ভুবন জোড়া মায়া (পর্ব-চৌদ্দ ও শেষ)

সুরভী হাসনীন
উত্তর পীরেরবাগ, ঢাকা।

ভুতনগরঃ ভুবন জোড়া মায়া (পর্ব-চৌদ্দ ও শেষ)

সকাল থেকে গা ম্যাজম্যাজ করছিল দিলারা বেগমের। মগবাজার রেললাইন বস্তির ডান পাশে মাইকের গলির তিন দোকান পরে জামশেদ হুজুরের দাওয়াখানা। রেললাইন ধরে যেতে যেতে হালকা হাসে দিলারা। কত স্মৃতিঘেরা এই পথ। নাসিমা, লুলু বুজি, রাবেয়া, জাহানারা, দিলারা, সবাই মিলে ছুট লাগাত বড় হুজুরের পেছনে। জামশেদ হুজুর গত হবার পর মোসতারিনা বুজি এই দাওয়াখানা টিকিয়ে রেখেছেন। স্বল্প আয়ের মানুষদের চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথি বেশ বড় একটা অংশ জুড়ে থাকে। দিলারার ভাষায় কবিরাজী ঔষধ।

গতকাল সারাদিন ধরে সুলায়মান তদারকি করে দেয়াল তুলেছে পশ্চিম অংশে। দেয়াল তোলার আগে দুপাশের বিল্ডিংয়ের ঢালাই ভেঙেছে আম্মা। সবাইকে সরিয়ে দিয়ে নিজের হাতে তামার পাত্রে আল্লাহ্ রাসুলের কালাম লেখা পাত গেড়েছেন মাটির ভেতর। দুরাকাত নফল নামাজের পর আসরের নামাজের আগে দেয়াল তুলার কাজ করিয়েছে সুলায়মান। শেষে সকলে মিলে আসরের নামাজ আদায় করেছে দেয়ালের অপর পাশে। কথিত আছে, বড় হুজুরের সময় থেকে এখানে মানুষ ছাড়াও আর একদল সৃষ্টির জীব বাস করেন। তারা ইবাদত করেন। তাদের বিরক্ত করলে তার ফলাফল ভালো হয় না।

সুলায়মান কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে পরে। বেলায়েত ছেলেটা এই দেয়াল ভাঙার পর পর বেশ আনন্দিত ছিল। লেখাপড়ায় মনোযোগী। হাসিখুশি থাকত বেশ। দেয়ালটা কি তবে একটা অলিখিত চুক্তি এই জাহানের দুই সৃষ্ট জীবের মধ্যে! বুঝতে গেলে মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে সুলায়মানের। পেছন ফিরতেই দেখে এক দৃষ্টিতে বেলায়েত তাকেই দেখছে। কিছুটা দুঃখ, কিছুটা ক্রুরতা ভরা সে তের বছরের সামান্য বালকের চাহনি অসহ্য ঠেকে তার কাছে। নামাজের পাটি গোছানোর নির্দেশ দিয়ে সে বেরিয়ে যায়।

-তিনটা তিতা গোল্লা এক লগে, আর দুইডা মিডা গোল্লা একলগে, তিন বেলা কইরা সাত দিন। ফিস দিবা একশত পাঁচ টেকা। এক নিঃশ্বাসে কথা বলে থামে মোসতারিনা আপা।

– আশি টাকা দেই, আপন মানুষ আপনে, সব সময় আহি, হাসি মুখে দিলারা জিজ্ঞেস করে।

-শোন দিলারা, আব্বায় আর বড় হুজুরে তোমারে স্নেহ করত, কেন জানো? তুমি বাটপারি কর না। তোমার দিল সাচ্চা। দেও আশি টাকাই দেও। তয় তুমি একটু সবধানে থাইক। জয়নাল ফোন দিয়া তোমার কথা জিগাইল। কি হইছে মাদ্রাসায়। কও তো।

দিলারা বড় করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কি বলবে আপাকে সে। কোথা থেকে শুরু করবে। সব যেখানে তালগোল পাকিয়ে আছে,কার থেকে কোন কথায় সে সবটুকু বলে বোঝাবে। আদৌ পারবে তো বলতে? জয়নাল কেন ফোন করেছে। সে এখানে এসেছে কে বলল? কাকে বলল? তার বাইরে থাকাটা কার দরকার?
রুকসানা খুব করে সাজে। নীল সালোয়ার, লাল কামিজে ঘুরে ফিরে আয়না দেখে। লাল নীল শেডের ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে নেয়। বুকের কাছটায় হাত বোলায়। এখানে কত কষ্ট লুকানো আছে। সেই যে আব্বা আম্মা একসাথে এক্সিডেন্টে মারা গেল। তারপর উচ্ছিষ্টের মত ঘুরেছে। সব শেষে ঠাঁই মিলল এখানে।

দিনতো ভালই কাটছিল। হঠাৎ ঝড়ে সব তছনছ হয়ে গেল। জীবনটা লজ্জায়, কষ্টে শেষ করতে গিয়েও করেনি। ততদিনে কেউ জানিয়েছে, আসছে পৃথিবীতে। সেই অদেখা আপন কেমন হত? যদি আসত পৃথিবীতে। কান্নায় দমক ওঠে রুকসানার। পেটের ওপর হাত রাখে। চুপিচুপি কথা বলে হেসে দেয়। চোখের কোনায় লেপ্টানো কাজলে তাকে কতটা ক্রুব্ধ বাঘিণীর মত দেখায়।

কুসুম মেয়েটা কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়েছে। দরজায় তালা ঘুরিয়ে বুকের ভেতর চাবি রাখে। কাজ শেষে ফিরলে তালা খুলে দেবে রুকসানা। মাছুম হুজুর কত দিন বাদে রুকসানাকে দেখবেন। আচ্ছা কেমন হবে মুখটা দেখার পর!

দিলারা বেগম ধীর পায়ে দাওয়াখানা থেকে বের হয়। রহমত মাস্টার যদি জামশেদ হুজুরের দাওয়াখানায় এসে উনার ছোট মেয়েকে বিয়ে করে, তাহলে নাসিমার পেটে কার সন্তান ছিল? মাছুম বিয়ে পরানো শেষে চলে গিয়েছিল। নাসিমার লাশ সবচেয়ে আগে দেখে খোদেজা। খোদেজার চিৎকারে মাছুম দৌড়ে বেরোবার পর তার পেছন বাকি সবাই যায়। চোখে অন্ধকার সয়ে সন্ধ্যে আসার আগে খুব কাছ থেকে, একদম শরীর ঘেঁসে একটা পাগলি বিড়বিড় করতে করতে যায় -তারে নিয়া দে দিলারা, তারে নিয়া দে, রাইতের পর দিন আহে রাইত যে নাই বেশি।

শেষপর্ব

ঘুম থেকে কুসুম জেগেছে অনেকক্ষণ। দরজা খুলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে বসে থেকে হাদিস পড়তে বসে।

” একদা এক ইয়াহূদী পাদরী নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে এসে সম্বোধন করে বলল, হে মুহাম্মাদ! অথবা (বলল) হে আবুল কাসিম! “কিয়ামাতের দিন আল্লাহ তা‘আলা আকাশমণ্ডলীকে এক আঙ্গুলে, জমিনসমূহকে এক আঙ্গুলে, পাহাড় ও গাছপালাকে এক আঙ্গুলে; পানি ও মাটি এক আঙ্গুলে এবং সকল প্রকার সৃষ্টিকে এক আঙ্গুলে তুলে ধরবেন। তারপর এগুলো দুলিয়ে বলবেন, আমিই বাদশাহ্‌, আমিই অধিপতি”। পাদ্‌রীর কথা শুনে রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিস্ময়ের সাথে তার সত্যায়ন স্বরূপ হাসলেন। অতঃপর তিনি পাঠ করলেনঃ (অর্থ) “তারা আল্লাহর যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করেনি। কিয়ামাতের দিন সমস্ত পৃথিবী তাঁর হাতের মুষ্ঠিতে এবং আকাশমণ্ডলী থাকবে তাঁর ডান হাতের মুঠোয়। পবিত্র ও মহান তিনি, তারা যাকে অংশীদার স্থাপন করে, তিনি তার থেকে অনেক উর্ধ্বে” (সূরাহ্‌ আয্‌ যুমার ৩৯ : ২৭)। (ই.ফা. ৬৭৮৯, ই.সে. ৬৮৪৩) “

সুবহানাল্লাহ, আল্লাহ পাক মহান। কুসুমের চোখ ভিজে আসে। জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়ায় দুরাকাত নফল ইবাদতের জন্য। অজান্তে চোখ দিয়ে টপটপ পানি পরে জায়নামাজ ভিজে যায়। মায়ের মুখ মনে পড়ে না। বাবার আর সৎ মায়ের নিষ্ঠুর অত্যাচার থেকে বাঁচতে এই মাদ্রাসায় মামা ভর্তি করে দিয়েছিল। সুন্দর স্বপ্নের মাঝপথে মাছুম দৈত্য তার প্রাণ পাখি নষ্ট করে দিয়েছিল। দিলারা বুজি যেন আবার সে স্বপ্নে বাঁচার আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছেন। কৃতজ্ঞ চিত্তে স্রষ্টার উদ্দেশ্যে সিজদায় নামে কুসুম।

দিলারা অনেকক্ষণ ধরে দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। দারোয়ানকেও দেখছে না বাহিরে। সব কোথায় গেল। সুলায়মান সদরঘাট গেছে মাদ্রাসার জন্য বেডিং কিনতে গেছে। কাল রাতে ছয় কন নতুন ছেলে ভর্তি হয়েছে মাদ্রাসায়। অনেকক্ষণ ধাক্কিয়ে ক্লান্ত দিলারা পাশের চায়ের দোকানে বসে পরে। কয়েকজন কাস্টমার একটু সরে বসে বয়স্ক একজন মহিলাকে জায়গা করে দেয়। আজকে দোকানটায় একটু বেশি ভীড়। কারণটা একটু পর বোঝে দিলারা। মাছুম হারামজাদা মাদ্রাসায় এসেছে আজ? কখন এল সে? এতটা সাহস সে দেখাল কিভাবে। দ্রুত মাথায় চিন্তার জট গুটিয়ে নেয় দিলারা। রুকসানা আর কুসুম মাদ্রাসায় আছে। সিতারা চলে গেছে কিছুদিন হল। রুকসানার শরীর এখনও দুর্বল। শরীর যতটা দুর্বল নয় তার থেকে বেশি দুর্বল তার মন। নামাজে দাড়ালেও কেঁপে কেঁপে বসে পরে। মেয়েটা দুর্ঘটনাটার জন্য নিজেকে দায়ী ভাবে। অনেক বুঝিয়েছে সিতারা। কুসুমের বয়স কম। কুসুম বুঝটা নিলেও রুকসানা গ্রহণ করতে সময় লাগবে। পেটের সন্তান নষ্ট করার মত নিকৃষ্ট আর কষ্টের একটা বিষয়ের মধ্য দিয়ে গেছে নাজুক মেয়েটা কুসুমের সাথে বেলায়েতের বন্ধুত্ব অনেকটা সাহায্য করেছে ওকে। বেলায়েতের ও একটা সমস্যা আছে। সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে সে পাশটা বন্ধ করে দিয়েছে দিলারা। সে বিষয়ে আরো পরে ভাবা যাবে। এখন মাছুমের বিষয়টা তাকে অস্থির করে তোলে।
হুক্কা টানা মাছুম হুজুরের নতুন নতুন মেয়ে মানুষের মতন শখ। এই পুদিনা ফ্লেভারের হুক্কাটা এবার সৌদি থেকে তার এক মুরিদ পাঠিয়েছে। নতুন এই মক্কেলটা তাকে পীর মানে। বেশ শাঁসালো লোকটা। একবারে পঞ্চাশ হাজার পাঠিয়েছে। টাকাটার সাথে আরো কিছু যোগ করে ছেলের সারা বছরের কলেজের ফিস দেয়া শেষ। এই ছেলেটাকে পুলিশে দিতে পারলে সে নিশ্চিন্ত। লোকমানকে কোনদিকে সরিয়ে দিতে হবে। অনেক কিছু জেনে গেছে। নতুন করে কাউকে ধরতে হবে।

দরজায় খুটখুট শব্দে হাসি আসে মাছুমের। কুসুম মেয়েটা এসে গেছে। নতুন কাঁচা মেয়েটার শরীরে এখনও নরম নরম একটা ভাব। রুকসানার ভুলটা এই মেয়েটার সাথে করা যাবে না। প্যাকেটটা বালিশের নীচে চালান করে দরজার দিকে এগোয় মাছুম।
-দরজা বন্ধ কর কুসুম।
-দরজা বন্ধ হুজুর।
-খাটে বয়, আমি মেসওয়াক কইরা আহি।

বাথরুমের দিকে আগাতে গিয়ে মাছুম খেয়াল করে না দরজাটা বন্ধ হয়নি। সে ফাঁক গলে আবছা ধোঁয়াটে কিছু ভেতরে ডুকেছে রুকসানার শরীর ঘেঁসে। খাটে বসে রুকসানা। একটু খেয়াল করলেই দেখতে পেত তার পাশেই এক ছায়াঘেরা অবয়ব ঘেঁসেছে নীরবে। গড়গড়া শেষে বের হয়ে বাতি নেভায় মাছুম। উত্তেজনায় খাটের দিকে তাকাতে ভুলে গেছে। বউ মাতারিটা এখন আর আগের মত আনন্দ দেয় না। আবার বিয়ে করার কথা বললেই দিলারার কথা বলে, থানা – পুলিশের ভয় দেখায়। আহা দিলারা, বুকের কাছে পশমে হাত বোলায় মাছুম। নাসিমা টাও। দিলারা পালিয়ে না গেলে ওকেই রাণী বানিয়ে রাখত। নাসিমাটা বেশি গোলমাল পাকিয়ে ফেলেছিল। পেট বাঁধিয়ে বসেছিল এখনকার রুখসানা মাতারিটার মত। ভাগ্য, দিলারাকে বিষয়টা জানানোর সময় পায়নি নাসিমা। দিলারার সাথে মাছুমের বিয়ের খবরে ছুটে আসছিল সেদিকে। খাদিজা পথেই রুমে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। আর হাত পা বেঁধে অপেক্ষা করছিল মাছুমের।খাদিজাটাও কি বোকা ছিল। দিলারাকে তালাক দিয়ে ওকে বিয়ে করবে কথা দিয়েছিল মাছুম। আহারে, খাদিজার মউতটা অন্যরকম হয়েছে। সব ঐ জ্বীনের কান্ড। দিলারা এই কাজটা ভালো করেছে। জায়গা বন্ধ করে দেওয়াল তুলে দিয়েছে।

অন্ধকারে কুসুমকে বুকে টানে মাছুম। এক ছিটকায় সাথে সাথে সরে বসে।
-কেডা তুই?
-আমি আপনের রুকসানা
-হারামজাদী তুই কেন আইসস।
-আপনে কুসুমরে ছাইড়া দেন, আমি তো মরিনাই
-তুই বাইরে যা, অক্ষণ যা।

গায়ে পাঞ্জাবী গলিয়ে বাইরে বেরিয়ে যাবার আগেই ধোঁয়াটা ঘিরে ধরে মাছুমকে। সেই একটা কেমন রক্ত মাংস পঁচা গন্ধে ঘরের ভেতর ভরে ওঠে। ওয়াক ওয়াক শব্দ করে হড়হড়িয়ে বমি করে দেয় রুকসানা। মাছুম ভয়ার্ত হয়ে চিৎকার করে লোকমান আর আব্বাস খাদেমকে ডাকতে গিয়েই টের পায়, তার শ্বাসনালী শক্ত করে চেপে ধরেছে অদৃশ্য দুটো হাত। কানের কাছে ফ্যাসফ্যাসে গলায় হাতের মালিক বলতে শুরু করে
-ও মাছুম, আমারে তো এমনেই গলা চিপা ধইরা রশিতে লটকায় দিসিলা। খোদেজার লগে মিল্লা কি কামডা করছিলা তুমি জ্ঞানে পাও? অনেকদিন ধইরা অপেক্ষায় ছিলাম, কবে তোমারে পামু। পারি নাই এই ঘর বন্ধ করা আছেল। সই দিলারা আমার কামডা না বুইঝা সহজ কইরা দিসে। ঘরের কুনা কানি থিকা সব পুরান কাগজ বাইর কইরা ঘর সাফা করতে কইছে। তাবিজ -মাবিজ সহ সব ফেলাইছে সুলায়মান। তাইতো আইজ তুমারে কাছে পাইছি। লও, চল আমার লগে। জাহান্নামে কেমনে যাই তুমারে ছাড়া। 
দারোয়ান কিছু বলার আগে সুলায়মান তার ঘাড় ধরে বাইরে বের করে দেয়। ভেতরে ঢুকে দিলারা লোকমান আর আব্বাসের দিকে তাকায়। তীব্র সেই দৃষ্টির হুকুম উপেক্ষা করার দুঃসাহস তাদের হয় না। ভেতর বাড়িতে ছুটতে থাকে দিলারা আর সুলায়মান। বেলায়েত আর তার সাথের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খেলা বন্ধ করে তাদের মায়ের মত আপার পেছনে আসতে থাকে। দিলারা ভেতরে ঢোকার আগেই খবর দিয়েছে কাছের থানায়। মাছুমকে আজ হাতেনাতে ধরবে সে। তীব্র একটা হাহাকার যেন তাকে স্পর্শ করে। হায়রে জীবন, না স্বামীর সুখ, না সংসার, না পিতামাতা কোন কিছুই সৃষ্টিকর্তা তাকে দিলেন না। আজ অন্তত আরেকটি মেয়ের সর্বনাশ যেনো সে বাঁচাতে পারে।

ধীরে ধীরে মাটিতে পরতে থাকে মাছুম। অশরীরি সেই হাতের বাঁধন ঢিলে হয় আস্তে আস্তে। রুকসানা ঘটনার তীব্রতায় কিছু বুঝে না উঠলেও মাছুমকে পড়ে যেতে দেখে কোমরে গোজা ছোট ছুরিটা চালিয়ে দেয় গলা বরাবর। ফিনকি দিয়ে এত দিনের জমাট পাপ বেরিয়ে আসে। চিৎকার করে রুকসানা -আয়, আয় বেজন্মর বাচ্চা, অখন আয়। ধম্ম ধম্ম কইরা কত মাইয়ারে নষ্ট করছস, তোর তো ঘুম আইত না। আইজ তরে ঘুম পাড়ায় দিলাম। ধোঁয়াটা যেন জড়িয়ে ধরে রুকসানাকে। পরম মমতায় গায়ে মাথায় হাত বোলায়। তারপর দমকা বাতাসের মত বেরিয়ে যায় দরজা ধরে। সবার আগে সুলায়মান পৌঁছায়। নিস্তেজ রুকসানাকে দ্রুত শুইয়ে দেয় সে। আর দিলারা দরজা ধরেই দাঁড়ায়। যে মানুষটা এত ঘেন্নার ছিল, সেই লোকটা আজ মরেছে কুকুরের মত। পরের সময়টা দ্রুত কাটে। লাশ পোস্টমর্টেমের জন্য নিয়ে যায় পুলিশ। রুকসানাকে নিয়ে যায়, হয়ত কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে জায়গা হবে তার।

দশ দিন পর…

পীর মাছুম আলি মাদ্রাসায় একটা শুক্রবার ভোর। ফজরের সালাত শেষে বেলায়েত এসে দাঁড়িয়েছে ফুলের বাগানের কাছে। তার বন্ধুটিকে ভীষণ মনে পরে। আগের মত বন্ধু এখন সব সময় আসে না। তবে প্রায়শই আসরের নামাজটা দুজন একসাথে আদায় করে। হালকা একটা মিষ্টি সুবাস ঘিরে ধরে বেলায়েতকে। হাসি মুখে মাথা নাড়াতে নাড়াতে কথা বলা শুরু করে বেলায়েত। জোড়া ভুবন মায়ায় বাঁধা পড়ে যাওয়া এই সমবয়সী আল্লাহর সৃষ্ট জীবের প্রতি আল্লাহর অপার করুণা বর্ষিত হোক।

নামাজের পাটিতে বসে দীর্ঘসময় রুকসানার জন্য দুয়া করে দিলারা। মেয়েটা খুব দুঃখী। আল্লাহ পাক তাকে সহি সালামতে ফিরিয়ে আনুক। মেয়েটাকে সে দত্তক নেবে। আর কোথাও যেতে দেবে না। মায়ের মত আগলে রেখে মানুষ করবে এই মাদ্রাসার প্রতিটি ছেলেমেয়েকে। হিসাবের খাতাটা খুলে দিলারা। ভেতরে দুবেনী করা পনের বছরের দুটো হাস্যোজ্জ্বল কিশোরীর ছবি আটকে আছে। নাসিমার ছবির ওপর হাত বুলায় দিলারা। নাসিমাও আটকে ছিল জোড়া ভুবন মায়াতে। ঘুরে বেরিয়েছে আক্রোশ নিয়ে, আর শেষ মুহূর্তে হিসেব নিয়েছে পাপের। খুব মনে পরে তার সইকে। এতটা কাছে থেকেও কখনো বুঝতে পারেনি কতটা কষ্ট নীরবে সই লুকিয়ে চলেছিল।

ঘরের জানালা দিয়ে ফুলের বাগান দেখা যায়। কুসুম দরজা খুলে বাগানের দিকে এগোয়। এখন আর মাছুম হুজুরের মত কেউ তাদের বাগানে দেখলে বকবে না। ধীরে ধীরে বেলায়েত আর কুসুম ঘুরে বেড়ায় বাগান জুড়ে। আল্লাহর পবিত্র শিশু ফুলেদের কলকাকলিতে প্রাঙ্গণ ভরে ওঠে।

পৃথিবীটাই এমন। এখানে পাপ আছে, পূন্য আছে। পাপীর বিনাশ আছে। মানুষের জন্য সৃষ্ট পৃথিবীতে আল্লাহ তার সাথে সৃষ্টি করেছেন আরো অসংখ্য প্রাণ। সবাইকে নিয়ে জীবন ও ধরিত্রী। যে যার ভুবনে তার প্রিয় বা অপ্রিয় কিছুর মায়া বা প্রতিশোধের নেশায় আটকে থাকে কেবল। আমরা সেদিকে আর না ভাবি। একদল শিশু এসে যোগ দিয়েছে বাগানে। তারা জান্নতের ফুল বাগানের মত আনন্দে মেতে উঠেছে। আল্লাহর আরশ যেন খুশিতে এক পশলা বৃষ্টি উপহার দেয়।
আনন্দে আত্মহারা শিশুদল ভিজতে ভিজতে মনের আনন্দে গায়- তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে …

সমাপ্ত

https://ochinpurexpress.com/%e0%a6%ae%e0%a6%a8%e0%a7%8b%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%a4/%e0%a6%ad%e0%a7%81%e0%a6%ac%e0%a6%a8-%e0%a6%9c%e0%a7%8b%e0%a7%9c%e0%a6%be-%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a7%9f%e0%a6%be-%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ac-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%8b-%e0%a6%93/

অচিনপুর ডেস্ক/ জেড. কে. নিপা

Post navigation