– অতুলপ্রসাদ সেন মোদের গরব, মোদের আশা,আ-মরি বাংলা ভাষা!তোমার কোলে,তোমার বোলে,কতই শান্তি ভালোবাসা! কি যাদু বাংলা গানে!গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে,গেয়ে গান নাচে বাউল,গান গেয়ে ধান কাটে চাষা! বিদ্যাপতি, চণ্ডী, গোবিন্,হেম, মধু, বঙ্কিম, নবীন-ঐ ফুলেরই মধুর রসে,বাঁধলো সুখে মধুর বাসা!…
Tag: অতুলপ্রসাদ সেন
অতুলপ্রসাদ সেন
অতুলপ্রসাদ সেন (২০ অক্টোবর ১৮৭১ – ২৬ আগস্ট ১৯৩৪) ছিলেন ব্রিটিশ ভারতবর্ষে ঊনবিংশ শতাব্দীতে আবির্ভুত একজন বিশিষ্ট বাঙালি গীতিকার, সুরকার ও গায়ক।তিনি একজন বিশিষ্ট সঙ্গীতবিদও ছিলেন। তার রচিত গানগুলির মূল উপজীব্য বিষয় ছিল দেশপ্রেম, ভক্তি ও প্রেম। তার জীবনের দুঃখ ও যন্ত্রণাগুলি তার গানের ভাষায় বাঙ্ময় মূর্তি ধারণ করেছিল; “বেদনা অতুলপ্রসাদের গানের প্রধান অবলম্বন”।
প্রাথমিক জীবন
১৮৭১ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকায় তার মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাদের আদি নিবাস শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার মগর গ্রামে। অতি অল্পবয়সেই অতুলপ্রসাদ পিতৃহারা হন। বাল্য কালে পিতৃহীন হয়ে অতুল প্রসাদ ভগবদ্ভক্ত, সুকন্ঠ গায়ক ও ভক্তিগীতিরচয়িতা মাতামহ কালীনারায়ণ গুপ্তের আশ্রয়ে প্রতিপালিত হন। পরবর্তীকালে মাতামহের এসব গুণ তার মাঝেও সঞ্চালিত হয়। মাতামহের নিকটই সঙ্গীত ও ভক্তিমূলক গানে তার হাতেখড়ি।অতুল প্রসাদ ১৮৯০ সালে প্রবেশিকা পাশের পর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন ও কিছুদিন অধ্যয়ন করেন।পরে লন্ডনে গিয়ে আইন শিক্ষা করেন। ইংল্যাণ্ড যাবার পথে ভেনিসের কাছে জাহাজে বসেই একটা বিদেশি গানের সুরে মোহিত হয়ে ঐ সুরকে মাথায় রেখে অতুলপ্রসাদ প্রথম লিখে ফেলেন একটি বিখ্যাত গান – ‘উঠ গো ভারতলক্ষ্মী’। লণ্ডনের মিডল টেম্পলে ব্যারিস্টারি পড়াকালীন ব্রিটিশ মিউজিয়াম ঘুরে দেখার সৌভাগ্য হয় তাঁর। চিত্তরঞ্জন দাশ, সরোজিনী নাইডু, অরবিন্দ ঘোষ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রমুখদের সঙ্গে লণ্ডনেই সাক্ষাৎ ঘটে তাঁর। ব্যারিস্টারি পড়ার পাশাপাশি পাশ্চাত্য সঙ্গীত, নাটক, অর্কেস্ট্রা ইত্যাদি শুনতে শুনতে গানের ভিত তৈরি হয় তাঁর মনে।
বিবাহ ও লন্ডনের প্রবাস জীবন
১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে ব্যারিস্টারী ডিগ্রী লাভের উদ্দেশ্য নিয়ে আইন পড়তে অতুলপ্রসাদ লণ্ডনে গমন করেন। কিছুদিন পর বড়মামা কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্ত সেখানে গেলে মামাতো বোন হেমকুসুমের সঙ্গে অতুলপ্রসাদের প্রেম হয় এবং তিনি হেমকুসুমকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। তখন ভারতবর্ষের আইনে ভাই-বোনে এরকম বিয়ে গ্রহণযোগ্য ছিল না। আর এ ব্যাপারে পরিবারের পক্ষ থেকে ওঠে প্রবল আপত্তি। অতুলপ্রসাদ তার সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন। আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার অতুলপ্রসাদ তার কর্মগুরু সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহের পরামর্শক্রমে স্কটল্যান্ড গমন করেন; যেখানে এরূপ বিবাহ আইনসিদ্ধ ছিল। স্কটল্যান্ডে গিয়ে ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে মামাতো বোন হেমকুসুমকে বিয়ে করেন অতুলপ্রসাদ।
লক্ষ্ণৌতে বসবাস
অতঃপর বিলেত থেকে ব্যারিষ্টারি পাশ করে তিনি কলকাতা ও রংপুরে আইন ব্যবসা শুরু করেন। সেখান থেকে তিনি পরে লক্ষ্ণৌতে চলে যান। সেখানে তিনি একজন শ্রেষ্ঠ আইনজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন এবং আউধ বার এ্যাসোসিয়েশন ও আউধ বার কাউন্সিলরের সভাপতি নির্বাচিত হন। লক্ষ্ণৌ নগরীর সংস্কৃতি ও জীবনধারার সঙ্গেও তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে পড়েন। ১৯০২ থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত অতুল প্রসাদ আইন ব্যবসা উপলক্ষে লক্ষ্ণৌতে অতিবাহিত করেন। সে সময় তার বাংলোতে প্রায় প্রতি সন্ধ্যায়ই গানের আসর বসতো। আর সেই আসরে গান শোনাতে আসতেন আহম্মদ খলিফ খাঁ, বরকৎ আলী খাঁ এবং আব্দুল করিমের মতো বিখ্যাত ওস্তাদগণ। ভালো সঙ্গীতের আসর পেলে তিনি আদালত ও মক্কেলদের কথাও ভুলে যেতেন। অতুল প্রসাদ অধিকাংশ গান লক্ষ্ণৌতেই রচনা করেন।
সঙ্গীত
বাংলা ভাষা সাহিত্যে ও সঙ্গীতের এক অতি পরিচিত নাম অতুল প্রসাদ সেন। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, গীতিকার ও গায়ক। বাংলাভাষীদের নিকট অতুল প্রসাদ সেন প্রধানত একজন সঙ্গীতজ্ঞ ও সুরকার হিসেবেই পরিচিত। তার গানগুলি মূলত স্বদেশি সঙ্গীত, ভক্তিগীতি ও প্রেমের গান; এই তিন ধারায় বিভক্ত। তবে তার ব্যক্তি জীবনের বেদনা সকল ধরনের গানেই কম-বেশি প্রভাব ফেলেছে। এজন্য তার অধিকাংশ গানই হয়ে উঠেছে করুণ-রস প্রধান।
বিবিধ প্রসঙ্গ
অতুল প্রসাদ প্রবাসী (বর্তমান নিখিল-ভারত) বঙ্গ-সাহিত্য সম্মিলন প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। তিনি উক্ত সম্মিলনের মুখপত্র উত্তরার একজন সম্পাদক এবং সম্মিলনের কানপুর ও গোরখপুর অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন। রাজনীতিতে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও প্রথমে কংগ্রেসের সমর্থক ছিলেন, পরে লিবারেলপন্থী হন। অতুলপ্রসাদ তার সমগ্র জীবনের উপার্জিত অর্থেরও বৃহৎ অংশ স্থানীয় জনকল্যাণে ব্যয় করেন। এমনকি তিনি তার বাসগৃহ ও গ্রন্থস্বত্বও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে দান করে যান।
মৃত্যু
ব্রিটিশ ভারতের লক্ষ্ণৌতে বসবাসকালে তিনি ১৯৩৪ সালের ২৬ আগস্ট মারা যান। সেখানেই তার শেষকৃত্য হয়। গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলাধীন কাওরাইদ (কাওরাদি) ব্রহ্ম মন্দিরের পাশে সমাধিস্থলে তার চিতাভস্ম সমাহিত করা হয়। এখানে একটি স্মৃতিফলক আছে। এতে লেখা ছিল ‘‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা! / তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা!‘‘ — ১৯৭১ খিস্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধের সময় তখনকার স্মৃতিফলকটি পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে ভেঙ্গে যায়। পরে নতুন করে করা হয়। নতুন স্মৃতিফলকে লেখা আছে:
অতুল প্রসাদ সেন
জন্ম – ১৮৭১ ২০শে অক্টোবর
মৃত্যু – ১৯৩৪ ২৭শে আগস্ট
শেষে ফিরব যখন সন্ধা বেলা সাঙ্গ করে ভবের খেলা
জননী হয়ে তখন কোল বাড়ায়ে রবে
আমার যে শূন্য ডালা, তুমি ভরিয়ো
আর তুমি যে শিব তাহা বুঝিতে দিয়ো।
জল বলে চল, মোর সাথে চল
– অতুলপ্রসাদ সেন জল বলে চল, মোর সাথে চলতোর আঁখিজল, হবে না বিফল, কখনো হবে না বিফল।চেয়ে দেখ মোর নীল জলে শত চাঁদ করে টল মল।জল বলে চল, মোর সাথে চল।বধু রে আন তরা করি, বধুরে আন তরা করি,কূলে এসে…
নীচুর কাছে নীচু হতে শিখলি না রে মন
– অতুলপ্রসাদ সেন নীচুর কাছে নীচু হতে শিখলি না রে মন,তুই সুখি জনের করিস পূজা, দুঃখীর অযতন।মূঢ় মন, সুখি জনের করিস পূজা, দুঃখীর অযতন।নীচুর কাছে নীচু হতে শিখলি না রে মন।লাগে নি যার পায়ে ধুলি, কি নিবি তার চরণ ধুলি,নয়রে…
ওগো নিঠুর দরদী
– অতুলপ্রসাদ সেন ওগো নিঠুর দরদী, ও কি খেলছ অনুক্ষণ।তোমার কাঁটায় ভরা বন, তোমার প্রেমে ভরা মন,মিছে খাও কাঁটার ব্যথা, সহিতে না পার তা আমার আঁখিজল,ওগো আমার আঁখিজল তোমায় করেগো চঞ্চলতাই নাই বুঝি বিফল আমার অশ্রু বরিশন।ওগো নিঠুর দরদী।ডাকিলে কও…
ভারত-লক্ষ্মী
– অতুলপ্রসাদ সেন উঠ গো, ভারত লক্ষ্মী! উঠ আদি জগত-জন-পূজ্যা!দুঃখ দৈন সব নাশি’, কর দূরিত ভারত লজ্জা |ছাড়গো, ছাড় শোক-শয্যা, কর সজ্জাপুনঃ কমল-কনক-ধন-ধান্যে!জননি গো, লহ তুলে বক্ষে, সান্ত্বন-বাস দেহ তুলে চক্ষে ;কাঁদিছে তব চরণ তলে, ত্রিংশতি কোটি নরনারী গো |কাণ্ডারি!…
বল, বল, বল সবে
– অতুলপ্রসাদ সেন বল, বল, বল সবে, শত বীণা-বেণু-রবে,ভারত আবার জগত-সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে |ধর্মে মহান্ হবে, কর্মে মহান্ হবে,নব দিনমণি উদিবে আবার পুরাতন এ পুরবে!আজও গিরিরাজ রয়েছে প্রহরী,ঘিরি তিনদিক নাচিছে লহরী,যায়নি শুকায়ে গঙ্গা গোদাবরী, এখনও অমৃতবাহিনী |প্রতি প্রান্তর, প্রতি…
বল, বল, বল সবে
– অতুলপ্রসাদ সেন বল, বল, বল সবে, শত বীণা-বেণু-রবে,ভারত আবার জগত-সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে |ধর্মে মহান্ হবে, কর্মে মহান্ হবে,নব দিনমণি উদিবে আবার পুরাতন এ পুরবে!আজও গিরিরাজ রয়েছে প্রহরী,ঘিরি তিনদিক নাচিছে লহরী,যায়নি শুকায়ে গঙ্গা গোদাবরী, এখনও অমৃতবাহিনী |প্রতি প্রান্তর, প্রতি…
হও ধরমেতে ধীর
– অতুলপ্রসাদ সেন হও ধরমেতে ধীর হও করমেতে বীর,হও উন্নত শির, নাহি ভয় |ভুলি ভেদাভেদ জ্ঞান, হও সবে আগুয়ান,সাথে আছে ভগবান,—হবে জয় |নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান,বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান্ ;দেখিয়া ভারেতে মহা-জাতির উত্থান—জগজন মানিবে বিস্ময়!তেত্রিশ কোটি মোরা নহি…