়ে কোথায় কার কাছে নিরাপদ? সময় নিয়ে নিজেকে গুছিয়ে প্রস্তুত করেছে রুকসানা। কুসুম নয়, সে যাবে আজ মাসুম আলির ঘরে। 

চলবে…

https://ochinpurexpress.com/%e0%a6%ae%e0%a6%a8%e0%a7%8b%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%a4/%e0%a6%ad%e0%a7%81%e0%a6%ac%e0%a6%a8-%e0%a6%9c%e0%a7%8b%e0%a7%9c%e0%a6%be-%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a7%9f%e0%a6%be-%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ac-%e0%a6%a6%e0%a6%b6-%e0%a6%8f%e0%a6%97%e0%a6%be/

অচিনপুর ডেস্ক/ জেড. কে. নিপা

Post navigation