মায়ের ডায়েরি

বন্যা হোসেন
অটোয়া, কানাডা।

গল্প: মায়ের ডায়েরি

বিছানায় শুয়ে সিলিংয়ের পাখাটার দিকে তাকিয়ে আছি। পাঁচটা ব্লেড, দেশে পাখার তিনটা ব্লেড দেখতেই অভ্যস্থ। পাখার গোল মাথার নীচ থেকে একটা বড় বাতি ঝুলছে। একটুও ঝুল, ময়লা লেগে নেই। এদেশে ধূলা নেই।

ফ্ল্যাটটার কাঁচের বড় জানালাগুলো সবসময়েই বন্ধ থাকে। বারান্দার দরজাও খুব কম খোলা হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় কাঁচের ওপারে কি টুটুলের মুখ? একটু হতাশ, একটু বিমর্ষ?

প্রথম কদিন এখানে এসে আমি ইচ্ছে করেই ঘড়ির সময় বদলাই না। ঢাকার সাথে দশ ঘন্টার পার্থক্যটা মাথায় রেখে দুদেশের পরিস্থিতিকে এক সূতায় গাঁথতে ইচ্ছে হত। ঢাকায় লালমাটিয়ার বাসায় বেডরুমের ঘড়িতে বাজে বিকেল পাঁচটা ।

ভাইয়া গতকাল ফোনে বললো, ‘ভ্যাপসা গরম পড়েছে শীলু। ইলেকট্রিসিটি চলে গেলেও আইপিএসের কল্যাণে একটু আরাম হয়েছে।’ প্রিয় ভাতিজা দীপ্ত জিজ্ঞেস করে, ‘ফুপী ওখানে কেমন ঠাণ্ডা?’

এখানেও খুব গরম পড়েছে। দুপুরে রোদে বেরুলে খুব কষ্ট হয়। কেমন যেন শুষ্ক ঝাঁঝালো গরম। সন্ধে আটটা পর্যন্ত খুব গরম। সূর্য অস্ত যায় রাত নয়টায়। এত লম্বা দিন, শরীরের ভিতরটা কেমন করে।

হাতঘড়ি ঠিক করে নিলাম এখানকার সময়ের সাথে মিলিয়ে। অসুবিধে হচ্ছে হিমেলের বেরনোর সময় , খাওয়ার সময় —–এখানকাার সময় আর ঢাকার সময়ের সাথে মিলাতে যেয়ে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
এখন এই সকাল ছটাতে আবার একটু শীত করছে। রেশমের লেপ দিয়ে ঢাকা বুক থেকে পা পর্যন্ত। সারা দিন-রাত নিঃশব্দে চলে এসি। ডাইনিং রুমে এসির সুইচ। একটা বিশেষ আরামদায়ক তাপমাত্রায় সর্বক্ষণ থাকে হিমেলের ফ্ল্যাটটি। বাড়ি, গাড়ী, শপিং মল, বাস, ট্রেন সর্বত্রই এসি লাগানো ।

আজ দশদিন হল এসেছি, আরও একমাস থাকবো। অনেকদিন পর যেন পরিপূ্র্ণ সুখের অনুভুতিতে আছি। হিমেলের সান্নিধ্যে আরও একমাস, অনেকটা সুন্দর সময় এখনও হাতে আছে। কিন্তু এই সময়টা ফুুরিয়ে যাবে, দেশে ফিরতে হবে, ছুটি ফুরিয়ে যাবে। আর সেই সত্যিকারের প্যাচপ্যাচে গরম, বৃষ্টি,ধূলা, ভীড়, জ্যাম, মানুষজনের চিৎকার, চেঁচামেচি —-এই সব ঠেলে জীবনযাপন করতে অভ্যস্থ হয়ে যাবো।

হিমেলের কি মনে হচ্ছিল মা দেশে গরমে কষ্ট পাচ্ছে? তা-ই কি এসময় নিয়ে এল মাকে? হিমেলের প্রতি অসম্ভব মায়া আমার, তীব্র টান—–কি করবো, একমাত্র সন্তানের জন্য এমনটাই হওয়ার কথা। টুটুলের অনুপস্থিতিতে আমি একাই এই উথাল-পাথাল ভালোবাসার মায়াটাকে বাড়িয়ে চলেছি।

হিমেল এখনও ঘুমাচ্ছে। ওর মোবাইলে সাতটায় অ্যালার্ম বাজে। সাতটায় উঠে ছেলেটা শাওয়ার, নাশতা সেরে অফিসে বের হয়। অ্যালার্ম যদি না বাজে এই ভয়ে আমি আগেই উঠে পড়ি রোজ। ছেলে হাসে আমার এই অকারণ দুঃশ্চিন্তা দেখে।

”তুমি যখন থাক না আমি কি উঠি না? তাছাড়া, আমার অফিসে ওরকম ঘড়ি ধরে পৌঁছানোর নিয়ম নেই। যখনই পৌঁছাই না কেন কাজ শেষ করার দায়িত্ব আমার নিজের।’
আশ্চর্য হই, হিমেলের কথা শুনে । আমাদের দেশে এমন নিয়ম চালু করলে কেমন হয়?

ছেলের ঘরে এসে বিছানায় বসি। ওর পিঠে হাত রেখে আনমনে ঢাকার লালমাটিয়ার বাড়িটির কথা মনে হয়। হিমেলের দাদুর তৈরী বাড়ি। টুটুলের সঙ্গে বিয়ের পর একতলায় দুটি ঘর বরাদ্দ হয়েছিল আমাদের জন্য। হিমেল এদেশে আসার পর থেকে ওর ঘরটা খালি পড়ে থাকত। দেবরের ছেলে অনিন্দ্যকে বলে দেই ওখানে পড়ার জন্য। যখন হিমেল ফিরবে দেশে, তখন দেখা যাবে।
জমিলা এসে ঘরের কাজগুলো করে দিয়ে যায়। সে এখন গ্রামের বাড়ি গেছে, বরিশালে ওর বাড়ি। ওখানে প্রচণ্ড ঝড় হয়েছিল, ওদের গ্রামের বিধ্বস্ত অবস্থা, খাবার পানির মহাসংকট। টিভিতে দেখাচ্ছে কিশোরী মা মরা বাচ্চা কোলে নিয়ে বোবা চোখে তাকিয়ে আছে, তৃষ্ণার্ত মানুষ হাহাকার করছে। রিলিফ সামগ্রী পৌছানো সম্ভব হচ্ছে না।

হিমেলের টিভিতে কেবল নেই, ল্যাপটপে দেশের খবর দেখে নিই। রেশমের লেপমোড়া শীত শীত করা এই গরমের সকালে জমিলার উদ্ভ্রান্ত মুখ, কান্নাভেজা চোখ, উষ্কখুষ্ক চুলসহ চেহারাটি মনে আনার চেষ্টা করছি। জমিলার ছোট ভাইটার খবর পাচ্ছে না, ফোনে জানিয়েছে। সারা বছর ধরে ভাইয়ের জন্য কত কিছু জমা করে…শার্ট প্যান্ট, গেন্জী,খাতা, কলম,পেন্সিল, কারো বাতিল করে দেয়া ভিডিও গেম। ওর ভাইটা কোথায় হারিয়ে গেল, ভাবতেই গা শিরশিরিয়ে উঠল।

এখানে অখণ্ড স্তব্ধতা চারদিকে। মাঝে মাঝে যেন পাখির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। অ্যালার্ম বাজে। ছেলের চুলে হাত বুলিয়ে ওকে জাগিয়ে দেই।
আহ্ মা আর দুমিনিট, আর ত্রিশ সেকেণ্ড বলে না ছেলে কলেজ জীবনের মত, বরং নিঃশব্দে হাসিমুখে উঠে পড়ে।

হিমেল একটু ভারী নাশতা করে সকালে। দুধ,ওটমিল, মধু, ডিম, রুটি, চীজ, ফল। আমি মগ্নভাবে ফল কাটছি–পিচ, আপেল যেন সারাজীবন ফল কাটাতেই পারদর্শিতা অর্জন করেছি।

শাওয়ার থেকে বেরিয়ে নিজের হাতে ইস্ত্রি করা কাপড় পড়ে হিমেল, আফটার শেভ আর সুগন্ধী জেল এর বলয়ে সজ্জিত হয়ে হিমেল অফিস যাওয়ার জন্য তৈরী। কাচের ঝকঝকে গ্লাসে পানি এগিয়ে দেই রোজকার মতন। আর তখনই কিভাবে যেন জমিলার তৃষ্ণার্ত মুখখানা মনের মধ্যে ভেসে ওঠে। ফল কাটার ছুরিটা বুড়ো আঙ্গুলের কোণায় লেগে যায়।
রক্তে মাখামাখি হয়ে যায় পিচ ফলের টুকরা-একি! একি! বলে হিমেল ছুটে আসে, জোর করে হাত ধুইয়ে দেয়। ব্যাণ্ডএডের প্লাষ্টার লাগিয়ে দিয়ে রাগী গলায় বলে, ‘আর কখনও ছুরিতে হাত লাগাবে না মা’

অন্য দিনের মত নীচে নেমে ছেলেকে বিদায় জানাতে ইচ্ছে করে না, গোমড়া মুখে বসে থাকি ছুরিতে হাত না দিয়ে রান্না করবো কিভাবে। ছেলেটা দুপুরে এসে খেয়ে যায় মা এসেছে বলে। অফিস ওর কাছেই, একঘন্টার লাঞ্চ ব্রেক নেয়। কিছুতো রাঁধতে হবেই, রাইস কুকারে ভাত বসিয়ে মাছের ঝোল ,মুগডাল আর ফ্রোজেন সবজি করে নিই । আজ ছুরি ছাড়াই কাজ চালিয়ে নিলাম, বেশ গর্ব ভরা মনে ভাবছি, হিমেলকে বলব।

ছেলের ভাল লাগে না মায়ের পঞ্চান্ন বছর বয়সের জবুথবু ভাব। ঘরকুনো হয়ে বসে থাকা, তাকে ভাত, ডাল, মাছ, সবজি দেশী পদ্ধতিতে রান্না করে খাওয়ানো।
বাইরে ঝকঝকে দিন, ঘন নীল আকাশ, তরতাজা গাছগুলি সবুজ পাতার বাহারে সজ্জিত, প্রতিটি পাতায় আলোবাতাস লুকোচুরি খেলছে এমন সময়ে বাড়িতে কেমন করে সারাক্ষন থাকা যায়। হিমেল এখানকার নানা দেশের বৈচিত্র্যময় খাবারে অভ্যস্থ হয়ে গেছে গত পাঁচ বছরে। ওর ভাল লাগে ভিয়েতনামীজ, মেক্সিকান, গ্রীক রেষ্টুরেন্টে খেতে। এত বৈচিত্র্য আমার ভাল লাগে না, এত অপরিচিত খাবারের সমাহারে ভয় ভয় লাগেে।

হিমেল আমাকে বলে , ‘অফিস যাওয়ার সময় তোমাকে মিউজিয়ামে নামিয়ে দিয়ে যাই, তুমি সারাদিন ঘুরে বেড়াও, ফেরার পথে তুলে নেব।’
কোথায় দাড়াবো, তুই কোথায় খুঁজে পাবি আমাকে, আমার ফোন নেই…এসব বলে কাটিয়ে দেই ওকে। আজ বলে গেছে, ফোন নিয়ে আসবে।

আসলে ছেলেটা কাছে কাছে থাকলে ভাল লাগে, একা একা ঘুরে বেড়াতে আর ভাল লাগে না।
ঢাকায় পরিচিতরা এখানে আমাকে দেখলে অবাকই হবে, ছেলে অফিসে বেড়িয়ে গেলে দুপুরবেলার এই শীলার সাথে তাদের চেনা শীলার মিল কম।

কলেজের চাকরীর পাশাপাশি কিছু লেখা-লেখি সাহিত্যচর্চা সারাজীবনই করে এসেছি। বন্ধুবান্ধবের সাথে আড্ডা, গল্প,গেট টুগেদার, গানের অনুষ্ঠানে যাওয়া, আত্মীয় প্রতিবেশীদের দরকারে এগিয়ে যাওয়া সবই আন্তরিকতার সাথে করি।
বাড়িতে দেবর রেজা, ওর বউ সুমি আর ওদের ছেলে অনিন্দ্যর সঙ্গে খুবই ভাল সম্পর্ক-টুটুলের অনুপস্থিতিতে সম্পর্কে টান ধরেনি। রেজা আর সুমির অকৃত্রিম ভালবাসা আমি ঠিকই টের পাই।
এখানে এলে ছেলে নিয়ে যায় নানা শপিং মলে আর রেষ্টুরেন্টে, আর্ট আর ন্যাচারাল হিষ্ট্রীর মিউজিয়ামে সপ্তাহের শেষে। ডিনারের পর কোন মুভিতে নিয়ে যায়। তখনও আমি সামাজিক প্রাণী থাকার চেষ্টা করি।
দুপুরের নির্জন বাড়িতে আমি এক মগ্ন, মায়াবী অভিভাবক, এখানে আমি মা ও বাবা মেশানো এক ছায়ামূর্তি। অকারণেই ভ্যাকুয়াম ক্লিনার বের করে কার্পেট পরিষ্কার করি, ক্লিনিং লিক্যুইড দিয়ে কিচেনের হলুদ দাগ তুলি, ছেলের জামাকাপড়, বিছানার চাদর তুলে মেশিনে দেই ধোয়ার জন্য-অভ্যাসবশতই করি।
ভাবি, কোন দরকার আছে কি, ছেলে তো নিজেই সব কাজকর্ম করে নিচ্ছে সারাবছর। এদেশে সবাই তাই করে।

আসলে অনেকদিন পর টুটুুল এসে জুড়ে বসেছে মনের ভিতর। টুটুলের চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করছি একলা সন্তানের গৃহস্থালী। আর নানারকম খুঁত, নানাধরনের অভাব খুঁজে খুঁজে বের করছি।

ভেবে দেখলাম, লালমাটিয়ার বাড়িতে এভাবে টুটুল আসে না। হয়তবা নানা মানুষের আসা যাওয়া, নানাজনের সাথে আমার মেলামেশা তাকে স্বাচ্ছন্দ্য দেয় না। এখানে দুপুরের নির্জনতায় হিমেলের ফ্ল্যাটে সে ছড়িয়ে থাকে। নিজের অন্তিম অবস্থার ছবি থেকে বোধহয় তারও মুক্তি মেলে।

ছবিটা রঙিন ছিল কিন্তু হাড় হিম করা শীতল। কতদিন মুখে খাবার তুলতে পারিনি, রাতে ঘমাতে পারিনি, তখনও শাশুড়ী বেঁচে, সঙ্গে নিয়ে শুতেন আমাকে তার বিছানায়। ঘুমের ঔষধ খেয়েছি একটানা চার-পাঁচ বছর।

রিকশায় ছেলেকে নিয়ে খেলার মাঠে যাচ্ছিল টুটুল। পরমুহূর্তেই পেপারের হেডলাইন-ট্রাকের ধাক্কায় রিকশা পিষ্টঃ নিহত দুইজন, আহত শিশু। রিকশাওয়ালা সাথে সাথেই মারা যায়। ছেলে সুদ্ধ টুুটুল ছিটকে পড়ে উলটোদিকের রাস্তায়। ছোট্ট হিমেলকে সে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিল। মাথা ও মুখ চুরমার হয়ে যাওয়া টুটুল রক্তাক্ত অবস্থায় পড়েছিল ফুটপাথে। আহত হিমেল ধূলাকাদা মেখে বাবার কাছে বসে কাঁদছিল। ওখানে পৌঁছেই টুটুলকে টপকে ছেলেকে কোলে তুলে নেই। হাসি-খুশী জীবনপিয়াসী টুটুল এক মুহূর্তের যান্ত্রিক আঘাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।

তখন হিমেলের পাঁচ বছর, টুটুলের পয়ত্রিশ আর আমার ত্রিশ। শ্বশুর-শাশড়ী, দেবর, ননদ আর হিমেলকে নিয়ে টইটুম্বুর সংসার। সকালেও বের হওয়ার সময় কথা হল বিকেলে ফিরেই হিমেলকে নিয়ে খেলার মাঠে যাবে। আমার ক্লাস দেরীতে ছিল বলে সে আবদার করলো আমি যেন হালিম তৈরী করে রেখে যাই। প্রেসার কুকারে হালিম বানিয়ে চলে গেছি কলেজে। হালিম খেতে খুব ভালবাসতো। সেই হালিম কাজের লোকেরা এসে নিয়ে যায় রাতে।

জীবন যেন এক সাজানো ছবির অ্যালবাম। এক একটা ছবি কেউ ঘষে তুলে দেয়, এক একটা মানুষ সেই অ্যালবাম থেকে উঠে চলে যায়। বাকি ছবিগুলো দিয়ে কাজ চালিয়ে নিতে হয় কোনরকমে ।

কতদিন, মাস যেন সংজ্ঞাহীনের মত ছিলাম। কলেজ থেকে ছুটি নিয়েছিলাম ছয়মাস, হিমেলের প্রতি ভালবাসা, দায়িত্ববোধ সব চুরমার হয়ে পড়েছিল এক বড় রাস্তার ফুটপাথে। ধীরে ধীরে কবে যে জীবন স্বাভাবিক হল, রক্তাক্ত দৃশ্যপট বদলে পরিণত হল সাদা কালো স্মৃতিতে তা আর মনে নেই।
এত দিন পরে এখন এই বিদেশের নির্জন বাড়িতে আমি টুটুলের উপস্থিতি অনুভব করছি।
টুটুল তোমার মনে কোন কষ্ট নেই তো? তুমি কি ভাব টুটুল?
মা-বাবা, ভাইয়া এমনকি শ্বশুড়-শাশুড়ীও বিয়ের কথা বলেছে। শুনে কেমন যেন লাগতো আমার। মনে হত, ফুটপাথে পড়ে থাকা একটা শরীরকে ফেলে দিয়ে চলেছি বিয়ের কনে হতে। তাই ওপথে আর যাওয়া হয়নি।

হিমেলকে একাই মানুষ করেছি আমি। সবাই সাহায্য করেছে, কিন্তু আমি আমার সবটুকু দিয়েছি, বুকের সবটুকু উত্তাপ দিয়েছি ওকে। কিছু ভুল-ভ্রান্তি তো হয়েছে নিশ্চয়ই, কখনোই ওকে বেশী শাসন করতে পারিনি, তুমি পছন্দ করতে না। যখন ও জেদ করতো তখন এত অসহায় লাগতো।

তুমি চলে যাওয়ার পর ওর খেলার মাঠেও আমাকে হাজিরা দিতে হত, নয়ত ছেলের মুখ ভার। দাদা-দাদীকে চোখে হারাতো সে, কিন্তু তুমি নেই বলে ছেলেটা আমাকে আঁকড়ে ধরল। তবে দেখো টুটুল, ছেলেটা পরিশ্রমী নিজে নিজেই পড়ালেখা করে কিরকম স্বাবলম্বী হয়ে গেল।

হঠাৎ মনে হচ্ছে , তোমার সাথে কটা দিনই বা কাটিয়েছি। অল্প কয়েকটা দিন। বাইশ বছরে আমি তোমার বউ হলাম, পঁচিশে তোমার ছেলের মা, আমার ত্রিশে তুমি আমাকে ছেড়ে গেলে। আটবছর মাত্র।
তুমি চলে গেলে নাকি রয়ে গেলে, হিমেলের মধ্যে বাড়তে থাকলে তিলে তিলে।

হিমেলের কপালে ঝাঁপিয়ে পড়া কোঁকড়া চুল, ওর মিটিমিটি হেসে তাকানো, দুপা টেবিলে তুলে দিয়ে সোফায় বসে টিভি দেখা…কয়েকটা চেনা ভঙ্গি যেন অবিকল তোমার।

ছেলের কম্পিউটারে ছবি দেখছিলাম। কত জায়গায় বেড়াতে যায় হিমেল। এর মধ্যে আমেরিকার অর্ধেকটা যেন তার দেখা হয়ে গেছে। ওয়াশিংটন, অ্যারিজোনা, নেভাদা,সানডিয়েগো-ছবিতে ঠাসা তার কম্পিউটার -এখন তো প্রিন্ট করেনা কেউ। ধৈর্য ধরে সে ছবিগুলি দেখছি। একটি ফটোতে দেখি হিমেলের গলা জড়িয়ে বসে আছে এক বিদেশী কন্যা, হাসিতে ঝলমলে মুখ, সোনালী চুলের অপরূপা।
ওর গার্লফ্রেণ্ড হয়েছে নাকি? আমাকে বলেনি তো? বাবা থাকলে কি বাবাকে বলতো? কিভাবে জিজ্ঞেস করা যায় কথাটা?

সন্ধেবেলা অফিস থেকে ফিরে হিমেল চেঁচিয়ে বলে-উই আর গোয়িং আউট। শনি, রবির সাথে আর দুদিন ছুটি নিয়ে লং উইকএণ্ড বানিয়েছে। প্লেনের টিকেট কেটেছে, বেড়ানো হবে সানফ্রান্সিসকো।
আমার আর কি —ছুটির মধ্যে আর একটা ছোটাছুটি।

চারদিন গাড়ীটা থাকবে এয়ারপোর্টের পার্ক এণ্ড ফ্লাই জোনে। গাড়ী রেখে বাসে বসে চলে যাই এয়ারপোর্টের দরজায়। এখানে ভোর পাঁচটা। দেশে দুপুর তিনটা বাজে। জমিলা কি ফিরে আসবে?

হিমেল আমাকে বসিয়ে কফি আনতে গেছে, এরই মাঝে চিন্তার কোন এক ফাঁক দিয়ে জমিলার অশ্রুহীন চেহারাটা ঢুকে পড়ে। জমিলা জানিয়েছে, ভাইকে এখনও খুঁজে পায়নি। ওদের বসতবাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে, এই অবস্থায় বাবা-মাকে রেখে ও ফিরবে না ঢাকায়। রিলিফের জিনিষ কিছুই ও পায়নি। ঢাকা থেকে রেজা জিনিষপত্র টাকাপয়সাসহ লোক পাঠিয়েছে।
এয়ারপোর্টের ভিতরটা ঠাণ্ডা। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে হিমেল আসছে। কফি আর হাতে কি যেন—নিশ্চয় চকলেট চিপ কুকিজ—-ছেলেটা এত চকলেট খেতে পারে।

হিমেল এলেই শুরু হবে সুখানুভুতির টান, তাই এটুকু সময়ের মধ্যে দেশের কথা ভাবতে চেষ্টা করি। প্রতিদিন পেপারে পড়ছি শিশু ধর্ষণ, হত্যা। ধর্ষণ এখন নিত্যদিনের ঘটনা। তরুনী, যুবতী, শিশু, বৃদ্ধা নারী কারো রেহাই নেই। তার উপর চলছে পোশাকের শালীনতা নিয়ে বিতর্ক, বিকৃত মানুষের বিকৃত ভাবনা, খুন, হত্যা, জঙ্গী,বাড়িঘর ভাঙ্গার ছবি, ঝড়ে মানুষের দুর্গতি…কষ্ট হয় কি?

চোখ বুজে থাকি কপালের দুপাশ ধরে ভাবার চেষ্টা করি, কতখানি আমার কষ্ট টুটুলকে হারিয়ে, কোন কান্না জমে উঠছে কি, ছুটি ফুরোলে ফিরে যেতে হবে হিমেলকে ছেড়ে —নাহ্ মাথাটা ফাঁকা হয়ে আছে।

নিজেকে মনে হচ্ছে অ্যাকুরিয়ামে রাখা লালচে সোনালী মাছ …সাঁতরাচ্ছি , ঘুরছি, সবকিছু দেখছি, কিন্তু কোনকিছুর সঙ্গে যুক্ত হতে পারছি না…।
কি হল মা, মাথা ধরেছে? কফির ট্রে পাশে রেখে উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে আছে হিমেল।

ওকে কি এখন জিজ্ঞেস করা যায় ছবিটা কার?
ওই ছবির সঙ্গে অনেক কিছু জড়িয়ে আছে, ওর ভবিষ্যৎ, দেশে ফিরে আসা না আসা। কফিতে চুমুক দিয়ে বেশ ভাল লাগে…মনে হয়, ভালই তো হয়, যদি আমার ছেলে সোনালী চুলের মেয়েকে বিয়ে করে এদেশেই থাকে —ছবির মত সাজানো বাড়ি, গ্যারেজে পাশাপাশি দুটা গাড়ী—বদেশের যা অবস্থা, ভাংচুর, ভীড়, অব্যবস্থা আর অরাজকতার মধ্যে কিভাবে থাকবে।
মাকে হিমেল জানালার পাশেই বসতে দেয়। প্লেনটা এখানে খুব উচুঁ দিয়ে উড়ছে, নীচে খয়েরী জমিতে কেবল ভাঁজ, পাহাড়ের ভাঁজ, মনে হয় সারি সারি আদিম প্রাণীর শরীর যেন দাড়িয়ে আছে।
আমি একটু জুস নিলাম। আহ্ কি ভাল!

মনে হল হিমেলকে সুখে রাখতেই হবে । টুটুল তো তাই চেয়েছিল।
আমাকে যদি আরও একা হয়ে যেতে হয় বুড়ো বয়সে, এই পর্বতশেণীর নির্জনতার মধ্যে যদি পড়েও থাকতে হয়, তাহলেও হিমেলের সাফল্য দূর থেকে দেখে আরাম হবে আমার। একদিন দুর্ঘটনার রক্ত আর আঘাতের মধ্যে বসেছিল হিমেল, ওকে অক্ষত সম্পূর্ণ সুরক্ষার বলয়ে রাখতেই হবে আমার।

এখানে বেশ ঠাণ্ডা। সাগরের হিমধরা হাওয়া হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে। সমুদ্রের ধারের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে প্লাকার্ডগুলো দেখছিলাম, ‘বিয়ারের জন্য কিছু ক্যাশ দরকার বা সত্যি বলছি আমি ক্ষুধার্ত’ ইত্যাদি, মাথা নীচু করে যে বসে আছে তাকে গৃহহীন মনে হয়। একজন টুপি পেতে বেহালা বাজিয়ে চলেছেে । দৈনন্দিন দারিদ্র্যতা বড় শহর সাম্রজ্যবাদের ভাঁজে লুকিয়ে রাখে ।

‘মা, এখানে প্রতিদিন কিছু লোক কাজ হারাচ্ছে, দোকান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, অর্থনীতি দুর্বল হচ্ছে, অস্ত্র নিয়ে এরা রাজনীতি করছে বিশ্বজুড়ে, বর্ণবৈষম্য, স্বাস্থ্যনীতি এরকম আরো অনেক সমস্যা এদের।’

হিমেলের কথাগুলো শুনে হঠাৎ ভীষণ শীত লাগে, ভয় করে, ঠাণ্ডায় দাঁড়িয়ে থেকে মনে হতে থাকে একটা মেঘ এসে যেন হিমেলকে আড়াল করে দিল।
ঝকঝকে নীল আর চর্চিত সভ্যতার ভিতরেও রক্ত ঝরছে। ছেলেকে বলি, তুই দেশে ফিরেই আয় হিমেল। কবে আসবি?

হিমেল বলে, ফিরে আমি যাবই । এখানকার সম্পদ আমাকে টানেনি কোনদিন। তবে, মা, তোমাকে অ্যান্জেলার কথা বলিনি, আমার বান্ধবী। ও সমাজসেবা কর্মী। এখন গেছে আফ্রিকায় রুরাল হেলথে কাজ করতে। এরপর ও যাবে বাংলাদেশে। আমরা দুজনে মিলে কিছু করবো মা, একটা কোন প্রতিষ্ঠান করা যেতে পারে …স্বাস্থ্য, শিক্ষা সবকিছু মিলিয়ে…।

হ্যাঁ, ঠিক আছে, তবে জমিলাদের গ্রাম দিয়েই হয়ত শুরু করা যেতে পারে। তোর বাবাও হয়ত এরকমই চাইতো।
আমার কথায় হিমেল হাসে। বাবার স্মৃতি প্রায় মুছেই গেছে তার মনে। পঁচিশ বছর আগের কথা। কেবল মনে আছে মা এসে ওকে কোলে তুলে নিয়েছিল, মায়ের বুকের ভিতর সে কাঁপছিল, কাঁদছিল।
মা, তোমাকেও কিন্তু কাজ করতে হবে আমাদের সঙ্গে। হিমেল হাসে।
সমুদ্রতীরে বেহালায় মোর্ৎসার্ট বাজছে। মনের মধ্যে ভেসে আসা সুরকে অন্তরে ভরে নিচ্ছি। টুটুল আর হিমেল তো আমার পাশেই আছে।

অচিনপুর/ শারমীন সুলতানা ববি

Post navigation