চোখটিপের বিজ্ঞান

মুকিত মোহাম্মদ
টোকিও, জাপান।

নন-ফিকশন: চোখটিপের বিজ্ঞান

১.
উইংক বা চোখটিপ দেয়া আর পলক পড়ার মাঝে কী পার্থক্য?
যে কাউকে প্রশ্নটা করলেই ত্বরিৎ জবাব চলে আসবে, ‘চোখটিপ এক চোখে দেয়।’
এখন যদি ত্যানা প্যাঁচাই, যদি বলা হয়, ‘কারও যদি শুধু একচোখেই পলক পড়ে, তাহলে?’
সমস্যা নেই, উত্তর আছে। সেটা হলো ‘সময়ের দৈর্ঘ্য’।
চোখের পলক নিমিষেই পড়ে ( গুগল ঘেঁটে দেখে নিন সেকেন্ডে মানুষের কতবার পলক পড়ে), কিন্তু চোখটিপ বা উইংক দিতে হয়, ধীরেসুস্থে, একটু সময় নিয়ে।

মনে করার চেষ্টা করুন প্রথম কবে উইংক করেছিলেন?
কেমন ছিল সে ঘটনাটা?
মনে করতে করতে আপাতত চোখটিপকে বিদায় জানাই।
আসুন এর কাছাকাছি ব্যাপারগুলো নিয়ে একটু পড়াশোনা করি, শেষে আবার চোখটিপের কথায় ফিরে আসব।

২.
এডিসনকে নিয়ে একটা মুভি হয়েছিল, যেখানে দেখানো হয় যে এডিসন তাঁর তৈরী ‘কাইনেটোস্কোপ’ বা সহজে বললে ভিডিও ক্যামেরা প্রথম ব্যবহার করতে যাচ্ছেন। ক্যামেরার সামনে একব্যক্তি বসে আছেন (অনেক আগে দেখেছি কে, কেন বসেছিলেন কিছুই মনে নেই), এডিসন যেই ক্যামেরা অন করলেন, অমনি লোকটা দিল এক ‘হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ–চ্চো!!’!
জানি না আসলে মুভিটায় যা দেখিয়েছে তা সত্যি কিনা, তবে সত্যি হলে মানুষের তোলা প্রথম মোশন পিকচারটা হবে হাঁচি দেয়ার।

আসলে তা না, তার অনেক আগেই মাইব্রিজ নামক আরেক নাইনটিন্থ সেঞ্চুরী গীক (বাংলায় কি আঁতেল বলা যায়, একটু ভিন্ন) বের করে ফেলেছিলেন বিদঘুটে নামের “জু …স্কোপ’ (পুরো নামটা মনে নেই)। তো এই মাইব্রিজ মহোদয়ই খেয়াল করেছেন যে স্থিরছবির একটা সিরিজকে খুবদ্রুত শাটার ফেলে প্রদর্শন করলে সেটা চলমান একটা দৃশ্য হয়ে যায়।

সেই থেকে মুভির শুরু, আজ মুভি দেখে মানুষ হাসে, কাঁদে, ভালবাসে, প্রত্যয়ী হয়, আরো কতকিছু। ধন্যবাদ সেইসব গীকদের।

মুভি নিয়ে আরেকটা মজার ব্যাপার হলো, এর ভুলগুলো। একই সিকোয়েন্সের সবগুলো দৃশ্য সবসময় একটানে নেয়া হয় না। তো, যখন পুরোনো দৃশ্য আবার নেয়া হয়, মুভি এ্যাসিস্ট্যান্টরা যারপরনাই ব্যস্ত থাকেন যাতে অবিকল আগের সেটটি তৈরী হয়, কিন্তু মানুষ বলে কথা, ভুল থাকবেই। মজার ব্যাপার হলো সবাই সেই ভুলগুলোকে ফ্রেন্ডলি/স্পোর্টিংলি নেয়, টিকেটের দাম ফেরত দিতে হবে বলে রাস্তায় বেরোয় না।
৩.
কেন মানুষ রাস্তায় নামে না? কারণ যখন সে মুভি উপভোগ করে তখন এই সামান্য ভুলগুলো পুরোপুরি তার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়, কোন সমস্যাই হয় না। কেন হয় না, কারণ মুভি খুব ফাস্ট, এত অল্পসময়ে এসব সু্ক্ষ্মভুল ধরা মানুষের পক্ষে সম্ভব না। সত্যি বলতে কি, মুভিতে তো আরও বড় সমস্যাই আছে। মুভি হলো একগাদা স্থিরচিত্রকে পরপর দেখানো, খুব দ্রুত। এরকম একগাদা স্থিরচিত্রকে পরপর দেখানো হলেও আমাদের কাছে সেটা নিরন্তর (কন্টিনিউয়াস) মনে হয়, কারণ, স্থিরচিত্রগুলোর মাঝের অল্পসময়ের গ্যাপটা আমরা ধরতে পারি না।

অনেকদিন পর্যন্ত এ ব্যাপারে অনেকেরই ধারনা ছিল (আমার ধারনা এখনও পারসেপশন মেজরের অনেক গবেষক একই ধারনা পোষন করেন) ভুল, অধিকাংশ গবেষকরাই সহজতম ব্যাখ্যাটা বেছে নিয়েছিলেন, বলেছেন, মানুষের মুভি বা টিভির সামনে বসে অর্থাৎ দ্বিমাত্রিক স্ক্রিনে দেখা জগতের পারসেপশন (পারসেপশন হলো সেই মেকানিজম যেটা দিয়ে চোখে ঢোকা দৃশ্য, কানে শোনা শব্দ কে আমরা ইন্টারপ্রিট করে ব্রেইনে পাঠাই), আর রিয়াল লাইফে ত্রিমাত্রিক জগতের পারসেপশন, এই দুটো পারসেপশনের মেকানিজম এক না। সেজন্যই, স্থিরচিত্রগুলোর মাঝের গ্যাপ আমরা লক্ষ্য করি না, কিন্তু রিয়াল লাইফে আমরা কন্টিনিউয়াস সিন দেখি।

একটু দাঁড়ান!

রিয়াল লাইফে কি আমরা আসলেই কন্টিনিউয়াস সীন দেখি?

৪.
এই নিয়ে পরীক্ষা করেছেন কেন্ট স্টেটের লেভিন আর হার্ভার্ডের গবেষক সিমন।
তাঁরা মজার একটি পরীক্ষা করেছেন, যেখানে একগ্রুপ দর্শকদের একটি দৃশ্য দেখানো হয় যেটায়, একজন অভিনেত্রী ফোন রিং শুনে উঠে আসেন, রিসিভার তোলেন আর ফোনে কথা বলা শুরু করেন। দৃশ্যটি যখন ধারন করা হয়, তখন অভিনেত্রীর কথাবলার মাঝপথে একবার ‘কাট’ করে, তাঁর জায়গায় অন্য একজন অভিনেত্রী অন্য একটি পোশাক পরে ফোনে কথা বলা শুরু করেন।

মুভিটা দেখানোর জন্য দর্শকদের দুটো গ্রুপে ভাগ করা হয়।

প্রথম গ্রুপকে কোন কিছু না জানিয়েই মুভি শুরু করে দেয়া হয়। শেষ হবার পর দর্শকদের বলা হয় তারা কোন ‘অদ্ভুত’ কিছু দেখেছেন কিনা। ৬৬% বলেন, দেখেননি।

আরেক গ্রুপকে মুভি শুরুর আগেই অদ্ভুত কিছু আছে কিনা জিজ্ঞেস করে মুভি দেখতে বলা হয়। দেখা গেল প্রায় সবাই বুঝতে পারছে কোথায় কি ঝামেলা।

৫.
এতো গেল সেলুলয়েডের পর্দায় আমাদের পারসেপশনের ঝামেলার কথা, এখন রিয়াল লাইফে আসলে কি হয় সেটাও দেখা দরকার।
সেজন্যও লেভিন আর সিমন একটা মজার পরীক্ষা করেছেন, তবে সত্যি বলতে কি, পরীক্ষাটা আমার পছন্দ হয়নি; তাও শেয়ার করি।
এই পরীক্ষায় ফুটপাতের উপর একজন অভিনেতা র‌্যান্ডমলি একজন পথচারীকে ধরে ‘অমুক জায়গায় কিভাবে যাব?’ জিজ্ঞেস করবে, কথা বলতে বলতে ফুটপাতে তার পাশাপাশি হাঁটবে।
তখন তাদের পাশদিয়ে আরও দুজন অভিনেতা ভারী কিছু নিয়ে ক্রস করে যাবে, ঠিক যে মুহুর্তে তারা পরস্পরকে ক্রস করবে, সে মুহুর্তে কথা বলতে থাকা অভিনেতা আর ভারী জিনিস বয়ে যাওয়া একজন অভিনেতা দ্রুত নিজেদের মাঝে জায়গা বদল করে নেবে। অর্থাৎ, পথচারীর সাথে প্রথমে যে কথা বলছিল, আর পরে জায়গা বদলের যে কথা বলছে, তারা ভিন্ন লোক।
এই পরীক্ষায় দেখা গেলো, ৫০% এর মতো পথচারী ব্যাপারটা টেরই পায়নি।
মানে রিয়াল লাইফেও আমরা কন্টিনিউয়াসলি দেখি না।

(এই পরীক্ষাটা আমার এজন্য পছন্দ হয়নি যে হয়ত পথচারী অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল, পথে হাঁটতে হাঁটতে আমরা যখন কথা বলি তখন আমরা সবসময় একে অন্যের দিকে তাকিয়ে কথা বলি না।)
৬.
তবে রিয়াল লাইফে যে আমরা আসলেই কন্টিনিউয়াসলি দেখি না, তার আরো সহজ প্রমাণ আছে। আমাদের চোখের পলক পড়ার পর আবার চোখ খোলার মাঝে যে সময়টুকু পাই, তা হলো ৮০ মিলিসেকন্ড। এই ৮০ মিলিসেকেন্ড আমাদের চোখে আলো ঢোকে না, অর্থাৎ রিয়াল লাইফে যদি আমরা কন্টিনিউয়াসলি দেখতাম তাহলে কিছুক্ষণ পরপর আমরা কালো (!) একটা ক্যানভাসের মতো দেখতে পেতাম।

এই যে গ্যাপ বা ইনকনসিস্টেন্সী, এটা কেন আমরা ধরতে পারছি না? সেটা আরেক কাহিনী, আরেকদিন বলব, শুধু এটুকু বলে রাখা যায়, আমাদের নিউরাল সিস্টেম একটা ট্রিক মাস্টার!

আমাদের চোখ-নাক-কান-ত্বক-জিহ্বার মাধ্যমে যে পরিবেশগত ইনপুটগুলো আমাদের শরীরে ঢোকে, সেগুলোকে নিউরাল সিস্টেম আবার প্রসেস করে, প্রসেসের পর তার অর্থটা আমরা বুঝি। এই প্রসেসিংয়ের সময়ই সে যাবতীয় যাদুকরী কাজগুলো করে, সব প্রত্যঙ্গ গুলোর মাধ্যমে ঢোকা ইনপুটগুলোর মধ্যে একটা সমন্বয় ঘটায়। সেটা নিয়ে গবেষনা চলছে দিনরাত, মজার একটা ব্যাপার বেরিয়ে আসছে, সেটা হলে মানুষের ব্রেইন টাইমকে কিভাবে নিচ্ছে।

সে নিয়ে আবার আলোচনা করা যাবে পরে, আজ শুরু করলাম চোখটিপি দিয়ে, সেটা দিয়েই শেষ করি।

৭.
অনেকেই উঠতি বয়েসে চোখটিপি প্র্যাকটিস করেন, এটা সত্যি যে ভাল উইংকারদের আলাদা একটা কদর আছে, বন্ধুদের মাঝেও, মিষ্টি-দুষ্টু মেয়েদের মাঝেও।
তো পরামর্শ বা উপদেশ যাই বলুন, সেটা হলো, উইংক প্র‌্যাকটিস করুন ঠিক আছে, তবে হাত পাকাতে পাকাতে এমন করে ফেলবেন না যে তা ৮০ মিলিসেকেন্ডের কম সময়েই সেরে ফেলছেন!
তাহলে নিজেই তালগোল পাকিয়ে ফেলবেন উইংক আর চোখের পলক নিয়ে। উইংক দেয়ার জায়গায় চোখের পলক ফেলে, চোখের পলক ফেলার জায়গায় উইংক করে বিপদে পড়তে পারেন ।
আর তাছাড়া যাকে লক্ষ্য করে উইংকটা ছুঁড়লেন, সে দেখা যাবে পুরো সময়টা চোখের পলক ফেলে রেখেছিল।

এসব ছাইপাশ কথার চেয়ে, একটা প্রশ্ন করে রাখি শেষে।
ছোটবেলায় নিশ্চয়ই দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন, অলিম্পিকেও হয়ত দেখেন। আলোর গতি শব্দের চেয়ে বেশি, তার পরেও দৌড় প্রতিযোগিতায় ডেস্টিনেশনের কাছে উজ্জল বাতির ফ্ল্যাশ ব্যবহার না করে, প্রতিযোগীদের পেছনে বিপজ্জনক বন্দুকের গুলি ব্যবহার করা হয় কেন?

উত্তর হয়তো পরে কখনও দেবো।

অচিনপুর ডেস্ক / এস.এস.ববি

Post navigation