পর্ব-৪: জানা-অজানায় ‘তাজমহল’

আরিফুর রহমান 

সম্পাদক, অচিনপুর.কম

অনেক ইতিহাস গবেষকের মতে সম্রাট শাহজাহানের তাজমহল তৈরির পেছনে মমতাজের প্রতি প্রেমের কোন স্পর্শই ছিল না। বিষয়টা শুনতে বেজায় বেখাপ্পা লাগে, তাই না?

শাহজাহান ছিলেন স্থাপত্য নির্মাণে ব্যাকুল। বলা যায়, এটা একেবারে তার নেশায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল। তার ধ্যান-জ্ঞান-কামনা সবই ছিল, তিনি এমন অপরূপ এক স্থাপত্য তৈরি করবেন, যা তার নামকে অমর করে রাখবে শতাব্দীর পর শতাব্দী। আর মমতাজের মৃত্যু হয়ে গেল তার এই স্বপ্ন পূরণের অসিলা, এটা কোন প্রেম বা বিরহ কিছুই ছিল না।

তাজমহল নির্মাণে সম্রাট শাহজাহান বিপুল পরিমান অর্থ ব্যয় করেন। এর ফলে রাজকোষ এক সময় খালি হয়ে যায়। আর এর ভার গিয়ে পরে প্রজাদের উপর। প্রজাদের থেকে কড়ায়গণ্ডায় কর আদায়ের ফলে সাম্রাজ্যে একসময় দুর্ভিক্ষ নেমে আসে। সে আমলে তাজমহল নির্মাণ ব্যয় হিসাব করা হয়েছিল ৩২ মিলিয়ন রুপি। এই পুরো অর্থ ছিল সাধারণ মানুষের রক্ত চুষে আদায় করা খাজনার টাকা। শাহ্জাহান এ টাকাই ব্যয় করেছেন নিজের মৃত স্ত্রীর কবরের উপর স্মৃতিসৌধ নির্মাণের মতো ব্যক্তিগত অভিলাষ পূরণে।

তাজমহল নির্মাণের ১১ বছর পর শায়েস্তা খাঁ সুবেদার হয়ে বাংলায় আসেন। শায়েস্তা খাঁর আমলে টাকায় কত মণ চাল পাওয়া যেতো ৮ মণ। অর্থাৎ তখন ১ মণ চালের দাম ছিল সাড়ে ১২ পয়সা বা .১২৫ টাকা। আর বর্তমানে ১ মণ চালের সর্বনিম্ন মূল্য কত? সম্ভবত: ৯০০ থেকে ১,০০০ টাকার মধ্যে হবে। ধরে নিলাম, ৯০০ টাকা। এখন ৯০০ কে .১২৫ দিয়ে ভাগ করলে ভাগফল হবে, ৭,২০০। এর মানে তখনকার চেয়ে এখন দাম বেড়েছে ৭,২০০ গুন বেশি। তাহলে তাজমহলের জন্য ব্যয়কৃত অর্থের পরিমান বর্তমানে দাঁড়াবে ৩২ মিলিয়ন x ৭,২০০ রুপি বা ২৩,০৪০ কোটি রুপিতে যা ২৮,৩১৪ কোটি টাকার সমান।

কিন্ত এ সময়ে এসে একটা হিসাব করলে দেখা যাবে, তাজমহল থেকে ভারত সরকার যে আয় করেছে, তার কাছে এই ব্যয় কিছুই না। এটা ভারতের একটা স্থায়ী আয়ে পরিনত হয়েছে। তাজমহলের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জীবন জীবিকা জড়িয়ে আছে প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষের। বর্তমানে মুঘল আমলের আশ্চর্য শিল্পকলা দেখতে আগ্রায় প্রতি বছর গড়ে ৬০ লক্ষ আন্তর্জাতিক পর্যটকের ভিড় হয়। প্রতি বছর পর্যটন মৌসুমে ভারতে সবচেয়ে বেশি পর্যটক আসেন তাজমহলে৷ দেশের রাজকোষে সবচেয়ে বেশি অর্থ জমা পড়ে তাজমহল থেকেই৷ সব খাত বাদ দিয়ে শুধু টিকিট বিক্রি থেকে ভারত প্রতিবছর আয় করে ২৫ কোটির বেশী রুপি। আর বর্তমানে ভারত সরকার তার এই আয় বাড়িয়ে নিয়েছে অনেক গুণ। এখনতো টিকিটের মূল্য আরও বৃদ্ধি করা হয়েছে।

বিখ্যাত স্মৃতিসৌধ তাজমহলের দর্শন ফি এক লাফে বেড়ে গেল। আগে ভারতীয়দের ৫০ রুপিতে তাজমহলের মূল সমাধিস্থল দেখার সুযোগ ছিল। কিন্তু এখন তাজমহলের মূল সমাধিস্থল দর্শনসহ সব মিলিয়ে তাদের জন্য ফি নির্ধারিত হয়েছে ২৫০ রুপি। যারা শুধু তাজমহল চত্বর দেখবেন, তাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে ৫০ রুপি। ৫০ রুপির টিকিট কেটে দর্শনার্থীরা ভেতরে ঢুকতে পারবেন না। দেখতে পারবেন না তাজমহলের মূল সমাধিস্থল। তারা তাজমহলের চারপাশ ও যমুনার সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। মোট কথা, ভারতীয় পর্যটকদের তাজমহলের সবটুকু ঘুরে দেখতে খরচ পড়বে মোট ২৫০ রুপি। সার্কভুক্ত দেশের পর্যটকদের দিতে হবে ৭৪০ রুপি, এতদিন যা ছিল ৫৪০ রুপি। আর বিদেশি পর্যটকদের গুনতে হবে ১ হাজার ৩০০ রুপি, আগে যা ছিল ১ হাজার ১০০ রুপি।

মজার ঘটনা হল, একদা এক হিন্দু ব্যবসায়ী মার্বেল পাথর দিয়ে বৃন্দাবনে তার আরাধ্য দেবতার মন্দির বানানোর জন্য তাজমহলের দাম হেকে ছিলেন ২ লাখ টাকা। তাজমহল বিক্রি হয়নি এতো কম টাকায়। কিন্তু আগ্রা দূর্গের ভেতরের অত্যন্ত সুন্দর মোতি মসজিদ বিক্রয় হয়ে যায়, মাত্র সাড়ে ১২ হাজার পাউন্ডে। তখন মোতি মসজিদ, তাজমহলসহ অসংখ্য স্থাপত্য নির্মাণে বহুমূল্য শ্বেত মর্মর পাথরের ব্যবহার করেছিলেন সম্রাট শাহজাহান।

ভরা পূর্ণিমার ভালবাসার এ মহাস্থাপনা সোনালি আর নীল আলোয় লুকোচুরি খেলে। আর কুয়াশা মাখা দিনে ভালবাসার এ স্তম্ভ যেন মেঘের গায়ে ভেসে বেড়ায়। প্রচলিত আছে, গম্বুজগুলো থেকে যে রঙ-বেরঙের আলোর ছটা বিচ্ছুরিত হয় তা নারীর আবেগ ও অনুভুতিকেই প্রকাশ করে। যদি আপনার প্রিয়জনকে নিয়ে তাজমহল ভ্রমণ করতে চান তাহলে পূর্ণিমার রাতে তাজমহল দর্শন করতে ভুলবেন না। রাতের জোছনা মাখা তাজমহলের রূপ, সোনায় মোড়ানো গম্বুজ আর সবুজ চাদরের লনের তুলনা এ ধরিত্রীর কারো সাথে সম্ভব নয়।

শাহজাহানের রাজত্বকালকে ঐতিহাসিকগণ মুঘল যুগের স্বর্ণযুগ বলে অভিহিত করেছেন। অদৃষ্টের নির্মম পরিহাসে তাঁর রাজত্বকালের শেষের দিকে তার সন্তানদের মাঝে উত্তরাধিকার বিষয়ক দন্দ্ব মুঘল তথা সমগ্র মুসলিম ভারতের ইতিহাসে একটি কলংকময় ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। এ কারণে সম্রাট শাহজাহানের শেষ জীবন হয়ে উঠেছিল হৃদয়বিদারক ও মর্মান্তিক।

চলবে…

Post navigation