মন জানালায় কিছুক্ষণ

অমিতা মজুমদার
ঢাকা।

স্মৃতি কথাঃ মন জানালায় কিছুক্ষণ

দক্ষিণবঙ্গ থেকে ঢাকায় আসার বাড়তি পাওনা।

আজকের ঢাকায় আসা আর আজ থেকে ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে ঢাকায় আসার অভিজ্ঞতাই বলি বা আনন্দ বলি আকাশ-পাতাল তফাৎ। আমি প্রথম ঢাকায় আসি ঊনআশি সালে। তখন ষ্টীমার ছাড়া সমগ্র দক্ষিণবঙ্গের ঢাকাগামী যাত্রীদের বরিশাল থেকে সম্ভবত দুই-তিনখানা লঞ্চ ছিল তাতেই আসতে হত। তাই ব্যাপারটা বেশ চিড়া-মুড়ি, জল নিয়ে গুছিয়ে দূরদেশে যাত্রার মত ছিল।বিছানাও নিতে হত। সাধারণ যাত্রীদের পক্ষে স্বল্পসংখ্যক বিলাসবহুল কেবিনে যাতায়াত সম্ভব ছিল না। তাই চাদর বিছিয়ে তাতে বসে শুয়ে আসা-যাওয়া করতে হত বেশিরভাগ মানুষের। আমার প্রথম আসাটা ছিল একটা পরীক্ষা দিতে। তাই অনেক দ্বিধাদ্বন্দের পর বড়দাকে রাজী করিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে বুকের দুরুদুরু কাঁপুনি নিয়ে রওয়ানা হয়েছিলাম। যখন বরিশাল এসে পৌঁছুলাম লঞ্চ প্রায় ছেড়ে দেয়। এমভি মাসুদ, না যেন এমভি সামাদ নামক একটা বিশাল লঞ্চের ডেকে একটু ফাঁকা জায়গা পেয়ে কোনরকমে বসলাম। তখন এই যে অজানা অচেনা সহযাত্রীরা মিলে পাশাপাশি গাদাগাদি করে রাতভর আধো ঘুম আধো জাগরণে আসা-যাওয়া করত তাতে খুব একটা কারো অস্বস্তি ছিল না। কারণ তখন এই একরাতের পথযাত্রায় সহযাত্রীদের প্রতি ছিল না সন্দেহ বা অবিশ্বাস। দেখা যেত পাশাপাশি যেতে যেতে কখন এক পরিবারের মত হয়ে গেছে নিজেদের অজান্তে। খাবার ভাগ করে খাওয়া, গল্প করা কোন কিছুতেই আজকের দিনের মত সন্দেহ ছিল না। এখন তো কেউ কিছু দিতে বা কারো কাছ থেকে কিছু খেতে যাওয়ার আগে দশবার ভাবে এর পেছনে উদ্দেশ্য কি? যাইহোক এই যাত্রায় সবচেয়ে মজার ব্যাপার ছিল যারা তাস খেলতে পারে তাদের জায়গার অভাব হত না। দেখা যেত চারজন মিলে খেলা শুরু করেছে, পাশে বসে দাঁড়িয়ে দেখছে আর দশজন। একসময় একজন ভুল খেলছে, পাশ থেকে একজন বলে দিচ্ছে অন্য তাস খেলতে। এভাবে কখন হাত বদল হতে হতে তারা কেমন বন্ধু হয়ে যেত। তবে আমার ভালো লাগত রাতের পদ্মা। বিশেষ করে সে রাত যদি হত কৃষ্ণ পক্ষের। সে সময় বিদ্যুতের এতো রমরমা ছিল না বিধায় মনে হত গাঢ় কালো চাদরে ঢাকা চারপাশ আর তার মাঝখান দিয়ে টিমটিমে একটা আলোকরশ্মি পথ কেটে চলছে ধীরে ধীরে। আর সেই আঁধারের মাঝে দূর থেকে দেখা যায় একটা আলোর মালা পদ্মার পার ঘেঁষে নাচছে।মালাখানি আশ্চর্যরকম ভাবে জলের উপরে এবং জলের নীচে সমান ছন্দে নাচছে। তখন তো পদ্মার এপার ওপার ছিল না।সেই কুল নাই, কিনারা নাই আর কি। সেই পদ্মায় রাতভর ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকায় কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে জেলেরা মাছ ধরত। ছোট ছোট নৌকাগুলি একটার সাথে আর একটা যেন গায়ে গায়ে মিলে থাকত। আর সেই কুপিগুলি যার ছায়া পরত নদীর জলে তারা ঢেউয়ের তালে আর বাতাসের দোলায় এই আলোর মালাখানি গেঁথে রাখত। সে ছবি যারা দেখেছে তারাই জানে কি অপরূপ তার আকর্ষণ। এতো গেল মাঝ রাতের কথা। সূর্যাস্ত আর সূর্যোদয় তার অনির্বচণীয় সৌন্দর্য না হয় অন্য কোনদিন বলব। এর সাথে আছে সদরঘাটের নানারকম শব্দ, দৃশ্য যা নৌপথে না গেলে জানাই হত না। আছে বরিশালে পৌঁছুতে পৌঁছুতে সকালের নাস্তা হিসেবে পাওয়া নারকেল কোরা সহযোগে চিড়া ভাজা, সেদ্ধ ডিম যা অমৃত সমান। আরো পাওয়া যেত মিস্টি, পরোটা (এখনকার মত ভেজাল নয়)। যাই হোক “ধান নদী খাল এই তিনে বরিশাল” আর সেই বরিশাল থেকেই সমগ্র দক্ষিণবঙ্গের মানুষদের ঢাকায় আসার সহজ এবং সাধ্যের মধ্যে ছিল এই নৌপথ। দক্ষিণবঙ্গের অনেক মানুষ এখনো সড়ক পথে চলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে না। আগে একটি প্রচলিত গল্প ছিল যেটা বলার লোভ সামলাতে পারলাম না।
আগে দক্ষিণবঙ্গের কেউ ঢাকায় আসার আগে যারা ঢাকায় থাকেন তাদের ঠিকানা নিয়ে আসতেন। সদরঘাট এসে পকেট থেকে ঠিকানা বের করে দেখতেন কার বাসায় সহজে যাওয়া যায়। সেখানে গিয়ে রাতভর যাত্রার ক্লান্তি দূর করে প্রাকৃতিক ক্রিয়াদি সারাসহ স্নান করে নাস্তা সেরে একটা ঘুম দিত। তারপরে উঠে নিজের কাজকর্মের ব্যাপারে চিন্তা করতেন। ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগেও ঢাকায় চাকুরীর, ভর্তির্পরীক্ষা, চিকিৎসাসহ নানারকম অফিসিয়াল কাজে যারা আসত তাদের যাত্রা এবং গন্তব্য এরকমই ছিল। যাদের বাসায় উঠতেন তারাও রক্তের সম্পর্ক নাহলেও সহজভাবেই এই উপদ্রবটুকু মেনে নিতেন।
এখন গ্রাম, পাড়া বা দূর আত্মীয় তো দূরের কথা, একই পরিবারের বা নিকট সম্পর্কের হলেও কেউ কারও বাসায় না উঠে হোটেলে ওঠায় নিজে যেমন স্বস্তি বোধ করে, তেমনি কাউকে অস্বস্তিতেও পরতে দেয় না।

অচিনপুর ডেস্ক/ জেড. কে. নিপা

Post navigation