তাবাসসুম নাজ
টরেন্টো, কানাডা।
উপন্যাস: রূপকথা নয় (১ম পর্ব)
– ফুপী, আমাকে এই ফেইরি টেলটা পড়ে শোনাও না।
দুপুরের খাবার শেষে বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে আধশোয়া হয়ে বীথি গল্পের বইটা কেবল-ই মেলে ধরেছিল। গল্পের নায়ক আর নায়িকা, তিতির আর হিমেল, মহাসংকটে পড়ে গেছে। দুজনের সম্পর্ক মনে হচ্ছে আর টিকবে না। বীথি রূদ্ধশ্বাসে মার্ক করে রাখা জায়গা থেকে কেবলি পড়তে আরম্ভ করেছে, তার মধ্যে এই উৎপাত। উৎপাত আর কেউ না, তারই পাঁচবছর বয়সি ভাস্তি মম, তার বড়ভায়ের সবেধন নীলমণি।
তিতির আর হিমেলের সম্পর্কের টানাপোড়নে খাবি খেতে খেতে বীথি আনমনার মত বলে
-হু?
– ফুপি-ই-ই, আমাকে বইটা পড়ে শোনাও না।
– এখন না, সোনা। এখন ফুপী পড়ছে। যাও মাকে বল, সে পড়িয়ে দেবে।
– মা ঘুমায়। আর মা তোমার কাছে আসতে বলেছে।
– তাহলে বাবাকে বল।
– বলেছি। বাবাও বলেছে তোমার কাছে আসতে।
বাহ! বাহ! বাহ! মনে মনে ভাইয়া আর ভাবীর তারিফ না করে পারল না বীথি। কন্যারত্নের জন্ম দিয়েই কর্মসাবাড়! এখন দুপুরের খাবার খেয়ে নাসিকা গর্জনসহ ভাতঘুম দিচ্ছে, বংশের বাতিকে তার ঘাড়ে গছিয়ে দিয়ে। আর মম এরও বলিহারি যাই, অমনি দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে চলে এসেছে। অন্যসময় হলে বীথির কোন আপত্তি ছিল না। মম তার চোখের মণি। কিন্তু এখন অবস্থা সঙ্গীন, পরিস্থিতি বড়ই নাজুক। তিতির আর হিমেলের ছাড়াছাড়ি হল বলে!
অনুনয়ের সুরে বীথি বলে
-মম সোনা, ফুপী এখন ব্যস্ত। আমি রাতে তোমাকে পড়িয়ে শোনাবো। প্রমিজ করছি পুরাটা বলব, কেমন?
-না আআআ! এখনি! মম এর চেহারা কাঁদো কাঁদো হয়ে উঠল, ঠোঁট গেল ফুলে। চোখে পানি এই আসলো বলে! একেবারে পাকা অভিনেত্রী!
কি আর করা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ড্রামা কুইন ভাস্তির কথা রাখতে বীথি ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
বই বন্ধ করে বলে
-আচ্ছা! আচ্ছা! কই দেখি কী বই?
বলার শুধু অপেক্ষা। মম একলাফে বিছানায় উঠে বীথির পাশঘেষে শুয়ে পড়ে তার দিকে বইটা এগিয়ে দিল
-এই যে ফুপী।
বইটা হাতে নিয়ে বীথি প্রথমে একটু উল্টে পাল্টে দেখে। পাতলা বই, তেমন মোটা না। বইয়ের পাতায় পাতায় ভর্তি রঙিন ছবি আর সামান্য একটু করে লেখা। গল্পের নাম- ‘দা প্রিন্সেস এন্ড দা পি’। ইংরেজি বই। অর্থাৎ- রাজকন্যা ও মটরশুটি। বেশ নাম তো, ইন্টারেস্টিং হবে বলে মনে হচ্ছে- বীথি ভাবে। মমকে একবার ইংরেজিতে আর তারপর বাংলায় তর্জমা করে শোনাতে আরম্ভ করে। কিন্তু গল্প যত আগায় ততই বীথির চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। এইটা কী গল্প? এই গল্পের লেখক কে? রূপকথা না ঘোড়ার ডিম! এমন গল্প দুধের বাচ্চাদের শুনিয়ে তাদের ব্রেইনওয়াশ করে দেবার কী মানে থাকতে পারে?
পড়তে পড়তে রাগে বীথির কান দিয়ে ধোঁয়া বের হতে লাগল। লেখকরে একবার হাতের কাছে পেলে …ইত্যাদি, ইত্যাদি।
সংক্ষেপে গল্পটা এমন- এক রাজ্যে ছিল এক রাজকুমার। রাজা ও রাণীর একান্ত ইচ্ছা রাজকুমার বিয়ে করে থিতু হয়। রাজকুমারের আপত্তি নাই কিন্তু তার একটা শর্ত আছে। সে যাকে বিয়ে করবে, তাকে হতে হবে একজন প্রকৃত রাজকুমারী। এখন এই প্রকৃত রাজকুমারীর সংজ্ঞা যে কি, তা কেউ জানে না। কারণ রাজকুমার নিজেও ঠিক স্পষ্ট করে বলতে পারে না। তাকে যে মেয়ে দেখানো হোক না কেন, সে তার একটা না একটা খুঁত বার করে তাকে প্রকৃত রাজকুমারীর লিস্ট থেকে ছাঁটাই করে দেয়।
– ওর বড্ড বেশী দেমাগ।
– ও লম্বায় খুবই খাটো।
– ওর চেহারায় দয়ামায়া বলতে কিছু নাই।
দূরদূরান্ত থেকে আগত বহু রাজকন্যা তাকে দেখানো হল, কিন্তু রাজকুমারের কাউকেই মনে ধরল না। প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু খুঁত ধরে তাদের সে বাতিলের দলে ফেলে দিল।
এতদূর পড়ে বীথি রেগে আগুন হয়ে গেল। মেয়েরা কি কোরবানীর গরু যে এভাবে লাইন দিয়ে দেখবে আর একটার পর একটা কারণ দেখিয়ে বাতিল করে দিবে? তাও যদি কারণগুলি যুক্তিযুক্ত হত। আরে বাবা! এত যে তোর নখরা, তোর নিজের যোগ্যতা কী? রাজার ঘরে জন্মেছিস বলেই না তুই রাজকুমার। যদি কোন চাষাভুষার ঘরে জন্মাতিস তো দেখতাম তোর এই নখরা কোথায় থাকত!
যাইহোক, এরপরের দৃশ্য রাজদরবারে। সেদিন প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল। আর রাজদরবারে রাজা ও রাণী রাজকুমারকে তলব করে তার ক্লাস নিচ্ছিল। দুজনেই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। এমন করলে চলবে? রাজকুমার তো উচ্চবংশের সব মেয়েদের দেখে, তাদের খুঁত বের করে, তাদের বাতিলের দলে ফেলে দিয়েছে। এখন বিয়ে করবেটা কাকে?
সেই কথা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল রাজা-রাণী, এমন সময় রাজপেয়াদারা এক অল্পবয়সী মেয়েকে রাজদরবারে এনে উপস্থিত করে। মেয়েটির সর্বাঙ্গ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরছে, জামাকাপড় কর্দমাক্ত, জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া। মুখে কাদা লেগে রয়েছে, চুলগুলি মুখের সাথে ল্যাপটানো।
রাজা, রাণী, রাজকুমার তিনজনে অবাক হয়ে তাকাতে মেয়েটি লীলায়িত ভঙ্গীতে অভিবাদন জানিয়ে বলে- আমি দূরদেশের রাজকুমারী সুরমা। এ রাজ্যের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমার ঘোড়ার গাড়িতে বজ্রপাত হয়ে গাড়ি উলটে যায়, অন্ধকারে ঝড়বৃষ্টির মধ্যে একলা হেঁটে তোমাদের রাজপ্রাসাদের সন্ধান পাই। আজকের রাতটা থাকবার জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
রাজা সাথে সাথে বলে উঠে- নিশ্চয় নিশ্চয়, এতো আমার সৌভাগ্য।
রাণীর দৃষ্টিতে কৌতুহল ফুটে ওঠে- সত্যি কি মেয়েটা একজন রাজকুমারী? কাপড়চোপরের যে অবস্থা, তাতে বোঝা কিছু যাচ্ছে না। যদিও মেয়েটার কথাবার্তা, আদব কায়দা একজন উচ্চবংশীয় মেয়ের পরিচয় দিচ্ছে, তারপরেও কিছুই বলা যায় না।
রাজকুমারের চোখেও আগ্রহ দেখা যায়। কিন্তু তার সেই এক গো! বিয়ে করব তো একজন প্রকৃত রাজকন্যাকেই করব, নাহলে নয়।
রাজকুমারের আগ্রহ বুঝতে পেরে রানী এক ফন্দি আঁটে। রাজপরিচারিকাদের ডেকে রাজকুমারীর দেখাশোনা করবার নির্দেশ দিয়ে দেয়। অন্যদিকে প্রধান রাজপরিচারিকাকে একপাশে সরিয়ে নিয়ে তার কানে ফিসফিস করে কিছু আদেশ দেয়। রাণীর আদেশ অনুযায়ী প্রধান রাজপরিচারিকা রাজকুমারীর জন্য বিশটি তোষকের এক এলাহী রাজশয্যা প্রস্তুত করে। ২০টি তোষকের উপরে সাজিয়ে দেয় ২০টি লেপ-কম্বল। শয্যা প্রস্তুত হয়ে গেলে আদেশমত রাণীমাকে ডেকে আনা হয়। রাণীমা সেই লেপ-কম্বল-তোষকের পাহাড়ের একদম নীচে একটা মটরের দানা লুকিয়ে রাখে। তারপরে রাজপরিচারিকাকে নির্দেশ দেয়- দূর্ঘটনার কবলে পড়ে রাজকুমারী সুরমা নিশ্চয় ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। তাকে শুয়ে পড়তে বল। কাল সকালে প্রাতঃরাশের সময় দেখা হবে।
পরদিন সকালে রাজকুমারী সুরমা প্রাতঃরাশ খেতে এলে রাজা ও রাণী তাকে সাদরে সম্ভাষন জানায়। রাজকুমারের চোখে আগের রাতের মতই ফুটে উঠে আগ্রহ ও মুগ্ধতা।
রাণী প্রশ্ন করে- রাতে ঘুম ঠিকমতো হয়েছিল তো, রাজকুমারী?
কিন্তু রাজকুমারীর চোখ ঘুম না হওয়ার জন্য লাল হয়ে আছে, ঘন ঘন হাই উঠছে।
কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়েই সে জবাব দেয়- ঠিক তা বলতে পারছি না, রানীমা। সত্যি কথা বলতে কি, আমি একেবারেই ঘুমুতে পারিনি। এত শক্ত বিছানায় শুয়ে অভ্যাস নাই তো। সেজন্য সারারাত্রি শুধু এপাশ ওপাশ করে কাটিয়েছি।
শুনে রাণীমার মুখে বিশাল এক হাসি ফুটে উঠল। খুশীতে আত্মহারা হয়ে সে রাজকুমারকে উদ্দেশ্য করে বলে
– এই নাও তোমার প্রকৃত রাজকুমারী। একমাত্র একজন প্রকৃত রাজকুমারী বিশটা তোষক আর বিশটা লেপ-কাঁথা মজুদ থাকা সত্ত্বেও ছোট একটা মটরের অস্তিত্ব টের পাবে আর সেই মটরের দানা তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাবে। এবারে আর কোনো অজুহাত শুনব না। তোমার শর্ত ছিল প্রকৃত রাজকুমারী ছাড়া বিয়ে করবে না। তো তোমার সামনে উপস্থাপন করছি একজন প্রকৃত রাজকুমারী-সুরমা।
রাজকুমার আগে থেকেই রাজকুমারীর প্রতি আগ্রহী ছিল। সে যে আসলেই একজন প্রকৃত রাজকুমারী তা জানার পর বিয়েতে রাজী হয়ে গেল।
ধুমধামের সাথে দুজনের বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পর তারা সুখে শান্তিতে বাস করতে লাগল।
রাজকুমার-রাজকুমারী তো সুখে শান্তিতে বাস করতে থাকল কিন্তু বীথির মন থেকে সুখশান্তি সব উধাও হয়ে গেল। সেখানে জায়গা করে নিল একরাশ বিস্ময় আর বিরক্তি। ছিঃ! ছিঃ! এইটা একটা সাচ্চা রাজকুমারীর পরিচয় হল? আর কিছু পেল না, একটা মটরের দানার মাপকাঠিতে তার রাজকুমারীত্ব মাপা হল! আর এসব গল্প ছোট ছোট বাচ্চাদের ধরে গেলানো হচ্ছে। গিলিয়ে তাদের ভবিষ্যৎ ঝরঝরা করে দেয়া হচ্ছে। বিয়ে হওয়াটাই যেন একমাত্র ‘এইম ইন লাইফ’! অন্যকিছু না করলেও চলে। তাও আবার এক অপদার্থ রাজকুমারের আজগুবি চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে। এসব পড়ে বাচ্চারা কী শিখবে? মনে মনে ফুঁসতে থাকে বীথি। গল্প শেষ হয়ে গেলে মম নিজের মনে খেলতে উঠে চলে যায়। কিন্তু বীথি কিছুতেই মন থেকে এই উদ্ভট, অবাস্তব সর্বোপরি বিপজ্জনক রূপকথা তাড়াতে পারে না।
বিকেলে চায়ের টেবিলে বসেও ভাইয়া ভাবীর কাছে সে প্রসঙ্গটা তোলে। আসিফ ভাইয়া ও রিফাত ভাবী দুজনেই উচ্চশিক্ষিত, আধুনিক মানুষ। দুজনে চাকুরীজীবি, তাদের লজিক পরিষ্কার। তাদেরকে বললে নিশ্চয় তারা এখন থেকে খেয়াল করে মেয়ের হাতে বই তুলে দেবে। এমন বই দিবে, যা পড়ে মম সঠিক পথের হদিস পায়। এসব মান্ধাতার আমলের ধ্যানধারণাওয়ালা শিক্ষা না পায়। মেয়েদের একমাত্র কাজ বিয়ে! মাই ফুট! আর রাজকুমারকে ধরে তো থাপড়ানো দরকার!
কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে ভাইয়া ভাবী তার কথাটাকে একরকম উড়িয়েই দিল। উল্টো নানারকম টিকাটিপ্পনী কেটে তার মেজাজটা দিল খারাপ করে।
ভাইয়া তো বলেই বসল- তুই দিনকে দিন একটা নিরস আর কাঠখোট্টা মেয়ে বনে যাচ্ছিস রে বীথি। হোয়ের ইজ ইয়োর সেন্স অফ হিউমার? তোর আসলে ফিজিক্স নিয়ে পড়া উচিৎ হয়নি।
– তো কি নিয়ে পড়া উচিৎ ছিল, হোম ইকোনমিক্স? বীথি রেগে কাই হল।
ভাইয়া একটু ভাবনার ভান করে, তারপরে বলে- তা মন্দ বলিসনি। তাহলে তোকে পাত্রস্থ করতে আমার সুবিধা হত!
বীথি পারে তো ভাইয়াকে ছিঁড়ে খায়- আমাকে পাত্রস্থ করার জন্য এতটা দুশ্চিন্তা না করলেও তোমার চলবে। আমি কি থালাবাটি নাকি যে আমার মালিকানা বদল করবে? আমার মালিক আমি নিজে।
শুনে ভাইয়া চা খেতে খেতে ফিকফিক করে হাসতে থাকে। রিফাত ভাবী অবশ্য অতটা নির্দয় নয়।
সে বীথিকে ঠান্ডা করবার জন্য বলে- বীথি, ব্যাপারটাকে তুমি যতটা সিরিয়াস ভাবছ, ততটা কিন্তু না। আমি কত ফেইরী টেলস পড়ে বড় হয়েছি। সব কাহিনী তো মোটামুটিভাবে এক। সেই রাজাপুত্র এসে উদ্ধার করবে লাচার রাজকুমারীকে আর তারপরে তারা সুখে শান্তিতে বাস করতে থাকবে। তাতে করে কি আমি তাদের মত ভাবতে শুরু করেছিলাম? ঠিকই তো পড়াশুনা করেছি, চাকরী করছি, আবার ঘরসংসারও করছি। কই, আমার তো কোনো ক্ষতি হয়নি।
মিটিমিটি হেসে ভাইয়া বলেছে- ক্ষতি হয়নি কারণ আমি তোমাকে বিয়ে করে তোমার লাচার অবস্থা থেকে উদ্ধার করে ফেলেছি, রিফাত। বাই দা ওয়ে, তোমার পানতারাসটা আজকে এত দারুণ হয়েছে যে শুধু এর মাপকাঠিতে আমি তোমাকে একজন প্রকৃত স্ত্রীর উপাধি দিয়ে দিলাম।
ভাইয়ার এতবড় অসম্মানসূচক কথা ভাবী গায়ে তো মাখলোই না, উপরন্ত শাকচুন্নীর মত হি হি করে হেসে গড়িয়ে পড়ল দেখে বীথি রাগ চেপে প্রশ্ন করল
-ভাবী, তুমি কী করে এই কথায় হাসতে পারো? ভাইয়া তোমাকে বিয়ে করে তোমাকে উদ্ধার করেছে? আত্মসম্মান কি একেবারে ধুয়ে খেয়ে ফেলেছ তুমি?
ভাবীর মুখের হাসি তাতে কিছুমাত্র কমে না।
হাল্কাভাবেই রিফাত ভাবী বলে
-আরে দূর, তোমার ভাইয়া কি সত্যি মিন করে বলেছে নাকি এসব? তাহলে তো ওর খবরই ছিল। আমাকে ঠাট্টা করবার জন্য এসব বলে, আর তুমি সেটা ধরতে পারো না দেখে ক্ষেপে যাও। সেটা বুঝে আসিফ আরো বেশি কথাটাকে উষ্কে দেয়। এতটা সিরিয়াস হবার কিছু নাই, বুঝলে?
বীথি বুঝল যে ভাইয়া ও ভাবীর কাছ থেকে কোনোরকম সাপোর্ট পাবার আশা তার নাই। আশ্চর্য কথা! এত অন্ধ মানুষ হয়! নিজেদেরই তো বাচ্চা! তার ভবিষ্যৎটা এভাবে কেউ বারোটা বাজায়। কেমন বাপ-মা এরা?
চা শেষ করে ওরা উঠে গেল টিভি রুমে। বীথি নিজের ঘরে ঢুকে পড়ার বই টেনে বসল। মম তার রুমেই খেলছে। ভাস্তির দিকে নজর পড়তে স্নেহে বীথির বুকটা ভরে যায়। কি সুন্দর ফুলের মত ফুটফুটে একটা মেয়ে। মেয়েটার মন এত সরল, একেবারে একতাল মাটির মত। তাকে যেভাবে আকৃতি দেবে, সে সেভাবেই বেড়ে উঠবে। আচ্ছা, আজকে যে গল্পটা পড়ল, সেটার স্থায়ী ছাপ কি ওর মনের মধ্যে পড়েছে? হয়ত একবারমাত্র শুনেছে বলে ওর মনে তেমনভাবে দাগ কাটেনি। কিন্তু রাত্রে যদি আবার শুনতে চায়? কিম্বা কাল? অথবা পরশু? মুখ দেখে তো মনে হল গল্পটা তার খুবই পছন্দ হয়েছে। বারবার সেই পছন্দ হওয়া গল্প শুনে যদি সে নিজেকে সেই রাজকুমারীর মত ভাবতে শুরু করে দেয়? যার ভাগ্য একজন রাজকুমারের খামখেয়ালীপনার উপর নির্ভর করছে। যার স্বাধীন কোন চিন্তা নাই। যার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে বিয়ে করে সুখে শান্তিতে বাস করা। কথাটা মনে হতে বইটার উপরে বীথির সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল। এই বইটাই যত নষ্টের গোড়া। আচ্ছা, বইটাকে বিদায় করে দিলেই তো ঝামেলা চুকে যায়। কিন্তু কিভাবে? এমনভাবে করতে হবে যাতে মমর চোখে না পড়ে। তাহলে সে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করবে। লুকিয়ে গার্বেজে ফেলে দিয়ে আসবে? নাহ, বইএর এতখানি অসম্মান করা তারপক্ষে সম্ভব না। ছোটবেলা থেকে সে বইয়ের যত্ন নেবার শিক্ষা পেয়ে এসেছে। তবে কাউকে দিয়ে দেবে? নাকি জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিবে? নাহ! এই আইডিয়াও বাতিল। এই খতরনাক বই যার হাতে পড়বে, তারই মুন্ডুটা চিবিয়ে খেয়ে তার ব্রেনওয়াশ করে ছেড়ে দেবে। তবে? ভাবতে থাকে বীথি। আচ্ছা, পুড়িয়ে ফেললে কেমন হয়? পুড়িয়ে দেওয়া গার্বেজে ফেলে দেওয়ার থেকে ভালো। অন্যের হাতে পড়ে যাবার সম্ভাবনাও সেখানে শুন্য।
এতক্ষণে একটা পথ পেয়ে বীথির মুখে হাসি ফুটে উঠে। সে পুড়িয়েই ফেলবে এই অলক্ষুণে বইটাকে। এ বইয়ের অশুভ প্রভাব যেন তার মমর উপরে কখনো না পড়ে। কিন্তু কাজটা করতে হবে খুব গোপনে। ভাইয়া, ভাবী, মম যেন ঘুরাক্ষণেও টের না পায়। টের পেলে ভাইয়া ভাবী তাকে পাগল ভাববে আর মম কেঁদে বাড়ি মাথায় করবে। কিন্তু কিভাবে? সে বইটাকে পোড়াবে কোথায়? এমন একটা জায়গা বেছে নিতে হবে যেখানে তাদের যাবার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ।
অনেক ভেবেচিন্তে হঠাৎ করে বীথির মাথায় দপ করে আইডিয়া চলে আসলো। ছাদে? ছাদই হচ্ছে সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। আজ রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সে চুপিচুপি ছাদে উঠে গিয়ে এই ঘোড়ার ডিমের বইটাতে আগুন ধরিয়ে দিবে। কাল সকালে কেউ উঠবার আগে বিউটিকে দিয়ে সবকিছু পরিষ্কার করিয়ে নেবে। তাতে কেউ বিন্দুবিসর্গ টের পাবে না। মমও খেয়াল করবে না। বাচ্চাদের মন- ‘আউট অফ সাইট, আউট অফ মাইন্ড’।
সমস্তকিছুর একটা সুরাহা করে ফেলে বীথির ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠে। বাই বাই, রাজকুমার-রাজকুমারী। তোমাদের ব্যাকডেটেড, সেক্সিস্ট ধ্যান-ধারণার জন্য তোমাদেরকে মোবারকবাদ। এই সব কুবুদ্ধি খবরদার আমার মমকে দিতে যাবে না!
চলবে…
অচিনপুর ডেস্ক /এসএসববি