__রফিক আজাদ নগর বিধ্বস্ত হ’লে, ভেঙ্গে গেলে শেষতম ঘড়িউলঙ্গ ও মৃতদের সুখে শুধু ঈর্ষা করা চলে।‘জাহাজ, জাহাজ’ – ব’লে আর্তনাদ সকলেই করি –তবুও জাহাজ কোনো ভাসবে না এই পচা জলে। সমুদ্র অনেক দূর, নগরের ধারে-কাছে নেই :চারপাশে অগভীর অস্বচ্ছ মলিন…
Tag: রফিক আজাদ
রফিক আজাদ
রফিক আজাদ (১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৪২ – ১২ মার্চ ২০১৬) ছিলেন একজন বাংলাদেশী আধুনিক কবি। ২০১৩ সালে তিনি সাহিত্যে একুশে পদক লাভ করেন। তিনি ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ষাটের দশকের অন্যতম প্রধান কবি হিসেবে চিহ্নিত। তিনি বিভিন্ন সাহিত্যপত্রের সম্পাদনা করেছেন এবং জীবিকাসূত্রে সরকারি চাকুরিও করেছেন।
জন্ম
রফিক আজাদ ১৯৪২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল থানার গুণী গ্রামের এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সলিম উদ্দিন খান ছিলেন একজন প্রকৃত সমাজসেবক এবং মা রাবেয়া খান ছিলেন আদর্শ গৃহিণী। দুই ভাই-এক বোনের মধ্যে তিনি সর্বকনিষ্ঠ। প্রকৃতার্থে তারা ছিলেন তিন ভাই-দুই বোন। কিন্তু তার জন্মের আগে মারা যায় সর্বজ্যেষ্ঠ ভাই মাওলা ও তৎপরবর্তী বোন খুকি। রফিক আজাদ যখন মায়ের গর্ভে তখন অকাল প্রয়াত বড় বোন অনাগত ছোট ভাইয়ের নাম রেখেছিলেন ‘জীবন’। রফিক আজাদ ‘জীবনের’ই আরেক নাম।
শিক্ষাজীবন
১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র রফিক ভাষা শহিদদের স্মরণে বাবা-মায়ের কঠিন শাসন অস্বীকার করে খালি পায়ে মিছিল করেন। ভাষার প্রতি এই ভালোবাসা পরবর্তী জীবনে তাকে তৈরি করেছিল একজন কবি হিসেবে, আদর্শ মানুষ হিসেবে। ১৯৫৬ সালে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় একবার বাবার হাতে মার খেয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন বাড়ি থেকে। উদ্দেশ্য, পি.সি সরকারের কাছে জাদু শেখা। ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ স্কুলের হেডমাস্টার তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বাড়িতে পাঠান। কৈশোরে লাঠি খেলা শিখতেন নিকটাত্মীয় দেলু নামক একজনের কাছে। তিনি সম্পর্কে রফিক আজাদের দাদা। দেলু দাদা ছিলেন পাক্কা লাঠিয়াল। গ্রামে নানা কিংবদন্তির প্রচলন ছিল তার নামে। সলিম উদ্দিনের চেয়ে তিনি বয়সে বড় হলেও গা-গতর দেখলে পালোয়ান বলেই মনে হতো। দেলু দাদা খুব আদর করতেন রফিক আজাদকে। বার-বাড়িতে শিক্ষা দিতেন লাঠি খেলা। এছাড়া গুণী গ্রামের পাশেই মনিদহ গ্রাম। এখানকার ষাট শতাংশ অধিবাসী ছিল নিম্নশ্রেণির হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। সুতার, ধোপা, দর্জি, চাষা ইত্যাদি। এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরাই ছিল রফিক আজাদের শৈশব-কৈশোরের বন্ধু। সাধুটী মিডল ইংলিশ স্কুল থেকে অষ্টম শ্রেণি পাস করে ভর্তি হলেন কালিহাতি রামগতি শ্রীগোবিন্দ হাই ইংলিশ স্কুলের নবম শ্রেণিতে। বাড়ি থেকে প্রায় তিন-চার মাইল দূরত্বে স্কুল। কালিহাতি সংলগ্ন গ্রাম হামিদপুরের এক দরিদ্র গেরস্থের বাড়িতে পেইং গেস্ট হিসেবে থেকে তিনি পড়াশোনা করেন। হামিদপুরে আগের মতো আর সেই বিধিনিষেধ নেই। কালিহাতি হাই স্কুলে পড়ার সময় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে সতীর্থ মাঈন উদ্দিন আহমদের সঙ্গে। সে ছিল ক্লাসের ফার্স্ট বয় এবং অত্যন্ত মেধাবী। সাহিত্যপাঠে আগ্রহ ছিল তার। এই মাঈনই রফিক আজাদের আড্ডার প্রথম গুরু। হামিদপুরে তার সঙ্গে শুরু হয় তুখোড় আড্ডা। তার মুখেই প্রথম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম শোনেন। দিবারাত্রির কাব্য, পুতুল নাচের ইতিকথা, পদ্মানদীর মাঝি প্রভৃতি উপন্যাসের সঙ্গে পরিচিত হন। মাঈন একদিন সন্ধ্যাবেলা ফটিকজানি নদীর তীর ঘেঁষা ডাকবাংলোর বারান্দায় বসে রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটি পুরো আবৃত্তি করে শুনিয়েছিল তাকে। সেই কবিতা শুনে স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন কিশোর রফিক আজাদ। অবাধ স্বাধীনতা, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় পড়ে নবম শ্রেণিতে ভালোভাবে পাস করতে পারলেন না আড্ডাপ্রিয় রফিক আজাদ। মাঈনও প্রথম থেকে তৃতীয় স্থানে চলে আসে। আড্ডার অন্য বন্ধুদের অনেকেই একাধিক বিষয়ে ফেল করে বসল। সারা বছর অহেতুক আড্ডা দিয়ে পরীক্ষায় এই দশা। অবশেষে ব্রাহ্মণশাসন হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেন।
কর্মজীবন
রফিক আজাদ ১৯৭২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির মাসিক সাহিত্য পত্রিকা উত্তরাধিকার এর সম্পাদক ছিলেন। রোববার পত্রিকাতেও রফিক আজাদ নিজের নাম উহ্য রেখে সম্পাদনার কাজ করেছেন। তিনি টাঙ্গাইলের মওলানা মুহম্মদ আলী কলেজের বাংলার লেকচারার ছিলেন। কাজ করেছেন বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন, উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে।রফিক আজাদের প্রেমের কবিতার মধ্যে নারীপ্রেমের একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে।
মুক্তিযুদ্ধ
রফিক আজাদ ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৭১ সালে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কাদেরিয়া বাহিনীর হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এই কবি।
প্রকাশিত গ্রন্থ
- অসম্ভবের পায়ে
- সীমাবদ্ধ জলে` সীমিত সবুজে
- চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া
- এক জীবনে
- পাগলা গারদ থেকে প্রেমিকার চিঠি
- প্রেমের কবিতাসমগ্র
- বর্ষণে আনন্দে যাও মানুষের কাছে
- বিরিশিরি পর্ব
- রফিক আজাদ শ্রেষ্ঠকবিতা
- রফিক আজাদ কবিতাসমগ্র
- হৃদয়ের কী বা দোষ
- কোনো খেদ নেই
- সশস্ত্র সুন্দর
- হাতুড়ির নিচে জীবন
- পরিকীর্ণ পানশালায় আমার স্বদেশ
- প্রিয় শাড়িগুলো
পুরস্কার ও সম্মাননা
- হুমায়ুন কবির স্মৃতি (লেখক শিবির) পুরস্কার (১৯৭৭)
- কবিতালাপ পুরস্কার (১৯৭৯)
- বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১)
- আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১)
- ব্যাংক পুরস্কার (১৯৮২)
- সুহৃদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৯)
- কবি আহসান হাবীব পুরস্কার (১৯৯১)
- কবি হাসান হাফিজুর রহমান পুরস্কার (১৯৯৬)
- বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা (১৯৯৭)
- একুশে পদক (২০১৩)
মৃত্যু
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৮ দিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর ২০১৬ সালের ১২ মার্চ রফিক আজাদ মৃত্যুবরণ করেন।
জীবন একটি নদীর নাম
__রফিক আজাদ জীবন একটি নদীর নাম,পিতামাতার ঐ উঁচু থেকেনেমে-আসা এক পাগলা ঝোরা—ক্রমশ নিম্নাভিমুখী;পাথুরে শৈশব ভেঙেকৈশোরের নুড়িগুলি বুকে নিয়েবয়ে চলা পরিণামহীনএক জলধারা—গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে বেলে-এঁটেল-দোআঁশমাটি ভেঙে-ভেঙে সামনে চলাএক ক্ষুদ্র স্রোতস্বিনী;এই বয়ে চলা পথেবিভিন্ন বৃক্ষের সঙ্গে চলেদ্বিরালাপ;একবার এক বৃদ্ধ অশ্বথের সঙ্গেহয় তার অল্পক্ষণ…
বৃষ্টি
__রফিক আজাদ ১.খররৌদ্রময় এই দিন—শ্যামল বাংলায় বুঝি ফের নেমে আসে খরা!খরতাপে রুদ্ধশ্বাসক্ষুদ্র এই গ্রামীণ শহর,এ রকম এই দিনে চেতনায়ও খরার প্রদাহ—নির্বাচনে হেরে-যাওয়া প্রার্থী যেন: বিরক্ত, বিব্রত;এ রকম দুঃসময়ে এল বৃষ্টির শব্দের মতোসুখকর এই পত্র—প্রাগের প্রাচীর থেকে উড়ে!কুপিত, বিব্রতকর এই রোদে…
আমাকে খুঁজো না বৃথা
__রফিক আজাদ আমাকে খুঁজো না বৃথা কাশ্মীরের স্বচ্ছ ডাল হ্রদে,সুইৎসারল্যান্ডের নয়নলোভন কোনো পর্যটন স্পটে,গ্রান্ড ক্যানালের গন্ডোলায়ও নয়,খুঁজো না ফরাসি দেশে_ পারীর কাফেতে, মধ্যরাতে;রাইন বা মাইনের তীরে, সুবিস্তীর্ণ ফলের বাগানে. . . আমাকে খুঁজো না জাম্বো জেটে,দ্রুতগামী যাত্রীবাহী জাহাজের কিংবা কোনোবৃহৎ…
নত হও, কুর্নিশ করো
__রফিক আজাদ হে কলম, উদ্ধত হ’য়ো না, নত হও, নত হতে শেখো,তোমার উদ্ধত আচরনে চেয়ে দ্যাখো, কী যে দু:খপেয়েছেন ভদ্রমহোদয়গণ, অতএব, নত হও, বিনীত ভঙিতে করজোড়েক্ষমা চাও, পায়ে পড়ো, বলো: কদ্যপি এমনটি হবে না, স্যার,বলো: মধ্যবিত্ত হে বাঙালী ভদ্রমহোদয়গণ,এবারকার মতো…
নগর ধ্বংসের আগে
__রফিক আজাদ নগর বিধ্বস্ত হ’লে, ভেঙ্গে গেলে শেষতম ঘড়িউলঙ্গ ও মৃতদের সুখে শুধু ঈর্ষা করা চলে।‘জাহাজ, জাহাজ’ – ব’লে আর্তনাদ সকলেই করি –তবুও জাহাজ কোনো ভাসবে না এই পচা জলে। সমুদ্র অনেক দূর, নগরের ধারে-কাছে নেই :চারপাশে অগভীর অস্বচ্ছ মলিন…
চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া
__রফিক আজাদ স্পর্শকাতরতাময় এই নামউচ্চারণমাত্র যেন ভেঙে যাবে,অন্তর্হিত হবে তার প্রকৃত মহিমা,-চুনিয়া একটি গ্রাম, ছোট্ট কিন্তু ভেতরে-ভেতরেখুব শক্তিশালীমারণাস্ত্রময় সভ্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। মধ্যরাতে চুনিয়া নীরব।চুনিয়া তো ভালোবাসে শান্তস্নিগ্ধ পূর্ণিমার চাঁদ,চুনিয়া প্রকৃত বৌদ্ধ-স্বভাবের নিরিবিলি সবুজ প্রকৃতি;চুনিয়া যোজনব্যাপী মনোরম আদিবাসী ভূমি।চুনিয়া কখনো কোনো…
যাও, পত্রদূত
__রফিক আজাদ যাও পত্রদূত, বোলো তার কানে-কানে মৃদু স্বরেসলজ্জ ভাষায় এই বার্তা: “কোমল পাথর, তুমিসুর্যাস্তের লাল আভা জড়িয়ে রয়েছো বরতনু;প্রকৃতি জানে না নিজে কতোটা সুন্দর বনভূমি।”যাও, বোলো তার কানে ভ্রমরসদৃশ গুঞ্জরণে,চোখের প্রশংসা কোরো, বোলো সুঠাম সুন্দরশরীরের প্রতি বাঁকে তার মরণ…
ভাত দে হারামজাদা
– রফিক আজাদ ভীষণ ক্ষুধার্ত আছিঃ উদরে, শরীরবৃত্ত ব্যেপেঅনুভূত হতে থাকে- প্রতিপলে- সর্বগ্রাসী ক্ষুধাঅনাবৃষ্টি- যেমন চৈত্রের শষ্যক্ষেত্রে- জ্বেলে দ্যায়প্রভুত দাহন- তেমনি ক্ষুধার জ্বালা, জ্বলে দেহদু’বেলা দু’মুঠো পেলে মোটে নেই অন্য কোন দাবীঅনেকে অনেক কিছু চেয়ে নিচ্ছে, সকলেই চায়ঃবাড়ি, গাড়ি, টাকা…
প্রতীক্ষা
– রফিক আজাদ এমন অনেক দিন গেছেআমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থেকেছি,হেমন্তে পাতা-ঝরার শব্দ শুনবো ব’লেনিঃশব্দে অপেক্ষা করেছি বনভূমিতে-কোনো বন্ধুর জন্যেকিংবা অন্য অনেকের জন্যেহয়তো বা ভবিষ্যতেও অপেক্ষা করবো…এমন অনেক দিনই তো গেছেকারো অপেক্ষায় বাড়ি ব’সে আছি-হয়তো কেউ বলেছিলো, “অপেক্ষা ক’রোএকসঙ্গে বেরুবো।”…
তোমার কথা ভেবে
__রফিক আজাদ তোমার কথা ভেবে রক্তে ঢেউ ওঠে—তোমাকে সর্বদা ভাবতে ভালো লাগে,আমার পথজুড়ে তোমারই আনাগোনা—তোমাকে মনে এলে রক্তে আজও ওঠেতুমুল তোলপাড় হূদয়ে সর্বদা…হলো না পাশাপাশি বিপুল পথ-হাঁটা,এমন কথা ছিল চলব দুজনেইজীবন-জোড়া পথ যে-পথ দিকহীনমিশেছে সম্মুখে আলোর গহ্বরে…।
যদি ভালবাসা পাই
– রফিক আজাদ যদি ভালবাসা পাই আবার শুধরে নেবজীবনের ভুলগুলিযদি ভালবাসা পাই ব্যাপক দীর্ঘপথেতুলে নেব ঝোলাঝুলিযদি ভালবাসা পাই শীতের রাতের শেষেমখমল দিন পাবযদি ভালবাসা পাই পাহাড় ডিঙ্গাবোআর সমুদ্র সাঁতরাবোযদি ভালবাসা পাই আমার আকাশ হবেদ্রুত শরতের নীলযদি ভালবাসা পাই জীবনে আমিও…
ভালোবাসার সংজ্ঞা
– রফিক আজাদ ভালোবাসা মানে দুজনের পাগলামি,পরস্পরকে হৃদয়ের কাছে টানা;ভালোবাসা মানে জীবনের ঝুঁকি নেয়া,বিরহ-বালুতে খালিপায়ে হাঁটাহাঁটি; ভালোবাসা মানে একে অপরের প্রতিখুব করে ঝুঁকে থাকা;ভালোবাসা মানে ব্যাপক বৃষ্টি, বৃষ্টির একটানাভিতরে-বাহিরে দুজনের হেঁটে যাওয়া;ভালোবাসা মানে ঠাণ্ডা কফির পেয়ালা সামনেঅবিরল কথা বলা;ভালোবাসা মানে…