রবিনসন ক্রুশো

– ড্যানিয়েল ডিফো

রবিনসন ক্রুশো
– ড্যানিয়েল ডিফো

রবিনসন ক্রুশো ইয়র্ক শহরে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে। ওর বাবা ওকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন এবং ওর বাবার ইচ্ছে ছিল আইন পাস করে সে ওকালতি করুক। কিন্তু রবিনের কেমন যেন একটা ঝোঁক ছিল মাথায় এবং তা ছেলেবেলা থেকেই-তা হলো, দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানো। বিশেষ করে তা যদি সমুদ্রযাত্রা হয় তবে তো কথাই নেই। বড় হয়ে তাই সে তার মা-বাবার কথা না-শুনে বাড়ি থেকে না বলে বেশকিছু পাউন্ড নিয়ে বেরিয়ে পড়ল লন্ডনের উদ্দেশে।

কিন্তু যাত্রার প্রথম থেকেই ওর দুর্ভাগ্য দেখা দিল। ইয়র্ক থেকে লন্ডনে আসার জন্য জাহাজে উঠল কিন্তু জাহাজটি ইয়ারমাউথ নামক স্থানে ডুবে গলে। ভাগ্য ভালো, অন্য একটি জাহাজ যাচ্ছিল ওদের সামনে দিয়ে ওরা ওদের লাইফবোটে সকলকে তুলে নিল। ক্রুশো কাছে যেটি অর্থ ছিল তা দিয়ে শেষ পর্যন্ত লন্ডন শহরে এসে সে পৌঁছল।

লন্ডনে আসার কদিন পরে জাহাজ-মালিকের সঙ্গে তার পরিচয় হলো। ভদ্রলোক জাহাজের ব্যবসা করেন এবং এ কারণে প্রায়ই গিনি উপকূলে যাতায়াত করেন। একদিন তিনিই রবিনসনকে বললেন- ‘তুমি যদি কিছু মনিহারি মালামাল নিয়ে আমার জাহাজে করে গিনি উপকূলে যাও তাহলে মোটা অঙ্কের টাকা লাভ করতে পারবে।’ রবিনসন এই ধরনের কিছু একটা করতে চেয়েছিল। তাই সে লন্ডনের বসবাসরত তার কিছু আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে কিছু পাউন্ড ধার করল এবং সে ঐ পাউন্ড দিয়ে কিছু প্লাস্টিকের খেলনা, কিছু পুঁতির মালা এবং আরও এমন কিছু কিনে নিল যেটি ঐ অঞ্চলের লোকজন পছন্দ করবে। এবার ঈশ্বরের নাম নিয়ে গিনির পথে সমুদ্রযাত্রা শুরু হলো।

প্রথম যাত্রাতেই ওর মোটামুটি বেশ লাভই হলো। অঙ্কের হিসেবে ৫ পাউন্ডের জিনিস সে বিক্রি করেছে ২০ পাউন্ডে। এবার ওর আনন্দ দেখে কে! লাভ হলো দুরকম-টাকা তো লাভ হলোই, তার নিজের চেষ্টায় জাহাজ চালানোও কিছু শিখে ফেলল। অবশ্য অল্পতে বেশি লাভের আশায় গিনিতে পরবর্তী যাত্রায় কী ঘটেছিল এবার তার বর্ণনা। গিনি থেকে বাণিজ্য করে ফিরে আসার পথে কয়েকজন মুর জলদস্যু ওর জাহাজ আক্রমণ করল, এবং ওকেসহ সবাইকে ধরে নিয়ে ক্রীতদাসরূপে বিক্রি করে দিল।

অবশ্য রবিনসনকে যার কাছে বিক্রি করা হয়েছিল সেই মনিব ছিল খুব ভালো। মনিব ভদ্রলোকের ছিল মাছধরার নেশা। মাছ কী করে ধরতে হয় রবিন তা ভালো করে জানত এবং সেই একটিমাত্র কারণে রবিন মনিবের আরও বেশি প্রিয় হয়ে উঠল।

যা হোক, রবিনসন তার মাথা থেকে পালিয়ে যাবার ইচ্ছেটা বাদ দেয়নি। অবশ্য পালিয়ে যাবার পথটা কিছুতেই ঠিক করতে পারছিল না। প্রায় বছর দুই পরে একদিন ওর সুযোগ হলো পালানোর। রবিন ওরই এক সমবয়সী মুর ছেলেকে নিয়ে সমুদ্রে গিয়েছিল মাছ ধরবে বলে- কৌশল করে নৌকাটা একটু গভীর সমুদ্রে নিয়ে মুর ছেলেটিকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল সমুদ্রে, আর ভয় দেখাল ফিরে না গেলে গুলি করে মারবে।

আশ্চর্য ঘটনা হলো, মুর ছেলেটি ওকে ভয় না পেয়ে বরঞ্চ সাহায্য করতে রাজি হলো। ছেলেটিকে রবিনসন আবার নৌকায় তুলে নিল।

আবার যাত্রা শুরু হলো। দুদিন বেশ কষ্ট করে চলার পর একটা পর্তুগিজ জাহাজের দেখা পেল। জাহাজ ওদের কাছে আসতেই ওরা জাহাজিদের সব জানাল। জাহাজিরা ওদের তুলে নিল জাহাজে এবং রবিনসনকে এনে নামিয়ে দিল ব্রাজিলের বন্দরে এবং জাহাজি নিজের জন্য মুর ছেলেটিকে রেখে দিল।

কিছুদিন ব্রাজিলে ওর বেশ সুখেই কাটল। অনাবাদি জমিতে চাষাবাদ করে নিজের অবস্থা ফিরিয়ে এনেছিল রবিন। কিন্তু ছোটবেলা থেকে অস্থিরচিত্ত রবিনের মাথায় আবার দুর্বুদ্ধি চাপল। ওখানকার স্থানীয়রা ওকে পরামর্শ দিল আবার গিনির সেই পুরোনো বাণিজ্যটা শুরু করতে। ওর তো সমুদ্রযাত্রার পুরোনো নেশা আছেই। তাই একদিন আবার তোড়জোড় করে বেরিয়ে পড়ল গিনির উদ্দেশে।

সমুদ্রযাত্রার প্রথম কয়েকটা দিন বেশ ভালোই যাচ্ছিল, হঠাৎ একদিন উঠল ভীষণ সামুদ্রিক ঝড়। সেই ঝড়ের মধ্যে ওদের জাহাজ গিয়ে আটকে গেল এক অজানা চড়ায়। আর চড়ার বালিতে জাহাজের তলা গেল ভীষণভাবে ফেঁসে। তবু অনেক ভেবে ওরা জাহাজে রক্ষিত ছোট নৌকায় করে ডাঙায় দিকে রওনা হয়েছিল। কিন্তু বিধি বাম, প্রচন্ড এক সমুদ্রের ঢেউ এসে ওদের নৌকাটা উল্টে দিল এবং ওরা সবাই ডুবে গেল। রবিনসনের ভাগ্য ভালো বলতে হবে, সে ভেসে উঠল এবং সাঁতার কেটে প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায় কূলে পৌঁছল। সেই রাতটা সে বন্য জীবজন্তুর ভয়ে একটা গাছের উপর বসে কাটিয়ে দিল।

পরের দিন ঘুম ভাঙতেই দেখল আকাশ পরিষ্কার, ঝড় উঠেছিল বলে মনেই হয় না। আরও আশ্চর্য, ঝড়ের বেগ ওদের বড় জাহাজটাকে প্রায় ডাঙাতেই নিয়ে এসেছে। রবিনসন ভাবল, আমরা যদি জাহাজেই থাকতাম তাহলে কাউকেই মরতে হতো না।

এখন আর ভেবে কী হবে? রবিনসনের খিদেও পেয়েছে প্রচন্ড। সে আবার জাহাজে গিয়ে উঠল- এবং খুঁজে দেখল খাবারগুলো ঠিক আছে কি না। খাবার ঠিকই ছিল। সে বেশ পেট পুরে খেয়ে নিল। তারপর জাহাজ থেকে কয়েকটা তক্তাকাঠ আর ছুতোরের যন্ত্রপাতি তীরে এনে কোনো রকমে রাত কাটানোর মতো একটা মাচা তৈরি করে নিল। তারপর বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে পড়ল দ্বীপটা ভালো করে দেখার জন্য। কিন্তু পাহাড়ের উপর উঠেই রবিনের মনটা দমে গলে। ঈশ্বরই জানেন কতদিন থাকতে হবে এই দ্বীপে।

রাতে অবশ্য কোনো রকম ঝামেলা হলো না। পরের দিন ঘুম থেকে উঠে রবিন স্থির করল, প্রয়োজনীয় যেটি কিছু জাহাজে এখনো ভালো আছে তা সবই নামিয়ে আনতে হবে।

সেদিন থেকে সময় পেলেই ভাটার সময় পানি কমতেই সে জাহাজে চলে যেত এবং নামিয়ে আনত প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্তর। বেশিদিন সময় পেলে রবিনসন হয়তো পুরো জাহাজটাই ডাঙায় তুলে নিয়ে আসত। পারল না, কারণ চৌদ্দ দিনের মাথায় এমন ঝড় উঠল তাতে ঐ ভাঙা জাহাজটা ঝড়ে কোথায় উড়ে গেল তার কোনো চিহ্নও পাওয়া গেল না।

অবশ্য জাহাজ থেকে রবিন কম জিনিস নামিয়ে আনেনি। এখন এসব জিনিস রাখবে কোথায় সেটাও এক ভাবনা। অনেক খুঁজে একটা পাহাড়ে ওঠার মধ্যপথে খানিকটা সমতল জায়গা আবিষ্কার করল। ওর উল্টো দিকে উঠে গেছে একটা খাড়া পাহাড়, সেদিক থেকে কোনো বন্য জানোয়ারের আক্রমণের সম্ভাবনাও খুবই কম। আর বাদবাকি তিনদিকে সে নারকেল পাতা দিয়ে বেশ শক্ত এবং উঁচু করে বেড়া দিয়ে দিল। প্রয়োজন হলে মই লাগিয়ে সে যাতায়াত করত, আর ভেতরে ঢুকেই মইটা তুলে নামিয়ে রাখত মাটিতে।

সব জিনিসপত্র রাখল সেখানেই। তৈরি করল বড় করে একটা থাকার মতো ছাউনি। তাছাড়া পাহাড়ের একটা অংশে প্রকান্ড এক গর্ত ছিল, সেটাও যোগ করে নিল ঘর হিসেবে।

থাকার মতো বাসা তৈরি হয়ে গেল ওর। ভাবল তৈরি করতে হবে কিছু আসবাবপত্র। যদিও এসব তৈরির অভ্যেস ওর নেই। যন্ত্র ব্যবহার করতে ওর খুব কষ্ট হলো। প্রথমে বন থেকে কাঠ নিয়ে তৈরি করল একটা চেয়ার। তারপর টেবিল, শেলফ, আরও কত কী! একধরনের শক্ত জংলাগাছের কাঠ দিয়ে তৈরি করল একটা কোদাল আর জাহাজের ভাঙা একটা লোহার টুকরো পুড়িয়ে পিটিয়ে তৈরি করল জ্বালানি কাঠ কাটা কুড়াল।

এর মধ্যে ঘটল এক মজার ঘটনা। রবিনসন জাহাজ থেকে নামানো জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতেই পেল একটা ছোট থলে, খুলে দেখল তাতে রয়েছে কতটা তূষ। থলেটা ওর দরকার ছিল ভিন্ন কারণে- তাই ঘরের বাইরে এসে তূষগুলো মাটিতে ফেলে দিল।

এর কিছুদিন পরেই নামল বর্ষা এবং বৃষ্টি। বৃষ্টি হবার কয়েক দিন পরেই রবিনসন আশ্চর্য হয়ে দেখল, যে তুষগুলো সে ফেলেছিল সেখানে অজানা গাছের বেশকিছু অঙ্কুর দেখা দিয়েছে। রবিনসনের খুব আনন্দ হলো। সে কোদাল দিয়ে সামনের আরও কিছু জমি কুপিয়ে তৈরি করে রাখল। একদিন দেখল অংকুরগুলো আসলে ধানগাছের- সাথে যবও আছে।

একদিন ধান আর যব গাছগুলো একটু বড় হলে সে তা চষাজমিতে ছড়িয়ে ছড়িয়ে বুনে দিল। কিছুদিনের মধ্যেই ঐ জমি থেকে বেশকিছু ধান ও যব পেল।

এবার রবিনসনের ভাবনা- এগুলো মাড়াই করবে কীভাবে? তাছাড়া চাই জাঁতাকল আর রুটি সেঁকবার জন্য তাওয়া। যাই হোক, বুদ্ধিমান রবিন শক্ত কাঠ দিয়ে জাঁতা তৈরি করল, আর নরম মাটি থালার মতো পিটিয়ে আগুনে পুড়িয়ে তৈরি করল তাওয়া।

এবার বড় সমস্যা হলো পোশাকের! জাহাজে যেটি ছিল তাতে আর কতদিন চলে? সেই বনে তো আর যাই হোক, পোশাক বা তৈরি কাপড় পাওয়া যাবে না। তখন আবার নতুন বুদ্ধি আঁটল রবিন- ঘরে রাখা ছিল বেশকিছু শুকনো ছাগলের চামড়া- সে ঐ চামড়া দিয়েই লজ্জা ঢাকার মতো পোশাক তৈরি করে নিল। গালভর্তি দাড়ি-গোঁফ আর তার উপর ছাগলের চামড়ার পোশাক- যেটি একখানা চেহারা হয়েছে রবিনসনের। ওভাবে দেখলে ওর স্বজাতি হয়তো অজ্ঞান হতো কিংবা ধরেই নিত রবিনসন পাগল হয়ে গেছে।

রবিনসনের আরও একটা মজার কথা হলো পৃথিবীর সাথে সম্পর্কহীন এক দ্বীপে বাস করলেও সে দিন-মাস বছরের হিসেব ঠিক ঠিক রেখেছিল। যেদিন রবিনসনের নৌকোডুবি হয় সেদিনের তারিখ ওর জানা ছিল- তারপর থেকেই রবিন প্রতিদিন পাহাড়ের গায়ে পরপর তারিখ লিখে ক্যালেন্ডার তৈরি করে রেখেছিল। প্রত্যেকদিন সকালে উঠে একটা করে তারিখ কেটে দিত সে। ঠিক বর্তমানের ডেটকার্ড বদলানোর মতো।

এভাবেই রবিনসনের দিনের পর দিন কাটতে লাগল। রবিনসন ঐ দ্বীপের মুকুটহীন রাজা। যতদূর দৃষ্টি যায় সবটাই ওর রাজত্ব। রবিনসন যখন খেতে বসত তখন ওর সব কুকুর বেড়ালগুলো বসত চারপাশে, তা দেখে মনে হতো রবিনসন রাজা আর ওরা সব যেন প্রজা, প্রজারা যেন সব ওর করুণা প্রত্যাশী। কিন্তু এভাবে বেশিদিন কাটল না, কিছুদিনের মধ্যেই দেখা দিল নতুন এক অশান্তি।

রবিনসন একদিন বেলাভূমিতে হাঁটছিল বালি কেটে কেটে নানান ভাবনা মাথায় নিয়ে। এর মধ্যেই হঠাৎ তার চোখ স্থির হয়ে যায় বালির ওপর প্রকান্ড এক পায়ের ছাপ দেখে। কিন্তু কোথাও জন মানব নেই, এই ছাপ এল কীভাবে, চিন্তা ওখানেই। কোনো কিছুর সন্ধান পেল না বলেই ওর ভীষণ ভয় হলো। শেষে এমন হলো, দিনে ভয়ে ভয়ে চলাফেরা করলেও রাতে ঘুমের মধ্যে মাঝে মাঝেই স্বপ্নে দেখল, কিছু লোক ওকে আক্রমণ করতে এগিয়ে আসছে। অবশ্য ওর ঘর খুব মজবুত করে তৈরি। তবুও রবিন আবার দ্বিগুণ দেয়াল তৈরি করল, যাতে করে ওর ঘর শত্রুর কাছে দুর্ভেদ্য হয়। অবশ্য তাতেও রবিনসনের পুরো ভয় কাটল না।

যাই যাই করে এভাবে কেটে গেল প্রায় দুটি বছর। রবিনসন এখন সেসব ভয়ের কথা প্রায় ভুলেই বসেছে। এমনি এক সকালে ঘুম থেকে উঠে বাইরে যেতেই দেখতে পেল পাঁচখানা নৌকা সাগরের তীরে বাঁধা। আরও স্পষ্ট করে দেখার জন্য রবিনসন পাহাড়ের উপর উঠল। সেখানে থেকে যেটি দেখল, তাতে ওর হাত-পা ভয়ে ঠান্ডা হয় আর কি!

রবিনসন দেখল প্রায় জনা ত্রিশেক লোক বিরাট এক আগুনের কুন্ডলীর চারদিকে ঘুরে ঘুরে নাচছে এবং বিদঘুটে আর বীভৎস রকমের চিৎকার করছে। একটু পরেই ওরা দুজন লোককে ওদের সেই নৌকা থেকে টানতে টানতে তীরের বালিতে নামিয়ে নিয়ে এল।

একজনকে তো সাথে সাথেই মেরে ফেলল। আর অন্যজন ওদের একটু অসাবধানতার সুযোগ পেয়ে দৌড় দিল। তিন জন লোক ছুটল ওর পিছু পিছু ওকে ধরতে। কিন্তু লোকটি ছুটছে প্রাণের দায়ে, তার সাথে ওরা পারবে কেন? ঐ লোকটি সোজা ছুটে আসছিল, রবিনসন ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে বসে সব দেখছে। প্রথমে ওর ভীষণ ভয় হয়েছিল। কিন্তু যখন দেখল ওদের মধ্যে একজন ফিরে যাচ্ছে তখন রবিনসন বাকি দুজনের হাত থেকে ওকে বাঁচাবে স্থির করল। ওর হাতে ছিল বন্দুক, মধ্যে একটা লোক, রবিনসনের নাগালের মধ্যে আসতেই কষে দিল এক ঘা। সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইল। এদিকে অন্য লোকটি রবিনসনকে নিশানা করে তীর ছুড়ছে দেখেই বাধ্য হয়ে সে গুলি করল।

দ্বিতীয় লোকটি মারা গেল।

যারা তিনজন এসেছিল ওদের তো ব্যবস্থা ভালোই হলো। কিন্তু রবিনসনের বন্দুকের গুলির শব্দ শুনে এবার যাকে সে বাঁচাল সে-ই ওঠে ভয়ে দিল ভোঁ দৌড়। অতিকষ্টে রবিন ওকে দৌড়ে ধরে আনল এবং তার ভয় ভাঙিয়ে দিল। তখন লোকটি বারবার ওর পায়ে ধরে কৃতজ্ঞতা জানাল।

রবিনসন ওকে এবার নিজের বাড়িতে নিয়ে গেল। কিছু খেতেও দিল, তারপর বিছানা দেখিয়ে বলল ঘুমোতে। লোকটি ভয়ে, ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় প্রায় আধমরা হয়ে গিয়েছিল, এবার ঘুমিয়ে একটু সুস্থ হয়ে উঠেই আবার সে রবিনসনের পা নিজের মাথায় রেখে ওদের প্রথা মতো বশ্যতা মেনে নিল।

এই পুরো ঘটনাটাই ঘটেছিল ইংরেজী ফ্রাইডে, মানে শুক্রবার। তাই রবিনসন ওর নাম রাখল ফ্রাইডে। এতদিন বেচারা রবিনসন ছিল একা দ্বীপবাসী। এবার তার দোসর হলো। ফ্রাইডে কথা বলতে জানত না- তাকে খুব যত্ন করে রবিন কথা বলা শেখাল। এমনিতে ফ্রাইডের মাথা খুব পরিষ্কার, যাকে বলে শার্প। সে অল্পদিনের মধ্যেই সব কাজকর্ম শিখে নিল। তাছাড়া ওর মনিবের প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসা দেখে রবিনসন খুবই মুগ্ধ হয়। তাইতো পরবর্তী জীবনে রবিনসন ক্রুশো বারবার বলত- ‘অমন বিশ্বাসী ভৃত্য বোধ হয় কেউ কোনোদিন পায়নি, যেমনটি ছিল ফ্রাইডে।’

এভাবে এই নিঝুম দ্বীপে কেটে গেল সাতাশটি বছর। এই সাতাশ বছরে রবিনসনের আরও দুজন সঙ্গী হলো, ওরা কী করে এল শুনো।

পূর্বের মতো একদিন রবিনসন আবিষ্কার করল সমুদ্রতীরে তিনখানা নৌকা। রবিনসন দূরবীন দিয়ে দেখল, আগের মতোই কিছু বর্বর লোক দুটি লোককে বেঁধে রেখেছে, প্রহার করছে এবং আয়োজন চলছে জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলবার। তখন রবিনসন আর ফ্রাইডে বন্দুক নিয়ে তাদের আক্রমণ করল। এতে মাত্র চারজন ছাড়া সবাইকে মেরে ফেলল ওরা দুজনে। বাকি চারজন আধমরা অবস্থায় কোনোরকমে ওদের এক নৌকা নিয়ে পালাল। ফ্রাইডে এবং রবিনসন তখন বন্দি দুজনকে হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিয়ে সুস্থ করে তুলল। এদের একজন স্পেন দেশের লোক আর অন্যজন ফ্রাইডের স্বজাতি। ফ্রাইডে কিন্তু তাকে দেখেই চুমুতে চুমুতে গাল ভরে ফেলল। অস্থির করে তুলল লোকটিকে। কিছু পরে জানা গেল লোকটি আসলে ফ্রাইডের বাবা।

ওরা একটু সুস্থ হয়ে উঠলে ওদের কাছ থেকে রবিনসন জানতে পারল ডাঙার কাছেই একটা জাহাজডুবি হয়েছে, তাতে কয়েকজন স্প্যানিশ এবং কয়েকজন পর্তুগিজ ছিল যাদের ধরে নিয়ে গেছে। এদিকে তাদের না আছে অস্ত্র, না আছে কোনো যন্ত্রপাতি। রবিনসন ওদের সব কথা শুনে নিজের দ্বীপে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে সম্মত হলো, কিন্তু শর্ত হবে যে, তারা এখানে সবাই রবিনসনের বশ্যতা স্বীকার করে নেবে এবং কখনো কেউ রবিনসনের বিরোধিতা করবে না। এই শর্তের কারণটাও রবিনসন ওদের বুঝিয়ে বলল, তা হলো, মানুষের সাধারণত স্বভাব হচ্ছে এমন, বিপদের সময় যে উপকার করে, বিপদ কেটে গেলে উপকারীর অপকার করতে ঐ মানুষের মনে বাধে না। এ ক্ষেত্রে বনের পশু বরং উত্তম প্রাণী।

রবিনসন আর ফ্রাইডে ওদের দ্বীপ থেকে ডাঙায় আনার জন্য একটা নৌকাতে ছাউনি তৈরি করল, সাথে রইল খাবার পানি। তারপর সেই নৌকা করেই ফ্রাইডের বাবা আর স্প্যানিশ খালাসিটি ঐ অভাগাদের উদ্ধারে যাত্রা করল।

আরও কিছুদিন পরে একদিন ফ্রাইডে এসে রবিনসনকে খবর দিল- দূরে আবারো একটা জাহাজ দেখা যাচ্ছে। রবিনসন খবরটা পেয়ে বেশ খুশিই হলো- তবুও মনের সন্দেহ দূর করতে কী উদ্দেশ্যে জাহাজটি এদিকে আসছে বুঝতে না পেরে আড়াল থেকে ব্যাপারটা পরখ করতে লাগল। ভাবখানা এই, দেখাই যাক না- কী হয়।

জাহাজ তীরের কাছে এসে নোঙর ফেলল, তারপর ঐ জাহাজের লোকেরা নৌকা করে এসে দ্বীপে নামল। আরও একটু সতর্কভাবে দেখে রবিনসন বুঝতে পারল ওরা সবাই শ্বেতাঙ্গ- ইংরেজ, ওর স্বজাতি। আর এই দলের তিনজন লোকের হাত-পা বাঁধা, ওরা বন্দি। যাই হোক, নৌকার লোকগুলো ঐ তিনজনকে চড়ায় ফেলে দিয়ে দ্বীপের ভেতর ঢুকল আর সেই ফাঁকে রবিনসন ওদের বন্দিত্বের কারণটা জেনে নিল।

ওরা বুঝতেই পারছিল না ওরা কোন জাতির লোক, কারণ কেউ কথার উত্তর দিচ্ছিল না। অবশ্য শেষে বুঝতে পারল ওরা রবিনসনেরই স্বজাতি। তাই তারা জানাল, জাহাজের খালাসিরা ষড়যন্ত্র করে ক্যাপ্টেন আর মেটদের বন্দি করেছে- তাদের ইচ্ছে ওদের এই নিঝুম দ্বীপে ফেলে জাহাজ নিয়ে পালাবে। রবিনসন ও ফ্রাইডে তাড়াতাড়ি ওদের বাঁধন খুলে দিল এবং তিনজনের হাতে তিনটি বন্দুক দিল আত্মরক্ষার জন্য। তারপর পাঁচজন মিলে ওদের খুঁজে বের করল। পুরো যুদ্ধের মতো আক্রমণ করল।

ঐ দুষ্টদলের চাঁই ছিল দুজন, প্রথমেই তাদের মেরে ফেলাতে সমস্ত ব্যাপারটা খুব সহজ হয়ে গেল। আর বাদবাকি যারা ছিল তারা সবাই রবিনসনের কাছে আত্মসমর্পণ করল। ক্যাপ্টেন তখন ঐ তিনজনের সাহায্যে তাদের বন্দি করে ফেলল।

রবিনসন ক্রুশোর জন্যে শুধু ওদের প্রাণই বাঁচাল না, জাহাজটি পর্যন্ত ফিরে পেল। আর সে কৃতজ্ঞতায় ওরা রবিনসনকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইল। রবিনসন ক্রুশো স্প্যানিশদের জন্যে অপেক্ষা না করে, যা-কিছু ব্যবহারের জিনিসপত্র ছিল সব গুছিয়ে রেখে সেগুলো তাদের ব্যবহারের জন্য অনুমতি দিয়ে একটা চিঠি লিখে রেখে ফ্রাইডেকে নিয়ে জাহাজে উঠল।

আটাশ বছর পরে এই এতদিনের অজানা দ্বীপ ছেড়ে রবিনসন ক্রুশো দেশের দিকে চলল এবং পঁয়ত্রিশ বছর পরে আবার দেশের মাটিতে পা দিল।

Post navigation

4 thoughts on “রবিনসন ক্রুশো

  1. In the great pattern of things you get a B+ with regard to hard work. Where you actually lost everybody ended up being on the facts. You know, they say, the devil is in the details… And that could not be more correct in this article. Having said that, permit me reveal to you precisely what did work. Your writing can be quite engaging and this is most likely why I am taking an effort in order to opine. I do not really make it a regular habit of doing that. Secondly, whilst I can certainly see the jumps in reason you come up with, I am not sure of just how you appear to connect your details which make your conclusion. For the moment I shall subscribe to your point but trust in the foreseeable future you link the dots better.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *