আনন্দ আনন্দ

মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম
পশ্চিম রাজপুরী, ঢাকা।

গল্প: আনন্দ আনন্দ

ঘড়িতে পাঁচটা বাজলেই ফরিদের বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করে। অফিসের অনেক লোকজন আছে যারা আটটা নয়টা পর্যন্ত বসে থাকে। ফরিদ বুঝে না এদের জীবনে কি অন্যকিছু নেই? কখনো একা একা নির্জনে কোথাও বসে থাকতে এদের ইচ্ছে করে না? রাস্তায় একা একা হাঁটতে ইচ্ছে করে না? গুনগুন করে গান গাইতে ইচ্ছে করে না? অথবা বাসায় গিয়ে ছেলে মেয়েকে বুকে নিয়ে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে না? ফরিদ হেঁটে হেঁটে বাসায় যায়। তার একা হাঁটতে খুব ভালো লাগে। সংসদ ভবনের সামনে কিছুক্ষন একা বসে থাকে। বাদাম খায়।

মাঝে মাঝে শিউলিকে নিয়ে ফরিদ সংসদে ঘুরতে আসে। শিউলি মুখ টিপে হাসে

-তোমার এখনো রং ঢং গেলো না। এতো বয়স হয়েছে তাও সংসদে ঘুরতে চাও। পার্কে বাদাম খেতে চাও।

ফরিদ হাসে
-তোমার ভালো না লাগলে বলো। বুড়ো হয়েছিতো কি হয়েছে? সঙ্গী খুঁজে নিবো। এখনকার মেয়েদের মধ্যে ঝিলিক আছে।

শিউলি রফিকের পাকা চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। হায়রে নানার বয়সী লোক! এখন আবার সঙ্গী খুঁজে পার্কে বসার ইচ্ছে।

বাসায় ছেলে মেয়ের সাথে ফরিদের দূরত্ব আছে। একসময় ছিলো এদের কোলে না নিয়ে শুলে ফরিদের ঘুম আসতো না। এখন ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে। তাদের নিজস্ব জগত হয়েছে। ফরিদ ফ্রি হতে চেষ্টা করে। কিন্তু তারপরেও ছেলে মেয়ের জগতে ফরিদ ঢুকতে পারে না। এখনো ফরিদের ইচ্ছে করে ছেলেমেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে।

পাশের সীটের শিকদার সাহেব বলছে

-ফরিদ ভাই কোম্পানির অবস্থা ভালো না। মালিকের ছেলে টাকা উড়াতে উড়াতে কোম্পানিকে পুরো ডুবাচ্ছে। শুনেছি অনেককেই নাকি ছাটাই করবে। এখন কয়েকদিন তাড়াতাড়ি বাসায় যাইয়েন না। কখন কার চক্ষুশূলে পড়েন তার কি ঠিক আছে?

ফরিদের এমন ভালো লাগে না। সারাদিন ফরিদ খুব মন দিয়ে কাজ করে। পাঁচটার পরের সময়টা হচ্ছে তার নিজস্ব সময়। তার নিজস্ব সময় যদি অন্য কেউ নিয়ে যায় তখন মনে হয় এইভাবে বেঁচে থাকার অর্থ কি। এইভাবেই মানুষ জীবিত থেকেও মরে যায়। ফরিদ উঠে দাড়ায়। সে ভয় পেয়ে জীবনটাকে কাটাতে চায় না।
এর মধ্যে পিয়ন এসে খবর দেয়

-স্যার আপনাকে বড় সাহেব ডাকছে।

বড় সাহেব অধিকাংশ সময় অসুস্থ থাকেন। তার ছেলে এখন কোম্পানি চালায়। অধিক লাভের আশায় ভুলভাল ইনভেস্টমেন্ট করে এখন কোম্পানি ডুবতে বসেছে। বড় সাহেবের রুমে ফিনাইলের গন্ধ।

ফরিদ সাহেব আপনি অনেকদিন এই কোম্পানিতে কাজ করেছেন। কোম্পানির বর্তমান অবস্থা তো জানেন। এই মাসে যে কর্মচারীদের বেতন দিবো সেই অবস্থা নেই।

-জী স্যার।
-কি বলবো ফরিদ সাহেব। আপনি পুরাতন লোক। আমার বিশ্বস্ত এবং প্রিয় কর্মচারী। কিন্তু এখনতো আমার গায়ে জোর নাই। আমি অসুস্থ থাকি। আমার ছেলে কোম্পানি চালায়। সে ঠিক করেছে আপানাকে আর রাখবে না। আপনি নাকি অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে যান। কাজের প্রতি মনোযোগ নাই। যদিও আমি তা বিশ্বাস করি না। কিন্তু কি করবো বলুন? ছেলেকে বললে ছেলে কথা শুনে না।

ফরিদের চোখ হটাত ঝাঁপসা হয়ে আসে। কত বচ্ছর এই কোম্পানিতে কাজ করেছে। তার সিটটা তার খুব প্রিয়। কুদ্দুসের আদা দিয়ে রং চা আর খাওয়া হবে না। শিকদার সাহেবের সাথে সুখ দুঃখের কথা আর বলা হবে না।

-জী স্যার। আমি আসি।
ফরিদের কেমন জানি দম বন্ধ হয়ে আসে। হটাত ছুটে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করে।

-ফরিদ সাহেব আমি বলে দিয়েছি আপনাকে এই মাসের বেতন সহ আরও দুই মাসের বেতন দিয়ে দিবে। আমি জানি এরমধ্যে আপনি চেষ্টা করলে অন্য কোথাও চাকরী পেয়ে যাবেন।

ফরিদ রাস্তা দিয়ে হাটতে থাকে। রাস্তাটা পার হলেই সংসদ ভবন। সেখানে কিছুক্ষন জোরে জোরে শ্বাস নিতে হবে। কেমন জানি দম বন্ধ হয়ে আসছে। ফরিদ ভাবে তার সংসার কিভাবে চলবে। সামনে ঈদ। বেতন দিবে, বোনাস দিবে কিনা তা বলে নাই। তাও বড় সাহেব চেয়েছে দেখে দুই মাসের বেতন বেশী পাওয়া যাবে। দুই মাস পর কি হবে? ফরিদ দেখে সংসদের সামনে একটা ছেলে একা একা কাঁদছে। ফরিদ ছেলেটার কাছে গিয়ে বসে।

-কি হয়েছে বাবু। ফরিদ জিজ্ঞেস করে।

ছেলেটা ফরিদের দিকে তাকায় না। ডুকরে ডুকরে কাঁদছে।

ফরিদের মন খুব নরম। বাচ্চাদের কান্না ফরিদের ভালো লাগে না। বাচ্চাটার বয়স আট থেকে দশ বচ্ছর হবে। ফুটফুটে একটা ছেলে। ফরিদ ছেলেটাকে কাছে টানে। ছেলেটা এইবার ফরিদের দিকে তাকায়। ফরিদ আবার জিজ্ঞেস করে

-কি হয়েছে বাবা?

ছেলেটা বলে
-আমার মা মারা গেছে। বাবা আরেকটা বিয়ে করেছে। সৎ মা বাসা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।

ফরিদ জানে এই ঢাকা শহরে কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। এই ছেলের গল্প যে সত্যি এমন কোন কথা নেই। কিন্তু ফরিদের সবসময় মানুষের কথা বিশ্বাস হয়। হয়তো এই কথা এই ছেলেটা অনেককেই বলেছে; কেউ বিশ্বাস করে নাই। কিন্তু ফরিদের বিশ্বাস হয়। ছেলেটার চোখ মুছে দেয়।

-তোমার ক্ষুধা লেগেছে বাবা।

ছেলেটা মাথা নাড়ে।
ফরিদ ছেলেটাকে নিয়ে হাটা দেয়। বাসায় নিয়ে গেলে শিউলি কনফার্ম চিল্লাচিল্লি করবে। আজকে এমনিতেই শিউলিকে চাকরী যাওয়ার খবর জানাতে হবে। ফরিদ কোন কিছু গোপন রাখতে পারে না। দুইটা সংবাদ একসাথে দিলে শিউলি কি করে কে জানে। আগে একটা দুসংবাদের কিছু করা যায় কিনা সেই চেষ্টা করা যাক। ফরিদ ভাবে কাকে ফোন দেয়া যায় চাকরীর জন্য। ফরিদের পরিচিত এক বন্ধু সরকারী চাকরী করে। বেশ প্রভাবশালী। মন্ত্রী মিনিস্টারের সাথে উঠা বসা। ফরিদ সালামকে ফোন দেয়
সালাম ফোন ধরেই বলে
-কিরে ফরিদ কেমন আছিস?

ফরিদ খুশী হয়। সে ভাবছিলো সালাম ফোন ধরে কিনা। ফোন ধরলেও চিনে কিনা। ধনী বন্ধু-বান্ধবরা গরীব বন্ধুদের চিনতে চায় না।

-বন্ধু আছি ভালো। তুই কেমন আছিস?

-এইতো দোস্ত ভালো আছি। এতো চাপ। চারদিকের চাপ সামলাতে সামলাতে দিন যায়।

-বন্ধু আমার একটা সাহায্য দরকার।
ফরিদ সরাসরি সালামের কাছে কথা তুলে।

-কি সাহায্য?

-দোস্ত আমার কোম্পানির অবস্থা ভালো না। তাই তারা লোক ছাটাই করছে। সেই তালিকায় আমি আছি। দীর্ঘ বিশ বছর কোম্পানির একাউন্টেন্টের কাজ করেছি। আজ বেকার হয়ে গেলুম। তোর কাছে তো কত লোক আসে। দেখ না আমার একটা ইন্টারভিউর ব্যবস্থা করে দেয়া যায় কিনা। এরপর যোগ্যতা দেখেই তারা নিলো। ফরিদের খুব আত্মবিশ্বাস ইন্টারভিউতে ফরিদকে বাদ দেয়ার উপায় নাই। ফরিদ একাউন্টস খুব ভালো বুঝে।

-দোস্ত তোকে কি যে বলবো। তুই আমার দোস্ত। আসলে তোকে সাহায্য করতে পারলে ভালোই লাগতো। কিন্তু মনে হয় না কিছু করতে পারবো। এখন একটা ইম্পর্ট্যান্ট মিটিংয়ের মধ্যে আছি; পরে আমি তোকে বুঝিয়ে বলবো।

সালাম ফোন রেখে দেয়।
ফরিদ হাসে। যাই হোক এটাও ভালো সালাম সরাসরি মানা করে দিয়েছে। ছেলেটা তার দিকে তাকিয়ে আছে। ফরিদ ভাবে এই জীবনে বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। ফরিদের দুঃখ ফরিদের সেই ভাগ্য নেই।

বাসায় গিয়েই ফরিদ শিউলিকে ডাক দেয়।
-শিউলি এই ছেলেটাকে কিছু খেতে দাও।

শিউলি ইফতার নিয়ে ব্যস্ত। শিউলি স্বামীর এই ধরনের আচরনে অভ্যস্ত। আগে তো আরও বেশী ছিলো। তাও ছেলে মেয়ে বড় হওয়ার পর কিছুটা কমেছে। ছেলেটাকে দেখে শিউলিরও মায়া লাগে। ছেলেটাকে খেতে দেয়।

শিউলি রুমে এসে ফরিদকে জিজ্ঞেস করে।
-কোথা থেকে আনছো?
ফরিদের ছেলে মেয়েরাও ফরিদের কাছে এসেছে।

-বাবা ছেলেটা কে?

-সংসদ ভবনের সামনে পেয়েছি। মা মারা যাওয়ার পর বাবা আরেক বিয়ে করেছে। সৎ মা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।

ফরিদের ছেলে মেয়ে ফরিদের মতোই হয়েছে। আহারে বাচ্চাটা। মা বাবুটা এখন থেকে আমাদের এইখানে থাকুক।

শিউলি চিল্লিয়ে উঠে।
-তোমাদের আহ্লাদ দেখলে আমার গা জ্বলে। কিভাবে সংসার চালাচ্ছি তা আমি জানি।

ফরিদ বলবে না বলবে না করেও বলে ফেলে
-শিউলি আমার চাকরী চলে গিয়েছে।
শিউলি ফরিদের দিকে তাকিয়ে আছে। ফরিদের ছেলে মেয়েরাও।

-কি বলছো।
শিউলি চিৎকার করে উঠে। কিভাবে? কেন?

কোম্পানির অবস্থা ভালো না। তাই লোকজন ছাটাই করছে।

শিউলি মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।

-এর মধ্যে এই ছেলেকে নিয়ে আসছো। তোমার মতো বোকা পুরুষ আমি জীবনে দেখি নাই।

ফরিদের ছেলে মেয়েরা বলছে

-বাবা তুমি চিন্তা করো না। আমরা টিউশনি করে চলতে পারবো। সংসারেও সাহায্য করবো। তবুও ছেলেটা থাকুক; কই যাবে।

ফরিদ হাসে। তার ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। মেয়ে কলেজে পড়ে। এখনই তাদের অনেক মায়া। ফরিদের ইচ্ছে করছে ছেলেমেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু ধরতে পারে না।
শিউলি চিল্লাচিল্লি করে

-আসছে দুইজন। টিউশনি করে সংসার চালাবে। আরেকজন চাকরী ছেড়ে রাস্তা থেকে ছেলে নিয়ে বাসায় চলে আসছে। তোমার এই কাজ আমি বহুদিন সহ্য করেছি। আর সহ্য করতে পারবো না। এই ছেলেকে বিদায় করো। এখুনি যাও।

ফরিদ গিয়ে দেখে ছেলেটার খাওয়া শেষ। ফরিদ ছেলেটাকে নিয়ে রাস্তায় বের হয়। আজকে হোটেলে ইফতার করতে হবে। ফরিদ জানে কিছুক্ষন পর শিউলির রাগ পরে যাবে। নিজেই ডাকাডাকি শুরু করবে। শিউলিরও ভীষণ মায়া। কিন্তু বেচারী কি করবে। সংসারে টানাটানি। এর মধেও কখনো শিউলির অভিযোগ করে না। ঈদে শিউলি কিছু নিতে চায় না। বরং বাচ্চারা নেয়ার পর ফরিদকে কিনে দিতে চায়। বলে

-তুমি অফিসে যাও। তোমার লাগে। আমি তো বাসায় থাকি। আমার নতুন জামা কাপড় দিয়ে কি হবে।

ফরিদ হাসে
-কেন তুমি আমার সাথে পার্কে যাও যে। তখন নতুন জামা কাপড় ছাড়া তোমাকে কি মানায়?

দুইজন হাসাহাসি করে।
ফরিদ ইফতারের অর্ডার দেয়। এর মধ্যে বাসা থেকে ফোন আসে। ফরিদের ছেলে ফোন দিয়েছে

-বাবা বাসায় এসে ইফতার করো। মা তোমাকে বাসায় আসতে বলেছে। বাসায় একজন লোক এসেছে। ইয়া বড় গাড়ি নিয়ে। তোমাকে খুঁজছে। তাড়াতাড়ি বাসায় আসো।

ইয়া বড় গাড়ি নিয়ে ফরিদের কাছে কে আসবে? ফরিদ ইফতার প্যাকেট করে নেয়। আজকে খরচ করতে ইচ্ছে করছে। একটা বড় বাটি হালিম কিনে ফেলে। ছেলেটাকে বলে

-চল যাই। বাসায় যাই।

বাসার সামনে বিশাল বড় গাড়ি। লোকজন গাড়ি দেখছে। ফরিদ অবাক হয়। এতো বড় গাড়ি নিয়ে কে আসলো? নিশ্চয় অন্য ফরিদকে খুঁজতে এসেছে। ঘরে ঢুকতেই দেখে একটা সুদর্শন ছেলে ফরিদের পায়ে ধরে সালাম করে।ফরিদ অবাক হয়।
ছেলেটার মুখে একটা অদ্ভুত আলো খেলা করে

-চিনতে পেরেছেন আমাকে বাবা?

ফরিদ ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। শিউলি, ফরিদের ছেলে মেয়ে সবাই দেখছে।

-না।

-মনে পরে আজ থেকে বিশ বচ্ছর আগে। একটা ছেলেকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে এসেছিলেন? ছেলেটা রাস্তায় কাদছিলো একা একা। কেউ তার কান্না শুনছিলো না। আপনি এসে বললেন

-কি হয়েছে তোমার?

ছেলেটা বললো সে যে এতিমখানায় বড় হয়। সেখানে তাকে প্রচন্ড মারে। ভয়ে সে পালিয়ে এসেছে।
ফরিদের মনে পড়ে

-ছোটন!!!

-হ্যাঁ বাবা। আমি ছোটন।

ছোটন ফরিদকে বুকে জড়িয়ে ধরে।
-তুই এতো বড় হয়ে গিয়েছিস! কত বছর যোগাযোগ নাই!

-বাবা আমি প্রতিদিন আপনার কথা ভাবি। সেই সময় আপনি আমাকে বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। প্রায়ই এসে আমাকে দেখে যেতেন। আমাকে জিজ্ঞেস করতেন কিছু লাগবে কিনা। এটা সেটা কিনে দিতেন। ঈদে, বিভিন্ন বন্ধে বাসায় নিয়ে যেতেন, রাতে আমায় জড়িয়ে ধরে ঘুম পাড়াতেন।

ছোটন শিউলির দিকে তাকিয়ে বলে

-মা চিনতে পেরেছেন?

শিউলি ছোটনের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়

-হুম। তখন আমার নতুন নতুন বিয়ে। ফরিদের পাগলামি দেখে আমি অবাক হতাম। ঈদে নিজে কিছু নিবে না; কিন্তু ছোটনকে তার দিতে হবে। আমি মাঝে মাঝে রাগ করতাম।

-এরপর আপনাদের ছেলে হয়। আমি যা খুশী হয়েছিলাম। ভাবলাম আমার ভাই হয়েছে। ইশ কি দিন ছিলো সেই সব দিনগুলো। সেই এতিমখানায় থাকলে আমি বোধহয় মারাই যেতাম। ঐ বোর্ডিং স্কুলের টিচাররা আমাকে খুব পছন্দ করতো। সবাই জানতো আপনারাই আমার বাবা-মা।
শিউলি চিল্লাচিল্লি করে

-আসছে দুইজন। টিউশনি করে সংসার চালাবে। আরেকজন চাকরী ছেড়ে রাস্তা থেকে ছেলে নিয়ে বাসায় চলে আসছে। তোমার এই কাজ আমি বহুদিন সহ্য করেছি। আর সহ্য করতে পারবো না। এই ছেলেকে বিদায় করো। এখুনি যাও।

ফরিদ গিয়ে দেখে ছেলেটার খাওয়া শেষ। ফরিদ ছেলেটাকে নিয়ে রাস্তায় বের হয়। আজকে হোটেলে ইফতার করতে হবে। ফরিদ জানে কিছুক্ষন পর শিউলির রাগ পরে যাবে। নিজেই ডাকাডাকি শুরু করবে। শিউলিরও ভীষণ মায়া। কিন্তু বেচারী কি করবে। সংসারে টানাটানি। এর মধেও কখনো শিউলির অভিযোগ করে না। ঈদে শিউলি কিছু নিতে চায় না। বরং বাচ্চারা নেয়ার পর ফরিদকে কিনে দিতে চায়। বলে

-তুমি অফিসে যাও। তোমার লাগে। আমি তো বাসায় থাকি। আমার নতুন জামা কাপড় দিয়ে কি হবে।

ফরিদ হাসে
-কেন তুমি আমার সাথে পার্কে যাও যে। তখন নতুন জামা কাপড় ছাড়া তোমাকে কি মানায়?

দুইজন হাসাহাসি করে।
ফরিদ ইফতারের অর্ডার দেয়। এর মধ্যে বাসা থেকে ফোন আসে। ফরিদের ছেলে ফোন দিয়েছে

-বাবা বাসায় এসে ইফতার করো। মা তোমাকে বাসায় আসতে বলেছে। বাসায় একজন লোক এসেছে। ইয়া বড় গাড়ি নিয়ে। তোমাকে খুঁজছে। তাড়াতাড়ি বাসায় আসো।

ইয়া বড় গাড়ি নিয়ে ফরিদের কাছে কে আসবে? ফরিদ ইফতার প্যাকেট করে নেয়। আজকে খরচ করতে ইচ্ছে করছে। একটা বড় বাটি হালিম কিনে ফেলে। ছেলেটাকে বলে

-চল যাই। বাসায় যাই।

বাসার সামনে বিশাল বড় গাড়ি। লোকজন গাড়ি দেখছে। ফরিদ অবাক হয়। এতো বড় গাড়ি নিয়ে কে আসলো? নিশ্চয় অন্য ফরিদকে খুঁজতে এসেছে। ঘরে ঢুকতেই দেখে একটা সুদর্শন ছেলে ফরিদের পায়ে ধরে সালাম করে।ফরিদ অবাক হয়।
ছেলেটার মুখে একটা অদ্ভুত আলো খেলা করে

-চিনতে পেরেছেন আমাকে বাবা?

ফরিদ ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। শিউলি, ফরিদের ছেলে মেয়ে সবাই দেখছে।

-না।

-মনে পরে আজ থেকে বিশ বচ্ছর আগে। একটা ছেলেকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে এসেছিলেন? ছেলেটা রাস্তায় কাদছিলো একা একা। কেউ তার কান্না শুনছিলো না। আপনি এসে বললেন

-কি হয়েছে তোমার?

ছেলেটা বললো সে যে এতিমখানায় বড় হয়। সেখানে তাকে প্রচন্ড মারে। ভয়ে সে পালিয়ে এসেছে।
ফরিদের মনে পড়ে

-ছোটন!!!

-হ্যাঁ বাবা। আমি ছোটন।

ছোটন ফরিদকে বুকে জড়িয়ে ধরে।
-তুই এতো বড় হয়ে গিয়েছিস! কত বছর যোগাযোগ নাই!

-বাবা আমি প্রতিদিন আপনার কথা ভাবি। সেই সময় আপনি আমাকে বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। প্রায়ই এসে আমাকে দেখে যেতেন। আমাকে জিজ্ঞেস করতেন কিছু লাগবে কিনা। এটা সেটা কিনে দিতেন। ঈদে, বিভিন্ন বন্ধে বাসায় নিয়ে যেতেন, রাতে আমায় জড়িয়ে ধরে ঘুম পাড়াতেন।

ছোটন শিউলির দিকে তাকিয়ে বলে

-মা চিনতে পেরেছেন?

শিউলি ছোটনের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়

-হুম। তখন আমার নতুন নতুন বিয়ে। ফরিদের পাগলামি দেখে আমি অবাক হতাম। ঈদে নিজে কিছু নিবে না; কিন্তু ছোটনকে তার দিতে হবে। আমি মাঝে মাঝে রাগ করতাম।

-এরপর আপনাদের ছেলে হয়। আমি যা খুশী হয়েছিলাম। ভাবলাম আমার ভাই হয়েছে। ইশ কি দিন ছিলো সেই সব দিনগুলো। সেই এতিমখানায় থাকলে আমি বোধহয় মারাই যেতাম। ঐ বোর্ডিং স্কুলের টিচাররা আমাকে খুব পছন্দ করতো। সবাই জানতো আপনারাই আমার বাবা-মা।
-হুম। একসময় এক দম্পত্তি তোকে পছন্দ করে। তারা অ্যামেরিকায় থাকতো। সেই বোর্ডিং স্কুলে ঘুরতে এসেছিলো। নিঃসন্তান দম্পত্তি। স্কুল থেকে আমার সাথে যোগাযোগ করে। আমি কোনভাবেই রাজি হচ্ছিলাম না। বললাম আমার ছেলেকে দিবো না। তখন শিউলি বললো আমাদের সাথে থাকলে তোর ভবিষ্যৎ আমাদের মতোই হবে। তার থেকে বিদেশে গেলে হয়তো ভাগ্যের পরিবর্তন হতে পারে।

-জী বাবা। আমার মনে আছে। আপনি কান্নাকাটি করে আমাকে বিদায় দিয়েছিলেন। আমার নতুন বাবা মা-র হাত ধরে বলেছিলেন ও আমার ছেলে। আপনাদের দিলাম। কখনো যদি ওর দ্বারা কষ্ট পান। আমার কাছে ফিরিয়ে দিবেন। কিন্তু ওকে কষ্ট দিবেন না।

-হুম মনে আছেরে। এই সংসারের চাপে কত কিছু ভুলে গিয়েছি।

তারা সবাই ইফতারি খেতে বসে। ছোটন ফরিদের ছেলে মেয়েদের জড়িয়ে ধরে।

বাবা ওর কত বড় হয়ে গিয়েছে। আমার ভাই-বোন।

কি করছিস এখন?
ফরিদ জিজ্ঞেস করে
এতো বড় গাড়ি পেলি কই?

-বাবা আমি অ্যামেরিকা গিয়ে প্রথম দিকে আমার খুব মন খারাপ থাকতো। কিন্তু আমার নতুন বাবা-মাও খুব ভালো। আমাকে ভীষণ আদর করতো। একসময় আমি পড়াশুনা শুরু করলাম। আমার রেজাল্ট ভালো হতে থাকলো। আমি ইউনিভার্সিটি পাশ করার আগেই অনেকগুলো নতুন সফটওয়্যার ডিজাইন করলাম। সেখানে সবচাইতে ক্রিয়েটিভ ইয়াং ট্যালেন্ট হিসেবে আমার বেশ নাম। কোম্পানিগুলো চড়া দামে আমার কাছ থেকে সফটওয়্যার কিনে নিলো। আমি বেশ টাকা পয়সার মালিক হলাম। আমার অ্যামেরিকার বাবা মারা গেছে বছর খানেক হয়। মা আমার সাথেই থাকে।

ফরিদ, শিউলি দুজন খুব খুশী হয়। কে এমন মনে রাখে পুরাতন দিনের কথা।

-বাবা আপনি আমাকে নতুন জীবন দিয়েছিলেন।

শিউলি ফোঁড়ন কাটে

-তোমার বাবা আজকেও একজনকে নিয়ে এসেছে।

ছোটন অবাক হয়
-বাবা আপনি এখনো আগের মতোন আছেন?
ছোটন ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে।

-আমি দুটো কাজে বাংলাদেশে আসছি। আমি বিয়ে করবো বাবা। আমেরিকায় একটা বাংলাদেশী মেয়েকে। আমার নতুন জীবন শুরু করার সময় আপনাদের আমার পাশে থাকতে হবে। আপনাদের অ্যামেরিকা যেতে হবে।

ফরিদ হাসে
-বাবা তুই আসছিস আমরা তাতেই খুশী। তুই জীবনে সুখী হবি। এটাই আমরা চাই। আর তোর বউ অবশ্যই সুখী হবে। শত হলেও তুই আমার ছেলে।

শিউলি হাসে
-কি আমার বাপরে…

-আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে বাবা, আমি আমার ভাই-বোনের জন্য কিছু করতে চাই। আমি আমার বাবা মা-র জন্য কিছু করতে চাই।

ছোটন চলে গিয়েছে।

শিউলি এসে ফরিদের পাশে বসে

-বিকেলে তোমার সাথে অনেক রাগ করেছি। দুঃখ পেয়েছো?

-ছোটনকে দেখে আমার দুঃখ চলে গিয়েছে।

ফরিদ শিউলির দিকে তাকিয়ে আছে।

শিউলি আবার বলতে থাকে

-থাক নতুন ছেলেটা আমাদের সাথে থাক। ওকেও একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিতে হবে। যাও ওর জন্য ঈদের ড্রেস কিনে নিয়ে আসো। কাল বাদে পরশু ঈদ। আমার জন্য যে শাড়ি কিনার কথা ছিলো সেটা লাগবে না। গত ঈদের শাড়ি এখনো নতুন।

ফরিদ শিউলিকে জড়িয়ে ধরে

-তুমি সারাজীবন কষ্ট করেই গেলা।

শিউলি জানে ফরিদ অল্পতেই কেঁদে দেয়। আরে বাবা পুরুষ মানুষ এইভাবে কাঁদলে হবে! ফরিদ একটা খাম বের করে শিউলিকে দেয়

-ছোটন দিয়ে গিয়েছে। আমাদের জন্য।

শিউলি খাম খুলে দেখে সেখানে একটা চেক লেখা। তিন কোটি টাকার চেক।

শিউলি চিৎকার করে উঠে

-এতো টাকা।

-হুম। বলে গিয়েছে শুধুমাত্র আমাদের জন্য সে এই টাকা দেশে ঢুকিয়েছে। সব কাগজপত্রও দিয়ে গিয়েছে যেন আমাদের সমস্যা না হয়।

ফরিদ আর শিউলির চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। শিউলি বলতে থাকে

-সারাজীবন তুমি মানুষের উপকার করেছো। আমার মনে হতো, কি বোকা আমার জামাইটা। আমাকে ক্ষমা করে দিও।

-না শিউলি, আমার সাথে সংসার করে তুমিও সারাজীবন কত কষ্ট করেছো। তোমাকে সুখ দিতে পারি নাই। এমন ঘটনা জীবনে বিরল ঘটনা। কেউ কি মনে রাখে; ছোটনের মতো মানুষ খুব কমই হয়।

শিউলি বলে
-তোমার মতো মানুষওতো কম। তুমি যেভাবে মানুষের বিপদে এগিয়ে যাও!

জীবনের গল্পগুলো বাঁধাধরা নিয়মে হয় না। আমরা হয়তো অনেকে তা জানি অনেকেই জানি না। জীবনে অনেক অদ্ভুত কিছুও ঘটে। অনেক ভালো কিছু ঘটে। ভালো, মহৎ মানুষের সাথে ভালো কিছু ঘটবে আমরা তাই আশা করি।

অচিনপুর ডেস্ক/ এস.এস.ববি

Post navigation