দর্পহরণ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কী করিয়া গল্প লিখিতে হয়, তাহা সম্প্রতি শিখিয়াছি। বঙ্কিমবাবু এবং সার্‌ ওয়াল্‌টার স্কট পড়িয়া আমার বিশেষ ফল হয় নাই। ফল কোথা হইতে কেমন করিয়া হইল, আমার এই প্রথম গল্পেই সেই কথাটা লিখিতে বসিলাম। আমার পিতার মতামত অনেকরকম ছিল;…

উলুখড়ের বিপদ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাবুদের নায়েব গিরিশ বসুর অন্তঃপুরে প্যারী বলিয়া একটি নূতন দাসী নিযুক্ত হইয়াছিল। তাহার বয়স অল্প; চরিত্র ভালো। দূর বিদেশ হইতে আসিয়া কিছুদিন  কাজ করার পরেই একদিন সে বৃদ্ধ নায়েবের অনুরাগদৃষ্টি হইতে আত্মরক্ষার জন্য গৃহিণীর নিকট কাঁদিয়া গিয়া পড়িল। গৃহিণী…

ফেল 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ল্যাজা এবং মুড়া, রাহু এবং কেতু, পরস্পরের সঙ্গে আড়াআড়ি করিলে যেমন দেখিতে হইত এও ঠিক সেইরকম। প্রাচীন হালদার বংশ দুই খণ্ডে পৃথক হইয়া প্রকাণ্ড বসত-বাড়ির মাঝখানে এক ভিত্তি তুলিয়া পরস্পর পিঠাপিঠি করিয়া বসিয়া আছে; কেহ কাহারো মুখদর্শন করে…

সদর ও অন্দর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিপিনকিশোর ধনীগৃহে জন্মিয়াছিলেন, সেইজন্যে ধন যে পরিমাণে ব্যয় করিতে জানিতেন তাহার অর্ধেক পরিমাণেও উপার্জন করিতে শেখেন নাই। সুতরাং যে গৃহে জন্ম সে গৃহে দীর্ঘকাল বাস করা ঘটিল না। সুন্দর সুকুমারমূর্তি তরুণ যুবক, গানবাজনায় সিদ্ধহস্ত, কাজকর্মে নিরতিশয় অপটু; সংসারের…

রাজটিকা 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নবেন্দুশেখরের সহিত অরুণলেখার যখন বিবাহ হইল, তখন হোমধূমের অন্তরাল হইতে ভগবান প্রজাপতি ঈষৎ একটু হাস্য করিলেন। হায়, প্রজাপতির পক্ষে যাহা খেলা আমাদের পক্ষে তাহা সকল সময়ে কৌতুকের নহে। নবেন্দুশেখরের পিতা পূর্ণেন্দুশেখর ইংরাজরাজ-সরকারে বিখ্যাত। তিনি এই ভবসমুদ্রে কেবলমাত্র দ্রুতবেগে…

পুত্রযজ্ঞ 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৈদ্যনাথ গ্রামের মধ্যে বিজ্ঞ ছিলেন সেইজন্য তিনি ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি রাখিয়া বর্তমানের সমস্ত কাজ করিতেন। যখন বিবাহ করিলেন তখন তিনি বর্তমান নববধূর অপেক্ষা ভাবী নবকুমারের মুখ স্পষ্টতররূপে দেখিতে পাইয়াছিলেন। শুভদৃষ্টির সময় এতটা দূরদৃষ্টি প্রায় দেখা যায় না। তিনি…

অতিথি 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম পরিচ্ছেদ কাঁঠালিয়ার জমিদার মতিলালবাবু নৌকা করিয়া সপরিবারে স্বদেশে যাইতেছিলেন। পথের মধ্যে মধ্যাহ্নে নদীতীরের এক গঞ্জের নিকট নৌকা বাঁধিয়া পাকের আয়োজন করিতেছেন এমন সময় এক ব্রাহ্মণবালক আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘বাবু, তোমরা যাচ্ছ কোথায়?’ প্রশ্নকর্তার বয়স পনেরো-ষোলোর অধিক হইবে…

ঠাকুরদা 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম পরিচ্ছেদ নয়নজোড়ের জমিদারেরা এককালে বাবু বলিয়া বিশেষ বিখ্যাত ছিলেন। তখনকার কালের বাবুয়ানার আদর্শ বড়ো সহজ ছিল না। এখন যেমন রাজা-রায়বাহাদুর খেতাব অর্জন করিতে অনেক খানা নাচ ঘোড়দৌড় এবং সেলাম-সুপারিশের শ্রাদ্ধ করিতে হয়, তখনো সাধারণের নিকট হইতে বাবু…

আপদ 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সন্ধ্যার দিকে ঝড় ক্রমশ প্রবল হইতে লাগিল। বৃষ্টির ঝাপট, বজ্রের শব্দ এবং বিদ্যুতের ঝিকমিকিতে আকাশে যেন সুরাসুরের যুদ্ধ বাধিয়া গেল। কালো কালো মেঘগুলো মহাপ্রলয়ের জয়পতাকার মতো দিগ্‌বিদিকে উড়িতে আরম্ভ করিল, গঙ্গার এপারে ওপারে বিদ্রোহী ঢেউগুলো কলশব্দে নৃত্য জুড়িয়া…

প্রায়শ্চিত্ত 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম পরিচ্ছেদ স্বর্গ ও মর্তের মাঝখানে একটা অনির্দেশ্য অরাজক স্থান আছে যেখানে ত্রিশঙ্কু রাজা ভাসিয়া বেড়াইতেছেন, যেখানে আকাশকুসুমের অজস্র আবাদ হইয়া থাকে। সেই বায়ুদুর্গবেষ্টিত মহাদেশের নাম ‘হইলে-হইতে-পারিত’। যাঁহারা মহৎ কার্য করিয়া অমরতা লাভ করিয়াছেন তাঁহারা ধন্য হইয়াছেন, যাঁহারা…

খাতা 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখিতে শিখিয়া অবধি উমা বিষম উপদ্রব আরম্ভ করিয়াছে। বাড়ির প্রত্যেক ঘরের দেয়ালে কয়লা দিয়া বাঁকা লাইন কাটিয়া বড়ো বড়ো কাঁচা অক্ষরে কেবলই লিখিতেছে–জল পড়ে, পাতা নড়ে। তাহার বউঠাকুরানীর বালিশের নিচে ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ ছিল, সেটা সন্ধান করিয়া বাহির করিয়া…

একটি ক্ষুদ্র পুরাতন গল্প

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গল্প বলিতে হইবে। কিন্তু আর তো পারি না। এখন এই পরিশ্রান্ত অক্ষম ব্যক্তিটিকে ছুটি দিতে হইবে। এ পদ আমাকে কে দিল বলা কঠিন। ক্রমে ক্রমে একে একে তোমরা পাঁচজন আসিয়া আমার চারিদিকে কখন জড়ো হইলে, এবং কেন যে…

মধ্যবর্তিনী 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম পরিচ্ছেদ নিবারণের সংসার নিতান্তই সচরাচর রকমের, তাহাতে কাব্যরসের কোনো নামগন্ধ ছিল না। জীবনে উক্ত রসের যে কোনো আবশ্যক আছে, এমন কথা তাহার মনে কখনো উদয় হয় নাই। যেমন পরিচিত পুরাতন চটি-জোড়াটার মধ্যে পা দুটো দিব্য নিশ্চিন্তভাবে প্রবেশ…

মহামায়া 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম পরিচ্ছেদ মহামায়া এবং রাজীবলোচন উভয়ে নদীর ধারে একটা ভাঙা মন্দিরে সাক্ষাৎ করিল। মহামায়া কোনো কথা না বলিয়া তাহার স্বাভাবিক গম্ভীর দৃষ্টি ঈষৎ ভর্ৎসনার ভাবে রাজীবের প্রতি নিক্ষেপ করিল। তাহার মর্ম এই, তুমি কী সাহসে আজ অসময়ে আমাকে…

কাবুলিওয়ালা 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমার পাঁচ বছর বয়সের ছোটো মেয়ে মিনি এক দণ্ড কথা না কহিয়া থাকিতে পারে না। পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া ভাষা শিক্ষা করিতে সে কেবল একটি বৎসর কাল ব্যয় করিয়াছিল, তাহার পর হইতে যতক্ষণ সে জাগিয়া থাকে এক মুহূর্ত মৌনভাবে…

স্বর্ণমৃগ 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আদ্যানাথ এবং বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী দুই শরিক। উভয়ের মধ্যে বৈদ্যনাথের অবস্থাই কিছু খারাপ। বৈদ্যনাথের বাপ মহেশচন্দ্রের বিষয়বুদ্ধি আদৌ ছিল না, তিনি দাদা শিবনাথের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করিয়া থাকিতেন। শিবনাথ ভাইকে প্রচুর স্নেহবাক্য দিয়া তৎপরিবর্তে তাঁহার বিষয়সম্পত্তি সমস্ত আত্মসাৎ করিয়া…

কঙ্কাল 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমরা তিন বাল্যসঙ্গী যে ঘরে শয়ন করিতাম তাহার পাশের ঘরের দেয়ালে একটি আস্ত নরকঙ্কাল ঝুলানো থাকিত। রাত্রে বাতাসে তাহার হাড়গুলা খট্‌খট্‌ শব্দ করিয়া নড়িত। দিনের বেলায় আমাদিগকে সেই হাড় নাড়িতে হইত। আমরা তখন পণ্ডিত-মহাশয়ের নিকট মেঘনাদবধ এবং ক্যাম্বেল…

খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম পরিচ্ছেদ রাইচরণ যখন বাবুদের বাড়ি প্রথম চাকরি করিতে আসে তখন তাহার বয়স বারো। যশোহর জিলায় বাড়ি, লম্বা চুল, বড়ো বড়ো চোখ, শ্যামচিক্কণ ছিপ্‌ছিপে বালক। জাতিতে কায়স্থ। তাহার প্রভুরাও কায়স্থ। বাবুদের এক-বৎসর-বয়স্ক একটি শিশুর রক্ষণ ও পালন-কার্যে সহায়তা…

রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যাহারা বলে, গুরুচরণের মৃত্যুকালে তাঁহার দ্বিতীয় পক্ষের সংসারটি অন্তঃপুরে বসিয়া তাস খেলিতেছিলেন, তাহারা বিশ্বনিন্দুক, তাহারা তিলকে তাল করিয়া তোলে। আসলে গৃহিণী তখন এক পায়ের উপর বসিয়া দ্বিতীয় পায়ের হাঁটু চিবুক পর্যন্ত উত্থিত করিয়া কাঁচা তেঁতুল, কাঁচা লঙ্কা এবং…

দেনাপাওনা 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাঁচ ছেলের পর যখন এক কন্যা জন্মিল তখন বাপমায়ে অনেক আদর করিয়া তাহার নাম রাখিল নিরুপমা। এ গোষ্ঠীতে এমন শৌখিন নাম ইতিপূর্বে কখনো শোনা যায় নাই। প্রায় ঠাকুরদেবতার নামই প্রচলিত ছিল– গণেশ, কার্তিক, পার্বতী, তাহার উদাহরণ। এখন নিরুপমার…

ঘাটের কথা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাষাণে ঘটনা যদি অঙ্কিত হইত তবে কতদিনকার কত কথা আমার সোপানে সোপানে পাঠ করিতে পারিতে। পুরাতন কথা যদি শুনিতে চাও, তবে আমার এই ধাপে বইস; মনোযোগ দিয়া জলকল্লোলে কান পাতিয়া থাকো, বহুদিনকার কত বিস্মৃত কথা শুনিতে পাইবে। আমার…

নতুনদা

– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নতুনদা– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দাঁড় বাধিয়া পাল খাটাইয়া ঠিক হইয়া বসিয়াছি। অনেক বিলম্বে ইন্দ্রের নতুনদা আসিয়া ঘাটে পোঁছিলেন। চাঁদের আলোতে তাহাকে দেখিয়া ভয় পাইয়া গেলাম। কলকাতার বাবু অর্থাৎ ভয়ংকর বাবু। সিষ্কের মোজা, চ্কচকে পাম্প–সু, আগাগোড়া ওভারকোটে মোড়া, গলায় গলাবন্ধ,…

প্রাণী

– মোশতাক আহমেদ ১. বিউন তার চশমাটা খুলে টেবিলের উপর রাখল। তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে ডুবে গেল গভীর চিন্তায়। এখনো সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে সে। আদৌ বিশেষ প্রাণীগুলো সে বিক্রি করবে, কি করবে না। আর বিক্রি করলে মূল্য কেমন চাইবে তা এখনো…

ভালোবাসা কি? ভালোবাসার সংজ্ঞা

_ রেদোয়ান মাসুদ ভালোবাসা  ( Valobasa )  বলতে মানুষের মনের আবেগ ও অনুভূতিকে বুঝায়। যা দেখা যায় না, ধরাও যায় না কিন্তু অনুভব করা যায়। মানুষ সেই ভালোবাসাকে তার মুখের কথা, চোখের ইশারা, বা তার বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দিয়ে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে প্রকাশ…

পুতুল

– মোশতাক আহমেদ রাত একটা।এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি হাকাচ্ছি ধানমন্ডিতে নিজের বাসার দিকে। আমার গাড়িটা ব্রান্ড নিউ টয়োটা এলিয়ন মডেলের। নতুন মাত্র পেয়েছি কোম্পানী থেকে। এয়ারপোর্টে এসেছিলাম বিদেশি এক বায়ারকে নিতে। যে গার্মেন্টসে চাকরি করি সেখানকার মালামাল পরিদর্শন করবে সে। কিন্তু…

হক সাহেবের হাসির গল্প (মরা কাউয়া)

– কাজী নজরুল ইসলাম স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপ্‌স্‌ বাংলার প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিনিধিরূপে ভারত সন্বন্ধে আলোচনা করবার জন্য হক সাহেবকে আমন্ত্রণ করেন। হক সাহেব দিল্লি গিয়ে স্যার স্ট্যাফোর্ডের সাথে আলোচনা করার পর যখন বেরিয়ে আসেন, তখন দলে দলে খবরের কাগজের প্রতিনিধি ও…

হক সাহেবের হাসির গল্প (দ্বিতীয় গল্প)

– কাজী নজরুল ইসলাম পাড়াগাঁয়ের গরিব মুসলমানদের মধ্যে একজন মোড়ল ছিলেন। তাঁকে সকলে ফকিরজি বলে ডাকত। তিনি দিনরাত আল্লা নাম জিকির করতেন। তাঁর গায়ে সর্বদা থাকত একটি চাদর। সেই চাদরে লেখা ছিল কোরান শরিফের অনেকগুলি বিখ্যাত সুরা (শ্লোক)। সেটিকে তিনি…

শেষ দিন (অনুপমার প্রেম-পর্ব-৬)

– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আজ অনুপমার শেষ দিল। এ সংসারে সে আর থাকিবে না। জ্ঞান হইয়া অবধি সে সুখ পায় নাই। ছেলেবেলায় ভালবাসিয়াছিল বলিয়া নিজের শান্তি নিজে ঘুচাইয়াছিল; অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করিয়াছিল বলিয়া বিধাতা তাহাকে একতিলও সুখ দেন নাই। যাহাকে ভালবাসিত মনে…

চন্দ্রবাবুর সংসার (অনুপমার প্রেম-পর্ব-৫)

– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তিন বৎসর পরে খালাস হইয়াও ললিতমোহন বাড়ি ফিরিল না। কেহ বলিল, লজ্জায় আসিতেছে না। কেহ বলিল, সে গ্রামে কি আর মুখ দেখাতে পারে? ললিতমোহন নানা স্থান পরিভ্রমন করিয়া দুই বৎসর পরে সহসা একদিন বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইল।…

বৈধব্য (অনুপমার প্রেম-পর্ব-৪)

– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তথাপি অনুপমা একটু কাঁদিল। স্বামী মরিলে বাঙালীর মেয়েকে কাঁদিতে হয়, তাই কাঁদিল। তাহার পর স্ব-ইচ্ছায় সাদা পরিয়া সমস্ত অলঙ্কার খুলিয়া ফেলিল। জননী কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, “অনু, তোর এ বেশ ত আমি চোখে দেখতে পারি না, অন্তত হাতে…

Posts navigation

  • 1
  • 2