শামস্ উদ দোহা
স্মৃতিকথা:
শিক্ষকতার প্রেমে
এক.
যুক্তরাষ্ট্রে আমার ফুলব্রাইট প্রোগ্রাম শেষ হবে ১৩ মে। এদিকে বাংলাদেশে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রীষ্মের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে ৮ মে। আমাদের একজন সহকর্মী আমার প্রথম সপ্তাহের ক্লাসগুলো নিচ্ছিলেন। আমার মনের প্রচন্ড অস্থির অবস্থা। কখন দেশে আসব, আর কখন ক্লাসরুমে ঢুকব। ম্যাডামকে বললাম আমি যেদিন আসব তার পরের দিন থেকেই ক্লাস নিতে চাই। ঢাকায় এসে পৌঁছালাম ১৭ মে রাত ১১ টায়। পরদিন সকাল ৯ টা ৩০ এ ক্লাসে গিয়ে ঢুকলাম। জেট ল্যাগে আক্রান্ত চোখ, টানা ৩৬ ঘন্টার জার্নিতে (আবুধাবীতে অতিরিক্ত একদিন) ক্লান্ত শরীর। কিন্ত ক্লাস শেষে সে কি এক তৃপ্তি! শিক্ষকতার প্রেমে না পড়লে কি আর এমন হয়!
দুই.
পরিবারের সবাইকে নিয়ে কুয়াকাটা বেড়াতে গেলাম। উদ্দেশ্য ছিল বস্তুগত উপহার না দিয়ে পরিবারকে কিছু স্মৃতি উপহার দিব। যাবার সময় লঞ্চে গেলেও আসার সময় সাকুরা পরিবহনের টিকিট কাটলাম। বাস ছাড়ল সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টায়। সবাই বলল বাস পৌঁছে যাবে ভোর পাঁচটার মধ্যে। আমি খুব আশ্বস্ত হলাম। পরদিন সকাল সাড়ে নয়টায় সেই একই ক্লাস। কিন্ত সেই বাস মাওয়া ফেরি ঘাটে দেরী হওয়ায় সকাল সাতটায় আমিন বাজারে আটকে আছে। আমার পরনে জিন্স আর টিশার্ট। তার মানে আমি যদি এখন ক্লাস ধরতে চাই আমাকে আমিন বাজার থেকে মাদারটেকে বাসায় গিয়ে কাপড় পাল্টে তারপর আবার মহাখালী ফিরে আসতে হবে। সময় মাত্র দুই ঘন্টা। দূরত্ব ঢাকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত। তারপর সেখান থেকে মহাখালী। সাথে অফিস সময়ের জ্যাম। ক্লাস ধরা অসম্ভব ব্যাপার! কিন্তু ক্লাস ধরতেই হবে।
আমি সাহস করে বাস থেকে নেমে দিলাম দৌড়। জ্যামে আটকে থাকা সব বাসগুলোকে পেরিয়ে গিয়ে টেকনিকালে গিয়ে পৌঁছলাম। নিয়মের ব্যতিক্রম না করে কোন সিএনজি রাজী হয় না। তারপর এক সিএনজিওয়ালাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে উঠে পড়লাম। সে দ্রুত গতিতে ছুটছে আর আমি সময়ের হিসাব করছি। আরও ভাবছি বাসায় গিয়ে কত তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে আবার মহাখালী আসা যায়। প্রতিটা পদক্ষেপেরও পরিকল্পনা করছি। এভরি সেকেন্ড কাউন্টস।
সিএনজি কিভাবে কিভাবে যেন ঠিক ৭ টা ৫৫ তে মাদারটেকে এসে পৌঁছল। ভাড়া দেবার পর তাকে জিজ্ঞেস করলাম মহাখালী যাবে কিনা। সে কোন উত্তর না দিয়েই চলে গেল। মাথায় পুরো বাজ। কিন্ত আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গেলাম।
বাসায় গিয়ে খুব তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে রাস্তার মধ্যে এসে দাঁড়িয়ে আছি। কেউ যেতে রাজী নয়। ঘড়িতে তখন ৮ টা ১৫। বাস বা রিকশা দিয়ে গিয়ে ক্লাস ধরার প্রশ্নই আসে না। একটু পর একটা সিএনজি পেয়ে গেলাম। সেই সিএনজিওয়ালাকে তখন আমার পৃথিবীর সবচেয়ে দয়ালু মানুষ বলে মনে হয়েছিল। কিন্ত তখনও শঙ্কা। ঢাকার নিয়ম ও সময় বলে লক্ষ্য কখনোই সম্ভব নয়। কিন্ত কিভাবে কিভাবে যেন সেটি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ৮ টা ৫৫ তে পৌঁছে গেল। আর আমি অফিসে ৯ টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম। ক্লাসের তখনো বাকি ৩০ মিনিট। ক্লাস নিয়ে ফের তৃপ্তির নিঃশ্বাস। এবার তৃপ্তির সাথে বিজয়ের হাসি।
কেউ ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারল না কেমন করে এই মানুষটি সেদিন ক্লাসটি ধরল। সেদিন আমার সত্যিই মনে হয়েছিল ভাগ্য সাহসীদেরই পক্ষ নেয়।
লেখক পরিচিতি : শামস্ উদ দোহা, সাহিত্যিক।শিক্ষক, ব্র্যাক ইউনিভাসিটি। বর্তমানে উচ্চ শিক্ষার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন।
অচিনপুর.কম/এমএ