অবশেষে

অনিকেত উদাসীন
দক্ষিণ লন্ডন, ইংল্যান্ড ।

গল্প: অবশেষে

ক্রিং ক্রিং ক্রিং… তারস্বরে মোবাইল এলার্মটা বেজে উঠল। রাত আড়াইটা।

প্রবল ঘুম-জড়ানো চোখে চয়ন সেটাকে স্নুজ করতে গিয়ে সম্বিৎ ফিরে পেল যেন! এ নিয়ে দুইবার করেছে বোধহয়। কী সর্বনাশ! তাকে যে ফ্লাইট ধরতে হবে। সে বিমান বন্দরও কাছেকূলে নয়। নৈশ বাস, হাঁটা ইত্যাদি করে মেলা পথ পাড়ি দিতে হবে। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে কোনমতে গুছিয়ে নিয়ে, পিঠে একটা রুকস্যাক চাপিয়ে বের হয়ে গেল। সাড়ে তিনটার নৈশ বাস ফস্কে গেলে অনেক দূর্ভোগ আছে কপালে!

জমাট শীত তার থাবা বিস্তার করতে শুরু করেছে। একটা ঝুম হয়ে থাকা ঠাণ্ডা জাঁকিয়ে বসতে চাচ্ছে যেন। পথঘাট প্রায় ফাঁকাই। শুধু সদাজাগ্রত ট্রাফিকের শব্দই রাতের নীরবতাকে খান খান করে দিচ্ছে। সেদিকে তাকাবার সময় নেই চয়নের। দীর্ঘদেহী চয়ন বড় বড় পা ফেলে মুহূর্তেই পৌঁছে গেল বাসস্টপে।

এবং যারপরনাই বিস্মিত হয়ে গেল। কেউ নেই শুধু অনিন্দ্যসুন্দর এক তরুণী ছাড়া। সাথে ঢাউস একটা লাগেজ। আর, আরো বিস্ময়ের, সে পরে আছে একটা ময়ূরকণ্ঠী নীল জামদানি! এই শীতেও তাঁর পরনে কোন শীতের পোশাক নেই। চয়নের মনে হল, ওতে ভালই হয়েছে নইলে এমন চমৎকার দেহ-বল্লরী কি দেখতে পেত! সে বোধহয় হাঁ হয়ে গিয়েছিল! চমক ভাঙ্গল অপ্রিয়কর এক জল-তরঙ্গ কণ্ঠে।

কী মেয়েমানুষ দেখস নাই জীবনে? খবিস জানি কুনহানকার! হাঁ কইরা গিলতাছে…

আ…আমাকে বললেন? বিস্ময়ে তোতলাতে থাকে চয়ন।

হ, তুই ছাড়া আর কে আছে এইহানে?

চয়ন সামলে নেয়। আপনি অভদ্রতা করছেন কিন্তু! তুই-তোকারি কেন করছেন? কী সব আজেবাজে কথা বলছেন!

ঠিক এই সময়ে বাসটা হেলতে-দুলতে চলে আসে। চয়ন ভদ্রতা করে মেয়েটাকে আগে ওঠার জন্য হাত দিয়ে ইঙ্গিত করে। মেয়েটা উঠে পড়ে এবং পেছন ফিরে চয়নকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-সং-এর মত দাঁড়ায় আছস ক্যান? এই ভারী লাগেজ আমি টাইন্যা তুলব তুই থাকতে?

ভারী রাগ হয়ে গেল চয়নের। সে আমি কি জানি? নিজের লাগেজ নিজেই টেনে নিন।

মেয়েটা কেমন অদ্ভুত চোখে তাকাল। হঠাত চয়নের বড় পছন্দ হয়ে গেল এই মুখরা মেয়েটাকে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠিয়ে দিল। আর দেমাগি মেয়েটা গটগট করে একটা ফাঁকা আসনে গিয়ে বসে পড়ল। একটা ধন্যবাদ তো তার পাওনা ছিল নাকি?

আপনার পাশে বসতে পারি?

-না, পারেন না। অসভ্য লোকদের আমি দুচোক্ষে দেখতে পারি না।

-বারে! আমি অসভ্য?

একশো বার। কিন্তু চয়নের রোখ চেপে গেল। সে ওর পাশে গিয়েই বসে পড়ল।

-এ কী? বসতে মানা করলাম, তা-ও বসে পড়লেন? বেশরমও দেখি!

-আরে, এখন দেখি সুন্দর ভাষায় কথা বলছেন! আমি ভাবলাম…

-কী ভেবেছিলেন? ভ্রুকুটি করে তরুণী।

কী মুখে কী ভাষা! হা হা হেসে ফেলে চয়ন।

ঠিক তখনই মেয়েটাও হেসে ফেলে। হাসলে গালে একটা টোল পড়ছে। নাকের ফুলটা বাসের মৃদু আলোতেও চমকে ওঠে।

আমি মিথি মানে মিথিলা। আপনি তো চয়ন, তাই না? আপনাকে অনেক কটু কথা বলে ভড়কে দিয়েছি। প্লিজ কিছু মনে করবেন না। সেলফ ডিফেন্স আর কী! আসেন সন্ধি করি–চাঁপাকলি আংগুলে হাত বাড়িয়ে দেয় মিথিলা।
চয়নের প্রকাণ্ড কর্কশ হাতে এই পেলব হাতটুকু যেন একটু অন্যরকম পরশ বুলিয়ে দেয়। সে নিজেকে সংযত করার একটা প্রবল চেষ্টা করতে থাকে।

-ও বাবা, সেলফ ডিফেন্স! তা আমার নাম জানলেন কী করে? যতদূর জানি আমি তো কেউকেটা কেউ নই! ফিল্মেও কাজ করি না। যদিও দেখতে মন্দ নই, কী বলেন?

-ঠোঁট উলটে ফেলে মিথিলা। বাব্বাহ, নিজের চেহারা নিয়ে এত দেমাগ? আপনার নাম ইংরেজি বাংলা দুটোতেই লেখা আছে ঐ রুকস্যাকের ট্যাগে।

-বাহ্‌, দারুণ চোখ তো আপনার! তা আপনার নিজেরও কি দেমাগ নেই?

-কেন, বলেন তো? অবাক হয়ে যায় মিথি।

-ন্যাকামো হচ্ছে? জানেন না বুঝি? মেয়েরা তো জানতাম খুব আয়না দেখে। এখন অবশ্য মোবাইলের সেলফি ক্যামেরাতেও দেখে।

-কচু জানেন। লজ্জা পেয়ে যায় মিথি। আপনি কিন্তু ফ্লার্ট করছেন।

-অ্যাঁ, করছি নাকি? ফ্লার্টিং-এর আর দোষ কী? আপনি বস্তুটাই ওরকম।

-কী! আমি বস্তু?

না মানে সবাই তো বস্তু, পদার্থ আর কী! হাসতে থাকে চয়ন।

যান, আপনার সাথে আর কথাই নাই! মেয়েদের সম্মান করতে জানতে হয়, বুঝলেন মিস্টার?

জ্বী, সে খুব ভাল জানি, মিস মিথিলা।

কে বললো আমি মিস? মিসেসও তো হতে পারি।

আপনি মিসেস?

এতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? হলে কি ফ্লার্ট করতেন না? এখন কি অন্য আসনে গিয়ে বসবেন? খুট করে হেসে ফেলে মিথি।

আপনি বড় অন্যরকম মিথিলা। বেশ সহজ। আর পাঁচটা মেয়ের মত না। তা হাসব্যান্ডের কাছে যাওয়া হচ্ছে নাকি?

ধরে নিন তাই।

সেজন্য শাড়ি পরেছেন নাকি? আপনাকে কিন্তু দারুণ দেখাচ্ছিল একেবার ঋতুপর্ণার মত!

আবার ফ্লার্ট করছেন?

এই তো আপনাদের সমস্যা। সত্যটা শুনতে চান কিন্তু বলতে গেলে তেড়ে আসেন মারতে।

মনে হচ্ছে খুব অভিজ্ঞতা মেয়েদের ব্যাপারে। তা সত্যবাদী যুধিষ্ঠির, আপনার উম্যান সম্পর্কে কিছু বলেন দেখি!

সে ডিপার্টমেন্ট-এ তো লবডঙ্কা!

এই তো মিথ্যে বলছেন। জুলফিতে পাক ধরেছে আর বলছেন কেউ নেই!

নেই তো বানিয়ে বলব নাকি? সেজন্য তো হ্যাংলার মত তাকিয়ে ফেলি মাঝে মাঝে।

সে তো দেখতেই পাচ্ছি!

কী বললেন?

নাহ কিছু না। এই বোরিং জার্নিটা ভালই লাগছে। আপনি না থাকলে হয়তো ঘুমিয়ে পড়তাম। আর কেমন ফিল্মি লাগছে তাই না?

চয়ন নিজের প্রশস্ত কাঁধটা দেখিয়ে দিয়ে, চাইলে এখনও পড়তে পারেন। ওটা ফাঁকাই আছে বহুদিন। হা হা হা।

যাহ, ফান নয়। সত্যিই আপনার কেউ নেই? যদি আপত্তি থাকে বলতে হবে না। এই অল্প সময়ের পরিচয়ে খুব বেশি তো দাবী করা যায় না, শোভনও নয়!

যদি বলি, নাকে দড়ি পরতে যাচ্ছি…

ওমা, কী মজা! সত্যিই?

তা তো খুশি হবেনই। মেয়েরা তো জন্ম থেকেই স্যডিস্ট! মজা তো পাবারই কথা!

কী যে সব বলেন না আপনি!

এরপর আর কথা হয় না। অস্বস্তিকর নিরবতা নেমে আসে। যেন হঠাৎ করেই একে অপরের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলতে থাকে। মিথিলা জানলা দিয়ে রাতের চলমান নৈশব্দের দিকে তাকিয়ে কী যেন একটা খুঁজতে থাকে। চয়নও চোখ বুজে ফেলে। মনোভঙ্গের উত্তুঙ্গ যাতনার মত কী একটা হারানোর বিষাদ দুইজনের মাঝের ছোট্ট জায়গাটিতে ভারী হয়ে বসে যেতে থাকে। কী এর মানে? জেনেও অজানার মত ভেসে বেড়াতে থাকে উত্তরটা।
মিথিলাও ঘুমিয়ে পড়ে একসময়। হঠাৎ ঘাড়ের কাছটায় একটা মাথার স্পর্শ পেয়ে চমকে ওঠে চয়ন। মিথিলা! কী অদ্ভুত একটা সুগন্ধ আসছে ওর শরীর থেকে। আর একটা অসহ্য উত্তাপ। সে উত্তাপ ছুঁয়ে স্রেফ মরে যেতে ইচ্ছে হল। কিন্তু এ যে অন্যায়! প্রাণপণে নিজেকে শাসাতে লাগল সে। জগতের তাবৎ ক্রূর ঘটনাগুলিই কেন ঘটে ওর সাথে? সামিন -এর আদল কেন এই যুবতীর উপরে? অলক্ষ্যে চোখ জ্বালা করে ওঠে চয়নের। ঠিক তখনই বাসটা গন্তব্যে পৌঁছে যায়।

সবাই নেমে যেতে থাকে। চয়ন মিথিলাকে আলতো করে ডাকে। ঘুম ভেঙ্গে নিজেকে চয়নের কাঁধে আবিষ্কার করে লজ্জায় এতটুকু হয়ে আসে মিথিলা।

-স্যরি, কী কাণ্ড বলেন! ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আপনাকে কষ্ট দিলাম!

-স্যরি কেন? আমার তো ভালই লাগল! মুখ টিপে হাসতে থাকে চয়ন।

-কী!
চোখ পাকিয়ে তাকায় মিথিলা, কিন্তু হঠাৎ চয়নকে টপকে আসনের উপরের তাকে রাখা ছোট্ট হ্যাণ্ড লাগেজটা নামাতে যায়। আর তখনি ওর উন্মুক্ত নাভীমূল আর ফর্সা পেটের অনেকটা চয়নের ঠোঁট ছুঁয়ে যায়! ঘটনার আকস্মিকতায় স্থাণু হয়ে যায় দুজনেই। যুগল পর্বতের মধ্যস্থিত গিরিখাদ পেরিয়ে চিবুকের কিনারা চুমে একজোড়া হরিণ চোখে আটকে যায় চয়ন। ক্ষণমাত্র, কিন্তু তাতেই কোথায় যেন একটা ভয়াবহ ভাংচুর হয়ে যায়। সে খবর যার ভাঙ্গে, সেই কেবল জানে!

বাইরে বেরিয়ে ঠাণ্ডার প্রকোপটা বুঝতে পারে মিথিলা। একটা গরম কিছু না নেয়াটা বিরাট বোকামি হয়ে গিয়েছে। শেষ রাতের হাড় কাঁপানো হাওয়ায় মিথি থেকে থেকে কেঁপে উঠতে থাকে। নাটক-সিনেমার বহুল চর্বিত চর্বণের মত হলেও চয়ন নিজের জ্যাকেটটা দিয়ে মিথিকে মুড়ে দেয়। মিথি বাঁধা দেয়, কিন্তু কোন কথা না বলে শক্ত হাতে তা প্রতিহত করে চয়ন।

বিমান বন্দরের ডিপার্চারের বিশাল পর্দায় যার যার গন্তব্য দেখে নেয় দুজনে। এখান থেকে আলাদা হয়ে যাবে তারা। হয়তো আর কোনোদিন দেখা হবে না। শুধু বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে একে অপরের চোখে। সেখানে কীসের একটা বোঝাপড়া যেন সব বাঁধা ছাপিয়ে উপচে পড়ে যাচ্ছে! কান্না পেয়ে যায় মিথির। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে,

-আপনার জ্যাকেটটা?

-থাক, তুমিই রাখ। আমাদের বন্ধুত্বের নিদর্শন!

আর কোন কথা হয় না। ওরা বোধহয় হারিয়ে গেল চিরতরে একে অপরের থেকে…

কিছু দিন পর… জ্যাকেটের পকেটে একটা চিরকুট পেল মিথিলা,

মিথিলা, ইউ আর আ টেরিব্যল লায়ার! আর একটা ফোন নাম্বার। এগার ডিজিটের।

ওপাশে রুকস্যাকের পকেটে আরেকটা চিরকুট পেল চয়ন,

চয়ন চৌধুরি, কাওয়ার্ড কোথাকার! আমি তোমাকে ঘৃণা করি। কেন বলতে পারলে না?

চয়নের হৃদপিণ্ডটা মুখে যে চলে এসেছিল, এটাও কি বলে দিতে হবে?

অচিনপুর ডেস্ক /এসএসববি

Post navigation