– বিষ্ণু দে অনেক দিনের অনেক যত্নে কমিয়েছি সন্ত্রাস।এদিকে আমার ছুটি শেষ হ’ল প্রায়,আজ তিনটেতে গাছ থেকে নেমে বসেছিলো জানলায়।এত ভীরু এত বিনীত কেন যে! এরাই তো ছিল খাসসমুদ্র-জয়ী সীতা-সন্ধানী সেতুবন্ধের সঙ্গী;দীন সজ্জন সাহসী উত্সাহিতমজুরেরই মত ভঙ্গী।এরা কেন ভয়ে ডালে-ডালে…
Tag: বিষ্ণু দে
বিষ্ণু দে
বিষ্ণু দে (১৮ জুলাই ১৯০৯ – ৩ ডিসেম্বর ১৯৮২) একজন বিখ্যাত বাঙালি কবি লেখক এবং চলচ্চিত্র সমালোচক। তিনি ১৯৭১ সালে তার স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ বইটির জন্য ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার জ্ঞানপীঠ লাভ করেন।
শিক্ষা এবং পেশাগত জীবন
বিষ্ণু দের জন্ম কলকাতার পটলডাঙার বিখ্যাত শ্যামাচরণ দে বিশ্বাসের পরিবারে। আদি নিবাস ছিল হাওড়ায়। তার পিতা অবিনাশ চন্দ্র দে ছিলেন একজন অ্যাটর্নি। বিষ্ণু দে কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউট এবং সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল-এ পড়াশোনা করেন । ১৯২৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর বঙ্গবাসী কলেজে আইএ পড়তে যান। ১৯৩২ সালে সাম্মানিক ইংরাজি বিষয়ে স্নাতক হন সেন্ট পল্স কলেজ থেকে। এরপর ১৯৩৪ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজিতে এম এ করেন। ১৯৩৫ সালে তিনি রিপন কলেজে (অধুনা সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) যোগদান করেন শিক্ষক হিসেবে। এরপর তিনি ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্সি কলেজে এবং ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি মৌলানা আজাদ কলেজে পড়ান। এরপর তিনি কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজেও অধ্যাপনার কাজ করেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ইংরাজীতে এম.এ.র ছাত্রী প্রণতি রায়চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় হয় । বেটোফেনের নাইন্থ সিম্ফনির মাধ্যমে তাঁদের পরিচয় ক্রমে গাঢ় হয়। পরে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ২রা ডিসেম্বর তাঁকে বিবাহ করেন ।
সাহিত্যকীর্তি
১৯২৩ সালে কল্লোল পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে যে সাহিত্য আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল কবি বিষ্ণু দে তার একজন দিশারী। রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতায় তার অবদান বাংলা সাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে। ১৯৩০ সালে কল্লোলের প্রকাশনা বন্ধ হলে তিনি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের পরিচয় পত্রিকায় যোগদান করেন এবং সেখানে একজন সম্পাদক হিসাবে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। ১৯৪৮ সালে চঞ্চল কুমার চট্টোপাধ্যায়ের সহায়তায় তিনি সাহিত্য পত্র প্রকাশ করেন। তিনি নিরুক্তা নামের একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেছিলেন। তার কবিতার মূল উপজীব্য হল মানুষ, তার সংগ্রাম ও রাজনীতি, সেখানে সমকালীন জীবনের, দেশ ও কালের, রাজনীতি ও সমাজের প্রতিধ্বনি। প্রথমদিকে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের দুই সংস্কৃতিরই প্রভাব পড়েছে তার লেখায়। দেশীয় পুরাণ, ইতিহাস, দর্শন, শিল্পসাহিত্য থেকে ইউরোপীয় ক্লাসিক ও আধুনিক শিল্প সাহিত্যের প্রভাব এবং পরে দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানের সময়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, তেভাগা-আন্দোলন ইত্যাদি থেকে শুরু করে স্বাধীনতার পরের ঘটনাবহুল জীবন ও আন্দোলন তার কবিতায় সরাসরি ছায়া ফেলেছে।
কবিজীবন
আধুনিক কবিদের মধ্যে দুর্বোধ্যতার অভিযােগে সর্বাপেক্ষা বেশী অভিযুক্ত যিনি, তার নাম বিষ্ণু দে (১৯০৯-১৯৮১)। এলিয়ট যেমন বিশ্বাস করতেন- “Poetry is not a turning loose of emotion, but an escape from emotion”,- বিষ্ণু দে-ও তেমনি কবিতায় কল্পনাবিলাস বা ভাববিলাসকে প্রশ্রয় দেন নি কখনও, মনন ও পাণ্ডিত্যের শিল্পিত প্রকাশ হিসাবেই তিনি ব্যবহার করেছে তার কবিতাকে। তাই সেই পাণ্ডিত্য ও মননের ভার তাঁর কবিতাকে করেছে সাধারণ পাঠকের কাছে দুরূহ এবং কবি হিসাবে বিষ্ণু দে হয়ে উঠেছেন আধুনিক কবিদের মধ্যে দুর্বোধ্যতম কবি।
দায়িত্বপূর্ণ লেখনী অসার আত্মপ্রকাশের গরজে অস্থির নয় বলেই তাঁর লেখা অল্পবিস্তর অসরল’
রচিত বই
- ছড়ানো এই জীবন (আত্মজীবনী)
- উর্বশী ও আর্টেমিস (১৯৩২)
- চোরাবালি (১৯৩৮)
- পূর্বলেখ (১৯৪০)
- রুচি ও প্রগতি (১৯৪৬)
- সাত ভাই চম্পা
- সাহিত্যের ভবিষ্যৎ (১৯৫২)
- সন্দীপের চর (১৯৪৭)
- অন্বিষ্ট (১৯৫০)
- নাম রেখেছি কোমল গান্ধার (১৯৫০)
- তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ (১৯৫৮)
- রবীন্দ্রনাথ ও শিল্প সাহিত্য আধুনিকতার সমস্যা (১৯৬৬)
- মাইকেল রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য জিজ্ঞাসা (১৯৬৭)
- ইন দ্য সান অ্যান্ড দ্য রেন (১৯৭২)
- উত্তরে থাকে মৌন (১৯৭৭)
- সংবাদ মূলত কাব্য
- সেই অন্ধকার চাই
- সেকাল থেকে একাল (১৯৮০)
- আমার হৃদয়ে বাঁচো (১৯৮১)
- স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ (জ্ঞানপীঠ পুরস্কার ১৯৭১)
জল দাও
– বিষ্ণু দে তোমার স্রোতের বুঝি শেষ নেই, জোয়ার ভাঁটায়এ-দেশে ও-দেশে নিত্য ঊর্মিল কল্লোলেপাড় গড়ে পাড় ভেঙে মিছিলে জাঠায়মরিয়া বন্যায় যুদ্ধে কখনো-বা ফল্গু বা পল্বলেকখনো নিভৃত মৌন বাগানের আত্মস্থ প্রসাদেবিলাও বেগের আভাআমি দূরে কখনো-বা কাছে পালে-পালে কখনো-বা হালেতোমার স্রোতের সহযাত্রী…
তুমিই মালিনী
– বিষ্ণু দে তুমিই মালিনী, তুমিই তো ফুল জানি ।ফুল দিয়ে যাও হৃদয়ের দ্বারে, মালিনী,বাতাসে গন্ধ, উৎস কি ফুলদানি,নাকি সে তোমার হৃদয়সুরভি হাওয়া ?দেহের অতীতে স্মৃতির ধূপ তো জ্বালি নিকালের বাগানে থামে নি কো আসা যাওয়াত্রিকাল বেঁধেছ গুচ্ছে তোমার চুলে,একটি…
মনে হয় প্রত্যেকে লেনিন
– বিষ্ণু দে তোমাদেরও মনে হয়, মনে হয় তোমারও প্রত্যেকে লেনিন ?লাজুক সুকান্ত ওই কথাটাই বলেছিল কৈশোর সংরাগে বহুদিন আগে –সহজ কিশোর বিনম্র কবি বাংলায় তার কথা শতবর্ষে জাগে |কারণ লেনিন নন দেবতা বা পুরাণ-নায়ক, তিনি একালের বীর,স্থির ধীর, ভাবুক,…
সুজলা সুফলা
– বিষ্ণু দে সুজলা সুফলা সেই মলয়শীতলা ধরণীভরণীবন্দনীয় মাতৃভূমি ঋষি (ও হাকিম) বঙ্কিমচন্দ্রেরসেই গণ-স্তোত্রগান এখনও হয়তো আনন্দেরশীর্ষ-চূড়ে কোনো সভায় স্বয়ম্ রবিঠাকুরেরসুরে সর্বাঙ্গ শিহরে অচৈতন্য শব্ দব্রহ্মে ধনীসমকণ্ঠে ওঠে সহস্রের গান, পাশের দূরেরদেহমনে সমভাব, মৈত্রী — রাখীবন্ধনে শপথে |সে-গান প্রাণের রন্ধ্রে,…
বাংলাই আমাদের
– বিষ্ণু দে আমরা বাংলার লোক,বাংলাই আমাদের, এদের ওদের সবার জীবন |আমাদের রক্তে ছন্দ এই নদি মাঠ ঘাটএই আমজাম বন,এই স্বচ্ছ রৌদ্রজলে অন্তরঙ্গ ঘরোয়া ভাষারহাস্যস্নাত অশ্রুদীপ্ত পেশল বিস্তার|চোখে কানে ঘ্রাণে প্রাণে দেহমনে কথায় স্নায়ুতেগঙ্গার পদ্মার হাসি একাকার, সমগ্র সত্তারঅজেয় আয়ুতে…
গার্হাস্থ্যাশ্রম (পূর্বরঙ্গ)
– বিষ্ণু দে তোমায় লেগেছে ভালো – সে-কথা তো জানো ?তোমার ও কটা চোখ – যদিচ বাঙালি,বুধবার থেকে কেন মনে পড়ে খালি !লোকে যাকে প্রেম বলে – সে কি তুমি মানো ?জেনে-শুনে চোখ দিয়ে আমাকে কি টানো ?না কি তুমি…
ভিড়
– বিষ্ণু দে নানামুনি দেয় নানাবিধ মত মন্বন্তর আসে!তবুও শহরে ওসারে বহরে জড়কবন্ধ ভিড়!বহু সাপ্লাই উঠে গেল শুনি, তবু আজো লাগে চিড়পদাতিক পথে, ট্রামে কারে ট্রাকে করে বিড়বিড়দরকারী বিনাদরকরী কেউ সরকারী চোরাকারবারী ফ’ড়েআমীর ওমরা মজুতদারের পাশেআমরা সবাই-তুমি আর আমি মৃত্যুর…
ঘোরসাওয়ার
-বিষ্ণু দে জন সমুদ্রে নেমেছে জোয়ার,হৃদয় আমার চড়া |চোরাবালি আমি দূর দিগন্তে ডাকি—কোথায় ঘোড়সওয়ার?দীপ্ত বিশ্ববিজয়ী! বর্শা তোলো |কোন ভয়? কেন বীরের ভরসা ভোলো?নয়নে ঘনায় বারে বারে ওঠাপড়া?চোরাবালি আমি দূর দিগন্তে ডাকি?হৃদয় আমার চড়া?অঙ্গে রাখিনা কারোই অঙ্গিকার?চাঁদের আলোয় চাঁচর বালির চড়া…
সে কবে
-বিষ্ণু দে সে কবে গেয়েছি আমি তোমার কীর্তনেকৃতার্থ দোহার |পদাবলী ধুয়ে গেছে অনেক শ্রাবণে ;স্মৃতি আছে তার |রৌদ্র-জলে সেই-স্মৃতি মরে না, আয়ু যেদুরন্ত লোহার |শুধু লেগে আছে মনে ব্যথার স্নায়ুতেমর্চের বাহার ||
আলেখ্য
-বিষ্ণু দে আঁটসাঁট বেঁধে আচল জড়ালো কোমরে,মুগ্ধ চোখের এক নিমেষের দেরিতেলঘু লাবণ্যে লাফ দিয়ে হল পার |কালো পাহাড়ের গায় চমকাল রেখা,শাড়ির শাদায় কস্তাপাড়ের সিঁদুরেকষ্টিতে ঋজু কোমল শরীরে তরল স্রোতের ছন্দ |এই লাবণ্যে এই নিশ্চিত ছন্দেআমরা সবাই কেনইবা পার হব নাসামনের…
অন্ধকারে আর
– বিষ্ণু দে অন্ধকারে আর রেখো না ভয়,আমার হাতে ঢাকো তোমার মুখদু-চোখে দিয়ে দাও দুঃখ সুখ,দু-বাহু ঘিরে গড়ো তোমার জয়,আমার তালে গাঁথো তোমার লয় |অসহ আলো আজ ঘৃণায় দগ্ধ,দূষিত দিনে আর নেইকো রুচি,অন্ধকারই একমাত্র শুচি,প্রেমের নহবত ঘৃণায় স্তব্ ধ |আমার…
ইলোরা
-বিষ্ণু দে আকাশে তোমার মুক্তি; ? যে কৈলাশ বেঁধেছ ভাস্করতোমার উর্মিল নৃত্যে, নীলিমা সে নৃত্যের সঙ্গিনী ;সেখানে নেইকো সোনা কৌটিল্যের নেই বিকিকিনি,সেখানে শূণ্যের চোখে সম্পূর্ণতা স্বাধীন, ভাস্বর |সে-দক্ষযজ্ঞের নাটে স্থিতি কাঁপে সংহারে-সংহারে,রাজসূয় অসূয়ার যুগ গত কুমার সম্ভবে ;নটরাজ সর্বহারা নীলকণ্ঠ…
তিনটি কাঠবিড়ালী
– বিষ্ণু দে অনেক দিনের অনেক যত্নে কমিয়েছি সন্ত্রাস।এদিকে আমার ছুটি শেষ হ’ল প্রায়,আজ তিনটেতে গাছ থেকে নেমে বসেছিলো জানলায়।এত ভীরু এত বিনীত কেন যে! এরাই তো ছিল খাসসমুদ্র-জয়ী সীতা-সন্ধানী সেতুবন্ধের সঙ্গী;দীন সজ্জন সাহসী উত্সাহিতমজুরেরই মত ভঙ্গী।এরা কেন ভয়ে ডালে-ডালে…
এবং লখিন্দর!
– বিষ্ণুদে হৃদয় তোমাকে পেয়েছি, স্রোতস্বিনী!তুমি থেকে থেকে উত্তাল হয়ে ছোটো,কখনো জোয়ারে আকণ্ঠ বেয়ে ওঠোতোমার সে-রূপ বেহুলার মতো চিনি।তোমার উৎসে স্মৃতি করে যাওয়া আসামনে-মনে চলি চঞ্চল অভিযানে,সাহচর্যেই চলি, নয় অভিমানে,আমার কথায় তোমারই তো পাওয়া ভাষা।রক্তের স্রোতে জানি তুমি খরতোয়া,ঊর্মিল জলে…
উর্বশী
– বিষ্ণু দে আমি নহি পুরূরবা। হে উর্বশী,ক্ষনিকের মরালকায়ইন্দ্রিয়ের হর্ষে, জান গড়ে তুলি আমার ভুবন?এসো তুমি সে ভুবনে, কদম্বের রোমাঞ্চ ছড়িয়ে।ক্ষণেক সেখানে থাকো,তোমার দেহের হায় অন্তহীন আমন্ত্রণবীথিঘুরি যে সময় নেই- শুধু তুমি থাকো ক্ষণকাল,ক্ষণিকের আনন্দাঅলোয়অন্ধকার আকাশসভায়নগ্নতায় দীপ্ত তনু জ্বালিয়ে যাওনৃত্যময়…