সোনার হাঁস

তাবাসসুম নাজ
টরোন্টো, কানাডা।

 রূপকথাঃ সোনার হাঁস

এক বনে বাস করত এক বুড়া কাঠুরে। তার তিন ছেলে। বড় দুই ছেলে ছিল চালাকচতুর, ছোটটা হাবাগোবা, আলাভোলা- নাম ডামলিং। ডামলিংকে নিয়ে তার দুই ভাই খুব হাসাহাসি করত, বাবা-মা তাকে নিয়ে চিন্তা করত- এর যে কি হবে!
এক সকালে বড় ভাই বলে- আমি আজ বনে কাঠ কাটতে যাব। শুনে মা সাথে খাবার বেঁধে দেয়-সুস্বাদু পাই আর আপেল জুস। বড় ভাই সারা সকাল কাঠ কেটে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে আসলে খেতে বসে। আরাম করে সবকিছু সাজিয়ে নিয়ে বসেছে, এমন সময় সেখানে আসে এক বুড়া। বলে- আমি খুব ক্ষুধার্ত, আমাকে তোমার খাবারের ভাগ দাও।
শুনে বড় ভাই মুখ বেঁকিয়ে বলে-তোমাকে ভাগ দিব? তাহলে আমার জন্য আর থাকবে কি? যাও যাও, নিজের কাজে যাও। শুনে বুড়া কিছু না বলে চলে যায়। বড় ভাই খাবার শেষ করে কাজে ফেরে কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই কুঠারের আঘাতে নিজেকে জখম করে ফেলে। তাই কাজকর্ম বন্ধ রেখে ঘরে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। সেই বুড়োটার কলকাঠি নাড়াতেই এমন হল কিন্তু।
পরেরদিন মেজভাই বনে গেল কাঠ কাটতে। তাকেও মা সুস্বাদু পাই আর আপেল জুস বেঁধে দেয় সাথে। মেজভাই সারা সকাল কাঠ কেটে দুপুরের খাবারের বিরতি নিতেই ফের দেখা গেল গতকালকের সেই বুড়োকে। আগের দিনের মতো সে বলে -আমি বড়ই ক্ষুধার্ত। আমাকে তোমার খাবারের ভাগ দাও। মেজভাই ছিল বড়ভাইয়ের কার্বন কপি। সেও বিরক্ত হয়ে বলে -তোমাকে দিয়ে আমার ভাগেরটা কমাই আরকি! যাও যাও, রাস্তা দেখো। গতদিনের মত বুড়া চলে যায়। এদিকে মেজভাইও বড়ভাইয়ের মত জখম হয়ে বাড়ি ফেরে।
এরপর ডামলিং বলে -বাবা, আমি কাঠ কেটে নিয়ে আসব।
বাবা রেগে ওঠে -তোমার ভাইরা যেখানে ঠুঁটো হয়ে ঘরে বসে আছে সেখানে তুমি গিয়ে কি করবে? তুমি তো কিছু পারো না!
কিন্তু ডামলিং গোঁ ধরে। শেষে বাবা বিরক্ত হয়ে বলে -আচ্ছা যাও। পরে আমার কাছে কাঁদতে আসবে না কিন্তু বলে দিচ্ছি।
পরের দিন ডামলিং গেল বনে। মা সাথে কিছু শুকনো রুটি আর পানি দিল। যথারীতি দেখা গেল সেই বুড়োকে। বুড়ো বলল -আমি খুব ক্ষুধার্ত। আমাকে তোমার খাবারের ভাগ দাও।
ডামলিং বলে -আমার কাছে খুব সামান্য শুকনো রুটি আর পানি আছে। চলো দুজনে ভাগ করে খাই।
ডামলিং খাবার বের করে। কিন্তু অবাক কান্ড। শুকনো রুটির বদলে নরম ধোঁয়া ওঠা গরম গরম পনীর আর মুরগীর পাই, সেই সাথে ঠাণ্ডা আপেলের জুস! দুজনে পেটপুরে খাবার পর বুড়ো বলে -তোমার জন্য পুরষ্কার আছে। ঐ যে গাছটা দেখছ, ওটাকে কেটে ফেল, ওর ফোঁকরে তোমার উপহার অপেক্ষা করছে। বুড়ো বিদায় নিয়ে চলে যায়।


ডামলিং আর দেরী করে না। গাছ কেটে ফেলতেই গাছের কোটরে একটা হাঁস মেলে, হাঁসের পালকগুলি সোনার তৈরি। ডামলিং হাঁস কোলে নিয়ে রওনা দেয়। পথিমধ্যে এক সরাইখানা পড়লে সেখানে রাত কাটাবে বলে ঠিক করে। সরাইখানার মালিকের ছিল তিন মেয়ে। তিনজনেই সোনার হাঁস দেখে কৌতুহলে ফেটে পড়ে। বড়জন তো বলেই বসে -ওই হাঁসের একটা পালক আমার চাইই চাই।


যেমন কথা তেমন কাজ। ডামলিং ঘুমিয়ে পড়তেই সে একটা পালক ছিঁড়বার জন্য হাঁসের লেজে হাত দেয়। ওমনি হাত লেজে আটকে যায়। হাজার চেষ্টা করেও ছাড়ানো যায় না। ব্যাপার দেখে মেজবোন এগিয়ে আসে। বড়বোনকে ছোঁয়ামাত্র সেও বড়জনের সাথে আটকিয়ে যায়। দুজনে আটকে পড়ে টানাটানি করছে এমন সময় আসে ছোটবোন। সে এগিয়ে আসতে তার দুইবোন হাঁহাঁ করে ওঠে -এসো না, এসো না। শুনে ছোটবোন আরো কৌতুহলি হয়ে মেজবোনকে ছুঁতেই সেও আটকে যায়। তারপর তিনজনেই এভাবে সকাল পর্যন্ত গুঁতাগুঁতি করতে থাকে।
সকালে ডামলিং উঠে কোনোদিকে না তাকিয়ে হাঁস কোলে নিয়ে রওনা দেয় -মেয়ে তিনটাকে খেয়ালও করে না। তাই ডামলিংয়ের পিছু পিছু তিনবোনকেও যেতে হয়।
অনেকদূর যাবার পর মাঠের মধ্যে এক পাদ্রীকে দেখা যায়। তিনবোনকে দেখে তার চোখ কপালে ওঠে, অবাক হয়ে সে বলে -কলিকাল! তিন তিনটা মেয়ে এক ছেলের পিছনে লেগেছে! লজ্জা শরমের মাথা খেয়েছ তোমরা? বলে ছোট বোনের হাত ধরে তাকে সরিয়ে আনার চেস্টা করতেই সেও আটকিয়ে যায়। ফলে তাকেও তিনবোন আর ডামলিং এর পিছু নিতে হয়। ব্যাপার দেখে তার ক্লার্ক দৌড়ে আসে, চোখ তার ছানাবড়া -ফাদার, ফাদার, কই যাচ্ছেন? অনেক কাজ পড়ে আছে চার্চে! বলে পাদ্রীর গাউন স্পর্শ করতেই তাকেও এই অদ্ভুত মিছিলের অংশ নিতে হয়।
আরো কিছুদূর যেতে দুজন লোককে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। পাদ্রী রাগে গরগর করতে করতে বলে – আমাদের সাহায্য কর, আমরা আটকে গেছি। লোক দুটো দৌড়ে এসে ছাড়ানোর চেস্টা করতে নিজেরাও আটকে গেল।

সবমিলিয়ে আটকে যাওয়া মানুষের সংখ্যা দাঁড়াল সাত।
ডামলিং তার বিরাট বাহিনী নিয়ে শহরে পৌঁছে। সেখানে রাজার এক মেয়ে ছিল। রাজকুমারী ভীষণ গোমড়ামুখী, কেউ তাকে কোনোদিন হাসতে দেখেনি। রাজা তাই ঘোষণা দিয়েছে -যে আমার মেয়ের মুখে হাসি ফোটাতে পারবে, আমি তার সাথে রাজকুমারীর বিয়ে দেব। একথা শুনে ডামলিং আর দেরী না করে রাজদরবারে হাজির হয়, পিছে তার আটকেপড়া লোকেদের মিছিল। তারা একে অপরের পা মাড়িয়ে দিচ্ছে, কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে বিরক্ত হয়ে ঝগড়াঝাঁটি করছে। এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে রাজকুমারী আর হাসি চাপতে পারে না, খিলখিল করে হেসে ওঠে।


রাজা তার কথা রাখে। ডামলিংয়ের সাথে রাজকুমারীর বিয়ে হয়, বিয়েতে মহা ধুমধাম হয়, রাজ্যের সবাইকে দাওয়াত দেয়া হয়।
ডামলিং আর রাজকুমারী সুখে শান্তিতে বাস করে। একসময়ে বুড়ো রাজা মারা গেলে ডামলিং রাজ্যের রাজা হয়ে যায়।

অচিনপুর ডেস্ক/ জেড. কে. নিপা

Post navigation