হক সাহেবের হাসির গল্প (দ্বিতীয় গল্প)

– কাজী নজরুল ইসলাম

পাড়াগাঁয়ের গরিব মুসলমানদের মধ্যে একজন মোড়ল ছিলেন। তাঁকে সকলে ফকিরজি বলে ডাকত। তিনি দিনরাত আল্লা নাম জিকির করতেন। তাঁর গায়ে সর্বদা থাকত একটি চাদর। সেই চাদরে লেখা ছিল কোরান শরিফের অনেকগুলি বিখ্যাত সুরা (শ্লোক)। সেটিকে তিনি সযত্নে রক্ষা করতেন। সেই চাদর গায়ে দিয়ে গ্রামের লোকদের অনেক মাজেজা (বিভূতি) দেখাতেন, রোগ ভাল করতেন, তাদের মাঠে বেশি ফলন ফলাতেন ইত্যাদি। আর এক গ্রামের মোড়ল তাই দেখে মনে করল – ওই মোড়লের যা কিছু শক্তি, ওই চাদরের গুণে। ওকে যে গ্রামের – এবং পাশের অনেক গ্রামের লোকেরা শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে, দাওত (নিমন্ত্রণ) করে খাওয়ায় তার কারণ ওই চাদরের শক্তি। ওই চাদর কেড়ে নিয়ে গায়ে দিলেই আমাকেও সকলে সম্মান দেবে, শ্রদ্ধা করবে, পির বলে মানবে। এই ভেবে একদিন সে হাত জোড় করে সেই ফকিরকে নিমন্ত্রণ করে এল রাত্রে খাওয়ার জন্য। সন্ধ্যায় সেই ফকির এসে হাজির হলেন অন্য গ্রামের মোড়লের বাড়িতে। তখন সে তার দলবল নিয়ে রামদা দেখিয়ে বলল, ‘তুমি যদি তোমার গায়ের ওই চাদর আমাকে না দাও, তা হলে তোমাকে কোতল করব।’ বেচারা ফকির ওর রক্ত-চক্ষু আর রাম-দা দেখে গায়ের চাদর দিয়ে পালিয়ে এল।

ও-গাঁয়ের মোড়ল চাদর গায়ে দিয়ে সগর্বে পাড়া বেড়িয়ে এল। আড়-চোখে দেখতে লাগল, কেউ চেয়ে দেখে কিনা। কেউ এসে সালাম করে কি না। কেউ জিজ্ঞাসাও করল না, ‘মোড়ল! খবর সব ভালো তো?’ মোড়ল হতাশ হল না। মনে করল, দু চারদিন গায়ে দিতে দিতে এর শক্তি বেরিয়ে পড়বে। দিন পনেরো ক্রমে ক্রমে একমাস গায়ে দিয়েও কোনো শক্তি পেয়েছে বলে মনে হল না। গ্রামের লোক হাসে আর বলে, মোড়লের মাথা খারাপ হয়েছে।

এদিকে ফকির চাদর হারিয়ে হতাশ হয়ে পড়লেন। চাদরের শোকে কাঁদতে লাগলেন। এই চাদর তিনি মক্কা-মদিনা-ফেরত এক হাজির কাছে পেয়েছিলেন। একদিন ফকিরজি আর থাকতে না পেরে নদীর ধারে সারা রাত্রি জেগে জিকির করেন আর কাঁদেন! ভোরের সময় একজন ফেরেশতা (দেবদূত) এসে বলল ‘তোমার কোনো ভয় নাই, তোমার চাদর তুমি ফেরত পাবে। ও গাঁয়ের মোড়ল চাদর গায়ে দিয়ে কোনো শক্তি পায়নি। সে-তো আল্লাকে ডাকে না। ধৈর্য ধরো, আর কিছুদিন গায়ে দিয়ে ও তোমার চাদর আবার তোমায় ফিরিয়ে দেবে।’

ফকির আনন্দে নৃত্য করতে লাগলেন।

হক সাহেব বালকের মতো হাসি হেসে বললেন, ‘ওই ফকিরের চাদরের মতো মুসলিম লিগ ওরা কেড়ে নিয়েছে। প্রথম প্রথম কষ্ট হয়েছিল, এখন আমি জানতে পেরেছি আমার চাদর অর্থাৎ আমার মুসলিম লিগ আবার আমার কাছে ফিরে আসবে।’

সকলে সোল্লাসে হেসে উঠলেন।

,

Post navigation

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *