হরর থ্রিলার “প্রতিবিম্ব“
শারমিন সুলতানা চৌধুরী
নিউ ইস্কাটন, ঢাকা।
প্রতিবিম্ব: ১
“বাবা, তোমাকে আজ অন্যরকম লাগছে।” ঘুম থেকে উঠে চোখ মুছতে মুছতে অর্ক বলল।
“কেমন রে? তুই ওঠতো, স্কুল আছে। তোকে নামিয়ে আমি অফিস যাবো।” অতনু রেডি হতে হতে বললো।
প্রতিদিন এই সময়টায় অতনু প্রেমাকে খুব মিস করে।ও থাকলে কি সহজই না মনে হত সব। এখন অর্ককে রেডি করিয়ে স্কুলে পাঠানোও একটা যুদ্ধ যেনো। কাজে সাহায্য করার মানুষ আছে একজন, তাও অতনু নিজেই অর্ককে ব্যাগ গুছিয়ে দেয়, কাপড় পরিয়ে দেয়।৬ বছরের অর্ককে যতটা পারে, সময়ও দেয় সে।
“বাবা, তুমি না অন্য কেউ লাগছো।” নাস্তার টেবিলে হাসছে অর্ক।
অতনু ইদানীং আয়না দেখার সময় পায় না সকালে।এখনো পেল না। অর্ক হাসছে, এটাই অনেক। মাকে ছাড়া যে কিভাবে থাকছে! প্রেমা যে কোথায় হারিয়ে গেল? দু’বছর হয়ে গেলো, কোন খোঁজ ও পাওয়া গেল না।
অতনুর সময় কাটে অপেক্ষায়। কেউ হারিয়ে গেলে মানুষ কেন যেন সেই সব স্মৃতিকেই আঁকড়ে ধরে! যা হারিয়ে যাওয়া মানুষটার প্রিয় ছিলো, তার স্পর্শ পেয়েছে, অতনুর তাই সময় কাটে স্টাডিতে। প্রমাণ সাইজের আয়নাটার সামনে।
এ আয়না যখন কেনা হল একটা পুরোনো আসবাবের দোকান থেকে, অতনুর আপত্তি ছিল। এত বড় আয়না তার তিন রুমের ফ্ল্যাটের সাথে এক্কেবারে যায় না। কিন্তু প্রেমার মুগ্ধ দৃষ্টি বাধ্য করল। প্রেমার খুব প্রিয় এই স্টাডিরুমটা। বাইরে এক চিলতে বারান্দা, কৃত্তিম ঘাস, প্রিয় ফুল আর উইন্ডচাইম। ছুটির বিকেলটা ভালোই কেটে যেতো।
প্রেমার পছন্দ সমরেশ, সুনীল। কেন জানি? সে আয়নাটার সামনে বসেই বই পড়তো। অতনু এখনো বুঝে পায় না। স্টাডিতে আয়না রাখার যুক্তি কি ছিলো প্রেমার। কি দেখতো ও এত, আয়নায়? রেগে তো একবার অতনু বলেই ফেলেছিলো, “যাও আয়নাতেই চলে যাও, ওটাই পৃথিবী তোমার।”
আজ প্রেমা নেই। অতনুর সময় কাটে আয়নাটার দিকে তাকিয়েই। প্রেমাকে যেন দেখতে পায় সে আয়নায়।প্রতি রাতে অনেকটা সময় কথা বলে সে প্রেমার সাথে, আয়নায় তাকিয়ে। না বলা কথাগুলো যেন বলেই ফেলতে হবে সব।
অফিসেও সবাই কেমন অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। কি করেছে সে! শার্ট আয়রন করা, ক্লিন শেভড, কি দেখছে সবাই?
জরুরী ফাইলগুলো আগে দেখতে হবে, সিগনেচার করতে গিয়ে অবাক হয়ে গেলো অতনু। সে বাম হাতে লিখছে কেন এত সাবলীল ভাবে? মোবাইলটা বের করে নিজেকে দেখলো একবার। অন্যরকম লাগছে, কি সেটা? শার্টটা পুরোনো। কলারের ঠিক নিচে একটু কালচে দাগ ছিল, বাম দিকটায়। কি আশ্চর্য! দাগ টা ডান দিকে এলো কিভাবে! নিজেকে দেখলো আবার।
সিঁথিটা বাম দিকে। তার চিবুকের তিলটাও তাই। অতনু অবাক হয়ে গেলো। কি হচ্ছে এসব? ভুতুড়ে কান্ড, নাকি সে ঘুমোচ্ছে এখনো? ঘুম থেকে উঠেই দেখবে সেই চিরাচরিত জীবন, সেই একাকীত্ব, সেই আয়না।
প্রতিবিম্ব ২
সারাদিন এলোমেলো হয়েই রইলো অতনু। এর ব্যাখ্যা কি? সিঁথি হয়তো সে অন্যভাবে করেছে, শার্টের দাগও ধরে নেওয়া যায়, খেয়াল নেই তার। কিন্তু চিবুকের তিল কি ভাবে দিক বদলায়! সারাজীবন সায়েন্স ফিকশনের ভক্ত অতনু। সায়েন্স দিয়ে ব্যাখ্যা হয় কি?
প্রেমা থাকলে এটা নিয়ে খুব ভয় পেত। ভুতের ভয় ছিলো ওর প্রচন্ড। কি সব অদ্ভুত ভুতের গল্প পড়তো, দেশ বিদেশের। ভয়ে শেষ রাতে লাইট জ্বালিয়ে ঘুমাতো প্রায়ই। একবার কি যেন পড়লো নেটে, রাত ২টায় একটা নির্দিষ্ট নাম বললে নাকি আয়নায় তার ভুত হাজির হয়, সেটা নিয়ে যে অতনু কি ভয়টা দেখিয়েছিলো। পরের ৩ দিন প্রেমা রেগে গিয়ে আর কথাই বলেনি।
বাসায় ফিরে খেয়ে নিলো বাবা-ছেলেতে মিলে। তাকে বাম হাতে খেতে দেখলে অবাক হবে অর্ক। তাই সাহায্য নিল বিদেশী কেতার। কাজের ছেলেটা উসখুশ করছে।কিছু বলতে চায় হয়তো। এই অসময়ে ছুটি চাইলে সেতো বিপদে পড়বে। তাও দিতে বাধ্য। অনেক বছর হলো কাজ করছে। প্রেমারও খুব বিশ্বস্ত রন্টু। বছর ১৬ হবে বয়স। এখানে আছে প্রায় ৫ বছর হবে। অর্ককে সেই দেখে রাখে, খেলে ওর সাথে, স্কুল থেকেও নিয়ে আসে।
“মামা, একটা কথা বলব?” রন্টু ভয়ে ভয়ে বললো।
“বল, কি লাগবে ?”
“ভাইয়ার সামনে বলব না? ও ঘুমায় যাক, তারপর”।
নিশ্চিত বেতন বাড়াবে। তাও ভালো, ছুটি না নিক এখন। অফিস থেকে এখন অতনু ছুটি পাবে না।
অর্ককে ঘুম পাড়িয়ে স্টাডির বারান্দায় এল অতনু। রন্টুটা স্টাডির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ইশারায় ডাকছে তাকে। বের হয়ে এলো সে।
“হয়েছে কি? বল তো? রুমে ঢুকিস না কেন? তোকে না আজ পরিষ্কার করতে বলেছিলাম বুকশেল্ফ গুলো?”
“মামা, আয়নাটা ফেলে দেন” ভয়ে বললো রন্টু।
“কেন? ফেলে দিবো কেন? তুই জানিস না, এটা তোর মামীর খুব পছন্দের ছিলো।”
“মামী ওইটার ভেতরে”
“কি? হা হা হা, তুই কি রে? তোকে তো তোর মামীর মত ভুতে পেয়েছে রে।”
“মামা, সত্য বলতেসি, মামীরে দেখসি আমি আজকে বিকালে। আমারে কইসে অর্ক ভাইয়ারে ডেকে দিতে।”
“চুপ! আমাকে বলেছিস, বলেছিস। অর্ককে এসব একদমই বলবি না। এমনিতেই একা থাকিস তোরা বাসায়। এসব মাথায় ঢুকাবি না ওর একদম।”
রন্টু জানতো মামা যে বিশ্বাস করবে না। সে গ্রামে শুনেছে, মৃত মানুষের মায়া পড়ে যায় প্রিয় মানুষদের উপর। কত ঝাড়ফুক চলে? শহরের মানুষ এসব মানে না, যতদিন না বিপদে পড়ে।
প্রতিবিম্ব ৩
বিপদটা যে এত তাড়াতাড়িই আসবে, রন্টু জানত না ভয়ংকর বিপদ।
রন্টু ভয় পেয়ে গেছে। অতনু জানে। আর ভয় পেলে সে ভয় সে অর্কের মধ্যেও ঢুকিয়ে দিবে। এটাও বেশ বুঝতে পারছে অতনু। তার নিজের সবকিছু যে দিক বদলেছে, আপাতত এটা নিয়ে সে ভাবার সময় পাচ্ছে না। অফিসে ভীষণ কাজের চাপ, অর্কেরও পরীক্ষা। দুই মিলিয়ে প্রাণ হাসফাস অবস্থা। রন্টুর ভয়টা কাটিয়ে দিতে হবে। না হলে কাজে রাখাও মুশকিল। গ্রামের ছেলে, রাত বিরেতে মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়াবে, কিন্তু শহরে এসে ভুতের ভয়ে কাত। কি আর করা?
অফিসে নিজের মতো করেই কাজ করে গেলো অতনু। আজ আর আগের দিনের মতো করে কেউ ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে না বারবার। হাসলো সে। সে যেন নতুন কোন গুজব, খুব তাড়াতাড়িই সবার উৎসাহে ভাটা পড়লো। তাহলে প্রেমা থাকলে নিশ্চয় এটা নিয়েও হাসাহাসি করতো।
কিন্তু রন্টু প্রেমাকেই বা দেখলো কেন? রাতে হলে সে কাটিয়ে দিত ঘুমের ঘোরে দেখেছে বলে। বিকেল বেলা সে কি বলে যুক্তি দিবে। নাকি কাজ করতে চাইছে না বলে গল্প বানাচ্ছে? তা তো হবার কথা নয়। ছেলেটাকে সে নাইট স্কুলেও পড়াচ্ছে, সামনে পরীক্ষাও তো দিবে।
অর্ককে স্কুল থেকে আনার কথা মনে করিয়ে দিতে মোবাইলটা হাতে নিতেই রন্টু অর্ককে স্কুল থেকে আনার কথা মনে করিয়ে দিতে মোবাইলটা হাতে নিতেই রন্টুর মোবাইল থেকে ফোন আসলো।
“মামা, আসেন আপনি। তাড়াতাড়ি, আমি বাসা থেকে বাইর হইয়া গেসি।” স্বর জড়িয়ে যাচ্ছে রন্টুর।
“কি হয়েছে? বাসা থেকে বের হয়ে গেছিস কেন?” রেগে গেলো অতনু।
“মামী, আবার দেখসি আমি।”
“শুধু তুইই দেখিস। আমি দেখি না, অর্ক দেখে না।”
“কেন দেখেন না, আমি কেমনে কমু? আজকে মামী হাতও বাড়ায় দিসে আমার দিকে। কি জানি কইলো বিড়বিড় কইরা।”
“রন্টু, কি চাস বলতো, বাড়ী যাবি?”
“মামা, আপনে আমার কথা বিশ্বাস করেন। আমার দিকে একটা কাগজও বাড়ায় দিসিলো মামী। আমি নেই নাই। মামীর হাতে রক্ত।”
“আমি আসছি অর্ককে নিয়ে। তুই বাসার সামনেই থাক।”
অফিসে বলে বের হয়ে গেলো অতনু। মহাঝামেলায় পড়া গেল। আরেকজন মানুষ খুঁজতে হবে, বাসায় থাকার জন্য। রন্টুও থাকল। তার পরিবার থেকে বারবার বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। এদের বলে তো বুঝানো যাবে না। তারপক্ষে সম্ভব না এখন। প্রেমা ফিরবে, সে জানতো, এতো সহজে সে হাল ছেড়ে দিবে?
অর্ককে নিয়ে বাসায় ফিরেই রন্টুকে ডেকে নিলো স্টাডিতে, আয়নার সামনেই। ছেলেটার মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেছে। আসলেই ভয় পেয়েছে ছেলেটা। এটা ভান নয়।
“মামা, আইসেন যখন আয়নাডা ভাঙেন”।
“অর্কের মায়ের স্মৃতি এটা। ভাঙতে পারব নারে।” অতনু বুঝাতে চেষ্টা করলো একটু।
“মামা, আমি থাকতে পারুম না আর, ডর লাগে। বাড়ি যাবো।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল অতনু। যা ভেবেছিলো তাই..
“আর কয়েকটা দিন থাক, আমি আরেকজন মানুষ খুঁজি বাসায় থাকার জন্য। না পেলে অর্ককে ওর নানার বাড়ি দিয়ে আসবো, তুই চলে যাস।”
আয়নাটা আরেকবার ভালো করে দেখলো অতনু।সাধারণ, কোন পরিবর্তন নেইতো। পরিষ্কার করা হয়নি কদিন। হয়তো ভয়েই করেনি রন্টু। আজথাক, নিজেই করে নিব।
হঠাৎই আয়নার কাছে মেঝেতে দৃষ্টি গেলো তার। একটা সাদা কাগজ ছোট্ট। খুলে দেখলো সে। অর্ক হয়তো প্লেন প্লেন খেলতে খেলতে ফেলে গেছে।
অফ হোয়াইট একটা ছোট্ট কাগজের টুকরো, কাঁপা হাতে লেখা “অর্ক” আর কিচ্ছু না।
অতনু স্থবির হয়ে গেলো হঠাৎ। প্রেমা তাকে চিঠি দিত একসময়। আবেগের কথা থাকুক না থাকুক। একটা অদ্ভুত কাজ সে করতো। বিভিন্ন রঙের আঙুলের ছাপ দিত চিঠির এক কোণ ঘেঁষে। কখনো হলুদ, কখনো নীল, কখনো সবুজ।
আজ রঙটা লাল, রক্তের মত লাল…
(চলবে)
অচিনপুর ডেস্ক / আ.সীমা