ক্রীতদাস

শারমিন আহমেদ
বক্সীবাজার, ঢাকা।

গল্প: ক্রীতদাস

এয়ারপোর্টের ভেতরের লাউঞ্চে কফি হাতে বসে আছে নিশি। ফ্লাইটের দেরী আছে। সময় হবার একটু আগেই এসে পড়েছে সে। হ্যাঁ, খানিকটা অভ্যেস আর খানিকটা ইচ্ছেও বটে। বাবার মতো হবার ইচ্ছে। ছোটবেলা থেকেই এই করে এসেছে। কেবলই বাবার মতো হতে চাওয়া। মা মাঝে মাঝে রেগে যেতেন।
—মেয়েটার মাথা নষ্ট করছো এভাবেই ও ভুলেই যাবে যে ও মেয়ে। সবাইকে ডমিনেট করবে তোমার মতোই!
প্রচ্ছন্ন খোঁচা মেরেই বলতেন।
হু! নিশির বাবা প্রচণ্ড রাগী মানুষ, কিন্তু রাগ পানি হতেও সময় লাগে না। তবে নিশির কোন কথায় বিরক্তি নেই এক্কেবারেই। মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠেও যদি বলতো,
—বাবাআআআ …বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে!
নিয়ে যেতেন। এসব দেখে মা গজগজ করতো বেশি। আফসোস করে কখনও বলেছেনও
—এই মেয়ে বিয়ে দেয়া মুশকিল হবে। কি যে বানাচ্ছে?
—বিয়ে দেবোই না। আমার মেয়ে আমার কাছেই থাকবে। বাবার একগুয়ে উত্তর।
—নিজে তো ঠিকই বিয়ে করেছো… প্রেমও করেছো, তবে! মেয়ে যদি এমন করে?
—নাহ! করবে না।
—তুমি জানো ?
—হু! জানি।
মা হাসতেন শেষে। হার মানা হাসি। এখন সে হাসছে যেমন। এসব মনে হলেই হাসি আসে। মধুর স্মৃতি এগুলো।

এয়ারপোর্টে এলে এজন্যই আগেই আসে। একটু আগে এসে বসে এসব ভেবে নস্টালজিক হয়। তাকে নিয়ে মা বাবা দুজনের ভেতরে এক প্রতিযোগিতা ছিলো। সে মজা নিতো কেবল। সুখের দিনগুলো কম হয় তবে এর ব্যপ্তি থাকে দীর্ঘকাল। আজো এসব ভাবতে গেলে চোখে ভাসে সব। তাকে পাবার জন্য বাবা-মাকে দীর্ঘ পরীক্ষা আর প্রতীক্ষা সইতে হয়েছে। হয়তো বা বাড়াবাড়ি রকমের আহ্লাদ পেয়েছেও সে কারণেই। অতো বেশি না পেলেও চলতো একবারে। তাহলে এখন আর চাতকের মতো স্মৃতি আঁকড়ে বসে থাকতে হতো না। বাবা তাকে মেয়ে মনে করেননি কখনোই। একটা ছেলের মতই বাস্কেট বল, ব্যাডমিনটনের পাশাপাশি ফুটবলও খেলেছে সে। লম্বা বলে গোলকিপার এর পজিশনে থাকতে হতো বেশিরভাগ সময়। ক্লাস শেষে খেলা আর খেলা শেষে ঘেমে ভিজে এসে গাড়িতে বাবার কোলে এক ঘুম। আর যেদিন বাবা আসতে পারতো না সেদিনও ঘুমাতো তবে কাঁদতে কাঁদতে। হ্যাঁ, খুব ছিঁচকাঁদুনী ছিলোও বটে। কথায় কথায় কান্না। সবাই বিরক্ত হতো কেবল বাবা বাদে। বাবার সাথে এতো অল্প সময় তবুও কত স্মৃতি।
এয়ারপোর্টের এই অপেক্ষমাণ সময়টা তার ভেতরের সেই ছোট্ট নিশি হয়ে থাকার…ফেলে আসা শৈশবকে খুঁজে নেবার। সাইপ্রেসের আকাশে এখন গভীর রাত। কালো মেঘের ফাঁকে অজস্র তারা। এখানে বাবা কোনটা?

‘এগুলো ভুলেই বাঁচতে হয়। চলতে হয়। এগুলো মাথায় নিয়ে জীবনে এগুনো যায় না। তোমাকে অনেক বড় কিছু হতে হবে। তোমার জীবন আর দশটা মেয়ের মত নয়। মনে রাখবে।’
হ্যাঁ মনে রেখেছেও সে। বাবার অবর্তমানে মা তাকে এক কঠিন জীবন দেখিয়েছেন। বাস্তবতা কত নির্মম জেনেছে তখনই। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে বাবাকে যেদিন এক প্লাটুন পুলিশবাহিনী গ্রেফতার করেছিলো …কি এক ভয়ঙ্কর রাত ছিলো। সে ঘুমিয়েছিলো বাবার বুকের মাঝে। কখন এতকিছু টের পায়নি। বাবা কখন উঠে গেছেন টের পায়নি। শুধু সকাল থেকে কেঁদে দিন পার করেছে। বাসায় নানু আর দিদা ছিলেন। বাকী আত্মীয়-স্বজনের একের পর এক ভিড়। বোঝেনি কেন আসছে? এরপর সময়ের নিয়মে দিন পার করা। একসময় বুঝেছে কান্নাটা আর মায়ার নয়। এটা মায়ের কাছে অশান্তির আর সবার কাছে করুণার।

নিশাত তারান্নুম নিশির বড় হতে লেগেছে সময়ের নিয়ম মেনেই কিন্তু পরিনত হতে হয়েছিলো সময়ের অনেক আগেই। হতেই হয়। বাবার সাথে জেলে গিয়ে দেখা করা, বারবার মায়ের সাথে কোর্ট-কাচারী দৌড়ে চিনেছে অনেক কিছু। মা মানুষের কথার ভয়ে স্কুল বন্ধ করেছিলো; সেটা আবার শুরু করিয়ে দিলেন। সিদ্ধান্ত একটাই আইনজীবী হতে হবে। হয়েছেও। শুধু বদলে গেছে অনেক কিছু। জলের ভেতর হাত রেখে মুষ্টিবদ্ধ করলেও যেমন শূন্য থাকে হাত… সময়টাও তেমনই। ঘিরে থাকে, ধরা যায় না। কেবল এগোয়। দুঃসময় হয়ে, সুসময় হয়ে…এর মাঝেই এক অভ্যস্ততা গড়ে ওঠে। মেনে আর মানিয়ে নেবার অভ্যস্ততা।

নাহ! কিচ্ছু হয়নি। সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ করে এরপর এলো সেই ভয়ঙ্কর রাত। কালো বর্ডার দেয়া খাম। মা জানতেন, এমন কিছুই হবে। বাবা বিশ্বাস করেননি। একদিন যাদের জন্য বাবা অনেক কিছুই করেছিলেন, তারা সব মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো। বাবা মাকে দুষতেন কেবল। ভাবতেন, মা ঠিকমতো বুঝাতে পারেনি। মাও কাঁদতেন তবে জেলগেট ছেড়ে বের হবার পর। শেষ দেখার সময় বাবার দাঁতের ব্যথার কারণে বাঁ গাল ফুলেছিলো। আচ্ছা, বাবা কি মৃত্যুর সময়ও সেই ব্যথা নিয়েই ছিলেন? নাকি মৃত্যুর যন্ত্রণা তার সব ব্যথা অনুভবের ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিলো? কে জানে? আর জানার উপায় নেই। কফিনের ভেতরে ঢোকানো শরীর …সব ঢাকা। কেবল অল্প মুখ বের করা দেখে চৌদ্দ বছরের নিশি তেমন কিছুই বোঝেনি। শুধু বুঝেছে, বাবা বলে আর কাউকে ডাকতে পারবে না কখনোই।

কখনও সমাজে বাস করাকে ঘৃণা করতে ইচ্ছে করে। এ সমাজের নিয়ম মানতে গিয়েই সাধু, আবার সমাজের নিয়ম পালটালেই অপরাধী। এ সমাজে সব বদলায়। নিয়ম কানুন, সরকার সব। সরকারের অধীনস্থ কর্মচারী মানেই কী ক্রীতদাস? হয়তো তাই। সরকার বদলাবে, সাথে বদলাবে নিয়ম। এক শাসনামলে যে বীরউত্তম পরেরবার সরকার বদলেই সে রাষ্ট্রবিরোধী হয়ে যায়?

এটাই হয়। এভাবেই হতে পারে। হোক, কার কীই বা যায় আসে তাতে? কজনই বা খবর রাখে? দিন বদলের পালায় আটকে থাকে শুধু সেই আক্রান্ত মানুষ নামের ক্রীতদাস আর তার পরিবার! বাবার মৃত্যু নিশিকে নিজ শহর থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। বড্ড একা সে। নাহ! বিয়ে করেনি সে। ভালো লাগেনি সেভাবে কাউকেও। মাও চলে গেছেন গতবছর। আগামীকাল মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী। মায়ের শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী এসময়টাতে সে নিজ দেশে ফিরতে চেষ্টা করে। একটা এতিমখানায় দোয়া পড়ায়। বাবা মা দু’জনের জন্যই। বুকের ভেতর জমে থাকা কান্নাটা এখানে এলেই আসে। সেই অর্থে সেও এক সময়ের ক্রীতদাস। ক্রীতদাসের পিঠে রক্ত জবার মত লাল ক্ষত থাকে। যুগ যুগ ধরে তারা সেটা বহন করে চলে নীরবে।

(কৃতজ্ঞতাঃ ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’ কবিতা/ কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ)।

অচিনপুর/ শারমীন সুলতানা ববি

Post navigation