– হুমায়ুন আজাদ ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো।ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালি গান, ভালো থেকো।ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা।ভালো থেকো পাখি, সবুজ পাতারা।ভালো থেকো। ভালো থেকো চর, ছোট কুড়ে ঘর, ভালো থেকো।ভালো থেকো চিল, আকাশের নীল, ভালো থেকো।ভালো থেকো…
Tag: হুমায়ুন আজাদ
হুমায়ুন আজাদ
হুমায়ুন আজাদ (২৮ এপ্রিল ১৯৪৭ – ১২ আগস্ট ২০০৪ খ্রিস্টাব্দ; ১৪ বৈশাখ ১৩৫৪ – ২৬ শ্রাবণ ১৪১১ বঙ্গাব্দ) একজন বাংলাদেশি কবি, ঔপন্যাসিক, ভাষাবিজ্ঞানী, সমালোচক, রাজনীতিক ভাষ্যকার, কিশোরসাহিত্যিক, গবেষক, এবং অধ্যাপক ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম প্রথাবিরোধী এবং বহুমাত্রিক লেখক যিনি ধর্ম, মৌলবাদ, প্রতিষ্ঠান ও সংস্কারবিরোধিতা, যৌনতা, নারীবাদ ও রাজনীতি বিষয়ে তার বক্তব্যের জন্য ১৯৮০-এর দশক থেকে পাঠকগোষ্ঠীর দৃষ্টি আর্কষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। হুমায়ুন আজাদের ৭টি কাব্যগ্রন্থ, ১২টি উপন্যাস ও ২২টি সমালোচনা গ্রন্থ, ৭টি ভাষাবিজ্ঞানবিষয়ক, ৮টি কিশোরসাহিত্য ও অন্যান্য প্রবন্ধসংকলন মিলিয়ে ৬০টিরও অধিক গ্রন্থ তার জীবদ্দশায় এবং মৃত্যু পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত হয়। ১৯৯২ সালে তার নারীবাদী গবেষণা-সংকলনমূলক গ্রন্থ নারী প্রকাশের পর বিতর্কের সৃষ্টি করে এবং ১৯৯৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সাড়ে চার বছর ধরে বইটি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ছিল। এটি তার বহুল আলোচিত গবেষণামূলক কাজ হিসাবেও স্বীকৃত। এছাড়াও তার পাক সার জমিন সাদ বাদ উপন্যাসটি পাঠকমহলে বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। তার রচিত প্রবচন সংকলন ১৯৯২ সালে হুমায়ুন আজাদের প্রবচনগুচ্ছ নামে প্রকাশিত হয়। তাকে ১৯৮৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০১২ সালে সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম এবং ভাষাবিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্য মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয়। ২০০৩ সালে তার রচিত কিশোরসাহিত্য ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না (১৯৮৫) এবং আব্বুকে মনে পড়ে (১৯৯২) জাপানি ভাষায় অনূদিত হয়েছিলো।
জীবন
প্রাথমিক জীবন
হুমায়ুন আজাদ ২৮ এপ্রিল ১৯৪৭ সালে তার মাতামহের বাড়ি, তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের (বর্তমানে বাংলাদেশ) অধীন বিক্রমপুরের কামারগাঁয় জন্ম নেন; যেটি বর্তমানে মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার অন্তর্গত। তার জন্ম নাম ছিল হুমায়ুন কবীর। ১৯৮৮ সালে ২৮ সেপ্টেম্বর নাম পরিবর্তনের মাধ্যম তিনি বর্তমান নাম ধারণ করেন।তার বাবা আবদুর রাশেদ প্রথম জীবনে বিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও পোস্টমাস্টার পদে চাকরি করতেন, পরে ব্যবসায়ী হন। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে তার বাবা মৃত্যুবরণ করেন। মা জোবেদা খাতুন ছিলেন গৃহিণী,যিনি ২০০৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তিন ভাই এবং দুই বোনের মধ্যে আজাদ ছিলেন পিতামাতার দ্বিতীয় পুত্রসন্তান। ছেলেবেলায় তার ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি রাড়িখাল গ্রামে বেড়ে ওঠেন।পরবর্তীতে তার বিভিন্ন লেখায় বিভিন্ন ভাবে রাড়িখাল গ্রামের বর্ণনা উঠে এসেছে এবং এ গ্রাম নিয়ে তিনি “রাড়িখাল : ঘুমের ভেতরে নিবিড় শ্রাবণধারা” নামে একটি লেখা প্রকাশ করেন। আজাদের মতে তার শৈশব ও কৈশোর ছিল তার জীবনের শ্রেষ্ঠ খণ্ড, যে সময়ের কথা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে তার ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না (১৯৮৫), নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু (২০০০), শ্রাবণের বৃষ্টিতে রক্তজবা (২০০২) এবং বিভিন্ন লেখায় উঠে এসেছে। আজাদের গ্রামের মাইল দুয়েক দক্ষিণে রয়েছে পদ্মা নদী, রাতের বেলায় নদীতে স্টিমার চলার ধ্বনি শৈশবে তাকে প্রভাবিত করায় তিনি তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম দেন অলৌকিক ইস্টিমার (১৯৭৩)।
উচ্চশিক্ষা
১৯৬২ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য আজাদ ঢাকায় চলে আসেন। মানবিক বিভাগে পড়ার ইচ্ছা থাকলেও বাবার ইচ্ছায় ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৬৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন।এরপর একই বছর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি এবং ১৯৬৮ সালে একই বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।উভয় পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। হুমায়ুন আজাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াকালীন সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্রাবাসে থাকতেন।
কর্মজীবন
১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ২২ বছর বয়সে তার কর্মজীবন শুরু হয় চট্টগ্রাম কলেজে প্রভাষক হিসাবে।সেখানে কিছুকাল কর্মরত থাকার পর ১৯৭০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। একই বছর ১২ ডিসেম্বর তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগ দেন।১৯৭৩ সালে তার প্রথম গবেষণা গ্রন্থ রবীন্দ্রপ্রবন্ধ: রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তা এবং একইবছর সেপ্টেম্বরে কাব্যগ্রন্থ অলৌকিক ইস্টিমার প্রকাশিত হয়। সে বছরের সেপ্টেম্বরে তিনি কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে ভাষাবিজ্ঞান পড়তে স্কটল্যান্ডে চলে যান। ১৯৭৬ সালে তিনি স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।তার গবেষণার বিষয় ছিল বাংলা ভাষায় সর্বনামীয়করণ। এই গবেষণাপত্র ১৯৮৩ সালে প্রোনোমিনালাইজেশন ইন বেঙলি নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে প্রকাশিত হয়। এডিনবরায় গবেষণাকালীন সময়ে তিনি রবার্ট ক্যাল্ডরের সহযোগিতায় কবি জীবনানন্দ দাশ এবং নিজের কিছু কবিতা অনুবাদ করেছিলেন, যেগুলি “লিডস বিশ্ববিদ্যালয় জার্নাল” এবং এডিনবরার বিশ্ববিদ্যালয়ের “চ্যাপম্যান” সাময়িকপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল।
ব্যক্তিগত জীবন
হুমায়ুন আজাদ ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পড়ার সময় লতিফা কোহিনুর নামের এক তরুণীর সঙ্গে পরিচিত হন এবং ১৯৭৫ সালের ১২ই অক্টোবর তাদের বিয়ে হয় টেলিফোনে; আজাদ তখন স্কটল্যান্ডে আর লতিফা বাংলাদেশে ছিলেন। তাদের দুই কন্যা মৌলি আজাদ, স্মিতা আজাদ এবং এক পুত্র অনন্য আজাদ। জ্যেষ্ঠ কন্যা মৌলি আজাদ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সহকারী সচিব হিসাবে দায়িত্বরত।
পুরস্কার এবং সম্মাননা
পুরস্কার | বছর | পুরস্কারের ক্ষেত্র | মন্তব্য |
---|---|---|---|
অগ্রণী ব্যাংক-শিশু সাহিত্য পুরস্কার | ১৯৮৬ | শিশু সাহিত্য | |
একুশে পদক | ২০১২ | ভাষা ও সাহিত্য | মরণোত্তর |
বাংলা একাডেমি পুরস্কার | ১৯৮৬ | সামগ্রিক অবদান | |
মার্কেন্টাইল ব্যাংক পুরস্কার | ২০০৪ |
মৃত্যু
২০০২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জার্মান কবি হাইনরিখ হাইনের উপর কাজ করার জন্য জার্মান সরকারের নিকট একটি বৃত্তির আবেদন করেছিলেন। ২০০৪-এর ৭ আগস্ট জার্মান কবি হাইনরিখ হাইনের ওপর গবেষণা বৃত্তি নিয়ে জার্মানি যান।
২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের ১১ আগস্ট রাতে একটি অনুষ্ঠান থেকে প্রত্যাবর্তনের পর আবাসস্থলে আকস্মিকভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন হুমায়ুন আজাদ। ১২ আগস্ট আবাসস্থলের নিজ কক্ষে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুর পর জার্মান সরকারের তত্ত্বাবধানে মিউনিখে তার নিজ বাসভবনে পাওয়া সব জিনিসপত্র ঢাকায় তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে। ওই জিনিসপত্রের ভেতরেই পাওয়া যায় তার হাতের লেখা তিনটি চিঠি। চিঠি তিনটি আলাদা তিনটি পোস্ট কার্ডে লিখেছেন বড় মেয়ে মৌলিকে, ছোট মেয়ে স্মিতাকে এবং একমাত্র ছেলে অনন্য আজাদকে। অনুমান করা হয়, ওই লেখার অক্ষরগুলোই ছিল তার জীবনের শেষ লেখা।তার মরদেহ কফিনে করে জার্মানি থেকে ঢাকায় আনা হয়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাযার নামাজ শেষে তার মরদেহ রাড়িখালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয় এবং পরে তার কবর সিমেন্ট দিয়ে পাকা করে একটি বইয়ের মত করে বানানো হয়।
ব্যাধিকে রূপান্তরিত করছি মুক্তোয়
__হুমায়ুন আজাদ একপাশে শূন্যতার খোলা, অন্যপাশে মৃত্যুর ঢাকনা,প’ড়ে আছে কালো জলে নিরর্থক ঝিনুক।অন্ধ ঝিনুকের মধ্যে অনিচ্ছায় ঢুকে গেছি রক্তমাংসময়আপাদমস্তক বন্দী ব্যাধিবীজ। তাৎপর্য নেই কোন দিকে-না জলে না দেয়ালে-তাৎপর্যহীন অভ্যন্তরে ক্রমশ উঠছি বেড়েশোণিতপ্লাবিত ব্যাধি। কখনো হল্লা ক’রে হাঙ্গরকুমীরসহঠেলে আসে হলদে পুঁজ,…
বাঙলা ভাষা
__হুমায়ুন আজাদ শেকলে বাঁধা শ্যামল রূপসী, তুমি-আমি, দুর্বিনীত দাসদাসী-একই শেকলে বাঁধা প’ড়ে আছি শতাব্দীর পর শতাব্দী।আমাদের ঘিরে শাঁইশাঁই চাবুকের শব্দ, স্তরে স্তরে শেকলের ঝংকার।তুমি আর আমি সে-গোত্রের যারা চিরদিন উৎপীড়নের মধ্যে গান গায়-হাহাকার রূপান্তরিত হয় সঙ্গীতে-শোভায়। লকলকে চাবুকের আক্রোশ আর…
ফুলেরা জানতো যদি
__হুমায়ুন আজাদ মুলঃ হেনরিক হাইনে ফুলেরা জানতো যদি আমার হৃদয়ক্ষতবিক্ষত কতোখানি,অঝোরে ঝরতো তাদের চোখের জলআমার কষ্ট আপন কষ্ট মানি । নাইটিংগেল আর শ্যামারা জানতো যদিআমার কষ্ট কতোখানি-কতোদুর,তাহলে তাদের গলায় উঠতো বেজেআরো ব হু বেশী আনন্দদায়ক সুর । সোনালী তারারা দেখতো…
প্রেমিকার মৃত্যুতে
__হুমায়ুন আজাদ খুব ভালো চমৎকার লাগছে লিলিআন,মুহুর্মুহু বিস্ফোরণে হবো না চৌচির।তরঙ্গে তরঙ্গে ভ্রষ্ট অন্ধ জলযানএখন চলবে জলে খুব ধীরস্থির।অন্য কেউ ঢেলে নিচ্ছে ঠোঁট থেকে লালমাংস খুঁড়ে তুলে নিচ্ছে হীরেসোনামণি;এই ভয়ে কাঁপবে না আকাশপাতাল,থামবে অরণ্যে অগ্নি আকাশে অশনি। আজ থেকে খুব…
তোমার দিকে আসছি
__হুমায়ুন আজাদ অজস্র জন্ম ধরেআমি তোমার দিকে আসছিকিন্তু পৌঁছুতে পারছি না।তোমার দিকে আসতে আসতেআমার এক একটা দীর্ঘ জীবন ক্ষয় হয়ে যায়পাঁচ পঁয়সার মোম বাতির মত। আমার প্রথম জন্মটা কেটে গিয়েছিলোশুধু তোমার স্বপ্ন দেখে দেখে,এক জন্ম আমি শুধু তোমার স্বপ্ন দেখেছি।আমার…
তোমার ক্ষমতা
__হুমায়ুন আজাদ তুমি ভাঙতে পারো বুক শুষে নিতে পারো সব রক্ত ও লবণবিষাক্ত করতে পারো ঘুম স্বপ্নময় ঘুমের জগততছনছ ক’রে দিতে পারো তুমি বন উপবনউল্টেপাল্টে দিতে পারো সব সিঁড়ি লিফট্ রাজপথ মিশিয়ে দিতেও পারো সঙ্গীতের সুরেসুরে বিষআমাকে প্রগাঢ় কোনো আত্নহত্যায়…
তৃতীয় বিশ্বের একজন চাষীর প্রশ্ন
__হুমায়ুন আজাদ আগাছা ছাড়াই, আল বাঁধি, জমি চষি, মই দিই,বীজ বুনি, নিড়োই, দিনের পরদিন চোখ ফেলে রাখি শুকনো আকাশের দিকে। ঘাম ঢালিখেত ভ’রে, আসলে রক্ত ঢেলে দিইনোনা পানিরূপে; অবশেষে মেঘ ও মাটির দয়া হলেখেত জুড়ে জাগে প্রফুল্ল সবুজ কম্পন।খরা, বৃষ্টি,…
তুমি হাতখানি রাখো
__হুমায়ুন আজাদ মূলঃ হেনরিক হাইনে প্রিয়তমা, তুমি হাতখানি রাখো আমার গুমোট বুকে।শুনতে পাচ্ছো শব্দ? কে যেনো হাতুড়ি ঠুকে চলছে?সেখানে এক মিস্ত্রি থাকে,যে বানিয়ে চলেছেএক শবাধার ।কার জন্যে জানো?—– আমার, আমার । উল্লাসে বিদ্বেষে নিরন্তর সে হাতুড়িঠুকছে দুই হাতে,কিছুতে ঘুমোতে পারছিনা…
গোলামের গর্ভধারিণী
__হুমায়ুন আজাদ আপনাকে দেখিনি আমি; তবে আপনিআমার অচেনানন পুরোপুরি, কারণ বাঙলারমায়েদের আমিমোটামুটি চিনি, জানি। হয়তোগরিব পিতার ঘরেবেড়ে উঠেছেন দুঃক্ষিণীবালিকারূপে ধীরেধীরে;দুঃক্ষের সংসারে কুমড়ো ফুলেরমতো ফুটেছেনঢলঢল, এবং সন্ত্রস্ত ক’রেতুলেছেন মাতাও পিতাকে। গরিবের ঘরে ফুলভয়েরই কারণ।তারপর একদিন ভাঙা পালকিতে চেপেদিয়েছেনপাড়ি, আর এসে উঠেছেন…
গোলাপ ফোটাবো
__হুমায়ুন আজাদ ওষ্ঠ বাড়িয়ে দাও গোলাপ ফোটাবো,বঙ্কিম গ্রীবা মেলো ঝরনা ছোটাবো।যুগল পাহাড়ে পাবো অমৃতের স্বাদ,জ্ব’লে যাবে দুই ঠোঁটে একজোড়া চাঁদ।সুন্দরীর নৌকো ঢুকাবো বঙ্গোপসাগরে,অতলে ডুববো উত্তাল আশ্বিনের ঝড়ে।শিউলির বোঁটা থেকে চুষে নেবো রস,এখনো আমার প্রিয় আঠারো বয়স।তোমার পুষ্পের কলি মধুমদগন্ধময়,সেখানে বিন্দু…
গরীবের সৌন্দর্য
__হুমায়ুন আজাদ গরিবেরা সাধারণত সুন্দর হয় না।গরিবদের কথা মনে হ’লে সৌন্দর্যের কথা মনে পড়ে না কখনো।গরিবদের ঘরবাড়ি খুবই নোংরা, অনেকের আবার ঘরবাড়িই নেই।গরিবদের কাপড়চোপড় খুবই নোংরা, অনেকের আবার কাপড়চোপড়ই নেই।গরিবেরা যখন হাঁটে তখন তাদের খুব কিম্ভুত দেখায়।যখন গরিবেরা মাটি কাটে…
এই তো ছিলাম শিশু
__হুমায়ুন আজাদ এই তো ছিলাম শিশু এই তো ছিলাম বালকএই তো ইস্কুল থেকে ফিরলাম এই তো পাখির পালককুড়িয়ে আনলাম এই তো মাঘের দুপুরেবাসা ভাঙলাম শালিকের সাঁতরিয়ে এলাম পুকুরেএই তো পাড়লাম কুল এই তো ফিরলাম মেলা থেকেএই তো পেলাম ভয় তেঁতুলতলায়…
এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়
__হুমায়ুন আজাদ এ লাশ আমরা রাখবো কোথায় ?তেমন যোগ্য সমাধি কই ?মৃত্তিকা বলো, পর্বত বলোঅথবা সুনীল-সাগর-জল-সব কিছু ছেঁদো, তুচ্ছ শুধুই !তাইতো রাখি না এ লাশআজ মাটিতে পাহাড়ে কিম্বা সাগরে,হৃদয়ে হৃদয়ে দিয়েছি ঠাঁই।
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে
__হুমায়ুন আজাদ আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।আমার খাদ্যে ছিল অন্যদের আঙুলের দাগ,আমার পানীয়তে ছিল অন্যদের জীবাণু,আমার বিশ্বাসে ছিল অন্যদের ব্যাপক দূষণ।আমি জন্মেছিলাম আমি বেড়ে উঠেছিলামআমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।আমি দাঁড়াতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো,আমি হাঁটতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো,আমি পোশাক পরতে শিখেছিলাম…
আমার কুঁড়েঘরে
__হুমায়ুন আজাদ আমার কুঁড়েঘরে নেমেছে শীতকালতুষার জ’মে আছে ঘরের মেঝে জুড়ে বরফ প’ড়ে আছেগভীর ঘন হয়ে পাশের নদী ভ’রেবরফ ঠেলে আর তুষার ভেঙে আর দু-ঠোঁটে রোদ নিয়েআমার কুঁড়েঘরে এ-ঘন শীতে কেউ আসুক আমার গ্রহ জুড়ে বিশাল মরুভূমিসবুজ পাতা নেই সোনালি…
আমার অশ্রু
__হুমায়ুন আজাদ মূলঃ হেনরিক হাইনে আমার অশ্রু এবং কষ্টরাশি থেকেফুটে উঠে ফুল থরে থরে অফুরান,এবং আমার দীর্ঘশ্বাসেবিকশিত হয় নাইটিংগেলের গান । বালিকা, আমাকে যদি তুমি ভালোবাসো,তোমার জন্য সে ফুল আনবো আমি—এবং এখানে তোমার দ্বারের কাছেনাইটিংগেলেরা গান গাবে দিবাযামি ।
আমাদের মা
__হুমায়ুন আজাদ আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি, বাবাকে আপনি।আমাদের মা গরিব প্রজার মত দাঁড়াতো বাবার সামনে,কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ ক’রে উঠতে পারতোনা।আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যেমাকে আপনি বলার কথা আমাদের কোনোদিন মনেই হয়নি।আমাদের মা আমাদের…
আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর
– হুমায়ুন আজাদ আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর শুনেছি তুমি খুব কষ্টে আছো।তোমার খবরের জন্য যে আমি খুব ব্যাকুল,তা নয়। তবে ঢাকা খুবই ছোট্ট শহর। কারো কষ্টেরকথা এখানে চাপা থাকে না। শুনেছি আমাকেছেড়ে যাওয়ার পর তুমি খুবই কষ্টে আছো।প্রত্যেক রাতে সেই…
সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে
__হুমায়ুন আজাদ আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।নষ্টদের দানবমুঠোতে ধরা পড়বে মানবিকসব সংঘ-পরিষদ; চলে যাবে, অত্যন্ত উল্লাসেচ’লে যাবে এই সমাজ-সভ্যতা-সমস্ত দলিলনষ্টদের অধিকারে ধুয়েমুছে, যে-রকম রাষ্ট্রআর রাষ্ট্রযন্ত্র দিকে দিকে চলে গেছে নষ্টদেরঅধিকারে। চ’লে যাবে শহর বন্দর ধানক্ষেতকালো মেঘ লাল শাড়ি…
আমি সম্ভবত খুব ছোট কিছুর জন্য
– হুমায়ুন আজাদ আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্য মারা যাবোছোট ঘাসফুলের জন্যেএকটি টলোমলো শিশিরবিন্দুর জন্যেআমি হয়তো মারা যাবো চৈত্রের বাতাসেউড়ে যাওয়া একটি পাঁপড়ির জন্যেএকফোঁটা বৃষ্টির জন্যে।আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবোদোয়েলের শিসের জন্যেশিশুর গালের একটি টোলের জন্যেআমি…
আত্মহত্যার অস্ত্রাবলি
__হুমায়ুন আজাদ রয়েছে ধারালো ছোরা স্লিপিং টেবলেটকালো রিভলবারমধ্যরাতে ছাদভোরবেলাকার রেলগাড়িসারিসারি বৈদ্যুতিক তার। স্লিপিং টেবলেট খেয়ে অনায়াসে ম’রে যেতে পারিবক্ষে ঢোকানো যায় ঝকঝকে উজ্জ্বল তরবারিকপাল লক্ষ্য ক’রে টানা যায় অব্যর্থ ট্রিগারছুঁয়ে ফেলা যায় প্রাণবাণ বৈদ্যুতিক তারছাদ থেকে লাফ দেয়া যায়ধরা যায়…
আমাকে ভালোবাসার পর
– হুমায়ুন আজাদ আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার,যেমন হিরোশিমার পর আর কিছুই আগের মতো নেইউত্তর থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত। যে কলিংবেল বাজে নি তাকেই মুর্হুমুহু শুনবে বজ্রের মত বেজে উঠতেএবং থরথর ক’রে উঠবে দরোজাজানালা আর…
ভালো থেকো
কবিতা: ভালো থেকো ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো।ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালি গান, ভালো থেকো।ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা।ভালো থেকো পাখি, সবুজ পাতারা।ভালো থেকো। ভালো থেকো চর, ছোট কুড়ে ঘর, ভালো থেকো।ভালো থেকো চিল, আকাশের নীল, ভালো থেকো।ভালো থেকো পাতা,…