– বুদ্ধদেব বসু কোথায় চলেছো? এদিকে এসো না! দুটোকথা শোনা দিকিএই নাও- এই চকচকে ছোটো, নুতন রূপোর সিকিছোকানুর কাছে দুটো আনি আছে, তোমারে দেবো গো তা-ও,আমাদের যদি তোমার সঙ্গে নৌকায় তুলে নাও।নৌকা তোমার ঘাটে বাঁধা আছে- যাবেকি অনেক দূরে?পায়ে পড়ি,…
Tag: বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসু (৩০ নভেম্বর ১৯০৮ – ১৮ মার্চ ১৯৭৪) বিংশ শতাব্দীর একজন প্রভাবশালী বাঙালি কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক, সম্পাদক ও সাহিত্য-সমালোচক ছিলেন। বিংশ শতাব্দীর বিশ ও ত্রিশের দশকে আধুনিক কবিতার যারা পথিকৃৎ তিনি তাদের একজন। তিনি বাংলা সাহিত্য সমালোচনার দিকপাল ও কবিতা পত্রিকার প্রকাশ ও সম্পাদনার জন্য তিনি বিশেষভাবে সমাদৃত।
ব্যক্তিগত জীবন
বুদ্ধদেব বসুর জন্ম তার মাতামহের বাড়ী কুমিল্লায়। তার পিতা ভূদেব বসু পেশায় ঢাকা বারের উকিল ছিলেন। তার মাতার নাম বিনয়কুমারী। বুদ্ধদেব বসুর মাতামহ চিন্তাহরণ সিংহ ছিলেন পুলিশ অফিসার। তার পৈতৃক নিবাস ছিল বিক্রমপুরের অর্থাৎ বর্তমান মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার মালখানগর গ্রামে। জন্মের চব্বিশ ঘণ্টা পরেই তার মাতা বিনয়কুমারীর ১৬ বছর বয়সে ধনুষ্টঙ্কার রোগে মৃত্যু ঘটে। এতে শোকাভিভূত হয়ে তার পিতা সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করে গৃহত্যাগ করেন। মাতামহ চিন্তাহরণ ও মাতামহী স্বর্ণলতা সিংহ’র কাছে প্রতিপালিত হন বুদ্ধদেব। বুদ্ধদেবের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের প্রথমভাগ কেটেছে কুমিল্লা, নোয়াখালী আর ঢাকায়।
শিক্ষাজীবন
বুদ্ধদেব বসু ১৯১৮ সালে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় সচ্চিদানন্দ ইনস্টিটিউশনে পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে ১৯২১ সালে ১৩ বছর বয়সে তিনি ঢাকায় আসেন এবং প্রায় দশ বৎসর ঢাকায় শিক্ষালাভ করেন। বুদ্ধদেব বসু ১৯২৩ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯২৫ সালে ঐ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম বিভাগে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। ১৯২৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে ঢাকা কলেজ) থেকে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আই. এ. পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে ইংরেজিতে ১৯৩০-এ প্রথম শ্রেণীতে বি. এ. অনার্স এবং ১৯৩১-এ প্রথম শ্রেণীতে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ছিলেন মেধাবী এক ছাত্র। বি. এ. অনার্স পরীক্ষায় তিনি যে নম্বর লাভ করেন তা একটি রেকর্ড; এবং অদ্যাবধি (২০২১) এ রেকর্ড অক্ষুণ্ণ আছে।
কর্মজীবন
অধ্যাপনার মাধ্যমেই তার কর্মময় জীবন শুরু। জীবনের শেষাবধি তিনি নানা কাজে-কর্মে ব্যাপৃত রেখেছেন। শিক্ষকতাই ছিল জীবিকা অর্জনে তার মূল পেশা। কর্মময় জীবনের শুরুতে স্থানীয় কলেজের লেকচারের পদের জন্য আবেদন করে দু’বার প্রত্যাখ্যাত হলেও ইংরেজি সাহিত্যে অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য পরিণত বয়সে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে সারগর্ভ বক্তৃতা দিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। বাঙলা ভাষার তুলনামূলক সাহিত্য সমালোচনার ক্ষীণস্রোতকে তিনি বিস্তৃত ও বেগবান করেন। ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত কলকাতা রিপন কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা করেন। ১৯৪৫ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত স্টেটসম্যান পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। ১৯৫২ সালে দিল্লি ও মহিশূরে ইউনেস্কোর প্রকল্প উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পিটসবার্গের পেনসিলভেনিয়া কলেজ ফর উইমেনে শিক্ষকতা করেন তিনি।১৯৫৬ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বুদ্ধদেব বসু তুলনামূলক ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক নিযুক্ত হন।
গ্রন্থপঞ্জি
কাব্যগ্রন্থ
- মর্মবাণী (১৯২৫),
- বন্দীর বন্দনা (১৯৩০),
- একটি কথা (১৯৩২)
- পৃথিবীর প্রতি (১৯৩৩),
- কঙ্কাবতী (১৯৩৭),
- দময়ন্তী (১৯৪৩),
- দ্রৌপদীর শাড়ি (১৯৪৮),
- শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩),
- শীতের প্রার্থনা: বসন্তের উত্তর (১৯৫৫),
- যে-আঁধার আলোর অধিক (১৯৫৮),
- দময়ন্তী: দ্রৌপদীর শাড়ি ও অন্যান্য কবিতা (১৯৬৩),
- মরচেপড়া পেরেকের গান (১৯৬৬),
- একদিন: চিরদিন (১৯৭১),
- স্বাগত বিদায় (১৯৭১)
উপন্যাস
- একদা তুমি প্রিয়ে (১৯৩৩),
- সাড়া (১৯৩০),
- সানন্দা (১৯৩৩),
- লাল মেঘ (১৯৩৪),
- বাসরঘর (১৯৩৫)
- পরিক্রমা (১৯৩৮),
- কালো হাওয়া (১৯৪২),
- তিথিডোর (১৯৪৯),
- নির্জন স্বাক্ষর (১৯৫১),
- মৌলিনাথ (১৯৫২),
- নীলাঞ্জনের খাতা (১৯৬০),
- পাতাল থেকে আলাপ (১৯৬৭),
- রাত ভ’রে বৃষ্টি (১৯৬৭),
- গোলাপ কেন কালো (১৯৬৮),
- বিপন্ন বিস্ময় (১৯৬৯),
- রুক্মি”” (১৯৭২)
গল্প
- রজনী হ’ল উতলা(১৯২৬),
- অভিনয়,
- অভিনয় নয় (১৯৩০),
- রেখাচিত্র (১৯৩১),
- হাওয়া বদল (১৯৪৩),
- শ্রেষ্ঠ গল্প (১৩৫৯),
- একটি জীবন ও কয়েকটি মৃত্যু (১৯৬০),
- হৃদয়ের জাগরণ (১৩৬৮),
- ভাসো আমার ভেলা (১৯৬৩),
- প্রেমপত্র (১৯৭২)
প্রবন্ধ
- হঠাৎ-আলোর ঝলকানি (১৯৩৫),
- কালের পুতুল (১৯৪৬),
- সাহিত্যচর্চা (১৩৬১),
- রবীন্দ্রনাথ: কথাসাহিত্য (১৯৫৫),
- স্বদেশ ও সংস্কৃতি (১৯৫৭),
- সঙ্গ নিঃসঙ্গতা ও রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৩),
- প্রবন্ধ-সংকলন (১৯৬৬),
- কবি রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৬)
- সমুদ্রতীর (১৯৩৭),
- আমার ছেলেবেলা (১৯৭৩),
- আমার যৌবন (১৯৭৩)
- আমি চঞ্চল হে (১৯৩৭)
- সব পেয়েছির দেশে (১৯৪১)
- উত্তর তিরিশ (১৯৪৫)
- জাপানি জার্নাল (১৯৬২)
- দেশান্তর (১৯৬৬)
- কবি রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৬)
- মহাভারতের কথা (১৯৭৪)
- কবিতার শত্রু ও মিত্র (১৯৭৪)
নাটক
- মায়া-মালঞ্চ (১৯৪৪),
- তপস্বী ও তরঙ্গিণী (১৯৬৬),
- কলকাতার ইলেক্ট্রা
- সত্যসন্ধ (১৯৬৮)
- প্রথম পার্থ(১৯৭০)
অনুবাদ
- কালিদাসের মেঘদূত (১৯৫৭),
- গহীন বালুচর (১৯৫৮),
- বোদলেয়ার: তাঁর কবিতা (১৯৭০),
- হেল্ডালিনের কবিতা (১৯৬৭),
- রাইনের মারিয়া রিলকের কবিতা (১৯৭০)
ভ্রমণ কাহিনী
- সব-পেয়েছির দেশে (১৯৪১),
- জাপানি জার্নাল (১৯৬২),
- দেশান্তর (১৯৬৬),
স্মৃতিকথা
- আমার ছেলেবেলা (১৯৭৩),
- আমার যৌবন (১৯৭৬)
সম্পাদনা
- আধুনিক বাংলা কবিতা (১৯৬৩)
সম্মাননা
- ১৯৭০ সালে পদ্মভূষণ উপাধি লাভ করেন।
- ১৯৬৭ সালে তপস্বী ও তরঙ্গিণী কাব্যনাট্যের জন্য সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।
- ১৯৭৪ সালে স্বাগত বিদায় গ্রন্থের জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার (মরণোত্তর) লাভ করেন।
মৃত্যু
বুদ্ধদেব বসু ১৯৭৪ সালের ১৮ই মার্চ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
প্রত্যহের ভার
– বুদ্ধদেব বসু যে-বাণীবিহঙ্গে আমি আনন্দে করেছি অভ্যর্থনাছন্দের সুন্দর নীড়ে বার-বার, কখনো ব্যর্থ নাহোক তার বেগচ্যুত, পক্ষমুক্ত বায়ুর কম্পনজীবনের জটীল গ্রন্থিল বৃক্ষে ; যে-ছন্দোবন্ধনদিয়েছি ভাষারে, তার অন্তত আভাস যেন থাকেবত্সরের আবর্তনে, অদৃষ্টের ক্রূর বাঁকে-বাঁকে,কুটিল ক্রান্তিতে ; যদি ক্লান্তিআসে, যদি শান্তি…
দায়িত্বের ভার
–বুদ্ধদেব বসু কিছুই সহজ নয়, কিছুই সহজ নয় আর |লেখা, পড়া, প্রুফ পড়া, চিঠি লেখা, কথোপকথন,যা-কিছু ভুলিয়ে রাখে, আপাতত, প্রত্যহের ভার –সব যেন, বৃহদরণ্যের মতো তর্কপরায়ণহ’য়ে আছে বিকল্পকুটিল এক চতুর পাহাড় |সেই যুদ্ধে বার-বার হেরে গিয়ে, ম’রে গিয়ে, মনযখন বলছে…
রুপান্তর
– বুদ্ধদেব বসু দিন মোর কর্মের প্রহারে পাংশু,রাত্রি মোর জ্বলন্ত জাগ্রত স্বপ্নে |ধাতুর সংঘর্ষে জাগো, হে সুন্দর, শুভ্র অগ্নিশিখা,বস্তুপুঞ্জ বায়ু হোক, চাঁদ হোক নারী,মৃত্তিকার ফুল হোক আকাশের তারা |জাগো, হে পবিত্র পদ্ম, জাগো তুমি প্রাণের মৃণালে,চিরন্তনে মুক্তি দাও ক্ষণিকার অম্লান…
চিল্কায় সকাল
– বুদ্ধদেব বসু কী ভালো আমার লাগলো আজ এই সকালবেলায়কেমন করে বলি?কী নির্মল নীল এই আকাশ, কী অসহ্য সুন্দর,যেন গুণীর কণ্ঠের অবাধ উন্মুক্ত তানদিগন্ত থেকে দিগন্তে;কী ভালো আমার লাগলো এই আকাশের দিকে তাকিয়ে;চারদিক সবুজ পাহাড়ে আঁকাবাঁকা, কুয়াশায় ধোঁয়াটে,মাঝখানে চিল্কা উঠছে…
মুক্তিযুদ্ধের কবিতা
– বুদ্ধদেব বসু আজ রাত্রে বালিশ ফেলে দাও, মাথা রাখো পরস্পরের বাহুতে,শোনো দূরে সমুদ্রের স্বর, আর ঝাউবনে স্বপ্নের মতো নিস্বন,ঘুমিয়ে পোড়ো না, কথা ব’লেও নষ্ট কোরো না এই রাত্রি-শুধু অনুভব করো অস্তিত্ব।কেন না কথাগুলোকে বড়ো নিষ্ঠুরভাবে চটকানো হ’য়ে গেছে,কোনো উক্তি…