হেলেন অফ ট্রয়

আহম্মেদ ইমতিয়াজ নীল
পান্থপথ, ঢাকা।

থ্রিলার: হেলেন অফ ট্রয়

এক.
‘আপনার ছেলের কোন ছবি এনেছেন, মিসেস ইসলাম?’ ধানমন্ডি থানার এস আই আদিল খান জিজ্ঞাসা করলো তার সামনে বসে থাকা মিসেস ইসলামকে।

এই ইসলাম দম্পতি আজ থানায় এসেছে, উনাদের একমাত্র ছেলে আকতার গতকাল থেকে বাসায় ফেরেনি।

‘ হা, এইতো এনেছি। ও গতকাল সকালে বললো, ওর বন্ধু সাইফুরের সাথে জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি ঘুরতে যাবে, এই বলে বের হয়ে আজ এত বেলা পর্যন্ত বাসায় ফেরেনি। এইরকম আগে কখনো করেনি, ফোনও বন্ধ পাচ্ছি।’

‘ওর বন্ধু সাইফুর কি বলে? জিজ্ঞেস করেছিলেন?’

‘করেছি, সাইফুর বললো, আকতার নাকি একাই গিয়েছে, ও সাথে যায়নি।’

‘আকতারের বাকি বন্ধুদের জিজ্ঞেস করেছিলেন?’

‘করেছি, আসলে আকতার, সাইফুর, আবির, তানিয়া, জেনি, নিপা এই কইজনের একটা গ্রুপ আছে, ওরা সবসময় একসাথে থাকে। একই ইউনিভার্সিটির একই সাবজেক্টে পড়ে, কিন্তু কেউ জানে না আকতার কোথায়…আমার খুব ভয় লাগছে ইন্সপেক্টর, আকতার এমনটা আগে কখনো করেনি।’

‘আমাদের পক্ষ থেকে চেষ্টার কোন ত্রুটি থাকবে না, আপনারা এখন বাসায় যান, আকতারের কোন খোঁজ পেলে আমরা জানাব।’

ইসলাম দম্পতি বের হয়ে যেতেই আদিল এ এস আই ইমরানকে ডেকে বললো,

‘ইমরান এই ছেলেটার ছবি আশেপাশের সব থানায় পাঠিয়ে দাও, হাসপাতালগুলোতেও একটু খোঁজ নাও।’

‘ওকে স্যার।’

‘আর শোনো, ছেলেটার মোবাইলের লাস্ট লোকেশান দেখতো, কোথায় দেখায়…আর হা, ওর সব বন্ধুগুলোকে থানায় ডাকো।’

দুই.
পরদিন সাইফুর মাসহ থানায় আসলো।

‘সাইফুর, গতপরশু আকতার তোমার সাথে দেখা করতে এসেছিল? তোমাদের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা ছিল?’

‘হা,স্যার, এসেছিল। আমরা ভর্তা ভাত খেতে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ঐদিন সকাল থেকে আমার শরীরটা ম্যাজ ম্যাজ করছিল। তাই আমি যাইনি, আকতার একা গিয়েছিল।’

‘তুমি কিভাবে জানলে আকতার জাহাঙ্গীরনগরেই গিয়েছিল? অন্য কোথাও তো যেতে পারে?’

‘আমাদের বাসায় বলে গিয়েছিল ঐখানেই যাচ্ছে। অন্য কোথাও গেলে আমি বলতে পারব না, আমি সারাদিন বাসায় ছিলাম, বের হইনি। আমার মাকে জিজ্ঞেস করেন।’

আদিল সাইফুরের মা এর দিকে তাকাল, মহিলা যথেষ্ট সুন্দরী, এই বয়সেও অসাধারণ ফিগার। না বললে কেউ বিশ্বাস করবে না তার ছেলে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে…

ভদ্রমহিলা আদিলের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললো,

‘আমি শায়লা, শায়লা রহমান, সাইফুরের মা, ওইদিন আমার ছেলে বাসা থেকে বের হয়নি। সারাদিন বাসায় ছিল, টিভিতে ক্রিকেট খেলা দেখেছে।’
ভদ্রমহিলাকে দেখে প্রশ্ন করার লোভটা সামলাতে পারল না আদিল,

‘আপনাকে দেখে অনেক কম বয়সী মনে হয়, কিছু মনে করবেন না, আপনি কি সাইফুরের স্টেপ মম?’

‘না, আমি সাইফুরের আসল মা, মাত্র ষোল বছর বয়সে আমার বিয়ে হয়, সতেরোতে মা হই।’

‘হুম, আচ্ছা সাইফুর তোমার কি মনে হয়, আকতার কোথায় যেতে পারে? বা ওর সাথে কারো কোন শত্রুতা ছিল? কিংবা, তোমাদের বয়সি ছেলেদের যেটা হয়, বান্ধবী নিয়ে মারামারি?’

‘আকতার সব মেয়ের সাথেই কম-বেশি ফ্লার্ট করতো, তবে কোন ক্লোজ বান্ধবী ছিল না, আর যতদুর জানি শত্রুও ছিল না ওইরকম কোন।’

‘দেখ সাইফুর, আকতারের মা খুব জোর দিয়ে বলছে, যে আকতার তোমার সাথে জাহাঙ্গীরনগর যাবে বলেই বের হয়েছে, আর তোমাদের ছাড়া আকতার কোথাও যায় না।’

‘স্যার, আমি তো বলছি, আকতার এসেছিল, কিন্তু আমি ওর সাথে যাইনি।’

সাইফুরের পাশে বসে থাকা মিসেস রহমান বেশ জোর দিয়ে বললেন,

‘আমার ছেলে ওইদিন বাসা থেকে বের হয়নি। সকালে আকতার এসেছিল, কিন্তু সাইফুর ওর সাথে যায়নি।’

‘ঠিক আছে, আপনারা এখন যেতে পারেন, তবে প্রয়োজন হলে আবার ডাকবো, আর আপনার হাসবেন্ড কোথায় মিসেস রহমান।’

‘আমার স্বামী ইতালি থাকে, ওখানে জব করে।’

‘আপাতত আপনাদের ছাড়ছি, কিন্তু কোন তথ্য যদি গোপন করে থাকেন, তার পরিণাম কিন্তু ভাল হবে না।’

মিসেস রহমান চলে গেলে ইমরান ঢুকলো আদিলের রুমে,

‘স্যার, আকতারের বন্ধু আবিরের সাথে কথা বলে আসলাম, আবির ওই দিন মা আর বোনকে নিয়ে শপিং এ গিয়েছিল, ওর মা আর বোন এ্যালিবাই।’

‘হুম, মা আর বোনের এলিবাই এ কাজ হবে না,তুমি এদের সবার, আকতারের সব বন্ধুদের মোবাইলের কল লিস্ট আর লোকেশান বের করো,সেই সাথে আকতারের বাবা মিস্টার ইসলামের অফিসে খোঁজ নাও, দেখ উনার সাথে কারো শত্রুতা আছে কিনা, আর আকতারের মোবাইলের লাস্ট লোকেশন কোথায় শো করে?’

‘জাহাঙ্গীরনগর ভার্সিটি স্যার, আমি মিস্টার ইসলামের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানাব স্যার।’

‘তার মানে আকতার জাহাঙ্গীরনগর গেছিল, কিন্তু ফিরে আসেনি, আর প্রায় তিন দিন হতে চলল, টাকা চেয়ে কোন ফোন আসেনি, ব্যাপারটা আমার ভালো লাগছে না ইমরান, অপহরণের কেসতো মনে হচ্ছে না।’

তিন.
আকতারের বন্ধু তানিয়া এসেছে থানায়। মেয়েটার চোখে মুখে সরলতার ছাপ, নাকটা একটু বোঁচা, তবে চেহারাটা মিষ্টি।

‘তানিয়া, আপনি শুনেছেন হয়তো, আকতার নিরুদ্দেশ, ব্যাপারটা খুব ক্রিটিকাল, যা জানেন বলেন এই ব্যাপারে।’

‘স্যার আমি ওইদিন একটা দাওয়াতে গিয়েছিলাম, ফ্যামিলির সবাই মিলে, তবে আকতার জাহাঙ্গীরনগর ঘুরতে যাবে বলেছিল।’

‘আকতারের কোন প্রেমিকা ছিল? বা আপনাদের বন্ধুদের মাঝে কাউকে ও পছন্দ করতো?’

‘না স্যার, আমার বন্ধুদের মাঝে, এমনকি পুরো ভার্সিটিতে কোন মেয়ের সাথে আকতারের কিছু ছিল না। তবে ও সব মেয়েকেই পটানোর চেষ্টা করতো। ভার্সিটির বাইরে কিছু থাকলে আমার জানা নেই। তবে একটা ব্যাপার…’

‘কি ব্যাপার?’

‘আমি আর জেনি মিলে মাঝে মাঝেই নিউমার্কেট যেতাম, আকতার মাঝে মাঝে আমাদের সাথে যেয়ে লেডিস আইটেম কিনতো এই ধরেন মালা, চুড়ি এইসব, আমি আর জেনি পছন্দ করে দিতাম।’

‘কার জন্য কিনতো বলতে পারবেন?’

‘না স্যার, আকতার এটা বলেনি কখনো, তবেও সব মেয়ের সাথেই ফ্লার্ট করতো, কাউকে দিবে হয়তো, আমি জানি না।’

‘তানিয়া আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, দরকার হলে আবার ডাকব।’

আকতারের বন্ধু নিপা যখন থানায় ঢুকলো আদিলের মনে হলো, এই মেয়ে থানায় বন্ধুর নিরুদ্দেশের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছে নাকি ফ্যাশান শোতে এসেছে? পুরো মুখ পুরু মেকআপে ঢাকা, এতো মেকআপ মানুষ মাখে কেমনে?

‘মিস নিপা, আপনার বন্ধুর ঘটনা শুনেছেন হয়ত, আকতার যেদিন নিরুদ্দেশ হয়, আপনি কোথায় ছিলেন?’
পারসোনাতে এসেছিলাম, ওইখানে একটি নতুন চাকমা মেয়ে এসেছে, দারুন ম্যাসাজ করে, আপনি বিয়ে করেছেন স্যার, ভাবিকে পাঠিয়ে দিতে পারেন…..’

‘মিস নিপা, আপনাকে যততুকু জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, ঠিক তততুকু বলবেন। তারপর, বিউটিপার্লার থেকে কোথায় গেছিলেন?’

‘আলমাসে গেছিলাম, লেডিস ব্যাগ দেখতে, ভালো পেলাম না, তবে একটা নেইল পালিস কিনেছি, পিংক কালার, এই যে, আজ নখে দিয়েছি, দেখুন সুন্দর না?’

‘আপনার নখ আপনি দেখুন, আচ্ছা, আপনার বন্ধু আকতার কাউকে পছন্দ করত?’

‘আমাকে করত স্যার, ইনফ্যাক্ট, আকতার, আবির, সাইফুর, সবাই আমাকে পছন্দ করত, আমি ওদের পাত্তা দেই না, বিয়ে করলে কোন আর্মি অফিসারকে করব, ফিগারটা হবে জন আব্রাহামের মত…’

‘নিপা আপনাকে আগে একবার নিষেধ করেছি, যা জিজ্ঞেস করছি, শুধু তাই বলবেন, বাড়তি কথা না, আপনি এখন যেতে পারেন, লাগলে আবার ডাকব।’

নিপা বের হয়ে যেতেই কন্সটেবলকে ডেকে চা চাইল আদিল, উহ মেয়েটা মাথাটা ধরিয়ে দিয়ে গেছে…

‘স্যার এক মহিলা এসেছে, আপনার সাথে দেখা করতে চায়’, কন্সটেবল বললো।

‘পাঠিয়ে দাও।’

একমাথা কালো চুলের কালো শাড়িপড়া একটা কালো মেয়ে ঢুকলো আদিলের রুমে…

বিধাতার একি অপরুপ সৃষ্টি, কালো মেয়েরাও এতো সুন্দরী হয়! কালো পাথরে খোদাই করা কালো মূর্তি… এই রকম মেয়েকে তো বেদিতে বসিয়ে পুজা করা যায়।

‘আমি জেনি…জেনিফার আবেদিন।’… দেবী কথা বলল…

‘বসুন।’

আদিলের টেবিলের সামনের চেয়ারে জেনি বসে আছে, এই কালো মেয়েটার জন্যই পুরো রুমটাই যেন আলো হয়ে আছে।

জেনি কালো শাড়ি পরেছে, কালো ব্লাউজ,কালো টিপ…ঠোঁট দুইটা এতো ভেজা ভেজা কেন? কি মেখেছে…না মেকআপ এর ছিটেফোটাও নাই…তাও এতো সুন্দর লাগছে কেন? নাকটা আরেকটু টিকোলো হলে ভালো হতো…. না না, নাকটাইতো বেশি সুন্দর… কি পাতলা…খাড়া নাক…

জেনি হাত দিয়ে মাথার চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে দিল…আগেইতো ভালো ছিল…না, এখন বেশি ভাল লাগছে…কি সুন্দর কপাল…আর টিপটা…ঠিক যেন…সুন্দর কপালে কাজলের আলপনা, হয়ত বা সত্যি কিংবা কল্পনা…আদিল কবি হয়ে যাচ্ছে না তো? এমন মেয়ের জন্য তো যে কেউ কবি হতে পারে…

‘আপনি আমাকে ডেকেছিলেন…’ দেবী কথা বলে উঠল।

‘হা’…নিজেকে সামলে নিয়ে আদিল বলল,

‘আপনার বন্ধু আকতারের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসা ছিল… আকতার কেমন ছেলে ছিল?’

‘ভালো, ফুর্তিবাজ, বড়লোক বাপের একমাত্র ছেলে, মেয়েদের পটানোর চেষ্টা করতো।’

‘আপনাকে করেছে কখনো?’

‘করেছে… আমি রেসপন্স করিনি…আর আমি একজনকে পছন্দ করি।’

‘আপনার কি মনে হয়, আকতার কোথায় যেতে পারে, বা কেউ কি ওকে গুম করতে পারে, আপনাদের বন্ধুদের মধ্যে কেউ?’

‘আমার বন্ধুদের মধ্যে কাউকে মনে হয় না।’

‘শুনেছি, আকতার অনেক সময় চুড়ি, মালা, এই সব কিনতো… কার জন্য…বলতে পারেন?’

‘আমি জানি না স্যার, বলেনি কখনো।’

‘আপনি আসতে পারেন, দরকার পরলে ডাকব আবার।’

শাড়ির আঁচলটা গুছিয়ে নিয়ে, জেনিফার উঠে দাড়াল…পিছন থেকে ওর এলো চুলের দিকে তাকিয়ে আদিল ভাবল, এই মেয়ের জন্যে তো গ্রীক-ট্রয় এর যুদ্ধ বেধে যেতে পারে…আবির, আকতার, সাইফুররাতো চুনোপুঁটি…

তাছাড়া জেনি বললো ও একজনকে পছন্দ করে…কে সে? আবির, সাইফুর, নাকি আকতার? এই পছন্দের কারনেই কি আজ আকতার নিরুদ্দেশ?

আদিলের চিন্তা ভাঙলো ইমরানের ডাকে…

‘স্যার, সবার মোবাইলের কল লোকেশন তো তাদের বয়ানের সাথেই মিলে যাচ্ছে। সন্দেহ করার কিছু পাচ্ছি না।’

‘আমরা চোখের সামনে সবসময় যা দেখি সেটা সত্যি হয় না ইমরান।’

‘আর স্যার, মিস্টার ইসলামের অফিসে প্রতিবেশীদের সাথে কথা বলেও কিছু পেলাম না৷ উনি ছাপোষা মানুষ, ব্যাংক এর ম্যানেজার… তেমন কার সাথে কোন ঝগড়া বা শত্রুতা নাই।’

‘হুম, আমদের ইনফরমারদের বল, এদের সবার উপর নজর রাখতে, চারদিন হয়ে যাওয়ার পরও যখন মুক্তিপনের ফোন আসেনি, খুব বেশি সম্ভাবনা রয়েছে, আকতার হয়ত বেঁচে নাই, মেরে গুম করে ফেলা হয়েছে…আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, ওদের সার্কেলের কেউই কাজটা করেছে।’
‘ওরা বয়সে অনেক নবীন স্যার, এত ভয়ানক ক্রাইম…. সম্ভব?’

‘সম্ভব ইমরান… সম্ভব। যখন, এর পিছনে কোন নারী থাকে, তখন এই বয়সী ছেলেগুলোও ডেস্পারেট হয়ে যায়, জঘন্য জঘন্য অপরাধ করে বসে। সবার আগে আমাদের আকতার নিরুদ্দেশ বা গুম যাই বল তার মোটিভ খুঁজে বের করতে হবে, সেটাই আমাদের নিয়ে যাবে খুনির কাছাকাছি।’

আকতার লেডিস আইটেম নিশ্চয় কোন মেয়ের জন্যে কিনতো, কিন্তু প্রশ্ন হলো কে সেই নারী? তাকে খুঁজে বের করলেই বাকি রহস্য হয়তো খোলাসা হবে…

কে হতে পারে সেই হেলেন অফ ট্রয়, যার জন্য হয়তো বলি চড়তে হলো আকতারকে? নিজের অজান্তেই ভুরু কুঁচকাল আদিল…

তানিয়ার সরল মুখশ্রীর আড়ালে কি লুকিয়ে আছে নোংরা কোন রুপ?

কিম্বা নিপার মেকআপ ঢাকা চেহারার অন্তরালে?

নাকি এই হেলেন অফ ট্রয় ওদের সার্কেলের সবচেয়ে রহস্যঘেরা সুন্দরী জেনি…জেনিফার আবেদিন??

চার.
সকালে থানায় এসে আদিল দেখলো মিস্টার ইসলাম এসেছেন, ভদ্রলোক বেশ উত্তেজিত।

‘একটু আগে মুক্তিপন চেয়ে আমার কাছে ফোন এসেছিল ইন্সপেক্টর, দশ লাখ টাকা চেয়েছে।’

‘তাই, কোথায় নিয়ে যেতে বলেছে?’

‘সেটা পরে ফোন করে জানাবে, আমি ঠিক করেছি টাকা দিয়ে দিব ইন্সপেক্টর, আকতার আমার একমাত্র ছেলে, কোন রিস্ক নিতে চাই না।’

কথা গুলো বলে ভদ্রলোক হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে গেলেন।

মুক্তিপণের কল এসেছে, তার মানে কি আকতার অপহরণ হয়েছে? প্রায় ছয়দিন পর টাকা চেয়ে কল আসল? কোথাও যেন একটা হিসাবে গরমিল…

তবে আশার কথা এটাই আকতার হয়তো এখনও বেঁচে আছে, সুস্থভাবে ওকে বাবা-মার কাছে ফিরিয়ে আনাটাই আসল, বাবা মার একমাত্র ছেলে, অনেক স্বপ্ন আছে ওকে ঘিরে।

ইমরানকে আকতারের বাবার ফোন সারভিলেঞ্চে রাখার কথা বলল আদিল, মুক্তিপনের টাকা কোথায় পৌছে দিতে হবে এটা জানানোর জন্য ফোন আসার কথা, সেই অনুযায়ী ফাঁদ পাততে হবে।

সবচেয়ে মর্মান্তিক খবরটা আসলো বিকেলে, সাভার পুলিশের কাছ থেকে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জঙ্গলে মধ্যে থেকে বস্তাবন্দী একটা লাশ পাওয়া গেছে, আকতারের ছবি দেখে সাভার পুলিশের ধারণা লাশটা আকতারের।

আকতারের বাব-মাকে খবর দেওয়া হলো লাশ সনাক্তকরণের জন্য। দুজনেই পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়লেন। পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হলো লাশ। আকতার অপহরণ কেস এখন আর অপহরণ কেস না, ইট ইজ আ কিলিয়ার কেস অফ মার্ডার।

মিডিয়াতে লিক হয়ে গেল খবরটা, ঢাকার এক ব্যাংক ম্যানেজারের ছেলের বস্তাবন্দি লাশ, স্যোসাল মিডিয়াও সরগরম, রাজধানীতে সবার নাকের ডগায় এতো বড় একটা ওকারেঞ্চ হয়ে গেল আর পুলিশ এখনও আঙুল চুষছে, সারাদেশের মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলল সবাই।

পাচ.
আকতারের পোস্টমর্টেমের রির্পোট আজ হাতে পেয়েছে আদিল, মৃত্যু সময় বলছে আকতার নিখোঁজ হবার দিন। তার মানে ওই দিনই আকতারকে মেরে লাশ বস্তা বন্দি করে জাহাঙ্গীর নগরের জঙ্গলে ফেলে আসা হয়। ধারালো কোন অস্ত্র দিয়ে আকতারের শরীরে অনেকবার আঘাত করা হয়। আকতারের প্রতি অনেক ঘৃণা ছিল খুনির মনে। আকতারের মতো ইউনিভার্সিটিতে সেকেণ্ড ইয়ারে পড়া একটা ছেলের প্রতি কার এতোটা আক্রশ থাকতে পারে?

হয়তো সাইফুর বা আবিরের একজন অথবা এদের দুজনেই খুনের সাথে জড়িত। কিন্তু যেভাবে খুন করা হয়েছে, আকতারের প্রতি এতো ক্ষোভ আবির বা সাইফুরের থাকবে কেন? ওদের কেউ কোন মেয়েকে ভালবাসত, আকতারও একই মেয়ের সাথে জড়িয়ে পড়েছিল, এমন কোন ত্রিমুখী প্রেমের সম্পর্কও সামনে আসেনি।

আকতারের পরিবারের সাথেও কারো কোন শত্রুতা পাওয়া যায়নি, বাবার উপর রাগের প্রতিশোধ ছেলের উপর নিবে এমন কোন এঙ্গেলও সামনে আসেনি।
আদিলের মনে হচ্ছে ভুল করে কেউ আকতারকে মার্ডার করে ফেলল নাতো? হতে পারে ওই দিন আকতার একা একা জাহাঙ্গীরনগর গিয়েছিল, জঙ্গলের দিকে হাটতে গেছিল, ওইখানে অন্য কারোর যাওয়ার কথা ছিল ওই সময়। জাহাঙ্গীরনগরের ভিতরের কোন ব্যাপার হতে পারে, কিংবা আকতার ওই সময় এমন কিছু দেখেছিল, যেটা তার দেখার কথা ছিল না। হয়ত কোন অপরাধের সাক্ষী হয়ে গিয়েছিল যার জন্য ওকে বলি চড়তে হল? ইনফরমারদের এই ব্যাপারে খোঁজ নিতে বলতে হবে, এই এঙ্গেলটা আগে খতিয়ে দেখা হয়নি।

কিন্তু তাই যদি হয়, তাহলে মুক্তিপণ চেয়ে ফোনটা করল কে? নাকি কেউ সুযোগ নিতে চেয়েছিল? হতে পারে… আর ওই ফোনের সিমটা কেনা হয়েছিলো একটা ফেক আইডি দিয়ে, ফোন যে কে করেছে বের করা যায়নি।

এরই মধ্যে আবিরের বাবা মা থানায় এসে হাজির, আবির গতকাল থেকে বাড়ি ফেরেনি, ফোনও বন্ধ।

পুলিশের সব সন্দেহ যেয়ে পড়ল আবিরের উপর। আদিলের মনে হল, আকতার মার্ডার কেসের ব্যাপারে আবির জড়িত বা কিছু জানে, সেই জন্যই এখন গা ঢাকা দিয়েছে। সব থানাকে এর্লাট করে দেওয়া হল আবিরের ব্যাপারে, ছবিও সার্কুলেট করা হলো।

তবে সবচেয়ে চমকে দেওয়া ব্যাপারটা ঘটলো পরের দিন বিকালে…

ছয়.
ধানমণ্ডি লেকের পাশ থেকে আবিরের লাশ উদ্ধার করলো পুলিশ।

গলায় কিছু পেচিয়ে খুন করা হয়েছে আবিরকে। আকতার মার্ডার কেসের ব্যাপারে যাকে সন্দেহ করা হচ্ছিলো সে নিজেই খুন হলো।

হয়তো আকতার আর আবিরের মার্ডার কেস একটা আরেকটার সাথে জড়িত, কিংবা দুটি বিছিন্ন ঘটনা। কিন্তু জোরাল কোন সুত্র এখনও পুলিশের হাতে আসেনি।

এমনও হতে পারে এই দুই খুনের আসল মাস্টারমাইণ্ড অন্য কেউ, যে এখনও পুলিশের রাডারে আসেনি। সেই হয়তো আবিরের সাহায্যে খুন করে আকতারকে আর সুযোগ বুঝে আবিরকেও সরিয়ে দেয়।

থানায় নিজের রুমে বসে এইসব সাত-পাঁচ ভাবছিল আদিল, হটাৎ ইমরান ঢুকলো ওর রুমে।

‘স্যার, কিছুদিন আগে কিছু বখাটে ছেলে আবিরের বোন মিশুকে ইভ টিজিং করে, আবির আর আকতার মিলে ওই ছেলেগুলোকে পিটায়। ওরা শাসায়, আবির আর আকতারকে দেখে নিবে। আবির মার্ডার এরপর থেকে ওই তিন জন মিসিং।’

‘আমাদের ইনফরমারদের খবর দাও, কোথায় আছে ওরা খুঁজে বের করুক। হতে পারে ওরা জড়িত বা কিছু জানে।’

‘স্যার, আরও একটা ব্যাপার, আবির আর মিশু কিন্তু সৎ ভাই-বোন, আবিরের মা ছোটবেলায় মারা যান। আর সবচেয়ে চমক জাগানো ব্যাপার এটাই স্যার, পোস্টমর্টেম অনুযায়ী যখন আবির খুন হয়, ওই সময় আবিরের মার ফোনের লোকেশান ছিল ধানমন্ডি লেক, আবিরের মার্ডার প্লেস।’

‘তাই নাকি? আচ্ছা, আমি একটু আবিরদের বাসা থেকে ঘুরে আসি, দেখি আবিরের মায়ের এঙ্গেল থেকে কিছু পাওয়া যায় নাকি।’

আবিরের মার সাথে কথা বলে তেমন কিছুই পাওয়া গেল না। আবির উনার সৎ ছেলে, কিন্তু নিজের ছেলের মতই মানুষ করেছেন, উনি ওই সময় মেয়েসহ ধানমন্ডি লেক ঘুরতে গিয়েছিলেন।
মহিলা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমার ছেলে এতো কাছে খুন হচ্ছে জানলে তিনি তো ছুটে যেতেন।

থানায় ফিরতেই ইমরান আদিলকে জানাল, বখাটে তিনটা ধরা পড়েছে, এক ঘন্টা ধরে ধোলাই করলাম, কিছু বের হলো না স্যার, ওরা আবির মার্ডারএ ঘাবড়ে যেয়ে পায়িয়েছিল, মার্ডারের সাথে কোনভাবেই জড়িত না।

সব এঙ্গেলই সম্ভাবনা জাগালেও ফলাফল এখনও পর্যন্ত শুন্য, এই কেস দুইটার যুতসই কোন সূত্র এখনও হাতে আসল না, নিজের রুমে বসে এইসব চিন্তা করছিল আদিল। কন্সটেবল এসে জানাল তানিয়া এসেছে, কিছু বলতে চায়।

‘বলুন তানিয়া, কি বলতে চান?’

‘স্যার, আপনাদের কতটুকু কাজে লাগবে জানি না, আমি আকতারকে একটা মালা কিনে দিয়েছিলাম, মানে পছন্দ করে দিয়েছিলাম, গতকাল ওই একই রকম মালা আমি আবিরের বোন মিশুর গলায় দেখেছি, ও ওর মার সাথে শপিংএ এসেছিল তখন। তবে একই মালা অনেক থাকতে পারে স্যার।’

‘একই মালা কিনা এই প্রশ্নের উত্তর তো মিশুই ভালো দিতে পারবে।’

‘কিন্তু স্যার, আকতার, সাইফুর দুজনেই আবিরের বোন মিশুকে নিজের বোনের মতো দেখত, আকতার একটা মালা মিশুকে দিতেই পারে।’

‘হা, পারে, তারপরও মিশুর সাথে একটু কথা বলব আমরা, তানিয়া, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, হয়ত এই ক্লুটা কাজে লেগেও যেতে পারে।’

মিশুকে থানায় ডাকার পর জানা গেল মালাটি সে আকতারের কাছ থেকে নেয়নি, তবে যার কাছ থেকে পেয়েছে সেটি চমক জাগানিয়া।
ইমরানকে ডেকে আদিল বলল,

‘গাড়ি বের কর ইমরান, হয়ত আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত হেলেন অফ ট্রয়কে পেয়ে গেছি।’

সাত.
লেডি কন্সটেবল এসে জানাল,

‘স্যার, মহিলা মুখ খুলেছে। আপনার সাথে কথা বলতে চায়।’

উঠে গেল আদিল,

‘বলুন মিসেস শায়লা রহমান, আর লুকিয়ে লাভ নেই।’

সাইফুরের মা শায়লার মাথার চুল গুলো এলোমেলো, চেহারা বিপর্যস্ত, লেডি কন্সটেবল ভালোই ধোলাই করেছে, এক গ্লাস পানি খেয়ে নিয়ে মহিলা বলা শুরু করলেন,

‘সাইফুরের বাবা প্রায় পাঁচ বছর হল ইতালিতে, আমাদের টাকা পয়সার কোন অভাব নাই, বাড়ি -গাড়ি সব আছে। সাইফুরের বন্ধু আকতার প্রায় আসত আমাদের বাসায়, সম্পর্কটা তৈরি হয় ধীরে ধীরে। আমার একাকিত্ত, আকতারের আমার প্রতি মুগ্ধতা দুজনকে কাছে নিয়ে আসে।’

মহিলা দম নেওয়ার জন্য একটু থামলেন,

‘সাইফুর জানতে পেরে যায় সম্পর্কটার ব্যাপারে, যেদিন আকতার খুন হয়, আমি বাজারে গিয়েছিলাম। বাসায় এসে দেখি ঘটে গেছে এই দূর্ঘটনা।’

‘তারপরের প্ল্যানটা তো আপনার, আকতারের লাশ বস্তা বন্দি করে জাহাঙ্গীরনগরে ফেলে আসা। মোবাইল ফোনও বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন, যাতে আমরা সন্দেহ না করি, কিন্তু মুক্তিপণ চেয়ে ফোনটা কে করেছিল? আর আবিরকে মারলেন কেন?’

‘মুক্তিপণ চেয়ে ফোনটা আবিরকে দিয়ে সাইফুর করায়, যাতে পুলিশের নজর অন্য দিকে যায়, আমরা ধারণা করিনি আকতারের লাশ কেউ খুঁজে পাবে। পরবর্তীতে আবির সব কিছু জানতে পারে, তাই আমি আর সাইফুর মিলে আবিরকেও দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়।’

‘হুম, মিশুকে মালাটা কি আপনি দেন?’

‘হা ইন্সপেক্টর, আকতার প্রায়ই আমার জন্য চুড়ি মালা আনত, আমি নিষেধ করতাম, ওইখান থেকে একটা মালা মিশুকে দেই, মিশু একদিন আবিরের সাথে এসেছিল আমাদের বাড়িতে বেড়াতে, কে জানে ওই মালাটাই কাল হয়ে দাড়াবে… সাইফুরের বাবা অনেকদিন কাছে নেই, সবার উপরে আমি একজন নারী, জৈবিক চাহিদা ত আমারও আছে।’

‘আপনার চাহিদার ব্যাপারে পুরোপুরি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আপনার জন্য, শুধু আপনার জন্য, দুটি প্রাণ ঝরে গেল, আপনি আর আপনার ছেলের ভবিষ্যৎও নষ্ট হলো। এই ব্যাপারে আপনি সাইফুরের বাবার সাথে সরাসরি কথা বলতে পারতেন, দরকার হলে আপনিও ইতালি যেতে পারতেন… অনেক কিছুই করতে পারতেন মিসেস শায়লা রহমান, এই নিষিদ্ধ সম্পর্কের পথ বেছে না নিয়ে। তাহলে হয়তো এই জঘন্য ক্রাইম ঘটত না…’

থানা থেকে বের হল আদিল, চমৎকার ভাদ্রের দুপুর, ঢাকা শহর এখন অনেক ব্যস্ত। যে যার জীবন-জীবিকার জন্য ছুটছে। নতুন নতুন বিল্ডিং, রাস্তা-ঘাট, ফ্লাই ওভারে প্রতিদিনই রূপ বদলাচ্ছে এই শহর…বাড়ছে মানুষের জীবনযাত্রার মান, কমে যাচ্ছে মুল্যবোধ, হারিয়ে যাচ্ছে মনুষ্যত্ব…

ফোনের রিংটোনের শব্দে চমক ভাঙ্গে আদিলের, ইমরানের ফোন,

‘স্যার, মিস্টার আর মিসেস জামান নামের এক দম্পতি থানায় এসেছে, উনাদের ছেলে আহসান জামান গতকাল থেকে বাসায় আসেনি।’

‘মিসিং ডাইরী লেখ, আমি আসতেছি…’

থানার দিকে হাঁটা দেয় আদিল…

হয়তো নতুন কোন জঘন্য অপরাধের খাতা খুলতে যাচ্ছে…

অচিনপুর ডেস্ক/ এসএসববি

Post navigation