মেঘের খেলা ( পর্ব ২৫)

বন্যা হোসেন
অটোয়া, কানাডা।

উপন্যাস: মেঘের খেলা (পর্ব ২৫)

আজ অনেকদিন পর সকালে ফুরফুরে মন। ঘুম থেকে উঠে টের পেয়েছে বুকের ভেতর থাকা অস্বস্তিটা নেই । ভোর ফুটতে না ফুটতে নিয়মমাফিক ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় সুখী। পাশের বাসা থেকে কিছু পায়রা এসে এখানেও ঘুরে বেড়াচ্ছে ।রান্নাঘর থেকে কিছু খুঁদ এনে ছিটিয়ে দেয়। সকালের রোদের তেজে গ্রীষ্মের আগমনের ঘনঘটা পুরোদমে অনুভূত হচ্ছে।

অর্পার স্কুলের প্রিন্সিপালের সাথে মিটিং আজ সকালে। তাকে না জানালেও হত, তবে জানানোটাই সঠিক বলে মনে হলো তার । তিনি বেশ অবাক হলেন বিয়ের কথা শুনে । জানালেন আর একজন ক্লাস সিক্সের ছাত্রের অভিভাবকও বিয়ে করছেন। সাদী কি বলেছে জানা নেই, তাই সেও চেপে গেল। অর্পার জন্য দুসপ্তাহের ছুটির আবেদন করা হলো। প্রিন্সিপাল তাকে শুভকামনা জানালেন আন্তরিকভাবে। শাকিল তাকে প্রথম অভিনন্দন জানায়, তবে সেখানে ছিল বিস্ময়, খুশীর ঝিলিক চোখে পড়েনি।

আজ সকালে আম্মার ফোনও এসেছিল, সুখীর বিয়ের শাড়ীসহ অন্যান্য জিনিষ কেনার অনুমতি চাইছিলেন। সুখী আনন্দের সাথে জানিয়ে দেয় আম্মার পছন্দমত সব কিনে নিতে। আম্মা বলেন,
-তোমাকে বললাম আগে আগে চলে আসো, মীরাসহ ইচ্ছেমত শপিং করবে!
-আম্মা, আপনাদের পছন্দে আমার বিশ্বাস আছে!
-তুমি মীরাকে সব বলে দিও!
-আম্মা, আমি মীরার সংগে কি বলবো?
সুখী ছোট বাচ্চার মত প্রশ্ন করে।
-তোমার একমাত্র ননদের সাথে খাতির করে নাও, পরে শাশুড়ির নামে অভিযোগ করবে ওর কাছে।
-আমার কোন অভিযোগ নেই।
-এত দ্রুত সিদ্ধান্ত নিও না, বিয়ের এক সপ্তাহ পর যাচাই করা হবে তোমাকে!
আম্মাও রসিকতায় পটু।
সুখী জোরে হেসে ওঠে। সেই হাসি তার মুখে লেগে ছিল অফিসে লিফটে ওঠার আগে পর্যন্ত।

মীরা রাতে ফোন করেও একই রকম ঠাট্টা মশকরা করলো তার সাথে। পুরো পরিবারের সবাই খুব রসিক! অর্পার আর সুখীর জন্য কি কি কিনবে তা নিয়ে অনেক শলা পরামর্শ হলো। সুখী চমকে উঠলো যখন মীরা তাকে “ভাবী“ বলে সম্বোধন করলো। কেউ কোনদিন ভাবী ডাকেনি তাকে। ফিরোজের দিকের কাউকে সে চিনতো না, আর ফিরোজের বন্ধুরা সবাই তাকে নাম ধরে ডাকতো। মীরা এক হাসিখুশী, উচ্ছল, প্রাঞ্জল যুবতী যাকে অনায়াসেই আপন করে নেয়া যায়।

সেদিন রাতে খাওয়ার পালা চুকে যাওয়ার পর খালা এসে হঠাৎ এক অদ্ভুত আবদার পেশ করলো,
-আমি যামু বিয়াত। আমার লেইগ্যা টিকিট কাট।
অনেকদিন পর সুখী আজ মাথা ঠান্ডা করে তার সিদ্ধান্তে অটল থাকলো। সে কিছুতেই খালাকে সাদীদের বাড়ীতে নিয়ে যাবে না। এজন্য তাকে দুটা বেশী গালি দিতে পারে আসমা বেগম, কিন্তু বিয়ে বাড়ীতে তাকে নেয়া চলবে না। খালাকে তার সিদ্ধান্ত জানালে শুরু হয়ে যায় ধুন্ধুমার কাজিয়া, ঝগড়া।সুখী কোন কথা না বলে কানে ইয়ার প্লাগ লাগিয়ে গান চালিয়ে দেয়। মুখের সামনে এসে হাত-পা নেড়ে অনেক কিছু বলে গেল, অকথ্য গালিগালাজ নিশ্চয়ই।

প্রতিদিন রাতে সাদী ফোন করলে কথা হয়, আজকাল সেও মাঝে মাঝে করে। সাদীর সেদিনের কথায় বোঝা গেল সে কতোটা অপেক্ষা করে থাকে। সুখীর মধ্যে নিয়িমিত ফোন করার অভ্যাস নেই, প্রত্যাশাও করে না তাকে কেউ ফোন করবে। ফিরোজ যখন ট্যুরে যেতো সে অপেক্ষা করতো না ফোনের, কারণ ফিরোজ তাকে ঐভাবে তৈরী করেছিল মানসিকভাবে। তাই আজ আর কারো কাছে কোন প্রত্যাশা নেই, আশাও নেই। বাবা-মা তার ব্যবহারে এত বিরূপ হয়েছিল যে তাদের আর কোন প্রত্যাশা ছিল না। সাদী তা মেনে নিতে রাজী নয়। তার আশা আছে, প্রত্যাশা আছে, আবদার, বায়না, হুকুম, দাবী সব আছে। তাই সে বলে,
-আমি এসব বুঝি না! আমার দিনে ১০টা কল, ৫০টা টেক্সট চাই, দেরী করে এলে তোমাকে বকুনি দেবো, কৈফিয়ত দিবো তোমাকে যদি আমি দেরী করি।
সাদীর সব দাবী মৌলিক, যুক্তিসঙ্গত, বাস্তব। বাস্তবের মানুষ তো এমনই হবার কথা। সুখী তাকে শোনায় ফিরোজের বউকে সে কতটা করুণা করে বা ঐ মহিলাটির জন্য তার দুঃখবোধের কথা।
-সাদী,আমার নিজের জন্য আর কোন দুঃখ হয় না, দুঃখ হয় ফিরোজের বউয়ের জন্য। সেই মহিলা না জেনে অন্ধবিশ্বাসে স্বামীর সাথে সংসার করে যাচ্ছে।
সুখীর কথাগুলো অবিশ্বাস্য লাগে নিজের কানে। এত গভীরভাবে ভাবতে পারে কজন মানুষ।
শাহ আমানত এয়ারপোর্টে সাদীর আসার কথা। সুখী এত নার্ভাস আর ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ছিল যেন আশেপাশের সবাই জেনে যাবে সে এক ভন্ড দ্বারা প্রতারিত হয়ে এখানে এসেছে আরেকজনকে বিয়ে করতে। অস্থিরভাবে মাথা ঘুরিয়ে খুঁজছে সাদীকে। তার ফোনে টেক্সট এলো,
-আমরা ডানদিকে!
সাদীর সাথে দাঁড়িয়ে আছে আরেকজন। অর্পা সাদীকে দেখে দূর থেকেই খুশীতে লাফাচ্ছিল। কাছে এসেই প্রথম প্রশ্ন,
-রোহান কোথায়?
সাদী বলে,
-রোহান বাসায়।
সাদীর চাচাতো ভাই পাভেল এগিয়ে এলো সামনে, সালাম দিলো। সে আবার পশ্চিমা কায়দায় হাত বাড়ালো হ্যান্ডশেক করার জন্য। পাভেল বেশ লম্বা, একহারা গড়ন। সুখী এপর্যন্ত কোন কথা বলেনি। তার সাথে দুটো সুটকেস, সাদী বলে উঠলো ,
-মাত্র দুটো সুটকেস! সুখী মাথা হেলিয়ে সায় দেয়।
-যা লাগে সব কিনে দিবে এখান থেকে ভাইয়া! এখানে কিছুর অভাব নাকি!
সাদী গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ায়।
-আমি ঠিক বুঝিনি কি কি আনবো! আইডিয়া করতে পারিনি!
সুখী বোকার মত বলে ওঠে।
-বিয়ের আইডিয়া নেই নাকি শাড়ীর আইডিয়া নেই?
পাভেল লাগামছাড়া হাসি শুরু করে সুখীর কথায়। সুখীও হেসে দেয় লাজুক ভঙ্গীতে।
-শ্রাবন্তী কিন্তু বিজ্ঞাপনের কপি লিখে…আর তুই ওর কথা কেড়ে নিলি তোর দমকা হাসি দিয়ে।
-চল, যাই বাসায়। পাভেল বিনয়ের সাথে আহ্বান করে বাসায়।
-সাদী! সুখী ডাকে পিছন থেকে।
-হু!
-আমি তো হোটেলে যাবো!
-এখন বাসায় চল আপাতত, পরে বম্মার সাথে কথা বলে ঠিক করা যাবে তুমি কোথায় থাকবে! তোমার বান্ধবী না আসা পর্যন্ত তুমি আমাদের বাসায় থাকছো। ভাইয়া, রোহান আর বম্মা কিন্তু ভাইয়ার ফ্ল্যাটে থাকছে। মীরা আমাদের সাথে, তুমিও আমাদের সাথে।
পাভেল বলে যায় একটানা।
আর কিছু বলার রইলো না সুখীর, আম্মা চাইলে তা-ই করতে হবে।
পাভেলের টয়োটা করোলা গাড়ীতে উঠে বসার পর অর্পার প্রথম প্রশ্ন,
-আঙ্কেল, তোমার নিউ কার? অর্পার কৌতুহলকে নিবৃত্ত করার জন্য সুখী হিস করে মুখে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করতে বলে,
-অর্পা!
-হ্যাঁ, আংকেল! খুব বুদ্ধি দেখি এই পুতুলটার!
পাভেল হেসে বলে।
-গোল্ডেন কালার আমার প্রিয়! অর্পা খিলখিল হাসির সাথে উত্তর দেয়। সুখী আবার মেয়েকে শাসন করতে যায়, তার আগেই পাভেল বলে ওঠে,
-আরে, বাচ্চাকে বাচ্চার মত থাকতে দাও তো! পাভেল আদেশ দেয়।
-আপনি তো আম্মার মত বলছেন! সুখী হেসে বলে।
-আমি তো বম্মার কাছেই বড় হয়েছি, তার কাছেই সব শিখেছি।
গাড়ীতে সুন্দর ফুলের ঘ্রাণ, এসি অন করে দিয়েছে পাভেল, পাভেলের মজার মজার কথায় অর্পা মুগ্ধ। সে তার মাকে জিজ্ঞেস করে বসলো,
-মিমি, আমরা এখন থেকে এখানে থাকবো?
-না, অর্পা! সুখী ফিসফিস করে বললো।
-এই আংকেলকে ভালো লাগে! অর্পা খুশী খুশী মুখে বলে।
-আর আমি? সাদী দুঃখ পাওয়ার ভান করলো। অর্পা লজ্জা পেয়ে মায়ের ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে বলে ওঠে,
-রোহান তো আমার বন্ধু, তুমি মিমিকে জিজ্ঞেস কর তোমার বন্ধু হবে নাকি!
অদৃশ্য হয়ে যেতে পারলে এই মুহূর্তে সবচেয়ে ভালো হতো। লজ্জায় মিশে যাচ্ছে সুখী। পাভেলকে আর পায় কে! তার হাসির শব্দে গাড়ীও কেঁপে উঠতে পারে। অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো সে।
-শ্রাবন্তী!
এখানে আসার পর এই প্রথম সাদী তাকে শ্রাবন্তী নামে ডেকে উঠলো।
পাঁচলাইশ এলাকায় পুরোন অভিজাত বাড়ী সাদীদের, গাছপালায় ঘেরা ছিমছাম হলদে রঙের দোতলা। গেট দিয়ে ঢুকেই বকুল গাছ। চারদিকে বড় বড় ফলের গাছ, আম গাছে প্রচুর ফলন চোখে পড়লো। আম্মা, মামা, মামী তাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়ে ভিতরে নিয়ে গেলেন। পাভেলের বউ রিয়া আর মীরা এসে দেখা করে গেল। নাজমা কাল এলে সে চলে যাবে হোটেলে। সাদীর একটি ফ্ল্যাট আছে কাছেই, সেখানে সাদীসহ অনেকেই থাকছে বলে আম্মা এখানে তাকে জোর করলেন থাকার জন্য। আত্মীয়স্বজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারবেন সহজে, এই আম্মার যুক্তি। বাইরের বসার ঘরে তারা বসে আছে। আম্মা বলে গেছেন আগে কিছু নাশতা করে তারপর ওদের ঘর দেখিয়ে দিবেন।

পাভেলের বউ রিয়া খুব চেষ্টা করছে স্বাভাবিকতা বজায় রাখতে, কিন্তু চেষ্টা করেও পারছে না। বম্মাকে কিছু বুঝতে দেয়া যাবে না। কিন্তু সে মন থেকে মেনে নিতে পারছে না সাদীর বিয়ে। আর এত তাড়াহুড়োর কি ছিল? এক বছরের মধ্যে এত কিছু ঘটে গেছে! একটু অপেক্ষা কি করা যেতো না? সে রোহানকে ভালোবাসে, তাই চিন্তা হয় ভাসুরের জন্য। দেখা গেল নতুন বউ আর রেডিমেড মেয়ে পেয়ে সে ভুলে গেল নিজের ছেলেকে! এমন দৃষ্টান্ত ভূরি ভূরি আছে সমাজে। রিয়ার বাপের বাড়ীতেও এ নিয়ে কথা উঠেছে। তার মামাতো বোন রাজী ছিল সাদীকে বিয়ে করার জন্য, ডিভোর্সি, নিঃসন্তান মেয়ে। কিন্তু সাদী তখন বিয়ের কথা কানেই নিতো না। আর এই কয়েক মাসের মধ্যে কি অমর প্রেম হয়ে গেল, বিয়ের কথায় মুখে ফুলঝুরি ফুটছে! পাভেলটাকেও কিছু বলা যাচ্ছে না, বড়ভাইয়ের কথায় উঠে আর বসে! এ বিয়ে কতদিন টিকবে তা নিয়ে তার সন্দেহ আছে।
টাপুর-টুপুরের ঘরে তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বম্মার এই আদিখ্যেতাও সে বুঝে উঠছে না। বিয়ের আগেই কনেকে বাসায় কেন থাকতে দিতে হবে, হোটেল তো বুকিং করাই ছিল। কিছু করার নেই তার, বাড়ীর বউ হিসেবে সব কর্তব্য পালন করে যেতে হবে নিঃশব্দে হাসিমুখে। রোহানকে সে চেয়েছিল সাদী বাংলাদেশে ফিরে আসার পরই, সাদী দিতে রাজী হয়নি।

চা, নাশতা খাওয়ার পর রিয়া তাদের ঘর দেখিয়ে দেয়। রিয়ার মেয়েদের ঘরে আজ রাতে তাদের থাকার ব্যবস্থা। বেশ বড় ঘর, দুপাশে বড় বড় জানালার পাশে দুটো ডাবল বেড। সুখীর মন অস্থির, এখনও রোহানের সাথে দেখে হয়নি। আম্মা বললেন, সে কাছেই সাদীর ফ্ল্যাটে আছে মীরার স্বামী মাসুম আর বাচ্চাদের সাথে । অর্পা আসবে জানা কথা, তারপরও সে এড়িয়ে যাচ্ছে। এর মানে হলো, সে খুব নাখোশ সুখীর উপর। অর্পা ঘরে এসে মায়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-আমার ঘর এটা মিমি?
-না, এটা আমাদের ঘর! টাপুর বলে ওঠে, অনাত্মীয় বাচ্চাটিকে সে নিজের ঘর ছাড়তে রাজী নয়।
রিয়া তাকে চোখের ইশারায় চুপ করতে বললো, অর্পার দিকে ফিরে হাসিমুখে বললো,
-তোমার পছন্দ হলে তোমার ঘর হবে এটা!
অর্পা আহ্লাদে আটখানা হয়ে দৌড়ে এসে রিয়াকে জড়িয়ে ধরে।
সুখী ভীরু পায়ে বিছানায় বসে, আম্মা তাকে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে আরাম করতে বলে যান। রিয়াও বলে যায় কোন কিছুর প্রয়োজন হলে ডাকতে। সুখী শুকনো হাসি দেয়, অর্পাও বেরিয়ে যায় টাপুর টুপুরের সাথে। লাগোয়া বাথরুমে সে তার টয়লেট্রিজের ব্যাগটি রাখছিল, হঠাৎ কাঁধে নরম ঠোঁটের ছোঁয়ায় সে চমকে ওঠে। সাদী বলে,
-শ্রাবন্তী!
সুখীর হাত থেকে টুথপেস্টে পড়ে যায় সিরামিকের বেসিনে।
-সাদী! সে ভীরু গলায় বলে। সাদী তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়।
-তোমার মুখ থেকে সব রঙ কে চুরি করে নিল? এত ফ্যাকাশে কেন? কি হয়েছে?
-আমি…
কথা শেষ করতে পারছে না, তার গলায় কি যেন আটকে আছে।
-শ্রাবন্তী!
সুখীর চোখ পানিতে টলমল, সে কিছুতেই আবেগ ধরে রাখতে পারছে না, ঠোঁট কামড়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে।
-এটা আমাদের নিজেদের বাড়ী, চাচা-চাচীর মত ভালো মানুষ আমার লাইফে আর দেখিনি শ্রাবন্তী!
-আমার মনে হচ্ছে কোথায় এলাম, কেন এলাম!
-মানে, আফসোস হচ্ছে এখন? বিয়ে করতে এসে?
সুখী আর সেকথার উত্তর দেয় না। সে রোহানের কথা জানতে চায়।
-রোহান?
সাদীর মুখ চিন্তাযুক্ত, গম্ভীর, উদ্বিগ্ন মনে হলো।
-রোহান ঠিক আছে, মাসুমের সাথে আছে আমার ফ্ল্যাটে।মীরার বাচ্চারাও ওখানেই।
-বিয়েতে আসবে না?
-না!
-না? সুখীর চোখ নোনা জলে ভাসে আবার।
-আহ, শ্রাবন্তী আমি বলতে চেয়েছি আসবে না কেন!
-সাদী!
-ইটস অল গোয়িং টু বী ওকে! গলা খাঁকারি দিয়ে সুখীকে ছেড়ে সাদী বেরিয়ে যায় কামরা থেকে।

ঘুম ভেঙ্গে দেখে ঘামে শরীর ভিজে গেছে, এসি চলছে শব্দ করে। হঠাৎ করে সব অপরিচিত লাগে, অপরিচিত দেয়াল, বিছানা। চোখ অন্ধকারে সয়ে এলে মনে পড়ে যায় সব। সে দুঃস্বপ্ন দেখছিলো খালাকে নিয়ে । খালা ঘর থেকে বেরিয়ে চিৎকার করে বলছে, “আমারে বন্দী কইরা রাখছে “। পুলিশ এসে সুখীকে এরেস্ট করে নিয়ে যাচ্ছে। একটু ধাতস্থ হয়ে উঠে বসে, দেয়ালে হেলান দিয়ে। পাশের বিছানায় মীরা শুয়েছে তার ছোট পুত্রকে সাথে নিয়ে। সুখীর নড়াচড়ায় হোক বা যে কোন কারণে হোক সেও জেগে গেছে। বিছানা থেকেই জিজ্ঞেস করলো,
-কি হলো, ভাবী?
-উম্ম…সরি! পানি পিপাসা পেয়েছে।
-আমি নিয়ে আসছি।
-নাহ…তুমি ঘুমাও! আমি উঠে যাচ্ছি।
উঠে বের হলো ঘর থেকে, তার ব্যালকনিতে যাওয়ার অভ্যাস মাঝরাতে ঘুম ভেংগে গেলে। এখানে একতলায় সে কোন বারান্দা দেখেনি। পুরো বাড়ী ঘুরে দেখা হয়নি তার। তবে উঠানে যাওয়া যেতো দরজা খুলে, কিন্তু কারো ঘুম ভেংগে গেলে আবার বিশ্রী ব্যাপার হবে।
মীরা তার পিছন পিছন উঠে এসেছে। সে ডাকে,
-ভাবী।
তার হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যায় অন্যদিকে। সুখী বাথরুমের দিকে যাচ্ছিল। মীরা দুষ্টুমি করে বলে,
-রাস্তা ভুলে গেছো?
-আমি মাঝরাতে ঘুম ভাংগলেই ব্যালকনিতে চলে যাই, অভ্যাস হয়ে গেছে। সুখী সামান্য হেসে উত্তর দেয়।
-ভাইয়ের ফ্ল্যাটে কিন্তু ব্যালকনি আছে। মীরা তাকে মনে করিয়ে দেয়।
-বাইরে যাবে হাঁটতে?
-মানে…
সুখী কিছু বলা শুরু করতেই কারো কাশির শব্দ পাওয়া গেল। মীরা তার হাত ধরে নিয়ে আসে বাথরুমের দিকে। সুখীর হাতের চুড়িতে রিনিঝিনি শব্দ হয়, কাল রাতে আম্মা দুজোড়া সোনার চুড়ির সাথে লাল কাঁচের চুড়িও পরিয়ে দিয়েছেন। বাথরুমের দরজা খোলা, ছোট কাঁচের জানালা দিয়ে আসা চাঁদের আলোয় ভেতরটা ঝলমল করছে। উঁচু ড্রামের গায়ে চাঁদের প্রতিফলন, পাশেই ছোট দুই বালতি পানিতে ভর্তি। লাক্স সাবানের গন্ধে খুব পরিচিত একটা অনুভূতি। কি যে হয়ে গেল সবকিছু মিলিয়ে সুখীর, সে কান্নায় ভেংগে পড়লো।
-কি হলো, আরে? মীরা আতঙ্কগ্রস্ত, ভাইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে সবার চিন্তার শেষ নেই। কয়েকজন আত্মীয় গ্রামের বাড়ী থেকে এসেছেন কাল রাতে বিয়ে উপলক্ষে, তাদেরকে নীচু স্বরে একই কথা বলতে শুনেছে। ভাইয়ের জীবনে আর কোন এক্সিডেন্ট হলে আম্মাকে আর বাঁচানো যাবে না। কেউ এখনও জানে না তার আর মাসুমের সম্পর্কও খুব একটা ভালো যাচ্ছে না ইদানীং, বিশেষ করে ছোট ছেলেটা হওয়ার পর থেকে। মাসুম এসেছে ঠিকই কিন্তু তাদের নিজেদের মধ্যে ভালো করে কথা হয়নি এখনও। ভাইয়ার বিয়েটা হয়ে গেলে, নিজেকে নিয়ে ভাববে।
-ভাবী!
-মীরা, তোমরা সবাই খুব ভালো!
-এইজন্য তুমি কাঁদছ? সে হেসে বলে সুখীকে।
-জানি না মীরা, আমার খুব ভয় হয়। আমার খালা খুব একটা ভালো মানুষ না, স্বপ্ন দেখলাম সে ফ্ল্যাট থেকে কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে গেল…কিছু যদি করে বসে!
বাথরুমের সামনের জায়গাটা গুমোট গরম, দুজনেই ঘামছে। সুখী মনে মনে ভাবছে, ঢাকায় ফিরে যদি দেখতে পায় খালা সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে গেছে, তাহলে কি আবার বিপদ হবে কে জানে!
মীরা চুপ করে থাকে অস্বস্তিতে। তাদের পরিবার আত্মীয়স্বজনে ভর্তি, বউ একা এসেছে বিয়ে করতে এটা সে কল্পনাই করতে পারে না। একমাত্র আত্মীয় যার সঙ্গে থাকে সে এত খারাপ মানুষই বা হয় কেন যে তাকে ভাগ্নীর বিয়েতেও নিয়ে আসা যায় না? এই সমীকরণ তার বোধের অগম্য।

আম্মাকে দেখে দুজনেই চমকে ওঠে। আম্মাও অবাক দুজনকে বাথরুমের সামনে দেখে।
-কি হয়েছে?
-কিছু না আম্মা, ভাবীর রাতের বেলা নাকি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকার অভ্যাস। মীরা রসিকতা করে পরিবেশ হালকা করতে চায়।
-রাত দুটায়? আম্মাও বিস্মিত।
-আম্মা! স্বপ্ন দেখেছি, তাই উঠে এসেছি…বাজে স্বপ্ন!
-স্বপ্নকে স্বপ্ন হিসেবেই মনে করো…স্বপ্ন সত্যি হয় না।
আম্মা মৃদু হেসে আশ্বাস দেন। আম্মার বয়স্ক চোখেমুখে অভিজ্ঞতা আর আত্মবিশ্বাসের দৃপ্ত ঝিলিক দেখে সুখীর মন হালকা হয়।
আম্মা তার চুড়ি পরা হাত দুটো ধরে ভালো করে তাকান, তার মুখে হাসি ফুটে উঠে।
-খুব মানিয়েছে কিন্তু তোমার হাতে!
-থ্যাঙ্কস! আম্মার বদান্যতায় আবার চোখে পানি আসে।
-রোহানকে নিয়ে আসবে সাদী সকালে নাশতা খেতে।
আম্মা তার মনের কথা বুঝতে পেরে বলে ওঠেন, নাকি নিজেও আশাবাদী-এ বিয়েকে রোহান মেনে নিবে। আশায় বুক বেঁধেই এ সম্পর্কের শুরু, মনে মনে সবাই আশাবাদী যেন ইতিবাচক কিছু হয় ।

বৈশাখের প্রথম দিনে, এক রৌদ্র খরা দিনে সোনালী লাল বেনারসিতে সজ্জিত হীরা আর সোনার শৈল্পিক কারুকাজের অনবদ্য ডিজাইনের জুয়েলারীতে সুখীকে এক রাজরাণীর মত দেখাচ্ছিল। লাইট ক্রিম রঙের শেরওয়ানির সাথে একই রঙের চুড়িদার আর মেরুন দোপাট্টা পরিহিত সাদীকে দেখে অনেকেরই ঈর্ষায় গা জ্বলছিল। সকালেই বিয়ে পড়ানো হলো হোটেলে এসে। নাজমা আর অসীম দুই পাশে দাঁড়িয়ে থেকে সুখীর বাবা, মা, ভাইয়ের কর্তব্য সম্পাদন করলো। অশ্রুসিক্ত কন্ঠে কোনরকমে কবুল বলতে পারলো সুখী। রাতে হোটেল আগ্রাবাদে রিসেপশনের সময় ছিল সন্ধ্যে সাতটায়। সুখীকে নিয়ে পৌঁছাতে নাজমার কিছুটা দেরী হয়ে গেল। সাদীকে দেখে অদ্ভুত প্রশান্তি হচ্ছিলো তার হৃদয়ে। গত দুটো দিন যে উৎকণ্ঠা আর আশংকায় কাটছিল তা এখন কর্পূরের মত মিলিয়ে গেছে। রিসেপশনে শখানেক লোক এসেছে , প্রায় সবাই সাদীর আত্মীয় আর বন্ধু। সুখীর পক্ষ থেকে নাজমার পুরো পরিবার এসেছে। আম্মা আর মীরার কথায় বোঝা যাচ্ছে একেবারে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রাই নিমন্ত্রিত হয়েছে।
গায়ে হলুদ আর মেহেদীর অনুষ্ঠান আম্মা নিজেদের বাড়ীতেই আয়োজন করেন।সুখীর স্বপ্নেরও অতীত এমন জাঁকজমক করে প্রতিটি রীতিনীতি পালন-যে মেয়ের বিয়ে হয়েছিল কোন এঙ্গেজমেন্ট, গায়ে হলুদ, মেহেদী, বিয়ের অনুষ্ঠান, শাড়ী, গয়না ছাড়া, তার জন্য এ প্রাপ্তি অসামান্য। সাদীর মুগ্ধ চোখ দেখে সুখের চোরাবালিতে সে ডূবে যাচ্ছিল। সুখীর দুহাতে মেহেদী দেয়ার সময় মীরা নিজ হাতে পরম মমতায় তাকে খাইয়ে দিচ্ছিল।
অর্পার আনন্দের কোন সীমা পরিসীমা ছিল না। সে দুহাতে দুপায়ে মেহেদী দিয়ে মহানন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছিল প্রজাপতির মত সব অনুষ্ঠানে। মায়ের বিয়ের ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, সে ব্যস্ত প্রচুর বন্ধু বানাতে, খেলতে। বড়, ছোট যেই দেখে তাকে আদর না করে উপায় নেই, তার কথা শুনে সবাই হাসে। সে জীবনে কোনদিন একসাথে এক বাড়ীতে এতলোক দেখেনি। কিন্তু তার স্বভাবসিদ্ধ স্নিগ্ধতায় আর বাকপটুতায় সবাইকে মুগ্ধতার আবেশে জড়িয়ে রেখেছে প্রথমদিন থেকে।

কিন্তু এর ভেতরেই কিছু লোকের কৌতুহলী আর শংকিত দৃষ্টি এড়ানো সম্ভব হয়নি। সুখী বাথরুমে গিয়েছিল, বাইরে বসা মহিলারা জানতো না। তাদের মন্তব্যগুলো সবই কানে গেছে।
“কোনদিন ভাবতে পারিনি সাদী এরকম কিছু করবে।“
“মেয়ের কি অভাব ছিল নাকি দেশে।“
“সেকেন্ডহ্যান্ড তো এইজন্য সেকেন্ডহ্যান্ড পছন্দ হয়েছে, কারও কিছু বলার থাকবে না।”
“ আপা, দেখেছেন মেয়েটা কোন কথা বলে না “
‘’হুম, বিহারী নাকি? বাংলা বলতে পারে না মনে হয়।”
“ এত হুশহাশ করে বিয়ে করার কি হলো, সবাইকে বলেওনি!”
ঠিক সে মুহূর্তে সুখী বের হয়ে এলে, তাকে দেখে আবার ফিসফিস করে মহিলার দল।

রোহানের সাথে স্বাভাবিক হওয়ার প্রচেষ্টা সুখী অব্যাহত রেখেছে। ওকে ডেকে ডেকে কথা বলতে হয়, প্রশ্ন না করলে কিছু বলে না, কিশোর মন এক অজানা ভয়ে যেন কুঁকড়ে আছে। বিয়ের অনুষ্ঠানের পর সাদীর ফ্ল্যাটে নিয়ে আসা হলো তাকে প্রায় রাত একটার দিকে ।আম্মা, মীরা আর রিয়া তাদের সঙ্গে এসে বউ বরণ করে নেয়, মিষ্টি খাইয়ে আর কিছু আঞ্চলিক রীতি রেওয়াজ পালনের মধ্য দিয়ে। সাদী আবার বের হয়ে গেল বিভিন্ন কাজ শেষ করার জন্য। সে এসে দেখে এখানেও বিভিন্ন রুমে অনেক লোক, কেউ ঘুমাচ্ছে, কেউ গল্প করছে। অর্পাও দুই বাচ্চার মাঝে তার গোলাপী ভালুক জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। রোহানকে দেখা গেল, একটি বেডরুমে হেডসেট লাগিয়ে বসে আছে। সুখী কাছে গিয়ে বলে,
-ঘুম আসছে না, রোহান?
রোহান হেডসেট নামিয়ে প্রশ্ন চোখে তাকায়, সুখী আবার বলে, এবার সে মাথা নাড়ায়, সুখী তাকে বলে,
-আমার রুমে আসবে?
একথায় কেন যেন তার চোখে আলোর ঝিলিক দেখা যায়, সে উঠে দাঁড়াবার ভঙ্গী করেও, আবার বসে পড়ে।
-ঘুমিয়ে পড়, রোহান!
সুখী দরজা ভিড়িয়ে চলে গেলে রোহান তখনও দরজার পানে চেয়ে বসে থাকে।

সারাদিন বিয়ের হাঙ্গামার মধ্যে সাদীর সাথে কথা প্রায় হয়নি বললেই চলে। কিন্তু তার ফোন থেমে ছিল না। অসংখ্য টেক্সট করে সুখীকে পুলকিত করেছে অহর্নিশ।
‘’আমি অবাক হচ্ছি তোমার শান্ত আচরণে,শান্ত অথচ উষ্ণতায় ভরা“
“আমি শান্ত নই সাদী, কিন্তু এই চাটগাঁয়ের ভাষা ঠিক বুঝি না, তাই চুপ থাকি।“
‘’এত আনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়ে করাটা কি ভুল হলো?”
“না“ লিখে সে দুটো স্মাইলি, নারকেল গাছ আর নৌকার ছবি পাঠায়।
‘’ ব্যাংকক যেতে চাও হানিমুনে?’’
“ঢাকায় যাবো, সাদী!“
‘’কেন?”
‘’অর্পাকে কে রাখবে?”
‘’আম্মার কাছে থাকবে আমাদের বাচ্চারা।”
এই লেখাটি সে বহুবার দেখে, তার চোখে পানি এসেছে, চোখ মুছে আবার দেখে। ‘আমাদের বাচ্চা’ দুটি শব্দ, কিন্তু অনেক প্রত্যাশা, সম্ভাবনার দুয়ারের ইঙ্গিত।

সাদী মায়ের সাথে কথা বলছিলো রোহানকে নিয়ে। ঢাকায় ফিরতে ভয় লাগছে রীতিমতো। এর মধ্যে রোহান ঠান্ডাও লাগিয়েছে, সর্দি কাশি, হাঁচি সব একসাথে। আম্মা তাদের হানিমুনের ব্যাপারে জানতে চাচ্ছিলেন…সুখীকে নিয়ে কোথায় যাওয়া হবে। সুখী একেবারেই কোথাও যেতে চায় না, রোহানের বৈরী মনোভাব স্মরণ করে। আম্মাকে সে বলে,
-আম্মা, আমি ভয় পাচ্ছি শ্রাবন্তীকে অপমান না করে বসে!
-নাজমা আমাকে বলে গেছে রোহান শুধু আপনাদের একার সমস্যা না আন্টি!
-তাহলে মানছেন রোহান যে একটা সমস্যা!
-সুখীকে তুই পছন্দ করলি, বিয়ের প্রস্তাব দিলি, বিয়ে করলি! ১০/১১ বছরের বাচ্চার সাথে এত দ্রুত কিছু হবে না বাবা, সময় দিতে হবে, সময় লাগবে! সবাই মিলেই রোহানকে সাহায্য করতে হবে।
-আর তুই বউকে নিয়ে যা, ঘুরে আয়, আমি বাচ্চাদের দেখবো। রোহানের মন তো ভেঙ্গেছে, জোড়া লাগবে আবার। নতুন বউয়ের মন ভাঙ্গার কি দরকার!

বিয়ের দুদিন পর তারা ফিরে এলো ঢাকায় আম্মাসহ। রোহানের সাথে সম্পর্কটা একেবারেই খারাপ যাচ্ছে সাদী আর সুখীর, অর্পার সংগেও রোহান আগের সেই সখ্যতা রক্ষা করছে না, বরং প্রতি মুহূর্তে হিংসাসুলভ আচরণে সাদী অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে। এ বাড়ীতে এসে প্রথম রাত থেকেই শুরু হলো কঠিন পরীক্ষা-অর্পা রোহানের সাথে একই ঘরে থাকতে ইচ্ছুক। সাদী স্পেশাল অর্ডার দিয়ে মেয়ের জন্য একটি রুম রেডি করেছে চাটগাঁ যাওয়ার আগেই , মা ও মেয়ে দুজনের জন্যই ছিল তা এক
সারপ্রাইজ । প্রিন্সেস সাজসজ্জায় সজ্জিত রুমটি অর্পার খুব পছন্দ হলেও সে রোহানের সঙ্গে থাকার জন্য বায়না করে। আম্মা অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে দুই বাচ্চাকে নিয়ে এক ঘরে ঘুমাতে যান গল্প শোনানোর লোভ দেখিয়ে।

রোহান কিছুতেই অর্পাকে ছাড় দিতে রাজী নয়। বাবার কাছে তার অভিযোগ অর্পা ছিল তার স্কুলের বন্ধু , অর্পার মাকে বিয়ে করে সাদী সেই বন্ধুত্ব নষ্ট করেছে।

যতটা আনন্দ আর উচ্ছ্বাস ছিল বিয়ে করার জন্য, দাম্পত্য জীবন শুরু হওয়ার আগে সাদী এখন এই সংসারের ভবিষ্যত নিয়ে ততটাই সন্দিহান হয়ে পড়ে। সে সুখীর কাছে ব্যক্ত করে তার হতাশার কথা।
-আমি রোহানের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করেছি , আমি তো জানতাম সে কোনদিন রাজী হবে না!
সুখী শোনে সাদীর অব্যক্ত যন্ত্রণার কথাগুলো অশ্রুসজল চোখে।
-তুমি নিজেকে দোষ দিতে যেও না, তোমার কোন দোষ নেই, তুমি কোন কিছুর জন্য দায়ী নও! আমি আমার প্রিয় দুজনকেই একসাথে রাখতে চেয়েছি, হয়তো তোমাদের দুজনের প্রতি সঠিক বিচার করিনি, এজন্য আমি নিজেকেই দোষী মনে করি।
সাদীর গলা রূদ্ধ হয়ে আসে, সে চোখ মুছে আবার বলে,
-অন্যদিকে রোহানের মা-কেও ফিরিয়ে আনার ক্ষমতা আমার নেই!
এক হতাশাগ্রস্ত বিহ্বল বাবা ছেলের জন্য দুশ্চিন্তায় পূর্বতন স্ত্রীকে কবর থেকে ফিরিয়ে আনতে চান।
আম্মা সাতদিন থেকে চলে গেলেন আবার নিজের জায়গায়…সুখী আর সাদীকে নিজেদের সংসারে মনোনিবেশ করার জন্য উৎসাহ যুগিয়ে গেলেন। বাচ্চারা স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে, সুখী একমাসের ছুটি নিয়েছিল বিয়ে উপলক্ষে, আর সাদী তো পরদিন থেকেই অফিস করছে। সকালে সবাই বেরিয়ে গেলে সে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ছেলেমেয়ের কামরা গুছিয়ে রাখে, নতুন কিছু রান্নার চেষ্টা করে , যদিও রান্নার খালা প্রতিদিন আসেন, রোহানের পছন্দমত রান্না করেন। সুখীর একটু বেশী ঝাল খাওয়ার অভ্যাস, রোহান আর সাদী খুব কম ঝাল খায়, ওরা শুধু মাংস খায়, মাছ খেতে চায় না। আর সুখীর জীবন চলে না মাছ ছাড়া। এমন নানা অসংগতির সাথে আপোষ করেই নতুন জীবনকে আলিঙ্গন করে নিতে হয়েছে।
রোহানকে শাসন করা যায় না, আবার ওর সব আবদার মেনে নেয়াও মুশকিল। রোহান অদ্ভুত এক অস্থিরতার ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। বাবা আর ছেলের মধ্যে শূণ্যতা তৈরী হচ্ছে। সাদী রোহানের ব্যবহারে যে কষ্ট পায় তা অর্পার সান্নিধ্যে মিটিয়ে নিতে চেষ্টা করে। রোহানের সাথে যথাসম্ভব সময় কাটিয়ে বাকী সময়টা অর্পার সাথে বই পড়ে , নানারকম মেয়েলী খেলা নিয়ে মেতে ওঠে দুজনে। অর্পাও কম যায় না, সাদীকে নেলপলিশ লাগিয়ে, চোখ, ঠোঁট মেকাপে সাজিয়ে, চুলে ক্লিপ আটকে নায়িকা বানিয়ে তার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। প্রথমদিন বাবাকে ঐ অবস্থায় দেখে রোহান নিজেও হাসতে হাসতে খুন হয়েছিল। আবার নিজেকে শামুকের খোলসে ঢুকিয়ে নিতে দেরী করেনি।

সাদীর সাথে এখনও তার কেরিয়ারের ব্যাপারটি নিয়ে আলাপ করেনি সুখী। তবে তার ইচ্ছে নেই আগের চাকরিটিতে ফিরে যাওয়ার। সে ঘরে বসেই অনলাইনে হোম ইন্টিরিয়রের কাজে মনোনিবেশ করতে পারে, যা সে চাকরীর পাশাপাশি এতদিন করে এসেছে, কিছু আয়সংস্থান তো করতেই হবে। তার নিজস্ব পরিচিত কন্ট্র্যাক্টর দিয়েই কাজ করিয়ে নিবে। নাই নাই করেও সে একটি সংসার ফিরে পেয়েছে যেখানে স্বামী, সন্তান নিয়ে স্বপ্নগড়া আর স্বপ্নপূরণের সুযোগ আছে। বাচ্চারা স্কুল থেকে ফেরার পর তার উপস্থিতি খুবই দরকার। রোহান আর অর্পার মাঝে যেন ভাই-বোনের ভালোবাসা বজায় থাকে, বাবা আর ছেলের মাঝে যেন স্নেহ আর শ্রদ্ধার সম্পর্ক বজায় থাকে সে প্রচেষ্টায় সফলকাম তাকে হতেই হবে। নিজের জন্য চাওয়ার আর কিছুই নেই। রোহান তার সাথে ভদ্রভাবে কথা বললেই সে বর্তে যায়।

ছয়মাস পরঃ

খালার সাথে সম্পর্ক খারাপ হচ্ছিল, তার চাহিদা খুব বেড়ে গেছে। এভাবে চাহিদা পূরন করতে গেলে সুখীর সমস্ত সঞ্চয় শেষ হয়ে যাবে।সাদীকেও এ ব্যাপারে কিছু জানায়নি। তবে প্রতিবার খালার সাথে কথা বলার পর সুখীর মেজাজের পরিবর্তন দেখে বুদ্ধিমান সাদী ঘটনা আঁচ করে নেয়। খালা ইদানিং জুয়া খেলা শুরু করেছে পয়সার বিনিময়ে। প্রথম দিকে অনেক টাকা জিতে তার লালসা বেড়ে গেছে, পরে বেশী বড় দাও মারতে গিয়ে ধরা খেয়ে সুখীর শরণাপন্ন হয়েছে তার ধার মিটানোর জন্য। সাদী এই ব্যাপারটি সমাধানের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেয়। সে গিয়ে খালাকে পুলিশের ভয় দেখিয়ে গ্রামে তার পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেয়। ব্যাংকে পাঁচ লক্ষ টাকার ফিক্সড ডিপোজিট করে সুখীর নামে, প্রতি মাসের সুদের টাকা সুখী পাঠিয়ে দেয় গ্রামে। তারপরও খালা মাঝেমধ্যেই টাকার জন্য বিরক্ত করবে, সেটা জানা আছে। তবে আপাতত নিশ্চিন্ত হওয়া গেছে উটকো ঝামেলা থেকে।

নতুন সংসারের ভার সম্পূর্ণভাবে করায়ত্ত করে পরপর কয়েকটা ইন্টিরিয়রের কাজ সাফল্যের সাথে শেষ করে ফেললেও রোহানের মনোভাব একই জায়গায় আছে তার ব্যাপারে। সাদী দিনকে দিন আরও বেশী রোমান্টিক হচ্ছে, সুখীর উপর নির্ভরশীল হচ্ছে আর অর্পাকে চোখে হারাচ্ছে। রোহানের সাথে অর্পার সম্পর্ক কিছুটা উন্নতি হয়েছে, বড়ভাই হিসেবে নিজেকে মেনে নিয়েছে রোহান।

অর্পা যেদিন রোহানের নকল করে সাদীকে ‘ড্যাড‘ ডেকে উঠলো সেদিন রাতে তারা দুজনেই খুশীর অশ্রুতে নিজেদের ভিজিয়ে গভীর প্রণয়ে মগ্ন হয়েছিল।
সাদীর ইচ্ছে অর্পার মত দেখতে, বাকবাকুম বলার, কোঁকড়া চুলের আর একজন আসুক তাদের সংসারে। সুখীও স্বপ্ন দেখে একজন সাদীর যে তাদের দুজনের ভালোবাসার আশ্রয়ে বড় হবে।

আচমকা একদিন রোহান স্কুল থেকে ফিরলো প্রচন্ড জ্বর নিয়ে, দুদিন পর জানা গেল টাইফয়েড হয়েছে। সাতদিন ধরে প্রচন্ড জ্বর, বমিতে ছেলেটা মলিন হয়ে গেছে। সাদী আর সুখীর সমস্ত শান্তি উধাও। সুখী দিনরাত সেবা করছে, রোহান যদিও তাকে নিজের কাছে ঘেঁষতে দিতে চায় না, অসুস্থ শরীরে খুব একটা প্রতিবাদ করতেও পারছে না। কয়েকবার বমি করেছে সকাল থেকে রোহান, সাদীও আজ দুদিন পর কাজে গেল অর্পাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে। সুখী ছেলেকে পরিস্কার করে কাপড় বদলে সুপ বানাতে এসেছিল রান্নাঘরে। হঠাৎ শোনে অর্পা ডাকছে ক্ষীণ স্বরে ‘মিমি’ বলে, সে আবার কানপেতে শোনার চেষ্টা করে, কিছু শোনা যায় না। আর অর্পা কোত্থেকে আসবে, ওকে পৌঁছে সাদীও অফিসে চলে গেছে, সে জানে। কিন্তু আবার যেন শোনা যাচ্ছে… কাজ ফেলে এগিয়ে যায় করিডোর ধরে অর্পার রুমের দিকে। নাহ, কেউ নেই। পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো রোহানের ঘরের দিকে। হ্যাঁ, স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে, ‘মিমি’। ক্ষীণ, দুর্বল গলায় করুণ আর্তি শুনে সুখীর মাতৃহৃদয় ভালোবাসার কানায় কানায় উপছে উঠে। চোখের পানি আজ আর বাঁধ মানছে না।

কে বলেছে পৃথিবী থেকে সম্পর্ক, ভালোবাসা আর শিকড়ের টান উঠে যাচ্ছে? ভালোবাসার বীজ রোপণ করলে তা থেকে চারাগাছ গজিয়ে শাখা প্রশাখায় পল্লবিত হয়ে ফুল, ফলে সমৃদ্ধ হবেই। সার, মাটি আর পানির অভাব হলেই সে গাছ বিকশিত হতে পারে না। একটি দুর্ঘটনা বা দুঃস্বপ্নই মানুষকে হারিয়ে দিতে পারে না, ঘাত প্রতিঘাতে সিদ্ধ হয়েই জীবনের মর্ম বোঝা যায়।
আর, ভালোবাসা এক অনুশীলনসাপেক্ষ ব্যাপার । ভালোবাসার জন্য শুধু দিয়ে যেতে হয়, প্রতিদান চাইতে নেই।

সমাপ্ত

https://ochinpurexpress.com/%e0%a6%ae%e0%a6%a8%e0%a7%8b%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%a4/%e0%a6%ae%e0%a7%87%e0%a6%98%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%96%e0%a7%87%e0%a6%b2%e0%a6%be-%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ac-%e0%a6%9a%e0%a6%ac%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%b6/

অচিনপুর ডেস্ক /এসএসববি

Post navigation