– নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী অমলকান্তি আমার বন্ধু,ইস্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম।রোজ দেরি করে ক্লাসে আসতো,পড়া পারত না,শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলেএমন অবাক হয়ে জানলারদিকে তাকিয়ে থাকতো যে,দেখে ভারী কষ্ট হত আমাদের।আমরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিলাম,কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।অমলকান্তি সে-সব কিছু হতে চায়নি।সে রোদ্দুর হতে…
Tag: নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (১৯ অক্টোবর ১৯২৪-২৫ ডিসেম্বর ২০১৮) ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি কবি। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে আবির্ভূত আধুনিক বাংলা কবিদের অন্যতম। ‘উলঙ্গ রাজা‘ তাঁর অন্যতম বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থ লেখার জন্য তিনি ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে সাহিত্য একাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। কবি পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সাথে দীর্ঘকাল যুক্ত ছিলেন।
শৈশব ও কৈশোর
নীরেনের জন্ম ২ কার্তিক ১৩৩১ বঙ্গাব্দে (১৯ অক্টোবর, ১৯২৪) তারিখে ফরিদপুর জেলার চান্দ্রা গ্রামে।শৈশব কেটেছে সেই পূর্ববঙ্গেই, ঠাকুরদা আর ঠাকুমার কাছে। কবির ঠাকুরদা কর্মজীবন কাটিয়েছেন কলকাতায়। কর্মজীবন শেষে ৫০ বছর বয়সে কলকাতার পাট চুকিয়ে বাংলাদেশের ফরিদপুরের বাড়ি চান্দ্রা গ্রামে চলে আসেন। তার বাবা কলকাতাতেই ছিলেন। কলকাতার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে তিনি কাজ করতেন। দুই বছর বয়সে কবির মা বাবার কর্মস্থল কলকাতায় চলে যান। কবি থেকে যান তার ঠাকুরদা লোকনাথ চক্রবর্তীর কাছে। গ্রামে কাটিয়েছেন মহা স্বাধীনতায়—ইচ্ছেমতো দৌড়ঝাঁপ করে। কখনো গাছে উঠছেন; কখনো আপন মনে ঘুরেছেন গ্রামের এই প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। চার বছর বয়সে কবির কাকিমা বলেছিলেন, ’তুই তো দেখছি কবিদের মতোন কথা বলছিস!’ সেই সময়েই মুখস্থ করেছিলেন কবিগান, রামায়ণ গান। গ্রামের দিনগুলো খুব সুন্দর কাটিয়েছেন, তাই তিনি গ্রামের বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় যেতে চাইতেন না।
সাহিত্য জীবন
মাত্র ৫ বছর বয়সে তিনি প্রথম কবিতা লেখেন। কিন্তু সেটা কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। ১৬ বছর বয়স থেকে বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি কবিতা লিখে এসেছেন। ১৬ বছর বয়সেই “শ্রীহর্ষ” পত্রিকায় কবিতা লেখার মধ্যে দিয়েই সাহিত্যজগতে তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ হয়। “দৈনিক প্রত্যহ” পত্রিকায় তাঁর সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। “সত্যযুগ” পত্রিকার সাংবাদিক রূপে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর তিনি একে একে “মাতৃভূমি”, “স্বরাজ”, “ভারত”, “ইউনাইটেড প্রেস অফ্ ইন্ডিয়া” প্রভৃতি পত্রিকায় কাজ করা শুরু করেন। ১৯৫১ সালে যোগ দিয়েছিলেন ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায়। দীর্ঘ সময় তিনি ‘আনন্দমেলা’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। নীরেন্দ্রনাথের প্রথম কবিতার বই ‘নীল নির্জন’, প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৪ সালে। এরপর প্রকাশিত হয়েছে তার লেখা ‘অন্ধকার বারান্দা’, ‘নীরক্ত করবী’, ‘নক্ষত্র জয়ের জন্য’, ‘আজ সকালে’ সহ অসংখ্য কবিতার বই। সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারসহ বহু পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
ছোটগল্প ও উপন্যাস
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী একাধিক গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যে তার সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্রের নাম ভাদুড়ী মশাই।
১) "শ্যামনিবাস রহস্য" (১৯৯০) ২) "মুকুন্দপুরের মনসা" (১৯৯১) ৩) "বিষাণগড়ের সোনা" (১৯৯২) ৪) "চশমার আড়ালে" (১৯৯৩) ৫) "রাত তখন তিনটে" (১৯৯৪) ৬) "লকারের চাবি" (১৯৯৫) ৭) "বরফ যখন গলে" (১৯৯৫) ৮) "একটি হত্যার অন্তরালে" (১৯৯৭) ৯) "আড়ালে আছে কালীচরণ" (১৯৯৮) ১০) "পাহাড়ি দিছে" (১৯৯৮) ১১) "আংটি রহস্য" (২০০০) ১২) "জোড়া ভাদুড়ি" (২০০১) ১৩) "শান্তিলতার অশান্তি" (২০০২) ১৪) "কামিনীর কণ্ঠহার" (২০০৩)
উপন্যাস ‘নীরবিন্দু’ আত্মজীবনীমূলক। ভ্রমণ কাহিনি ‘গঙ্গাযমুনা’
পুরস্কার ও সম্মাননা
‘উলঙ্গ রাজা’ এই কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯৭৪ সালে ‘সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার’ পান কবি নীরেন্দ্রনাথ। তা ছাড়াও একগুচ্ছ পুরস্কার রয়েছে তার ঝুলিতে। ১৯৫৮ সালে ‘উল্টোরথ পুরস্কার’, ১৯৭০ সালে ‘তারাশঙ্কর স্মৃতি’ ও ১৯৭৬ সালে ‘আনন্দ শিরোমণি’ পুরস্কার পান কবি। ২০০৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডি. লিট প্রদান করে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে বঙ্গবিভূষণ পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করেছিল।
মৃত্যু
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী আর বেঁচে নেই। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ধ্রুবতারা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তার সৃষ্ট ‘অমলকান্তি’র মতোই যেন রোদ্দুর হয়ে গেলেন। দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগে ৯৪ বছর বয়সে চিরপ্রস্থান ঘটলো এই কিংবদন্তীর। ২০১৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল, পারেনি। আমাদের সমস্তটুকু ঘিরে যে প্রলয় অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, প্রিয় কবি, আপনি অন্তত আমাদের মাথার উপরে, আকাশের ‘নীল নির্জনে’ রোদ্দুর হয়ে থাকুন।
উলঙ্গ রাজা
– নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সবাই দেখছে যে, রাজা উলঙ্গ, তবুওসবাই হাততালি দিচ্ছে।সবাই চেঁচিয়ে বলছে; শাবাশ, শাবাশ!কারও মনে সংস্কার, কারও ভয়;কেউ-বা নিজের বুদ্ধি অন্য মানুষেরকাছে বন্ধক দিয়েছে;কেউ-বা পরান্নভোজী, কেউকৃপাপ্রার্থী, উমেদার, প্রবঞ্চক;কেউ ভাবছে, রাজবস্ত্র সত্যিই অতীবসূক্ষ্ম , চোখেপড়ছে না যদিও, তবু আছে,অন্তত থাকাটা…
মনে পড়ে
– নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ভুলে গেলে ভাল হত, তবু ভোলা গেল না এখনও।পঁয়ত্রিশ বছর পার হয়ে গেছে, তবু কোনো-কোনোমুহূর্তে তোমাকে মনে পড়ে।স্রোতের গোপন টানে ভেসে যায় পিতলের ঘড়া।অথচ বেদনা তার থেকে যায়। তাই বসুন্ধরাকেঁপে ওঠে ফাল্গুনের ঝড়ে।মনে পড়ে, মনে পড়ে, এখনও…
মেলার মাঠে
– নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী হাতখানা যার শক্ত করেআঁকড়ে ধরে রেখেছিলাম,হঠাৎ কখন ছিটকে গিয়েএই মাঠে সে হারিয়ে গেছে! এখন তাকে খুঁজব কোথায়!কোত্থেকে যে কোন্খানে যায়নিরুদ্দিষ্ট লোকজনেরাভিড়ের মধ্যে ভাসতে-ভাসতে। হাসতে-হাসতে যাচ্ছে সবাই,কেউ কিনেছে বেলুন-চাকি,কেউ ঝুড়ি, কেউ কাঁসার বাসন,কেউ নিতান্ত কাঠের পাখি। সকাল থেকেই…
হলুদ আলোর কবিতা
– নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী দুয়ারে হলুদ পর্দা। পর্দার বাহিরে ধুধু মাঠআকাশে গৈরিক আলো জ্বলে।পৃথিবী কাঞ্চনপ্রভ রৌদ্রের অনলেশুদ্ধ হয়।কারা যেন সংসারের মায়াবী কপাটখুলে দিয়ে ঘাস, লতা, পাখির স্বভাবেসানন্দ সুস্থির চিত্তে মিশে গেছে। শান্ত দশ দিক।দুয়ারে হলুদ পর্দা। আকাশে গৈরিকআলো কাঁপে। সারাদিন কাঁপে।…
হঠাৎ হাওয়া
– নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী হঠাৎ হাওয়া উঠেছে এই দুপুরেআকাশী নীল শান্তি বুঝি ছিনিয়ে নিতে চায়।মালোঠিগাঁও বিমূঢ়, হতবাক্।মেঘের ক্রোধ গর্জে ওঠে ঝড়ের ডঙ্কায়।এখনই এল ডাক।মন্দাকিনী মিলায় তাল তরঙ্গের নূপুরে। এ যেন হরধনুর টান ছিলাতেহেনেছে কেউ প্রবল টংকার।চিনের চোখ মীলিত। কার ভীষণ জটাজালআকাশে…
আবহমান
– নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী যা গিয়ে ওই উঠানে তোর দাঁড়া,লাউমাচাটার পাশে।ছোট্ট একটা ফুল দুলছে, ফুল দুলছে, ফুলসন্ধ্যার বাতাসে। কে এইখানে এসেছিল অনেক বছর আগে,কেউ এইখানে ঘর বেঁধেছে নিবিড় অনুরাগে।কে এইখানে হারিয়ে গিয়েও আবার ফিরে আসে,এই মাটিকে এই হাওয়াকে আবার ভালবাসে।ফুরয় না্…
সূর্যাস্তের পর
– নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সূর্য ডুবে যাবার পরহাসির দমকে তাদের মুখের চামড়া কুঁচকে গেল,গালের মাংস কাঁপতে লাগল,বাঁ চোখ বুঁজে, ডান হাতের আঙুল মটকেতারা বলল,“শত্রুরা নিপাত যাক।” আমি দেখলাম, দিগন্ত থেকে গুঁড়ি মেরেঠিক একটা শিকারি জন্তুর মতনরাত্রি এগিয়ে আসছে।বললাম, “রাত্রি হল।”তারা বলল,…
মিলিত মৃত্যু
– নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখ দ্বিতীয় বিদ্যায়।বরং বিক্ষত হও প্রশ্নের পাথরে।বরং বুদ্ধির নখে শান দাও, প্রতিবাদ করো।অন্তত আর যাই করো, সমস্ত কথায়অনায়াসে সম্মতি দিও না।কেননা, সমস্ত কথা যারা অনায়াসে মেনে নেয়,তারা আর কিছুই করে না,তারা আত্মবিনাশের পথপরিস্কার…
তোমাকে নয়
– নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী যেন কাউকে কটুবাক্য বলবার ভীষণপ্রয়োজন ছিল।কিন্তু না, তোমাকে নয়; কিন্তু না, তোমাকে নয়।যেন যত দুঃখ আমি পেয়েছি, এবারেচতুর্গুণ করে তাকে ফিরিয়ে দেবারপ্রয়োজন ছিল।কিন্তু না, তোমাকে নয়; কিন্তু না, তোমাকে নয়। দুই চক্ষু ভেসে গেল রক্তের ধারায়।দমিত আক্রোশে…
অমানুষ
– নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী শিম্পাঞ্জি, তোমাকে আজ বড় বেশি বিমর্ষ দেখলুমচিড়িয়াখানায়। তুমি ঝিলের কিনারে।দারুণ দুঃখিতভাবে বসে ছিলে। তুমিএকবারও উঠলে না এসে লোহার দোলনায়;চাঁপাকলা, বাদাম, কাবলি-ছোলা–সবকিছুউপেক্ষিত ছড়ানো রইল। তুমি ফিরেও দেখলে না।দুঃখী মানুষের মতো হাঁটুর ভিতরে মাথা গুঁজেঝিলের কিনারে শুধু বসে রইলে…