অমলকান্তি

– নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী অমলকান্তি আমার বন্ধু,ইস্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম।রোজ দেরি করে ক্লাসে আসতো,পড়া পারত না,শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলেএমন অবাক হয়ে জানলারদিকে তাকিয়ে থাকতো যে,দেখে ভারী কষ্ট হত আমাদের।আমরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিলাম,কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।অমলকান্তি সে-সব কিছু হতে চায়নি।সে রোদ্দুর হতে…

উলঙ্গ রাজা

– নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সবাই দেখছে যে, রাজা উলঙ্গ, তবুওসবাই হাততালি দিচ্ছে।সবাই চেঁচিয়ে বলছে; শাবাশ, শাবাশ!কারও মনে সংস্কার, কারও ভয়;কেউ-বা নিজের বুদ্ধি অন্য মানুষেরকাছে বন্ধক দিয়েছে;কেউ-বা পরান্নভোজী, কেউকৃপাপ্রার্থী, উমেদার, প্রবঞ্চক;কেউ ভাবছে, রাজবস্ত্র সত্যিই অতীবসূক্ষ্ম , চোখেপড়ছে না যদিও, তবু আছে,অন্তত থাকাটা…

মনে পড়ে

– নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ভুলে গেলে ভাল হত, তবু ভোলা গেল না এখনও।পঁয়ত্রিশ বছর পার হয়ে গেছে, তবু কোনো-কোনোমুহূর্তে তোমাকে মনে পড়ে।স্রোতের গোপন টানে ভেসে যায় পিতলের ঘড়া।অথচ বেদনা তার থেকে যায়। তাই বসুন্ধরাকেঁপে ওঠে ফাল্গুনের ঝড়ে।মনে পড়ে, মনে পড়ে, এখনও…

মেলার মাঠে

– নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী হাতখানা যার শক্ত করেআঁকড়ে ধরে রেখেছিলাম,হঠাৎ কখন ছিটকে গিয়েএই মাঠে সে হারিয়ে গেছে! এখন তাকে খুঁজব কোথায়!কোত্থেকে যে কোন্‌খানে যায়নিরুদ্দিষ্ট লোকজনেরাভিড়ের মধ্যে ভাসতে-ভাসতে। হাসতে-হাসতে যাচ্ছে সবাই,কেউ কিনেছে বেলুন-চাকি,কেউ ঝুড়ি, কেউ কাঁসার বাসন,কেউ নিতান্ত কাঠের পাখি। সকাল থেকেই…

হলুদ আলোর কবিতা

– নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী দুয়ারে হলুদ পর্দা। পর্দার বাহিরে ধুধু মাঠআকাশে গৈরিক আলো জ্বলে।পৃথিবী কাঞ্চনপ্রভ রৌদ্রের অনলেশুদ্ধ হয়।কারা যেন সংসারের মায়াবী কপাটখুলে দিয়ে ঘাস, লতা, পাখির স্বভাবেসানন্দ সুস্থির চিত্তে মিশে গেছে। শান্ত দশ দিক।দুয়ারে হলুদ পর্দা। আকাশে গৈরিকআলো কাঁপে। সারাদিন কাঁপে।…

হঠাৎ হাওয়া

– নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী হঠাৎ হাওয়া উঠেছে এই দুপুরেআকাশী নীল শান্তি বুঝি ছিনিয়ে নিতে চায়।মালোঠিগাঁও বিমূঢ়, হতবাক্‌।মেঘের ক্রোধ গর্জে ওঠে ঝড়ের ডঙ্কায়।এখনই এল ডাক।মন্দাকিনী মিলায় তাল তরঙ্গের নূপুরে। এ যেন হরধনুর টান ছিলাতেহেনেছে কেউ প্রবল টংকার।চিনের চোখ মীলিত। কার ভীষণ জটাজালআকাশে…

আবহমান

– নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী যা গিয়ে ওই উঠানে তোর দাঁড়া,লাউমাচাটার পাশে।ছোট্ট একটা ফুল দুলছে, ফুল দুলছে, ফুলসন্ধ্যার বাতাসে। কে এইখানে এসেছিল অনেক বছর আগে,কেউ এইখানে ঘর বেঁধেছে নিবিড় অনুরাগে।কে এইখানে হারিয়ে গিয়েও আবার ফিরে আসে,এই মাটিকে এই হাওয়াকে আবার ভালবাসে।ফুরয় না্‌…

সূর্যাস্তের পর

 – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সূর্য ডুবে যাবার পরহাসির দমকে তাদের মুখের চামড়া কুঁচকে গেল,গালের মাংস কাঁপতে লাগল,বাঁ চোখ বুঁজে, ডান হাতের আঙুল মটকেতারা বলল,“শত্রুরা নিপাত যাক।” আমি দেখলাম, দিগন্ত থেকে গুঁড়ি মেরেঠিক একটা শিকারি জন্তুর মতনরাত্রি এগিয়ে আসছে।বললাম, “রাত্রি হল।”তারা বলল,…

মিলিত মৃত্যু

– নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখ দ্বিতীয় বিদ্যায়।বরং বিক্ষত হও প্রশ্নের পাথরে।বরং বুদ্ধির নখে শান দাও, প্রতিবাদ করো।অন্তত আর যাই করো, সমস্ত কথায়অনায়াসে সম্মতি দিও না।কেননা, সমস্ত কথা যারা অনায়াসে মেনে নেয়,তারা আর কিছুই করে না,তারা আত্মবিনাশের পথপরিস্কার…

তোমাকে নয়

 – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী যেন কাউকে কটুবাক্য বলবার ভীষণপ্রয়োজন ছিল।কিন্তু না, তোমাকে নয়; কিন্তু না, তোমাকে নয়।যেন যত দুঃখ আমি পেয়েছি, এবারেচতুর্গুণ করে তাকে ফিরিয়ে দেবারপ্রয়োজন ছিল।কিন্তু না, তোমাকে নয়; কিন্তু না, তোমাকে নয়। দুই চক্ষু ভেসে গেল রক্তের ধারায়।দমিত আক্রোশে…

অমানুষ 

– নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী শিম্পাঞ্জি, তোমাকে আজ বড় বেশি বিমর্ষ দেখলুমচিড়িয়াখানায়। তুমি ঝিলের কিনারে।দারুণ দুঃখিতভাবে বসে ছিলে। তুমিএকবারও উঠলে না এসে লোহার দোলনায়;চাঁপাকলা, বাদাম, কাবলি-ছোলা–সবকিছুউপেক্ষিত ছড়ানো রইল। তুমি ফিরেও দেখলে না।দুঃখী মানুষের মতো হাঁটুর ভিতরে মাথা গুঁজেঝিলের কিনারে শুধু বসে রইলে…