– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রামের সুমতি– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক রামলালের বয়স কম ছিল, কিন্তু দুষ্টুবুদ্ধি কম ছিল না। গ্রামের লোকে তাহাকে ভয় করিত। অত্যাচার যে তাহার কখন কোন্ দিক দিয়া কিভাবে দেখা দিবে, সে কথা কাহারও অনুমান করিবার জো ছিল না।…
Tag: শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ৩১শে ভাদ্র, ১২৮৩ – ২রা মাঘ, ১৩৪৪ রবিবার (১৫ সেপ্টেম্বর ১৮৭৬ – ১৬ জানুয়ারি ১৯৩৮) ছিলেন একজন বাঙালি লেখক, ঔপন্যাসিক, ও গল্পকার। তিনি দক্ষিণ এশিয়া এবং বাংলা ভাষার অন্যতম জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। তার অনেক উপন্যাস ভারতবর্ষের প্রধান ভাষাগুলোতে অনূদিত হয়েছে। বড়দিদি (১৯১৩), পরিণীতা (১৯১৪), পল্লীসমাজ (১৯১৬), দেবদাস (১৯১৭), চরিত্রহীন (১৯১৭), শ্রীকান্ত (চারখণ্ডে ১৯১৭-১৯৩৩), দত্তা (১৯১৮), গৃহদাহ (১৯২০), পথের দাবী (১৯২৬), শেষ প্রশ্ন (১৯৩১) ইত্যাদি শরৎ চন্দ্র রচিত বিখ্যাত উপন্যাস।বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অপ্রতিদ্বন্দ্বী জনপ্রিয়তার দরুন তিনি ‘অপরাজেয় কথাশিল্পী’ নামে খ্যাত। তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে জগত্তারিণী স্বর্ণপদক পান৷ এছাড়াও, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে ‘ডিলিট‘ উপাধি পান ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে।
জন্ম ও পরিবার
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ৩১শে ভাদ্র, ১২৮৩ (১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ সেপ্টেম্বর) ব্রিটিশ ভারতের প্রেসিডেন্সি বিভাগের হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতৃপুরুষের নিবাস ছিল অধুনা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার কাঁচড়াপাড়ার নিকট মামুদপুরে৷ দেবানন্দপুর ছিল প্রকৃতপক্ষে তার পিতার মাতুলালয়৷ তার পিতার নাম মতিলাল চট্টোপাধ্যায় ও মাতার নাম ভুবনমোহিনী দেবী। তার মাতা উত্তর ২৪ পরগণা জেলার হালিশহরের রামধন গঙ্গোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র কেদারনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কন্যা৷ গঙ্গোপাধ্যায়রা কালক্রমে ভাগলপুর নিবাসী হন৷ পাঁচ ভাই আর বোনের মধ্যে শরৎ চন্দ্র ছিলেন দ্বিতীয়। তার দিদি অনিলা দেবী ছাড়াও প্রভাসচন্দ্র ও প্রকাশচন্দ্র নামে তার দুই ভাই ও সুশীলা দেবী নামে তার এক বোন ছিল। শরৎ চন্দ্রের ডাকনাম ছিল ন্যাঁড়া। দারিদ্র্যের কারণে মতিলাল স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে ভাগলপুরে শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন বলে শরৎ চন্দ্রের শৈশবের অধিকাংশ সময় এই শহরেই কেটেছিল।
শিক্ষাজীবন
শরৎচন্দ্রের পাঁচ বছর বয়সকালে মতিলাল তাকে দেবানন্দপুরের প্যারী পণ্ডিতের পাঠশালায় ভর্তি করে দেন, যেখানে তিনি দু-তিন বছর শিক্ষালাভ করেন। এরপর ভাগলপুর শহরে থাকাকালীন তার মামা তাকে স্থানীয় দুর্গাচরণ বালক বিদ্যালয়ে ছাত্রবৃত্তিতে ভর্তি করিয়ে দেন। ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে শরৎচন্দ্র ভাগলপুর জেলা স্কুলে ভর্তি হন। ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে মতিলালের ডিহিরির চাকরি চলে গেলে তিনি তার পরিবার নিয়ে দেবানন্দপুরে ফিরে গেলে শরৎচন্দ্র জেলা স্কুল ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এই সময় তিনি হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুলে ভর্তি হন, কিন্তু ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে দারিদ্র্যের কারণে স্কুলের ফি দিতে না-পারার কারণে তাকে এই বিদ্যালয়ও ত্যাগ করতে হয়। এই সময় তিনি ‘কাশীনাথ’ ও ‘ব্রহ্মদৈত্য’ নামে দুটি গল্প লেখেন। ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে মতিলাল পুনরায় ভাগলপুর ফিরে গেলে প্রতিবেশী সাহিত্যিক তথা তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় শিক্ষালাভের প্রতি শরৎচন্দ্রের আগ্রহ লক্ষ করে তাকে তার বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। এই বিদ্যালয় থেকে ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় বিভাগে এনট্রান্স পরীক্ষা পাস করে তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজে ভর্তি হন। এই সময় তিনি তার মাতামহের ছোটো ভাই অঘোরনাথের দুই পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ও গিরীন্দ্রনাথকে প্রতি রাতে পড়াতেন, তার বিনিময়ে অঘোরনাথ তার কলেজে পড়ার প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাতেন। এতৎসত্ত্বেও এফএ পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে না-পারার জন্য তিনি পরীক্ষায় বসতে পারেননি।
শেষ জীবন
মধ্যবয়সে শরৎচন্দ্র হাওড়া জেলার পানিত্রাস (সামতাবেড়) গ্রামের মাটির বাড়িতে বাস করতেন। দক্ষিণ-পূর্ব রেলের দেউলটি স্টেশন থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটারের পথ সামতাবেড়ের বাড়িটা রূপনারায়ণ নদের তীরে এক মনোরম পরিবেশে অবস্থিত। পাশাপাশি দুটো পুকুরে সানের ঘাট, বাগান, ডালিম, পেয়ারা গাছে ঘেরা। ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দের ঘরভাঙানি বন্যায় পাশাপাশি সব গাঁয়ের মাটির বাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। শরৎচন্দ্রের মাটির বাড়িটা রূপনারায়ণের কূলে থেকেও আশ্চর্যজনকভাবে রক্ষা পেয়ে যায়। জানালা পর্যন্ত ভিতটি ইঁট-সিমেন্টে গাঁথা ছিল বলে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পড়ে যায়নি। পরে সরকারি উদ্যোগে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে। পরবর্তীতে শরৎচন্দ্র শিবপুরেও থাকতেন। শিবপুর ব্যাতাইতলা বাজার থেকে চ্যাটার্জিহাট পর্যন্ত রাস্তা শরৎচন্দ্রের নামেই চালু আছে। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে শরৎচন্দ্র প্রায়শই অসুস্থ থাকতেন। চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি স্বাস্থ্য উদ্ধারের উদ্দেশ্যে দেওঘরে তিন চার মাস কাটিয়ে কলকাতা ফিরে এলে আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই সময় তার যকৃতের ক্যান্সার ধরা পড়ে, যা তার পাকস্থলী পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। বিধানচন্দ্র রায়, কুমুদশঙ্কর রায় প্রমুখ চিকিৎসক তার অস্ত্রোপচারের পক্ষে মত দেন। চিকিৎসার জন্য তাকে প্রথমে দক্ষিণ কলকাতার সাবার্বান হসপিটাল রোডের একটি ইউরোপীয় নার্সিং হোমে ও পরে ৪ নম্বর ভিক্টোরিয়া টেরাসে অবস্থিত পার্ক নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয়। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জানুয়ারি শল্য চিকিৎসক ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় তার দেহে অস্ত্রোপচার করেন, কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। চার দিন পর ১৬ জানুয়ারি সকাল দশটায় শরৎচন্দ্র শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
প্রকাশিত বই
উপন্যাস
বড়দিদি, ১৯১৩
বিরাজবৌ, ১৯১৪
বিন্দুর ছেলে, ১৯১৪
পরিণীতা, ১৯১৪
পন্ডিতমশাই, ১৯১৪
মেজ দিদি, ১৯১৬
পল্লী-সমাজ, ১৯১৬
চন্দ্রনাথ, ১৯১৬
বৈকুন্ঠের উইল, ১৯১৬
অরক্ষণীয়া, ১৯১৬
শ্রীকান্ত-প্রথম পর্ব, ১৯১৭
নিষ্কৃতি, ১৯১৭
দেবদাস, ১৯১৭
চরিত্রহীন, ১৯১৭
কাশীনাথ, ১৯১৭
দত্তা, ১৯১৮
স্বামী , ১৯১৮
শ্রীকান্ত-দ্বিতীয় পর্ব, ১৯১৮
ছবি, ১৯২০
গৃহদাহ, ১৯২০
বামুনের মেয়ে, ১৯২০
দেনা পাওনা, ১৯২৩
নব-বিধান, ১৯২৪
পথের দাবী, ১৯২৬
শ্রীকান্ত-তৃতীয় পর্ব, ১৯২৭
শেষ প্রশ্ন, ১৯৩১
শ্রীকান্ত-চতুর্থ পর্ব, ১৯৩৩
বিপ্রদাস, ১৯৩৫
শুভদা, ১৯৩৮
শেষের পরিচয় ,১৯৩৯}
বর
নাটক
ষোড়শী, ১৯২৮
রমা, ১৯২৮
বিরাজ বউ, ১৯৩৪
বিজয়া, ১৯৩৫
গল্প
রামের সুমতি ১৯১৪
পরিণীতা, ১৯১৪
বিন্দুর ছেলে, ১৯১৪
পথ-নির্দেশ, ১৯১৪
মেজদিদি, ১৯১৫
আঁধারে আলো ১৯১৫
দর্পচূর্ণ ১৯১৫
বৈকুণ্ঠের উইল, ১৯১৬
অরক্ষণীয়া, ১৯১৬
নিষ্কৃতি, ১৯১৭
কাশীনাথ, ১৯১৭
স্বামী, ১৯১৭
একাদশী বৈরাগী
ছবি, ১৯২০
বিলাসী, ১৯২০
মামলার ফল, ১৯২০
হরিলক্ষ্মী, ১৯২৬
মহেশ, ১৯২৬
অভাগীর স্বর্গ, ১৯২৬
অনুরাধা, ১৯৩৪
সতী, ১৯৩৪
পরেশ, ১৯৩৪
প্রবন্ধ
নারীর মূল্য
তরুণের বিদ্রোহ, ১৯১৯
স্বদেশ ও সাহিত্য, ১৯৩২
স্বরাজ সাধনায় নারী
শিক্ষার বিরোধ
স্মৃতিকথা
অভিনন্দন
ভবিষ্যৎ বঙ্গ-সাহিত্য
গুরু-শিষ্য সংবাদ
সাহিত্য ও নীতি
সাহিত্যে আর্ট ও দুর্নীতি
ভারতীয় উচ্চ সঙ্গীত
চলচ্চিত্রায়ণ
১৯৩৬-এর ‘দেবদাস’ চলচ্চিত্রে কুন্দন লাল সায়গল এবং যমুনা দেবী
তার সাহিত্য-কর্মকে ঘিরে ভারতীয় উপমহাদেশে এ পর্যন্ত প্রায় পঞ্চাশটি চলচ্চিত্র বিভিন্ন ভাষায় তৈরি হয়েছে।তার মধ্যে ‘দেবদাস’ উপন্যাসটি বাংলা, হিন্দি এবং তেলুগু ভাষায় আটবার তৈরি হয়। বিভিন্ন সময়ে ‘দেবদাস’ বাংলা ও হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেছেন প্রমথেশ বড়ুয়া, কানন দেবী, উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, দিলীপ কুমার, সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়া দেবী, সুমিত্রা মুখার্জি, শাহরুখ খান, ঐশ্বর্য রাই বচ্চন, মাধুরী দীক্ষিত প্রমুখ। এছাড়া সন্ধ্যারানি ও উত্তমকুমার অভিনীত বিখ্যাত বাংলা ছবি ‘বড়দিদি’, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও মৌসুমি চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ‘পরিণীতা’ ছবি নির্মিত হয়। ‘পরিণীতা’ উপন্যাস দু-বার চলচ্চিত্রায়িত হয়, বাংলা ছবি উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেন অভিনীত ‘চন্দ্রনাথ’, রজলক্ষ্মী-শ্রীকান্ত, উত্তমকুমার ও মাধবী মুখার্জি অভিনীত ‘বিরাজ বউ’, ঋষিকেশ মুখার্জির হিন্দি ছবি ‘মাঝলি দিদি’ অন্যতম। ‘স্বামী’ (১৯৭৭) চলচ্চিত্রের জন্য ফিল্মফেয়ার সেরা লেখকের পুরস্কার পান। ‘বিন্দুর ছেলে’ অবলম্বনে ‘ছোটি বহু’ (১৯৭১) নামে বিখ্যাত চলচ্চিত্র তৈরি হয়। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে ‘দত্তা’ চলচ্চিত্রে সুচিত্রা সেন এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এছাড়া তার ‘নববিধান’ উপন্যাসের ছায়া অবলম্বনে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে ‘তুমহারি পাখি’ নামে একটি ভারতীয় টিভি ধারাবাহিক নির্মিত হয়
কাশীনাথ
– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কাশীনাথ– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক রাত্রি চারটার সময় স্নানান্তে পূজাহ্নিক সমাপ্ত করিয়া টিকিটি বেশ উঁচু করিয়া বাঁধিয়া কাশীনাথ যখন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের টোল-ঘরের বারান্দায় বসিয়া দর্শনের সূত্র ও ভাষ্য গুনগুন স্বরে কণ্ঠস্থ করিত, তখন তাহার বাহ্য-জগতের কথা আর মনে…
নতুনদা
– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নতুনদা– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দাঁড় বাধিয়া পাল খাটাইয়া ঠিক হইয়া বসিয়াছি। অনেক বিলম্বে ইন্দ্রের নতুনদা আসিয়া ঘাটে পোঁছিলেন। চাঁদের আলোতে তাহাকে দেখিয়া ভয় পাইয়া গেলাম। কলকাতার বাবু অর্থাৎ ভয়ংকর বাবু। সিষ্কের মোজা, চ্কচকে পাম্প–সু, আগাগোড়া ওভারকোটে মোড়া, গলায় গলাবন্ধ,…
লালু : ১
– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লালু : ১– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছেলেবেলায় আমার এক বন্ধু ছিল তার নাম লালু। অর্ধ শতাব্দী পূর্বে—অর্থাৎ, সে এতকাল পূর্বে যে, তোমরা ঠিকমত ধারণা করতে পারবে না—আমরা একটি ছোট বাঙলা ইস্কুলের এক ক্লাসে পড়তাম। আমাদের বয়স তখন দশ-এগারো।…
লালু : ২
– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লালু : ২– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার ডাকনাম ছিল লালু। ভাল নাম অবশ্য একটা ছিলই, কিন্তু মনে নেই। জানো বোধ হয়, হিন্দীতে ‘লাল’ শব্দটার অর্থ হচ্ছে—প্রিয়। এ-নাম কে তারে দিয়েছিল জানিনে, কিন্তু মানুষের সঙ্গে নামের এমন সঙ্গতি কদাচিৎ…
লালু : ৩
– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লালু : ৩– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আমাদের শহরে তখন শীত পড়েছে, হঠাৎ কলেরা দেখা দিলে। তখনকার দিনে ওলাউঠার নামে মানুষে ভয়ে হতজ্ঞান হতো। কারও কলেরা হয়েছে শুনতে পেলে সে-পাড়ায় মানুষ থাকতো না। মারা গেলে দাহ করার লোক মেলা…
ছেলেধরা
– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছেলেধরা– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেবার দেশময় রটে গেল যে, তিনটি শিশু বলি না দিলে রূপনারায়ণের উপর রেলের পুল কিছুতেই বাঁধা যাচ্ছে না। দু’টি ছেলেকে জ্যান্ত থামের নীচে পোঁতা হয়ে গেছে, বাকী শুধু একটি। একটি সংগ্রহ হলেই পুল তৈরী…
দেবদাস
– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দেবদাস– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক একদিন বৈশাখের দ্বিপ্রহরে রৌদ্রেরও অন্ত ছিল না উত্তাপেরও সীমা ছিল না। ঠিক সেই সময়টিতে মুখুয্যেদের দেবদাস পাঠশালা-ঘরের এক কোণে ছেঁড়া মাদুরের উপর বসিয়া, শ্লেট হাতে লইয়া, চক্ষু চাহিয়া, বুজিয়া, পা ছড়াইয়া, হাই তুলিয়া,…
অনুরাধা
– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অনুরাধা– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক কন্যার বিবাহযোগ্য বয়সের সম্বন্ধে যত মিথ্যা চালানো যায় চালাইয়াও সীমানা ডিঙাইয়াছে। বিবাহের আশাও শেষ হইয়াছে।—ওমা, সে কি কথা! হইতে আরম্ভ করিয়া চোখ টিপিয়া কন্যার ছেলেমেয়ের সংখ্যা জিজ্ঞাসা করিয়াও এখন আর কেহ রস পায়…
অভাগীর স্বর্গ
– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অভাগীর স্বর্গ– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ঠাকুরদাস মুখুয্যের বর্ষীয়সী স্ত্রী সাতদিনের জ্বরে মারা গেলেন। বৃদ্ধ মুখোপাধ্যায় মহাশয় ধানের কারবারে অতিশয় সঙ্গতিপন্ন। তাঁর চার ছেলে, তিন মেয়ে, ছেলেমেয়েদের ছেলেপুলে হইয়াছে, জামাইরা-প্রতিবেশির দল, চাকর-বাকর- সে যেন একটা উৎসব বাধিয়া গেল। সমস্ত…
পল্লী সমাজ
– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পল্লী সমাজ– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১ বেণী ঘোষাল মুখুয্যেদের অন্দরের প্রাঙ্গণে পা দিয়াই সম্মুখে এক প্রৌঢ়া রমণীকে পাইয়া প্রশ্ন করিলেন, “এই যে মাসি, রমা কই গা?” মাসী আহ্নিক করিতেছিলেন, ইঙ্গিতে রান্নাঘর দেখাইয়া দিলেন। বেণী উঠিয়া আসিয়া রন্ধনশালার চৌকাঠের…
শেষ দিন (অনুপমার প্রেম-পর্ব-৬)
– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আজ অনুপমার শেষ দিল। এ সংসারে সে আর থাকিবে না। জ্ঞান হইয়া অবধি সে সুখ পায় নাই। ছেলেবেলায় ভালবাসিয়াছিল বলিয়া নিজের শান্তি নিজে ঘুচাইয়াছিল; অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করিয়াছিল বলিয়া বিধাতা তাহাকে একতিলও সুখ দেন নাই। যাহাকে ভালবাসিত মনে…
চন্দ্রবাবুর সংসার (অনুপমার প্রেম-পর্ব-৫)
– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তিন বৎসর পরে খালাস হইয়াও ললিতমোহন বাড়ি ফিরিল না। কেহ বলিল, লজ্জায় আসিতেছে না। কেহ বলিল, সে গ্রামে কি আর মুখ দেখাতে পারে? ললিতমোহন নানা স্থান পরিভ্রমন করিয়া দুই বৎসর পরে সহসা একদিন বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইল।…
বৈধব্য (অনুপমার প্রেম-পর্ব-৪)
– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তথাপি অনুপমা একটু কাঁদিল। স্বামী মরিলে বাঙালীর মেয়েকে কাঁদিতে হয়, তাই কাঁদিল। তাহার পর স্ব-ইচ্ছায় সাদা পরিয়া সমস্ত অলঙ্কার খুলিয়া ফেলিল। জননী কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, “অনু, তোর এ বেশ ত আমি চোখে দেখতে পারি না, অন্তত হাতে…
বিবাহ (অনুপমার প্রেম-পর্ব-৩)
– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আজ ৫ই বৈশাখ। অনুপমার বিবাহ-উৎসবে আজ গ্রামটা তোলপাড় হইতেছে। জগবন্ধুবাবুর বাটীতে আজ ভিড় ধরে না। কত লোক যাইতেছে, কত লোক হাঁকাহাঁকি করিতেছে। কত খাওয়ান-দাওয়ানর ঘটা, কত বাজনা-বাদ্যের ধুম। যত সন্ধ্যা হইয়া আসিতে লাগিল, ধুমধাম তত বাড়িয়া উঠিতে…
বিরহ (অনুপমার প্রেম-পর্ব-১)
– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একাদশবর্ষ বয়ঃক্রমের মধ্যে অনুপমা নবেল পড়িয়া পড়িয়া মাথাটা একেবারে বিগড়াইয়া ফেলিয়াছে। সে মনে করিল, মনুষ্য-হৃদয়ে যত প্রেম, যত মাধুরী, যত শোভা, যত সৌন্দর্য, যত তৃষ্ণা আছে, সব খুঁটিয়া বাছিয়া একত্রিত করিয়া নিজের মস্তিষ্কের ভিতর জমা করিয়া ফেলিয়াছে;…
বিলাসী
– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পাকা দুই ক্রোশ পথ হাঁটিয়া স্কুলে বিদ্যা অর্জন করিতে যাই। আমি একা নই—দশ-বারোজন। যাহাদেরই বাটী পল্লীগ্রামে, তাহাদেরই ছেলেদের শতকরা আশি জনকে এমনি করিয়া বিদ্যালাভ করিতে হয়। ইহাতে লাভের অঙ্কে শেষ পর্যন্ত একেবারে শূন্য না পড়িলেও, যাহা পড়ে,…
স্বামী
– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সৌদামিনী নামটা আমার বাবার দেওয়া। আমি প্রায়ই ভাবি, আমাকে এক বছরের বেশি ত তিনি চোখে দেখে যেতে পাননি, তবে এমন করে আমার ভিতরে বাহিরে মিলিয়ে নাম রেখে গিয়েছিলেন কি করে? বীজমন্ত্রের মত এই একটি কথায় আমার সমস্ত…
মহেশ
– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মহেশ– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১ গ্রামের নাম কাশীপুর। গ্রাম ছোট, জমিদার আরও ছোট, তবু দাপটে তাঁর প্রজারা টুঁ শব্দটি করিতে পারে না – এমনই প্রতাপ। ছোট ছেলের জন্মতিথি পূজা। পূজা সারিয়া তর্করত্ন দ্বিপ্রহর বেলায় বাটি ফিরিতেছিলেন। বৈশাখ শেষ…