তাবাসসুম নাজ
টরেন্টো, কানাডা।
উপন্যাস: রূপকথা নয় শেষ পর্ব (পর্ব ১০)
একমাস পরের কথা। আজ রাজকুমারী সুরমার বিয়ের দিন। রাজ্য জুড়ে হইচই হুলুস্থুল পড়ে গেছে বিগত একমাস ধরে। বিয়ের প্রস্তুতি নিতে গিয়ে রাণী বন্যাশ্রীর গলদঘর্ম অবস্থা। রাজপ্রাসাদে জোর গুজব যে এই প্রস্তুতিকে কেন্দ্র করে রাণীমা ও রাজা দিব্যজ্যোতির মধ্যে বিবাহিত জীবনের প্রথম কলহের সূত্রপাত হয়েছে। রাণীমা নাকি মাঝরাতে রাজাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে প্রশ্ন করেছেন
– আচ্ছা, ওড়নার বর্ডারটায় শুধু সোনালী জরি দিলে ভাল হয়? নাকি তাতে গোলাপী পাইপিং দিলে জরীর সোনালী রঙটা বেশি ফোটে?
জবাবে রাজা দিব্যজ্যোতি ক্ষিপ্তমুখে পাশ ফিরে শুয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়েছেন। ফলশ্রুতিতে পরেরদিন তাদের দুজনের মধ্যে বাক্যালাপ বন্ধ ছিল।
এদিকে রাজা রণবিজয় ও রানী উর্মিলার মুখে একান ওকান হাসি দেখা যাচ্ছে সবসময়। ফাইনালি! তাদের চোখের মণি অনিকেত এবারে বিয়ে করে থিতু হবে। রানী উর্মিলা অলরেডী ভবিষ্যৎ নাতিপুতির নাম ঠিক করে ফেলেছেন- অনিমেষ, অবিনাশ, অনিমিখ ইত্যাদি ইত্যাদি। তাদের রাজ্যেও সাজসাজ রব। সেই সাথে চলছে দূরদেশে যাত্রার প্রস্তুতি। রাজারাণী ও রাজকুমার অভীক দূরদেশে যাত্রা করে বউ নিয়ে ঘরে ফিরবে। রাণীমা উর্মিলার মনে ফেইরী গডমাদারের প্রতি এখনো কিছুটা রাগ রয়ে গেছে। এ বাগড়া দিয়ে না বসলে কবেই বিয়েটা হয়ে যেত। রাণীমা হয়ত এতদিনে দাইমার খোঁজে লেগে পড়তেন, কাঁথা সেলাইয়ের নির্দেশ দিয়ে দিতেন। কি আর করা। যাক, সব ভালো যার শেষ ভালো। অবশেষে ছেলেটার একটা হিল্লে হল। ওর দূর্দশা আর চোখে দেখা যাচ্ছিল না। মার চোখে কি ধূলা দেওয়া যায়? বিশেষ করে রাণী উর্মিলার মত বুদ্ধিমতী একজন মায়ের। রানী উর্মিলা তো ভয়ই পাচ্ছিলেন যে আর দুই একদিন যদি তার অনিকেত রাজকন্যা সুরমার সাথে দেখা করতে যায়, তবে তার হাড়গোড় আর একটাও আস্ত থাকবে না।
নিজের ঘরে আয়নার সামনে দাড়িয়ে প্রস্তুত হচ্ছে বীথি। আজ তার একটা বিরাট খুশীর দিন। রাজকন্যা সুরমার বিয়ে। এই বিয়েতে রাজকুমারী যে কতটা খুশী সেটা তার মুখ দেখে টের পাওয়া যাচ্ছে। খুশীর আতিশয্যে তার রূপ যেন দশগুণ বেড়ে গেছে। তাই বীথির মনে আর কোনো দ্বিধা নাই। রাজকুমার অভীকের সাথেও সে আগ বাড়িয়ে আলাপ করে নিয়েছে এবারে। গত এক সপ্তাহ আগে তারা রাজপ্রাসাদে এসে পৌঁছেছে। ছেলেটা খারাপ না, বুদ্ধিশুদ্ধি একটু কম আরকি। তা হোক, বেশি চালাক হয়ে কাজ নেই। রাজকুমারী সুরমার মত একটা নিস্পাপ মেয়ের জন্য রাজকুমার অভীকের মত একটা সরল ছেলেরই হয়ত প্রয়োজন ছিল। তাছাড়া দুজনে যে দুজনকে প্রচন্ড ভালবাসে তা তাদের কান্ডকারখানা দেখলেই বোঝা যায়। ট্রু লাভ না কি বলে, ঠিক সেইটা হয়েছে তাদের মধ্যে। রাজপ্রাসাদের আনাচে কানাচে প্রায়ই তাদের হাওয়া হয়ে যেতে দেখা যায়। ধমকাতে গিয়েও বীথি পারেনি, দেখেও না দেখার ভান করে থেকেছে। করুক তারা প্রাকবিবাহ প্রেম। পরস্পরকে জানা-বোঝার এই তো সময়।
আর একজনের সাথেও বীথির খুব ঘন ঘন দেখা হয়ে যাচ্ছে। সে আর কেউ না, ধ্রুব। ফেইরী গডফাদার হিসেবে সেও চলে এসেছে বিয়েতে উপস্থিত থাকতে। আর এসেই যাকে বলে একেবারে ‘স্টক’ করছে বীথিকে। বীথি যেখানেই যাক না কেন, কিছুক্ষণের মধ্যে ধ্রুবকেও সেখানে পাওয়া যাবে। প্রথম প্রথম বিস্ময়ের শেষ ছিল না বীথির। এই লোক কি তার রুটিন মুখস্ত করে রেখেছে নাকি? কিন্তু আজ দুই দিন হল তার কি যেন হয়েছে, সেও ধ্রুবকে মনে মনে আশা করছে। লাইব্রেরীতে, রাজউদ্যানে, রাজদরবারে যেখানেই সে থাক না কেন, তার চোখ শুধু ধ্রুবকেই খুঁজে বেড়াতে থাকে। এ নিয়ে মনের সাথে যুদ্ধ করে সে ক্লান্ত।
মন
– কি ধ্রুবকে খুঁজছ নাকি?
বীথি
– মোটেই না। রাজদরবারটা কি চমৎকারভাবে সাজানো হয়েছে সেটা দেখছি আমি।
মন
– থাক, আর বলতে হবে না। সবই বুঝি আমি।
-তুমি একটু বেশি বোঝো। কম বোঝবার চেষ্টা করলে ভালো হয়।
– সত্যি কথা বলব? হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে দিব? এই রৌদ্রের মধ্যে তুমি রাজউদ্যানে ঘুরঘুর করছিলে কিসের আশায় শুনি? তোমার প্রকৃতিপ্রেম আছে ঠিকই কিন্তু তাই বলে এতটা নাই!
শুনে বীথি রাগ করে মনের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল। পরে মনই মাফ-টাফ চেয়ে সরি বলে তার সাথে সন্ধি করে নিয়েছে।
একটু পরে শুরু হয়ে যাবে বিয়ের অনুষ্ঠান। বীথি সেখানে যাবে বলে তৈরি হতে থাকে। আজ সে যেমন খুশী, তেমনি তার হৃদয়জুড়ে উঠছে এক প্রচন্ড হাহাকার। কেন এই হাহাকার বীথির সেটা খুঁটিয়ে দেখবার সাহস নাই। একটু আগে আয়নার সামনে দাড়িয়ে সাজসজ্জা করতে গিয়ে হঠাৎ খেয়াল হয় যে আয়নায় তার প্রতিবিম্ব পড়ছে না। চমকে উঠেছিল বীথি। এইটা কি ভুতুড়ে ব্যাপার? সে দিব্যি জালজ্যান্ত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে কিন্তু তার ছায়া আয়নায় পড়ছে না কেন? চোখের সামনে নিজের হাত মেলে ধরে বীথি। তার হাত যেন রক্ত মাংসের হাত না। ধীরে ধীরে সেটা স্বচ্ছ হয়ে যাচ্ছে। কয়েকটা মুহূর্ত। তারপর পরপরই ঠিক হয়ে গেল। কাঁপতে কাঁপতে বিছানায় বসে পড়ল বীথি। এইটা কেমন হল? সে কি অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে? হঠাৎ বিদ্যুৎপৃষ্ঠের মত তার কাছে কারণটা স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ল। সে প্রিন্সেস এন্ড দা পি গল্পটা পড়ে প্রচন্ড রেগে গেছিল। এত রেগে গেছিল যে বইটা পুড়িয়ে ফেলে সেটাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল। তার সেই প্রচন্ড আবেগ তাকে এই গল্পের মাঝে এনে ফেলে দিয়েছে। একজন ফেইরী গড মাদার হিসেবে। তার কাজ ছিল রাজকুমারীর স্বার্থ দেখা, সে কাজটা সে করেছে। বিয়েটা থামিয়ে দিয়েছে, রাজকুমার রাজকুমারীর মনে প্রকৃত প্রেম জাগিয়ে দিয়েছে। আর এখন রাজকুমার রাজকুমারী বিয়ে করছে। অর্থাৎ ফেইরী গডমাদার হিসেবে তার কাজ শেষ। আর শেষ বলে তার উপস্থিতির আর কোনো প্রয়োজন নেই। সে ফিরে যাচ্ছে তার নিজের জগতে। তাই যদি হয়, তবে তো খুশীতে তার পাগল হবার কথা। খুশী সে হচ্ছে ঠিকই কিন্তু সেই সাথে কেন তার মন এত ভারাক্রান্ত লাগছে? কেন মনে হচ্ছে যে কিছু একটা সে ফেলে চলে যাচ্ছে?
জোর করে মন থেকে এসব চিন্তা দূর করে বীথি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গেল। বিশাল ডায়াসে পাশাপাশি রাজকুমার রাজকুমারীকে বসানো হয়েছে। দুজনকে দেখে একটা কথাই শুধু মনে আসে- রাজঘোটক জোড়, মেড ফর ইচ আদার কাপল। এত অপূর্ব জুটি বীথি কোনদিন দেখেনি, আর দেখবে কিনা সন্দেহ। তার মন দুজনের জন্য আশীর্বাদে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল।
বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়ে গেল। রাজা রাণী দিব্যজ্যোতি ও বন্যাশ্রী আর রণবিজয় ও উর্মিলা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে একে অন্যকে শুভকামনা জানালেন। প্রথম দেখায় রাণীমা বন্যাশ্রী ও উর্মিলা আবিস্কার করেছিলেন যে ছোটবেলায় তারা একসময়ে খেলার সাথী ছিলেন, একসাথে কিছুদিন পড়াশুনাও করেছিলেন। যদিও রাণীমা বন্যাশ্রীর পড়াশুনার থেকে প্রেমের নভেল পড়াতেই বেশী মন ছিল আর এদিকে রাণীমা উর্মিলা ছিলেন তার সম্পূর্ণ বিপরীত। তবুও সেটা তাদের বন্ধুত্বে বাঁধার কারণ হয়ে দাড়ায়নি। কিন্তু সেটা ছিল খুব সামান্য সময়ের জন্য। তারপরে তো দুজনেই বিয়ে করলেন। রাণীমা উর্মিলা চলে গেলেন রাজা রণবিজয়ের ঘরনী হতে। আর রাণীমা বন্যাশ্রী নিজ প্রাসাদেই রয়ে গেলেন। এখন দুই সখীর রাজ্য একত্রিত হচ্ছে জেনে দুজনের আনন্দের সীমা-পরিসীমা নাই। দুজন দুজনকে ‘বিয়ান’ ডেকে একনাগাড়ে হাসি-ঠাট্টা করতে থাকলেন।
এই আনন্দ উৎসবের মধ্যে বীথি এককোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে, এমন সময় এক পেয়াদা তাকে এক মোড়ক দিয়ে গেল। আশ্চর্য হয়ে বীথি মোড়ক খুলে দেখে তাতে রয়েছে দুটো মিষ্টি, একটা ডোনাট ও একটা স্ট্রবেরী ডেনিশ। দেখেই চিনল বীথি। রিফাত ডাইনীর কুটিরের ছাদের মিষ্টির কথা সে কোনদিন ভুলবে না। সে মিষ্টি খেতে চেয়েছিল দেখে তাকে শেষদিনের দিন রিফাত ডাইনী মিষ্টি পাঠিয়ে দিয়েছে। নাম না জানা এক আবেগে গলা বুজে আসে বীথির। এই অদ্ভুত রাজ্যে এত ভালবাসা তার জন্য মজুদ ছিল? নিজেকে সামলানোর জন্য সে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে রাজউদ্যানে এসে পড়ে। এক পাথরের বেদিতে বসে পড়ে ভাবনার রাজ্যে ডুবে যায়। মাথার উপরে অজস্র তারা ঝিকমিক করছে, সেই সাথে সোনার থালার মত এক চাঁদ। আজ পূর্ণিমা। আনমনা হয়ে বীথি চুপ করে ভাবতে থাকে।
-এখানে চলে আসলে যে? ধ্রুবর গলার স্বরে চমক ভাঙ্গে বীথির। ধ্রুব কখন এসেছে, এসে তার সামনে দাঁড়িয়েছে সে খেয়ালও করেনি।
-এমনি।
আস্তে করে জবাব দেয় বীথি।
-দেখো, জানি তোমার মনে রাজকুমার সম্বন্ধে এখনো সংশয় রয়ে গেছে। কিন্তু আমি তোমাকে বলছি রাজকুমার অভীকই হচ্ছে রাজকুমারী সুরমার যথার্থ সঙ্গী । ওরা সুখে শান্তিতে থাকবে। আমার কথাটা তুমি বিশ্বাস করে দেখো।
-আমি জানি সেটা, রাজকুমার অভীককে নিয়ে আমার মনে আর কোন সংশয় নাই।
-তবে? এখানে এসে এমন চুপ করে বসে আছ কেন?
ধ্রুবর গলার স্বরে কি যেন আছে, বীথি ঠিক ধরতে পারে না। পারে না দেখে তার মন নিস্ফল বেদনায় মথিত হতে থাকে। এখানে থাকা আর নিরাপদ না। এর সামনে থেকে সরে যেতে হবে।
সে উঠে দাঁড়িয়ে ধ্রুবর মুখোমুখি হয়ে বলে
– আমি চললাম।
কথাটা বলতে গিয়ে তার গলার স্বর কেঁপে উঠল, চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরে পড়ল। কথাটা তো দুই অর্থে প্রযোজ্য।
দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল ধ্রুব। দুইকদম এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে বীথির চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে গভীরভাবে প্রশ্ন করে
– কাঁদছ কেন?
মাথা নাড়ে বীথি। সে এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে না।
-বলবে না আমাকে?
ধ্রুব জবাবের জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, জবাব আসে না। তারপরে বীথির হাত তুলে ধরে তাতে চুমু খায়।
শিউরে উঠে বীথি। তাকে এখনি এই মুহূর্তে এখান থেকে পালাতে হবে। আর একদণ্ড এখানে থাকলে সে এর সামনে সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়বে। কোনোমতে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বীথি দৌড়ে পালিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু নিজের কাছ থেকে কে কবে পালাতে পেরেছে?
একমাস পরের কথা।
একমাস হল বীথি নিজের জগতে ফিরে এসেছে। সেই চিরপরিচিত দুনিয়া। সেই আসিফ ভাইয়া, রিফাত ভাবী, মম, তার ঘর, ইউনিভার্সিটির ক্লাস, সবকিছু আগের মত আছে। বদলে গেছে শুধু সে। তার মনে যে কি হয়েছে বীথি বলতে পারবে না। শুধু এক অসীম শুণ্যতা সে অনুভব করে। আর এক বুক হাহাকার। যে হাহাকার মনে চেপে রেখে সে স্বাভাবিক হবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। ক্লাসে যাচ্ছে, মমর সাথে খুনসুটি করছে, দিনশেষে চায়ের টেবিলে ভাইয়া ভাবীর সাথে গল্প করছে। কিন্তু কিছুতেই তার মন লাগছে না। মন সে যেন অন্য কোথাও ফেলে এসেছে। কিংবা বলা যায় অন্য কারো কাছে। এই অন্য কেউটা যে কে, সেটা বীথি প্রাণপণে উপেক্ষা করবার চেষ্টা করে। কি হবে এসব কথা ভেবে? একটা গল্পের বই এর চরিত্রের কথা ভেবে জীবনপাত করা কি কোনো সুস্থ মানুষের কাজ? লোকে শুনলে তাকে বদ্ধ উন্মাদ ভাববে। কিন্তু বীথি কিছুতেই তাকে ভুলতে পারে না। সারাদিন সব কাজের মধ্যে অসংখ্যবার ধ্রুবর কথা তার মনে পড়ে যায়। রাগে দুঃখে মাঝে মাঝে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করে বীথির। আর তো পারা যাচ্ছে না। এভাবে আর কতদিন? কবে এই দুঃসহ যন্ত্রণার অবসান ঘটবে?
আজ বিকেলে নিজের ঘরসংলগ্ন বারান্দায় রেলিঙে ভর দিয়ে সন্ধ্যাকাশের রঙখেলা দেখছিল বীথি। অন্যদিকে চায়ের টেবিলে আসিফ ভাই আর রিফাত ভাবী নিজেদের মধ্যে মৃদুস্বরে আলাপ করছে।
আসিফ ভাই বলছে
– বীথির সাথে কথা বলেছ?
-না, সুযোগ পাইনি। মেয়েটা যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছে। ইদানিং কি যে হয়েছে। আমার তো বেশ চিন্তা হচ্ছে।
-প্রেমে ছ্যাক ট্যাক খায়নি তো আবার?
-কি জানি, আমাকে তো কিছু বলে না। হঠাৎ করে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। অথচ প্রাণপণে চেষ্টা করছে নিজেকে স্বাভাবিক দেখাবার।
-হুম, এদিকে ধ্রুব তো বেশিদিনের ছুটিতে আসেনি। কথা বলে দেখ বীথির সাথে।
-আচ্ছা, দেখছি আমি।
ফোন বেজে উঠতে আসিফ ভাই ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর রিফাত ভাবী ভাবতে থাকে কিভাবে বীথির কাছে প্রসঙ্গটা তোলা যায়।
-বীথি।
-কি ভাবী?
আকাশ থেকে চোখ সরিয়ে রিফাত ভাবীর দিকে মুখ ফেরায় বীথি। ভাবীর মুখটা যেন একটু কাঁচুমাচু, কিছু বলতে চায়, কিন্তু বলতে সংকোচ করছে।
-কিছু বলবে ভাবী?
নরমভাবে বলে বীথি। এই একজনের কাছ থেকে সে প্রচুর ভালবাসা আর প্রশ্রয় পায়। কিছুদিন আগে পর্যন্ত এর সাথে সে অকপটে সমস্ত কথা শেয়ার করত। কিন্তু এখন তা আর হবার নয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে।
-ইয়ে, তোমার ভাইয়া বলছিল আজ একজন বেড়াতে আসবে আমাদের বাসায়।
-বেশ তো, বেড়াতে আসলে আসবে। একথা আমাকে বলছ কেন?
আশ্চর্য হয়ে গেল বীথি।
-তোমার ভাইয়ার ইচ্ছা তুমি তার সাথে একটু কথা বল। অবলীলায় স্বামীর ঘাড়ে সম্পূর্ণ দায় চাপিয়ে দেয় রিফাত ভাবী।
-আমি কথা বলব? কেন বলতো?
পরমুহুর্তে একটা ঝাঁকুনি খায় বীথি!
-আমাকে কি তার সামনে পাত্রী হিসাবে যেতে বলছ, ভাবী? তুমি… তুমি এই কথা বলছ?
লজ্জিতমুখে রিফাত ভাবী বলে- না, না, তা না। শুধু একটু দেখা করবে। বেচারা আমেরিকায় থাকে, ডাক্তার। কেবলি একটা হসপিটালে জয়েন করেছে। তোমার ভাইয়ার বন্ধুর ছোটভাই। খুব অল্প কয়দিনের ছুটিতে এসেছে। আসিফ তাই বলছিল …
ভাবীকে কথাটা শেষ করতে দেয় না বীথি। তার আগেই তীব্রভাবে বলে
-আমার পক্ষে সম্ভব না, ভাবী। আর আমি এখন পড়ার মাঝে আছি। পড়া ছেড়ে দিয়ে আমি বিয়ে করব, তোমাদের মাথায় এমন চিন্তা আসলো কিভাবে?
-বীথি, পড়া তোমাকে কেউ ছাড়তে বলছে না। আমরা তো পাগল না। আর দেখা করা মানেই বিয়ে না। তুমি শুধু একটু সামনে যাও, দুইচারটা কথা বলে দেখ। ভাল না লাগলে নাই। কেউ তো জোরাজুরি করছে না। কিন্তু তোমার ভাই তাকে বাসায় দাওয়াত দিয়ে এনেছে। সেও আসবে তোমার সাথে পরিচিত হবার উদ্দেশ্য নিয়ে। এখন তুমি যদি বের না হও তো কেমন দেখায় না ব্যাপারটা?
ভীষণ বিরক্ত হয় বীথি। এইটা কেমন কথা? না জানিয়ে তাকে এমন একটা পরিস্থিতিতে ফেলার মানেটা কি? সে এই লোককে কখনো বিয়ে করবে না। এই লোককে কেন, কাউকেই সে বিয়ে করবে না। বিয়েই যখন করবে না তখন মুখোমুখি হয়ে কথা বলবার কি অর্থ থাকতে পারে?
তারপরেও ভাইয়াকে অপ্রস্তুত সে করতে পারবে না। হাজার ইচ্ছা থাকলেও না। এখন অনিচ্ছা চেপে সঙের মত এই অশুভ মূর্তির সামনে তাকে গিয়ে বসতে হবে, কথা বলতে হবে। তীব্র বিতৃষ্ণায় বীথির মন পরিপূর্ণ হয়ে গেল। ঠিক আছে, ভাইয়া ভাবীর মান রাখতে সে সামনে বের হবে। কিন্তু পাঁচ মিনিট! পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সে ‘কেমন আছেন, ভালো আছি’ এসব ভড়ং সেরে পত্রপাঠ লোকটাকে বিদায় করে দেবে। লোকটা যেন আর কখনো এবাড়ির ছায়া মাড়ানোর কথা স্বপ্নেও না ভাবে।
-ঠিছ আছে, ভাবী। লোকটা এলে আমাকে বোলো। আমি একবার গিয়ে হ্যালো বলে আসবো। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। বিয়ে আমি করব না কখনো। আগেই তোমাদের জানিয়ে রাখলাম।
শুনে কাঁচুমাচু মুখ করে রিফাত ভাবী বলে
– ইয়ে বীথি, ও এই মুহূর্তে ড্রইংরুমে বসে আছে।
রিফাত ভাবীকে খুন করতে ইচ্ছা হল বীথির। সেটা না করতে পেরে শ্লেষের সাথে বলল
– বাহ বাহ বাহ। একেবারে আটঘাট বেঁধেই নেমেছ দেখছি। চল তাহলে। দেখি কোথায় তোমাদের সেই আমেরিকার ডাক্তার পাত্র। কথা যখন বলতেই হবে তখন ঝামেলা যত তাড়াতাড়ি চুকানো যায় ততোই ভালো।
হাঁ হাঁ করে ওঠে রিফাত ভাবী
– এভাবে যাবে? কাপড়টা বদলে চুলটা একটু আঁচড়ে গেলে হত না?
-ভাবী, আর একটা কথাও যদি বল তো আমি এই ঘর ছেড়েই বের হব না বলে দিলাম কিন্তু। ভীষন রেগে গিয়ে বীথি জবাব দেয়। রাগে, দুঃখে তার চোখ ফেটে কান্না পাচ্ছে। নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে। তার মন পড়ে আছে একজনের কাছে, আর সে আরেকজনের দৃষ্টির সামনে নিজেকে মেলে ধরবে? প্রচন্ড অনিচ্ছা নিয়ে ড্রইংরুমের দিকে এগোতে থাকে বীথি, পিছে পিছে রিফাত ভাবী।
ড্রইং রুমে ভাইয়া সোফায় বসে লোকটার সাথে কথা বলছে। তীব্র বিতৃষ্ণায় বীথি তার দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারে না, অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখে। ভাইয়া উঠে দাঁড়িয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়ে কেটে পড়ে। বীথির কানে ভাইয়ার কথার একবর্ণও ঢোকে না। সে কাঠ হয়ে সোফায় বসে সেন্টারটেবিলে রাখা ফুলের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। বীথি আশা করতে থাকে যে এই লোক তাকে জিজ্ঞেস করবে
– কেমন আছেন? তাহলে সেও ভালো আছি বলে কথা শেষ করে উঠে পড়বে। এর বেশি আর একটা কথাও তার পক্ষে বলা অসম্ভব।
-কেমন আছ?
লোকটার কথা কানে যেতেই মেজাজ তেতো হয়ে গেল বীথির। শুরুতেই তুমি! সৌজন্যবোধের কোনো বালাই নাই। বিদেশে থাকা এইসব পাত্ররা নিজেদের যে কি মনে করে। যেন এক একটা রত্ন! কৃপা করে দেশ থেকে মেয়ে বিয়ে করে একেবারে তাদের উদ্ধার করে দিচ্ছে। যার জন্য ভদ্রতা দেখাবার প্রয়োজন নাই। সাথে সাথে তার আর এক জগতের আর একজনের কথা মনে পড়ে গেল। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যে একটা বাড়তি ধাপ ফেলে তার দিয়ে এগিয়ে আসেনি। ধ্রুবর কথা মনে পড়তে বীথির বুকটা যেন গুড়া গুড়া হয়ে গেল। কোথায় গেলে এই দুঃসহ যাতনার হাত থেকে তার মুক্তি মিলবে?
-আমার দিকে তাকাবে না তুমি?
চমকে ওঠে বীথি। এই গলার স্বর তো সে চেনে। এই গলার স্বরের মালিককে সে গত একমাস ধরে শয়নে স্বপনে জাগরণে প্রতিটা পলে পলে অনুভব করেছে। করে প্রতিবার বেদনায় নীল হয়ে গেছে।
অসহ্য বিস্ময়ে চোখ তুলে তাকাতে ধ্রুবর সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। ধ্রুব! তার সামনে সোফায় বসে রয়েছে। কি করে সম্ভব এটা?
-তুমি! তুমি এসেছ? বহুকষ্টে শুধু এটুকু বলতে পারে বীথি। তার গলা বুজে এসেছে। হৃৎপিন্ড যেন ফেটে পড়বে যেকোন মুহূর্তে।
গম্ভীরভাবে ধ্রুব বলে
– হ্যাঁ, আমি এসেছি।
-কিভাবে সম্ভব এটা?
-দৈবযোগ বলতে পার। বাস্তবজীবনে ফিরে এসে আমি তন্ন তন্ন করে তোমাকে খুঁজেছি। আশেপাশে যত বাঙ্গালী পরিবার আছে, সবার মধ্যে তোমাকে খুঁজে বেড়িয়েছি। না পেয়ে অবাঙ্গালীদের মধ্যেও খোঁজবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমার মন বারবার বলছিল যে তুমি বাংলাদেশে আছ। সেজন্য হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়ে দেশে আসবার প্রস্তুতি নেই। দেশে এসে তোমাকে কোথায় পাব, কোথায় খুঁজব কিছু জানি না। শুধু জানি যে দেশে গেলে তোমাকে পাওয়া যাবে। এমন সময় ভাইয়ার বন্ধু আসিফ ভাইয়ের সাথে কাকতালীয়ভাবে যোগাযোগ হয়ে গেল ফেসবুকে। তার ওয়ালে তোমার ছবি দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে আমি আর এক মুহূর্ত দেরী করিনি।
বীথি রুদ্ধস্বরে বলে
– জানবার পর একবার তো আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারতে।
-মন সায় দিল না, বীথি। কিছু কিছু কথা আছে যা শুধু মুখোমুখি বলতে হয়। না হলে তার সব সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়।
বীথির চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়তে থাকে। হাত তুলে তা মুছে ফেলার সাহস হয় না। ভাইয়া, ভাবী নিশ্চয় আশেপাশে আছে, দেখতে পেলে কেলেংকারি হয়ে যাবে। সামনে বসে ধ্রুব সবই দেখতে পায় কিন্তু কিছু বলে না।
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে ধ্রুব এবারে প্রশ্ন করে
– যাবে তুমি আমার সাথে, বীথি?
-তোমার সাথে?
উদ্বিগ্নভাবে ধ্রুব বলে
– যাবে না? তোমার পড়া শেষ হওয়া পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করতে বলছ?
বীথি জবাব দিতে পারে না, দুদিকে মাথা নাড়ে। উদগত আবেগ সামলানো তারপক্ষে কঠিন হয়ে পড়ছে।
ধ্রুব আবার বলে
– বীথি, তুমি ওখানে গিয়েও তো পড়তে পারবে। আমি খোঁজখবর নিচ্ছি। এখানে না থাকলে পড়াশুনা হবে না, এমন তো না। আমাকে এজন্য অপেক্ষা করিয়ে রাখবে? যাবে না আমার সাথে?
বীথি মাথা নেড়ে শুধু জবাব দিতে পারে
– যাব।
সখী, ভাবনা কাহারে বলে
সখী, যাতনা কাহারে বলে
তোমরা যে বল দিবস রজনী
ভালোবাসা, ভালোবাসা
সখী, ভালোবাসা কারে কয়?
সমাপ্ত।
https://ochinpurexpress.com/%e0%a6%ae%e0%a6%a8%e0%a7%8b%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%a4/%e0%a6%b0%e0%a7%82%e0%a6%aa%e0%a6%95%e0%a6%a5%e0%a6%be-%e0%a6%a8%e0%a7%9f%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ac-%e0%a7%af/
অচিনপুর ডেস্ক /এসএসববি