তাবাসসুম নাজ
টরেন্টো, কানাডা।
উপন্যাস: রূপকথা নয়(৪র্থ পর্ব)
পরদিন সকালে প্রাতঃরাশ করবার জন্য উপস্থিত হলে রাজা রণবিজয় রাজকুমারী ও বীথিকে সাদরে অভ্যর্থনা জানান।
– এসো, এসো। আমরা কেবলি খেতে বসলাম।
রাণী উর্মিলা হাসিমুখে তাদের শুভসকাল জানালেও তীক্ষ্মদৃষ্টিতে রাজকুমারী সুরমাকে লক্ষ্য করতে থাকেন। রাণীকে নিয়ে রাজমহলে অনেক কানাঘুষা আছে। বেশিরভাগের মত-রাণীর বুদ্ধি প্রচুর। রাজা রণবিজয়ের চাইতে বেশী তো বটেই। কিন্তু কি করবে? মেয়ে হয়ে জন্মেছে, তাই সিংহাসনে বসা তার কপালে নাই।
রাজকুমারী সুরমা আর বীথি নাস্তার টেবিলে বসে। রাজকুমারী সলজ্জ দৃষ্টিতে রাজকুমার অভীকের দিকে তাকায়। দেখা গেল রাজকুমার অভীকেরও কম আগ্রহ না রাজকুমারীর প্রতি। গতকালকের হতশ্রী দশার বদলে একজন রাজকন্যার উপযুক্ত বেশভূষা থাকায় রাজকুমারী সুরমার রূপ আজ যেন দশগুণ বেড়ে গেছে। রাজকুমার অভীক তাই মুগ্ধদৃষ্টিতে রাজকুমারীর দিকে তাকিয়ে থাকে। বুঝতে পেরে রাজকুমারীর ঠোঁটে হাল্কা হাসি ফুটে উঠল।
ব্যাপারটা হয়ত আরো বহুদূর গড়াতো যদি ‘প্রকৃত রাজকুমারী’ নামক বাঁধাটা অশুভ মূর্তির মত দুজনের মাঝখানে এসে না দাঁড়াত। মনে পড়ামাত্র রাজকুমার অভীক চোখ সরিয়ে নিয়ে খাবারে মন দেয়।
এদিকে বুদ্ধিমতি রাণী উর্মিলার চোখে সবই ধরা পড়ল। আচ্ছা, তবে এই ব্যাপার! দেখা যাক, এই কন্যা যদি সত্যি সত্যি একজন রাজকুমারী হয়, তো এর সাথেই অনিকেতের বিয়ে দিয়ে এই ঝামেলা চুকিয়ে দেব, ভাবে রাণী উর্মিলা।
রাজকুমারী সুরমাকে উদ্দেশ্য করে এবারে তিনি প্রশ্ন করেন
-ঘুম ঠিকমত হয়েছিল তো, রাজকুমারী সুরমা?
রাজকুমারী একটু ইতস্তত করে। বিপদে আশ্রয়দাতার কাছে অভিযোগ জানানো কি ঠিক হবে?
কিন্তু শেষে বলেই ফেলে
-সত্যি বলতে কি, রাতে একেবারেই ঘুমাতে পারিনি, রাণীমা। সারারাত এপাশ ওপাশ করেছি।
রাজকুমারী সুরমা হাই তোলে, সারারাত না ঘুমিয়ে তার চোখ লাল।
বহুকষ্টে কৌতুহল সম্বরণ করে রানী উর্মিলা তার রাজকীয় মর্যাদার কথা খেয়াল করে শান্তভাবে প্রশ্ন করে
-শুনে যারপরনাই দুঃখিত হলাম, রাজকুমারী। কিন্তু কেন তুমি ঘুমাতে পারলে না?
– রাণীমা, কথাটা বলা হয়ত আমার খুব অকৃতজ্ঞতা হয়ে যাচ্ছে কিন্তু এত শক্ত বিছানায় আমি জীবনেও রাত কাটাইনি। শক্ত বিছানায় শুয়ে আমার সর্বাঙ্গে কালশিটা পড়ে গেছে। এই দেখেন। রাজকুমারী হাত সামনে মেলে ধরে বাহুর কালশিটা দেখায়।
রাজা ও রাজকুমার সাথে সাথে দুঃখসূচক ‘আহা’ ‘উহু’ করে উঠে। কিন্তু রাণী উর্মিলার মুখে একান ওকান হাসি দেখা গেল।
বিস্মিত হয়ে রাজা রণবিজয় প্রশ্ন করেন
-ইয়ে, তুমি হাসছ কেন?
জবাবে রানী উর্মিলা খুশীতে হাততালি দেয়। তারপরে সবার স্তম্ভিত দৃষ্টি খেয়াল করে নিজেকে সামলে নিয়ে বলতে থাকে
-কাল রাতে যখন রাজকুমারী সুরমা নিজেকে একজন রাজকুমারী বলে দাবী করে, তখন আমার মনে একটু সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। সত্যি কি সে রাজকুমারী নাকি আমাদের চোখে ধূলা দিতে চাইছে? সেজন্য আমি কাল রাতে এক পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছিলাম।
– কি সেই পরীক্ষা?
– আমি রাজপরিচারিকাদের ২০টি তোষক আর ২০টি লেপ দিয়ে রাজকুমারীর জন্য শয্যা প্রস্তুত করতে বলি। তারপরে সবকিছুর নীচে একটা ছোট্ট মটরদানা গুঁজে দিতে বলি। রাজকুমারী যদি সত্যি সত্যি একজন রাজকুমারী হয়, তবে এই সামান্য মটরের জন্য তার ঘুমে ব্যাঘাত হবে। আর যদি সে ভূয়া রাজকুমারী হয় তো সেসব তুচ্ছ করে ভোঁসভোঁস করে ঘুমাবে, মটরে তার কিছু আসবে যাবে না।
দেখা যাচ্ছে আমার পরীক্ষা করবার সিদ্ধান্তটা সঠিক ছিল। রাজকুমারী সুরমা যে সত্যি সত্যি একজন ‘প্রকৃত রাজকুমারী’ এ নিয়ে সন্দেহের আর কোন অবকাশ নেই।
তারপরে রাজকুমার অভীকের দিকে তাকিয়ে রাণীমা বলেন
-এই নাও, অনিকেত। ‘প্রকৃত রাজকুমারী’, ‘প্রকৃত রাজকুমারী’ করে তো জান খেয়ে ফেলছিলে। রাজ্যের সব মেয়ে দেখে বাতিল করে দিলে- কি না, তারা নাকি প্রকৃত রাজকুমারী না। এখন তোমার সামনে উপস্থিত করলাম একজন প্রকৃত রাজকুমারী- রাজকুমারী সুরমা। আর তো কোনো অসুবিধা নাই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রাজকুমারীর সাথে তোমার বিয়ের তারিখ পাকা করে ফেলতে হবে। আমি কবে থেকে তৈরী হয়ে বসে আছি।
রাজকুমার অভীকের মুখে প্রথমে বিস্ময়, তারপরে খুশীর ঝলক দেখা দিল। মনে মনে সে তো রাজকুমারীকে পছন্দ করেইছিল। এখন তাকে যখন ‘প্রকৃত রাজকুমারীর’ সার্টিফিকেট মা দিয়ে দিল, তখন আর কোনো বাঁধা রইল না। মায়ের বুদ্ধিমত্তার উপরে সবার-ই আস্থা আছে এরাজ্যে। বরং বাবা আর তার উপরই লোকে কেন জানি ভরসা করতে পারে না। রাজকুমার অভীক প্রেমে গদগদ দৃষ্টি নিয়ে রাজকুমারী সুরমার দিকে তাকায়। দেখে রাজকুমারীও প্রেমে গদগদ আরক্তমুখে অলরেডি তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
দেখে-শুনে রাজা খুশী হয়ে বললেন
-তবে আর দেরী কেন? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি নাতিপুতির মুখ দেখতে চাই!
– আহেম! রাণীমা উর্মিলা গলা খাঁকারি দিয়ে রাজাকে সতর্ক করে দেন। অর্থাৎ বিয়েটা তো আগে হতে দাও। উল্টাপাল্টা কথা বলে ওদের উস্কে দেবার কোনো দরকার আছে?
ভুল বুঝতে পেরে রাজা বলতে লাগলেন
– আচ্ছা আচ্ছা। বিয়েটা আগে হোক। কিন্তু তারপরে আমি নাতিপুতির মুখ দেখতে চাই কিন্তু!
বীথির আর সহ্য হল না। এতক্ষণ সে স্তম্ভিত হয়ে সবার কথা শুনছিল। ঘটনাটা কি তা বোঝবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু যখন দেখল যে এদের নাস্তা খাওয়া শেষ হল না কিন্তু রাজকুমারী সুরমাকে “প্রকৃত রাজকুমারীর” উপাধি দিয়ে কোরবানীর গরুর মত তার বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলা হল, তখন সে আর চুপ থাকতে পারল না।
তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলল
-অসম্ভব কথা। এ বিয়ে হতে পারে না। এ বিয়ে আমি মানি না।
সবাই আশ্চর্য হয়ে বীথির দিকে মুখ ফেরালো। রাণী উর্মিলা প্রচন্ড অসন্তষ্ট হলেন। বললেন
-সেটা তুমি বলার কে? রাজকুমারী, তোমার সহচরীর এত সাহস হয় কিভাবে? চাকরবাকরকে বেশি লাই দিলে এমনি হয়! চান্স পেলেই তারা মাথায় চড়ে বসে!
রাজকুমারী সুরমা আমতা আমতা করতে থাকে
-রাণীমা আমি তো ঠিক…
কথাটা সে শেষ করতে পারে না। কাঁদোকাঁদো মুখে বসে থাকে। তার ট্রু লাভ বুঝি হাত ফস্কে যায়!
বীথি তীরের মত সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দৃঢ়কন্ঠে বলে
– আমি রাজকুমারী সুরমার সহচরী নই। আমি তার ফেইরী গডমাদার। আমার কাজ রাজকুমারীর স্বার্থ দেখা। সেই সুবাদে আমি এই বিয়ে সর্বান্তকরণে বিরোধিতা করছি। রাজকুমারী কি গরু-ছাগলের সমান? তার রাজকুমারীত্বের পরীক্ষা নিয়ে তাকে অসম্মান করাকে আমি রাজকুমারীর চরম অপমানজ্ঞান করছি। আর যা বুঝতে পারছি, রাজকুমার অভীক কোন অংশেই কম না। রাজ্যের সবকয়টা মেয়েকে আলুপটলের মত দেখে তাদের বাতিল করে দিয়েছে। আর কোনো মেয়ে পাওয়া যাচ্ছে না তো রাজকুমারী সুরমাই সই। আশ্রিত অতিথির প্রতি আপনাদের এ কিরকম ব্যবহার?
রাজকুমার অভীক কাঁচুমাচু মুখ করে বসে থাকে। রাজা রণবিজয় একবার বীথির আর একবার রাণীমার মুখের দিকে তাকাতে তাকাতে বলতে লাগলেন
-এইটা কেমন ব্যাপার হল? আমি তো কিছুই বুঝছি না!
আর রাণীমা বীথির দিকে সটান তাকিয়ে থাকলেন। রাগে তার সর্বশরীর জ্বলে যাচ্ছে কিন্তু তার হাত পা বাঁধা, করার কিছুই নাই। তাদের রাজ্যে ফেইরী গড মাদারদের ক্ষমতা অনেক। তাদের মতের বিরুদ্ধে গেলে তারা এমন অভিশাপ দেবার ক্ষমতা রাখে যে তা আর কহতব্য নয়। এই বিয়ে তো এমনিও গেছে, ওমনিও গেছে। মাঝখান থেকে অভিশাপের ঠ্যালায় রাজকুমারের হয়ত আর বিয়েই হবে না, তাদের বংশ যাবে নির্বংশ হয়ে। রাণীমা উর্মিলা তাই মুখের কঠিন কঠিন কথা সব কষ্ট করে গিলে ফেললেন, চোখ দিয়েই বীথিকে ভস্ম করতে চাইলেন। বীথির অবশ্য তাতে কিছু এলো গেলো না।
সে এবারে রাজকুমারী সুরমাকে উদ্দেশ্য করে বলল
– উঠে এসো, রাজকুমারী সুরমা। এখানে আর একদন্ড নয়। চল আমরা রওনা দিয়ে দেই। রাজা রণবিজয়, দয়া করে আমাদের জন্য ঘোড়ার গাড়ির ব্যবস্থা করবার আদেশ দিন। আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রওনা দিয়ে দিতে চাই।
রাজকুমারী সুরমাকে সঙ্গে করে বীথি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসলো।
রাজকুমার অভীকের মনে আবারো অনেক দুঃখ। মানে আগে দুঃখ ছিল যে সে ‘প্রকৃত রাজকুমারী’ খুঁজে পাচ্ছে না, যার জন্য বিয়ে করতে পারছে না। আর এখন দুঃখ যে সে প্রকৃত রাজকুমারী খুঁজে পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাকেও বিয়ে করতে পারছে না। ভাগ্যের এ কেমন অবিচার? সেজন্য মনের দুঃখে সে সকাল সকাল ঘোড়ায় চড়ে বনে চলে এসেছে। আর এখন এক ঝর্ণার পাশে বসে নির্জনে নিজের দুর্ভাগ্যের কথা ভাবছে। রাজকুমারী সুরমা! আহা, কি অপরূপ সুন্দর একটা মেয়ে! প্রথম দেখাতেই তাকে ভালো লেগে গেছিল তার। পরেরদিন দ্বিতীয়বার দেখে তো সে পুরাই ফিদা। আর এখন এই মূর্তিমান অভিশাপ ফেইরি গডমাদারের অশুভ উপস্থিতির কল্যাণে একটুর জন্য তাদের বিয়েটা ফস্কে গেল। কেন? কেন? কেন?
যুগ যুগ ধরে কি সাচ্চা পেয়ারে এমনিভাবে বাঁধা পড়বে? দুহাতে নিজের চুল খামচে ধরে রাজকুমার অভীক হেড়ে গলায় গেয়ে উঠে
-‘আর কত রাত একা থাকব?’
একটু দূরে রাজকুমারের ঘোড়া বাহাদুর নিশ্চিন্ত মনে ঘাস চিবাচ্ছিল। রাজকুমারের বেসুরা, বেতালা গান শুনে চমকে উঠলো। সেরেছে কাজ! এই গান শুনলে তো তার বদহজম হয়ে যাবে!
গানের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচবার জন্য সে রাজকুমারকে প্রশ্ন করে
-রাজকুমারের কি মন খারাপ?
করুণ মুখ করে গান থামিয়ে রাজকুমার বলে
– হু।
– কেন?
– আমি সুরমাকে পেতে চাই।
ঘোড়া বাহাদূর একটু চিন্তা করে। এই সুরমাটা আবার কে? রাজকুমার গত দুই বছরে দুইশরও বেশি মেয়ে দেখেছে। তারমধ্যে সুরমা কোন জন?
সতর্কভাবে বাহাদুর প্রশ্ন করে -সুরমাকে চাওয়ার কারণ কি রাজকুমার?
– আমি ওকে ভালোবেসে ফেলেছি। ও-ই আমার ট্রু লাভ– প্রকৃত প্রেম।
নাক দিয়ে তাচ্ছিল্যের শব্দ করে বাহাদূর
– ভা-ল-বা-সা!
দূর, দূর, এসব ভালবাসা -টালবাসা একটা বায়বীয় পদার্থ।
‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই, কিছু নেই’।
তাই বলে
– এক মেয়ের পিছে এমন ঝুলে পড়লে কেন, রাজকুমার? আরো তো কত মেয়ে আছে। বাদ দাও ওর কথা।
– না, না। ওকে ছাড়া আমার চলবে না। আমি ওকেই চাই।
– অ!
নিস্পৃহ মুখে জানতে চায় বাহাদূর
– তা তোমার এই সুরমা থাকে কোথায়?
– দূরদেশে।
– কি বললে? চমকে উঠে বাহাদূর।
– দূরদেশ। রূপকথার রাজ্যের একদম কিনারায় পড়েছে যে দেশ, সেই দূরদেশের রাজকন্যা সে।
– দূরদেশ? দূরদেশে আমার দূর্দানা থাকে।
– দূর্দানাটা আবার কে? রাজকুমার অভীক বিরক্ত হয়ে জানতে চায়। সে মরছে নিজের জ্বালায়, তারমধ্যে আবার এসব নিত্যনতুন নাম!
– দূর্দানা, আমার ট্রু লাভ। এক ঘোড়া ব্যবসায়ীর নিষ্ঠুরতার জন্য আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। দূর্দানাকে সে বিক্রি করে দিল সুদূর দূরদেশে। তারপরে আমাদের আর কখনোই দেখা হয়নি।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাহাদুর।
– তোমাদের মধ্যে আবার ট্রু লাভও আছে? নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না রাজকুমার অভীক।
আহত দেখায় বাহাদুরকে
– তো? ট্রু লাভ শুধু তোমাদের মাঝেই থাকবে? আমরা কি দোষ করলাম শুনি?
তারপরে গা ঝাঁড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায় বাহাদুর
– সুরমা যখন তোমার ট্রু লাভ তো তুমি বিনা প্রতিবাদে তাকে যেতে দেবে? তাকে ছিনিয়ে নিয়ে আসতে পারবে না তোমার প্রবল ভালোবাসার জোরে?
কাঁদো কাঁদো মুখে রাজকুমার অভীক জানতে চায়
– কিভাবে করব সেটা?
তাচ্ছিল্যভরে বাহাদূর বলে
– প্রথমে তো ঝর্ণার পাশে বসে গান গাওয়া বন্ধ করতে হবে। আর তোমার সুরমাকে কখনো গান গেয়ে শোনাবে না, তাতে তার প্রেম চটে যেতে পারে।
– ওর সাথে দেখা হলে না ওকে গান গেয়ে শোনাবার প্রশ্নটা উঠে।
– দেখা করবার চেষ্টা থাকতে হবে, রাজকুমার। সাচ্চা প্রেম কি গাছের ফল যে তুমি গাছের তলায় হাঁ করে বসে থাকবে আর সেটা আপনি তোমার মুখে এসে পড়বে? চল, এখনি এই মুহূর্তে দূরদেশের উদ্দেশ্যে রওনা দেই আমরা। তুমি খুঁজবে তোমার সুরমাকে, আমি খুঁজব আমার দূর্দানাকে।
– দূরদেশ অনেক দূর। মিনমিন করে বলে রাজকুমার অভীক।
– যার নাম দূরদেশ, সেটা দূর তো হবেই। চল, চল, উঠে পড় আমার পিঠে। বাজে অজুহাতে যথেষ্ঠ সময় নষ্ট করেছ।
তো রাজকুমার অভীক আর ঘোড়া বাহাদূর রওনা দিয়ে দেয়। এক সময়ে তারা পৌঁছে যায় দূরদেশের রাজপ্রাসাদে।
রাজকুমার অভীক প্রশ্ন করে
– তুমি শিওর যে এই দোতলার জানালাটা রাজকুমারী সুরমার শোবার ঘরের জানালা?
– হ্যাঁ হ্যাঁ আমি শিওর। ঘোড়াদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় খুব প্রখর হয়। আমি হলফ করে বলতে পারি যে এটা তোমার সুরমারই শোবার ঘর। নাও, আর দেরী না করে উঠে যাও।
– কিভাবে উঠব?
– উফ, প্রতিটা স্টেপই কি তোমাকে বলে দিতে হবে? কেমন রাজকুমার তুমি? আমার পিঠের উপর দাঁড়াও। তারপরে দেয়ালের গোলাপ-ঝাঁড় বেয়ে ধীরে ধীরে উঠে যাও।
– আমার ভয় করছে, বাহাদুর।
– যার নাম অভীক, সে এত ভীতুর ডিম হয় কিভাবে? রাজ্যজুড়ে সমস্ত অভীকের নাক কেটে দিলে তুমি, রাজকুমার! নাও, আর কোনো কথা না। জলদি জলদি উঠে যাও পাইক-পেয়াদারা দেখবার আগেই।
রাজকুমার অভীক গোলাপ,-ঝাঁড়ের মাচা বেয়ে খুব ধীরে ধীরে দোতলার জানালার দিকে অগ্রসর হতে থাকল। প্রেমে যে এত পরিশ্রম তা কে জানত রে বাবা? জানলে সে প্রেমে পড়বার আগে দুইবার চিন্তা করত। কিন্তু এখন সে পুরোপুরি ধরা খেয়েছে। রাজকুমারী সুরমার জানালার কাছে কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাজকুমার অভীকের কান্নাকাটির অবস্থা হয়ে গেল। গোলাপের কাঁটায় সে অসংখ্যবার আঁচড় খেয়েছে। যাই হোক, বহু কষ্টে জানালা অব্দি পৌঁছে ঘরে উঁকি দিয়ে সে ফিসফিস করে ডাক দেয়
– রাজকুমারী সুরমা। রাজকুমারী সুরমা।
রাজকুমারীর কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। খুব সম্ভব সে ঘরে নেই। কিন্তু রাজকুমার অভীকের গলার শব্দ শুনে যে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো, সে হচ্ছে রাজকুমারী সুরমার প্রিয়পাত্র হাম্পটি ডাম্পটি।
হাম্পটি ডাম্পটিকে রাজকুমারী জানালায় ঠেস দিয়ে বসিয়ে রেখেছিল। হাম্পটি ডাম্পটিও এতদিন মনের আনন্দে সেখানে বসেছিল। আজ হঠাৎ দোতলার জানালায় ফিসফিস অশরীরী শব্দ শুনে চমকে ঘুরে গিয়ে টাল সামলাতে না পেরে পপাত ধরণীতল হল। ফলে তার শরীর অর্থাৎ ডিমের খোলা ভেঙ্গে ছত্রখান হয়ে চারিদিক ছড়িয়ে পড়ল।
হাম্পটি ডাম্পটিকে পড়ে যেতে দেখে রাজকুমার অভীকও ব্যালান্স হারিয়ে মাচা ভেঙ্গে হুড়মুড় করে চার হাত-পা ছড়িয়ে উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। তারপর বহুকষ্টে উঠে বসে বাহাদুরের খোঁজ করতে লাগল। যে অবস্থা, যত শিঘ্রী সম্ভব এখান থেকে পালাতে হবে। রাজপেয়াদারা যে কোনো মুহূর্তে চলে আসতে পারে।
কিন্তু বাহাদুরের কোনো চিহ্নই আশেপাশে খুঁজে পাওয়া গেল না। নিশ্চয় সে তার দূর্দানার খোজে গেছে- বিরক্ত হয়ে ভাবল অভীক। রাজকুমারের প্রেমের কোনো ঠিক-ঠিকানা নাই, রাজকুমারের ঘোড়া ঠিকই রোমান্স করে বেড়াচ্ছে! খোঁড়াতে খোঁড়াতে রাজকুমার আস্তাবলের দিকে রওনা দিল।
এদিকে রাজপেয়াদারা দৌড়ে এসে হাম্পটি ডাম্পটির ছড়িয়ে পড়া ডিমের খোলা শতচেষ্টা করেও জোড়া লাগাতে পারল না। না পেরে তারা হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিল।
পরদিন সকালে ‘আজকের দূরদেশ’ এর প্রথম পৃষ্ঠায় হাম্পটি ডাম্পটির করুণ পরিণতির খবর বড় বড় অক্ষরে ছাপা হল। একজন আবার তার স্মরণে একটা কবিতাও লিখে ফেললো-
Humpty Dumpty sat on a wall
Humpty Dumpty had a great fall
All the King’s horses & all the King’s men
Could not put Humpty together Again.
চলবে…
https://ochinpurexpress.com/%e0%a6%ae%e0%a6%a8%e0%a7%8b%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%a4/%e0%a6%b0%e0%a7%82%e0%a6%aa%e0%a6%95%e0%a6%a5%e0%a6%be-%e0%a6%a8%e0%a7%9f-%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ac-%e0%a7%a9/
অচিনপুর ডেস্ক / এসএসববি