জননী জন্মভূমি

– সুভাষ মুখোপাধ্যায় আমি ভীষণ ভালবাসতাম আমার মা-কে-কখনও মুখ ফুটে বলি নি।টিফিনের পয়সা বাঁচিয়েকখনও কখনও কিনে আনতাম কমলালেবু-শুয়ে শুয়ে মা-র চোখ জলে ভ’রে উঠতআমার ভালাবাসার কথামা-কে কখনও আমি মুখ ফুটে বলতে পারি নি। হে দেশ, হে আমার জননী-কেমন ক’রে তোমাকে…

মে-দিনের কবিতা

– সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্যধ্বংসের মুখোমুখি আমরা,চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্যকাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া। চিমনির মুখে শোনো সাইরেন-শঙ্খ,গান গায় হাতুড়ি ও কাস্তে,তিল তিল মরণেও জীবন অসংখ্যজীবনকে চায় ভালবাসতে। প্রণয়ের যৌতুক দাও প্রতিবন্ধে,মারণের পণ নখদন্তে;বন্ধন ঘুচে…

ফুল ফুটুক না ফুটুক

– সুভাষ মুখোপাধ্যায় ফুল ফুটুক না ফুটুকআজ বসন্ত। শান-বাঁধানো ফুটপাথেপাথরে পা ডুবিয়ে এক কাঠখোট্টা গাছকচি কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়েহাসছে। ফুল ফুটুক না ফুটুকআজ বসন্ত। আলোর চোখে কালো ঠুলি পরিয়েতারপর খুলে –মৃত্যুর কোলে মানুষকে শুইয়ে দিয়েতারপর তুলে –যে দিনগুলো রাস্তা দিয়ে…

তোমাকে বলি নি

– সুভাষ মুখোপাধ্যায় আকাশে তুলকালাম মেঘেযেন বাজি ফোটানোর আওয়াজেকালতোমার জন্মদিন গেল।ঘরে বৃষ্টির ছাট এলেওজানালাগুলো বন্ধ করি নি—আলো-নেভানো অন্ধকারেথেকে থেকে ঝিলিক-দেওয়া বিদ্যুতেআমি দেখতে পাচ্ছিলাম তোমার মুখ।আর মাঝে মাঝেহাওয়া এসে নড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছিলতোমাকে ভালবেসে দেওয়াটেবিলে রাখাগুচ্ছ গুচ্ছ ফুল।কাল কেন আমি ঘুমোতে পারি…

বলছিলাম কী

– সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলছিলাম–না, থাক্ গে।যা হচ্ছে হোক, কে খণ্ডাবেলেখা থাকলে ভাগ্যে।পাকানো জট,হারানো খেই,চতুর্দিকের দৃষ্যপটএখনও সে-ই–শক্ত করে আঁকড়ে-ধরাচেয়ারের সেই হাতল।বিষম ভয়, কখন হয়ক্ষমতার হাতবদল।বলছিলাম–না, থাক্ গে!কী আসে যায় হাতে নাতেপ্রমাণ এবং সাক্ষ্যে।মোড়লেরা ব্যস্ত বেজায়যে যার কোলে ঝোল টানতে।সারটা দেশ হাপিত্যেশে,পান্তা…

লোকটা জানলই না

– সুভাষ মুখোপাধ্যায় বাঁ দিকের বুক পকেটটা সামলাতে সামলাতেহায়! হায় ! লোকটার ইহকাল পরকাল গেল !অথচ আর একটু নীচে হাত দিলেইসে পেতো আলাদ্বীনের আশ্চর্য প্রদীপ,তার হৃদয় !লোকটা জানলোই না !তার কড়ি গাছে কড়ি হল ।লক্ষ্মী এল রণ-পায়েদেয়াল দিল পাহাড়াছোটলোক হাওয়া…

কেন এল না

– সুভাষ মুখোপাধ্যায় সারাটা দিন ছেলেটা নেচে নেচে বেড়িয়েছে।রাস্তায় আলো জ্বলছে অনেকক্ষণ এখনওবাবা কেন এল না, মা?বলে গেলমাইনে নিয়ে সকাল- সকাল ফিরবে।পুজোর যা কেনাকাটাএইবেলা সেরে ফেলতে হবে।বলে গেল।সেই মানুষ এখনও এলো না।কড়ার গায়ে খুন্তিটাআজ একটু বেশি রকম নড়ছে।ফ্যান গালতে গিয়েপা-টা…

যত দূরেই যাই

– সুভাষ মুখোপাধ্যায় আমি যত দূরেই যাইআমার সংগে যায়ঢেউয়ের মালা-গাঁথাএক নদীর নাম_ আমি যত দূরেই যাই। আমার চোখের পাতায় লেগে থাকেনিকোনো উঠোনেসারি সারিলক্ষ্মীর পাআমি যত দূরেই যাই।

পায়ে পায়ে

– সুভাষ মুখোপাধ্যায় সারাক্ষণসে আমার পায়ে পায়েসারাক্ষণপায়ে পায়েঘুরঘুর করে। তাকে বলিঃ তোমাকে নিয়ে থাকারসময় নেই-হে বিষাদ, তুমি যাওএখন সময় নেইতুমি যাও। গাছের গুঁড়িতে বুক-পিঠ এক করেযৌবনে পা দিয়ে রয়েছেএকটি উলঙ্গ মৃত্যু-আমি এখুনি দেখে আসছিঃ পৃথিবীতে গাঁক-গাঁক করে ফিরছেযে দাঁত-খিঁচানো ভয়,আমি…

প্রস্তাব ১৯৪০

– সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রভু, যদি বলো অমুক রাজার সাথে লড়াইকোনো দ্বিরুক্তি করব না, নেব তীরধনুক।এমনি বেকার, মৃত্যুকে ভয় করি থোড়াই,দেহ না চললে, চলবে তোমার কড়া চাবুক। হা-ঘরে আমরা, মুক্ত আকাশ ঘর-বাহির।হে প্রভু, তুমিই শেখালে পৃথিবী মায়া কেবল-তাই তো আজকে নিয়েছি…

হিংসে

– সুভাষ মুখোপাধ্যায় যাবার আগে মিটিয়ে নেবযার যার সঙ্গে আড়ি উঠলে ঝড় ছুটব বাইরেতারপরে তো বাড়ি ঠিক করি নি কিসে যাবহেঁটে না সাইকেলে ঝনঝনালে পকেটে পয়সামাটিতে দেব ফেলে মাটি কাঁপছে, কাঁপুক।চল্‌ রে ঘোড়া!হাতে তুলেছি চাবুক মুখপুড়িটা তাকাচ্ছে, দ্যাখ।বলছে, আ মর…

চিরকুট

– সুভাষ মুখোপাধ্যায় শতকোটি প্রণামান্তেহুজুরে নিবেদন এই_মাপ করবেন খাজনা এ সনছিটেফোঁটাও ধান নেই। মাঠেঘাটে কপাল ফাটেদৃষ্টি চলে যত দূরখাল শুক্‌নো বিল শুক্‌নোচোখের কোলে সমুদ্দুর। হাত পাতব কার কাছে কেগাঁয়ে সবার দশা একতিন সন্ধে উপোস দিয়েখাচ্ছি আজ বুনো শাক। পরনে যা…

এখন ভাবনা

 – সুভাষ মুখোপাধ্যায় ১.এখন একটু চোখে চোখে রাখো-দিনগুলো ভারি দামালো;দেখো,যেন আমাদরে অসাবধানেএই দামালো দিনগুলোগড়াতে গড়াতেগড়াতে গড়াতেআগুনের মধ্যে না পড়ে। আমার ভালোবাসাগুলোকে নিয়েইআমার ভাবনা।এখন সেই বয়স, যখনদূরেরটা বিলক্ষণ স্পষ্ট–শুধু কাছেরটাই ঝাপসা দেখায়। এখন সেই বয়েস, যখনআচমকা মাটিতেপ’ড়ে যেতে যেতে মনে হয়হাতে…

পরপার

 – সুভাষ মুখোপাধ্যায় আমরা যেন বাংলাদেশেরচোখের দুটি তারা।মাঝখানে নাক উঁচিয়ে আছে_থাকুক গে পাহারা। দুয়োরে খিল।টান দিয়ে তাইখুলে দিলাম জানলা। ওপারে যে বাংলাদেশএপারেও সেই বাংলা।।

সকলের গান 

 – সুভাষ মুখোপাধ্যায় কমরেড, আজ নতুন নবযুগ আনবে না?কুয়াশাকঠিন বাসর যে সম্মুখে।লাল উল্কিতে পরস্পরকে চেনা-দলে টানো হতবুদ্ধি ত্রিশঙ্কুকে,কমরেড, আজ নবযুগ আনবে না? আকাশের চাঁদ দেয় বুঝি হাতছানি?ওসব কেবল বুর্জোয়াদের মায়া-আমরা তো নই প্রজাপতি- সন্ধানী!অন্তত, আজ মাড়াই না তার ছায়া। কুঁজো…

আলালের ঘরের দুলাল

– সুভাষ মুখোপাধ্যায় বুলবুলিতে ধান খেয়েছেখাজনা দেব কিসেপায়ে শিকল দিয়ে কোকিলমরছে কেশে কেশে এ গাঁয়েতে বান তোও গাঁয়েতে খরাযে করে হোক আখেরে ভোটভাতের টোপে ধরা নীচেয় থাকে হাবা বোবাওপরতলায় কালাকাজের জন্যে মানুষ হন্যেদরজাগুলোয় তালা এই এটাকে চেয়ারে বসাওই ওটাকে হটাসামনে…

একটি সংলাপ 

– সুভাষ মুখোপাধ্যায় মেয়ে: তুমি কি চাও আমার ভালবাসা ?ছেলে: হ্যাঁ, চাই !মেয়ে: গায়ে কিন্তু তার কাদা মাখা !ছেলে: যেমন তেমনিভাবেই চাই ।মেয়ে: আমার আখেরে কী হবে বলা হোক ।ছেলে: বেশ!মেয়ে: আর আমি জিগ্যেস করতে চাই ।ছেলে: করো ।মেয়ে: ধরো’…