তাবাসসুম নাজ
টরেন্টো, কানাডা।
উপন্যাস: রূপকথা নয় (পর্ব ৩)
বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ চলবার পর হঠাৎ চারিদিক কেমন অন্ধকার হয়ে এল। কী ব্যাপার দেখার জন্য বীথি জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে উঁকি দিতেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। এমন বৃষ্টি যে, একহাত দূরে পর্যন্ত কিছু দেখা যাচ্ছে না। সেই সাথে কড়াৎ কড়াৎ শব্দে বাজ পড়তে লাগল। কর্দমাক্ত, পিচ্ছিল বিপজ্জনক রাস্তা দিয়ে ঘোড়ারগাড়ি এঁকেবেঁকে চলতে থাকে। গাড়ির ভিতরে রাজকুমারী সুরমা আর বীথি সিঁটিয়ে বসে থাকে। দুজনে এমন ঝাঁকুনি খাচ্ছে যে নিজের আসনে বসে থাকাই মুশকিল, মনে হচ্ছে, যে কোনো মুহূর্তে তারা ছিটকে পড়বে। যেন অনন্তকাল ধরে তারা এই ভয়ঙ্কর ঝড়বৃষ্টির মধ্যদিয়ে প্রাণ হাতে করে এগিয়ে চলছে। ঘোড়াগুলি যে প্রচন্ড ভয় পেয়েছে তা তাদের ক্রমাগত চিঃ চিঃ ডাক শুনে বোঝা যাচ্ছে। আর সেই ভয়ার্ত ঘোড়াগুলির উপর কোচওয়ান যখন সপাং সপাং করে চাবুক মারতে থাকল, বীথির মনে হল যেন চাবুকটা তার পিঠেই পড়ছে। দাতমুখ খিঁচে সে কাঠ হয়ে বসে থাকে। ক্রমে অবস্থার আরো অবনতি হয়। বাইরে যেন তান্ডবলীলা শুরু হয়েছে। মুহূর্তে মুহূর্তে আকাশের বুক চিরে বিকটশব্দে বাজ পড়ছে। হঠাৎ করে বীথির খুব কাছে একটা কানফাটা শব্দ হল, পরমুহূর্তে ঘোড়াগাড়িটা উল্টে গিয়ে পাশের খানায় পড়ে গেল। গাড়ির মধ্যে রাজকুমারী সুরমা আর বীথি তালগোল পাকিয়ে গড়াগড়ি খেল।
প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠলে বীথি উঠে বসার চেষ্টা করে। ভাগ্য ভালো যে ঘোড়ার গাড়িটা উল্টে পড়বার সময় বাড়ি খেয়ে গাড়ির দরজা খুলে গেছে। না হলে দুজনেরই সলিল সমাধি হয়ে যেতে পারত। প্রায় অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে বীথি গাড়ি থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বের হয়ে আসলো।
বেরিয়ে এসে ডাকল- রাজকুমারী সুরমা?
খুব ক্ষীণ গলায় রাজকুমারীর সাড়া পাওয়া গেল
-হুউউউ।
-রাজকুমারী, গাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে আসো। ভিতরে বসে থাকা বিপদজনক।
রাজকুমারী সুরমা গুটিসুটি হয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে জড়সড় হয়ে উঠে দাঁড়াল।
বীথি প্রশ্ন করল
-তুমি ঠিক আছ তো, রাজকুমারী?
কথাটা শোনামাত্র হাউমাউ করে কেঁদে উঠল রাজকুমারী। সে যে প্রচন্ড ভয় পেয়েছে তা বোঝাই যাচ্ছে।
বীথি একটা হাত বাড়িয়ে দিল রাজকুমারীর দিকে
-ভয় পেয়ো না, রাজকুমারী। তবে আমাদের এই খানা থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উঠে পড়তে হবে। যে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে, এই খানা কিছুক্ষণের মধ্যে ভরে উঠবে আর আমরা পড়ব তখন বিপদে।
ভাগ্য ভালো যে খানাটা খুব গভীর না, পানিও কোমরপানি সমান। তারপরেও রাস্তায় উঠতে বীথিকে প্রচুর কসরত করতে হল। একে তো বৃষ্টি আর অন্ধকারের জন্য কিছু দেখা যাচ্ছে না, তার উপর চারিদিক কাদায় পিচ্ছিল হয়ে গেছে। বহু কষ্টে রাস্তায় উঠে দেখে রাজকুমারী ঠিক আগের জায়গায় মুর্তির মত দাঁড়িয়ে রয়েছে। বীথি প্রচন্ড বৃষ্টি আর বজ্রপাতের উপর দিয়ে চিৎকার করে ওঠে
-রাজকুমারী, উঠে এসো। ওখানে থাকাটা খুব রিস্কি হয়ে যাচ্ছে।
রাজকুমারীর দিক থেকে প্রাণের কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।
বীথি এবারে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে প্রচন্ডস্বরে ধমকে উঠল
-রাজকুমারী! এই মুহূর্তে উঠে এসো বলছি। এই যে আমার হাত। আমার হাত ধরে চলে আসো, কোন ভয় নাই।
রাজকুমারী কাঁদতে কাঁদতে বীথির হাত ধরে হামাগুড়ি দিয়ে বহুকষ্টে উঠে আসলো। রাজকুমারীকে সাহায্য করতে গিয়ে বীথি নিজেই দুই চারবার খানার মধ্যে প্রায় পড়োপড়ো হয়, কিন্তু কোনোরকমে শেষমুহূর্তে নিজেকে রক্ষা করে। রাজকুমারী উঠে আসলে দুজনে সেই তুমুল ঝড়জলের মধ্যে রাস্তায় বসে পড়ে হাঁপাতে থাকল। বীথি নিজেকে সামলে নেয় সর্বপ্রথম। যে বিপদে তারা পড়েছে, এখন মাথা ঠান্ডা না রাখলে চলবে না।
তাই সে প্রশ্ন করে
-তোমার সাথে কি কেউ ছিল যে আমাদের সাহায্য করতে পারে?
কাঁদতে কাঁদতে রাজকুমারী সুরমা জবাব দেয়
-কোচওয়ান ছিল, পাইক পেয়াদা ছিল।
-তাহলে তারা গেল কই? আশেপাশে কেউ আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। দেখি তো।
বলে বীথি যেই উঠে দাঁড়াতে গেছে, অমনি রাজকুমারী তার হাত খপ করে চেপে ধরে হাঁউমাউ করে উঠে
-আমাকে ছেড়ে যেও না।
বীথি আবার বলে
-ভয় পেও না। চল, তুমিও চল আমার সাথে চল।
দুজনে মিলে আশেপাশে যতটুকু পারে খোঁজাখুঁজি করে কারো কোনো সন্ধান পেল না। ঘোড়াগুলি পর্যন্ত নাই। খুব সম্ভব ঘোড়াগুলি ছুটে গেছে। আর কোচওয়ান, পাইক এরা অন্ধকারে তাদেরকে খুঁজে না পেয়ে আশ্রয়ের খোঁজে রওনা দিয়ে দিয়েছে।
যেটা কিনা তাদেরও খুব তাড়াতাড়ি করা দরকার, বীথি বুঝতে পারল। তা না হলে দুজেনই বাজপোড়া হয়ে শিক কাবাব হয়ে যাবে অচিরেই। আর এ ব্যাপারে বীথিকে আগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। বোঝা যাচ্ছে রাজকুমারী এ ধরণের পরিস্থিতে কাঁদাকাটা ছাড়া আর কিছু করতে পারে না। যদিও এটা তার রাজ্য আর বীথি এখানে সম্পুর্ণ নতুন। তারপরও।
সিদ্ধান্তে পৌঁছাতেই বীথির মেরুদন্ড সোজা হয়ে গেল, চোয়াল শক্ত হল। সে তুমুল বৃষ্টির শব্দের উপরে চেঁচিয়ে বলল
-রাজকুমারী, আমাদের আশ্রয়ের খোঁজ করতে হবে। তোমার লোকেরা কেউ নাই, সব চলে গেছে। আর এখানে থাকা আমাদের ঠিক হচ্ছে না।
শক্তভাবে রাজকুমারী সুরমার হাত চেপে ধরে বীথি অজানার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে দিল।
রাজকুমার অভীকের জীবনে একটাই দুঃখ। না, মানে রাজকুমার হবার সুবাদে তার জীবনে সুখই সুখ। কিন্তু তার প্রধান যে চাওয়া সেটা পূরণ হচ্ছে না, আর সেটা থেকে তার মনে দুঃখ জমছে।
রাজকুমার অভীক রাজা রণবিজয় ও রাণী উর্মিলার একমাত্র সন্তান, সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। অবশ্য রাজারাণী তার নাম অভীক রাখেননি, রেখেছেন অনিকেত। কিন্তু নামটা তার পছন্দ না। অনিকেত অর্থাৎ যার কোনো ঘরবাড়ি নাই। এ আবার কেমন নাম? এত বড় রাজপ্রাসাদ যার মজুদ, তার নাম কিভাবে অনিকেত হয়? সেজন্য রাজকুমার নিজেই নিজের নাম বদলে দিয়েছে, রেখেছে অভীক। অর্থাৎ কিনা যার কোনো ভয় নাই। তবে এ নিয়ে রাজপ্রাসাদে জোর গুজব চালু আছে। রাজকুমারের নতুন নামটা নাকি একেবারে পানিতে পড়ে গেছে। কারণ তার মতো ভীতু রাজকুমার সচরাচর দেখা যায় না। সাধারণের মতামত যাই থাক না কেন, একথা রাজকুমার অভীকের মুখের উপরে বলার সাহস কারো নাই। আর নাই বলে রাজকুমার অভীক তার নাম নিয়ে বড়ই পরিতৃপ্ত।
রাজারাণীর একান্ত ইচ্ছা রাজকুমার অভীক বিয়ে করুক। রাজকুমারেরও আপত্তি নাই। কিন্তু সে এক আজব শর্ত জুড়ে দিয়েছে। সে বিয়ে করবে ঠিকই, কিন্তু তার রাণীকে হতে হবে একজন প্রকৃত রাজকুমারী। শুনে রাজারাণী কথাটার তেমন গুরুত্ব দেয়নি প্রথমে। তাদের একমাত্র বংশধর সিংহাসনের উত্তরাধিকারী রাজকুমার অভীক একজন রাজকুমারী বিয়ে করবে না তো কি একজন ঘুঁটেকুড়ানী বিয়ে করবে নাকি?
কিন্তু কাজের বেলায় দেখা গেল ব্যাপরটা অত সহজ না। গত দুই বছরে রাজকুমারকে শতশত মেয়ে দেখানো হয়েছে। তারমধ্যে রাজকুমারী তো ছিলই, অন্যান্য উচ্চবংশীয় সর্বগুণে গুনান্বিতা মেয়েদেরও কম দেখানো হয়নি। কিন্তু রাজকুমারের মুখে একই কথা- আমি প্রকৃত রাজকন্যা চাই।
– রাজকুমারী মণিমালা একজন প্রকৃত রাজকন্যা।
– দূর, ওর বড্ড বেশী দেমাগ। ধরাকে সরা জ্ঞান করে।
– তাহলে রাজকুমারী অম্বালিকা?
– অম্বালিকার নাম যতটা লম্বা, সে নিজে ততটাই খাটো। ও প্রকৃত রাজকন্যা হতে যাবে কোন দুঃখে?
– তবে রাজকুমারী বহ্নিশিখা।
– হিংসা করে করে এই মেয়ের মুখটা কেমন চিমসা হয়ে গেছে। এই মেয়ে আদপে রাজকন্যা কি না তা নিয়েই আমার সন্দেহ আছে, প্রকৃত রাজকুমারী তো পরের কথা!
তো এই হচ্ছে রাজকুমার অভীকের অবস্থা। সে প্রকৃত রাজকন্যার আশায় বসে আছে। কবে তার দেখা পাবে, দেখা পেলে তাকে বিয়ে করবে। কিন্তু দেখা না পেয়ে তার মনে দুঃখ ঘনীভূত হচ্ছে।
অপরদিকে রাজা রণবিজয় ও রাণী উর্মিলার মনে দুঃখ ঘনীভূত হচ্ছে না। যা ঘনীভূত হচ্ছে তা হচ্ছে রাগ। ছেলে কোথায় বিয়ে করে থিতু হবে, নাতিনাতনী’র মুখ দেখাবে, তা না ‘প্রকৃত রাজকুমারী’ ‘প্রকৃত রাজকুমারী’ ধুয়া তুলে একের পর এক মেয়ে বাতিল করে দিচ্ছে। এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে আশেপাশের রাজ্যে কোনো রাজকুমারী বা উচ্চবংশীয় মেয়ে নাই, যাকে রাজকুমার বাতিল করে দেয়নি। কিন্তু তার এই ‘প্রকৃত রাজকুমারীর’ সংজ্ঞা তাকে জিজ্ঞেস করতে যাও, সে নিজেও ঠিকমত বলতে পারবে কিনা সন্দেহ। কি যে সে খুঁজছে তা কেউ বলতে পারে না।
রাজারাণী এ নিয়ে বিষম চিন্তিত। বিশেষ করে রাণী উর্মিলা তো মহাবিরক্ত। তিনি সেই কবে থেকে ছেলের বিয়ের প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছেন, তো ছেলে মেয়ে খুঁজেই পায় না। এমন করলে কিছুদিনের মধ্যে আশেপাশের সব বিবাহযোগ্য মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে। তখন কি হবে? রাণী উর্মিলা তাই আজ রাজা রণবিজয়কে রাজদরবারে পাকড়াও করেছেন-
– অনিকেতের ব্যাপারটা কী বল তো?
– তার আমি কি জানি? তোমার ছেলে, তুমিই ভালো বুঝবে।
রাজা রণবিজয় দিব্যি ঘাড় থেকে সব দায়দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে দিলেন। রাণী উর্মিলা বুঝলেন যে রাজার কাছ থেকে সাহায্যের কোনো আশা নাই। বরাবরের মতই রাজা ছেলের কৃতিত্বে ‘আমার ছেলে’ ‘আমার ছেলে’ বলে লাফঝাঁপ করবেন। কিন্তু একটু এদিক ওদিক হয়েছে কী, অমনি সেই ছেলের দায়ভার তাকে পুরোটাই বহন করতে হবে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাণী উর্মিলা সিদ্ধান্ত নিলেন- মেয়ে হয়ে জন্মানোই এক জ্বালা!
তবে তিনি রাজাকেও এত সহজে ছাড় দিলেন না।
বললেন
-এভাবে তো চলতে পারে না। অনিকেতের খুব শীঘ্র বিয়ে করা দরকার। দুইদিন পর আর কোনো বিবাহযোগ্য মেয়ে পাওয়া যাবে না। তখন হবেটা কী?
মোচে তা দিতে দিতে রাজা রণবিজয় ব্যপারটার গুরুত্ব বুঝে হুংকার দিলেন
-ওরে কে আছিস? রাজকুমারকে একবার খবর দে তো।
রাজকুমার অভীক সামনে এসে দাঁড়াতে রাজা রণবিজয় সরাসরি কাজের কথায় চলে এলেন।
– তুমি বিয়ে করছ কবে?
আমতা আমতা করে রাজকুমার জবাব দেয়
-বাবা, আমি তো প্র…
– থাক, থাক, আর বলতে হবে না। তোমার এই প্রকৃত রাজকুমারীর আশায় তো তুমি বুড়ো হতে চললে আর আশেপাশের সব রাজকন্যারা বিয়ে করে তিন বাচ্চার মা হয়ে গেল। তুমি কি এই বংশের নাম ডোবাতে চাও নাকি? খেঁকিয়ে উঠলেন রাজা রণবিজয়।
রাজকুমার অভীক দাঁড়িয়ে মাথা চুলকাতে থাকে। তার সেরকম কোনো ইচ্ছা নাই। তার একটাই ইচ্ছা কিন্তু সেটাও তো পূরণ হচ্ছে না।
এমন সময় রাজদরবারের প্রধান ফটক ধীরে ধীরে খুলে গেল। রাজপেয়াদারা দুইজন মেয়েকে রাজার সামনে এনে উপস্থিত করল। মেয়ে দুইটার হতশ্রী দশা। জামাকাপড় কাদামাখানো, জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া। দুজনের চুল দিয়ে, পোষাক দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরছে। চুলের মধ্যে পাতা আর ভাঙ্গা ডাল দেখে বুঝে নিতে কষ্ট হয় না যে তারা এই অন্ধকার ঝড়বৃষ্টিতে বনজঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এসেছে। বলা বাহুল্য, মেয়ে দুইটা রাজকুমারী সুরমা ও বীথি।
রাজকুমারী সুরমা অপূর্ব ভঙ্গীতে রাজাকে অভিবাদন জানায়। অগত্যা বীথিকেও রাজকুমারীর দেখাদেখি তা করতে হল। যদিও তার অভিবাদনের ছিরি দেখে রাজার চোখ কপালে উঠে গেল।
রাজকুমারী সুরমা বলে- আমি দূরদেশের রাজকুমারি সুরমা আর এ হচ্ছে আমার ফেইরী গ…
বীথি তাড়াতাড়ি বলে উঠে -আমি রাজকুমারী সুরমার সহচরী।
রাজকুমারী সুরমা আবার বলে- আমরা এরাজ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। পথিমধ্যে আমাদের গাড়ি উল্টে যায়, ঘোড়া পালিয়ে যায়, বাকীদেরও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। আজ রাত্রির জন্য আমরা আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
শুনে রাজা রণবিজয় বলেন- অবশ্যই, অবশ্যই। এতো আমার সৌভাগ্য।
রাণী উর্মিলা অবশ্য এত সহজে বিশ্বাস করলেন না। রা-জ-কু-মা-রী। সত্যি নাকি? বেশ তো, তিনি পরীক্ষা করে দেখবেন আসলেই রাজকুমারী নাকি অন্যকিছু। আজকাল কি কাউকে বিশ্বাস আছে? তাদের রূপকথার রাজ্যেও অনেক ভ্যাজাল ঢুকে পড়েছে!
রাজপরিচারিকাদের ডেকে তিনি রাজকুমারী ও তার সহচরীর জন্য শুকনো কাপড় ও রাতের খাবারের ব্যবস্থা করবার নির্দেশ দিলেন। আর প্রধান রাজপরিচারিকাকে একপাশে ডেকে নিয়ে কিছু বিশেষ নির্দেশ দিয়ে দিলেন।
স্নান সেরে শুকনো জামাকাপড় পরে চুল আঁচড়াচ্ছে রাজকুমারী সুরমা, ঘরে ঢোকে বীথি। বীথিকে দেখে রাজকুমারী সুরমার মুখে খুশীর হাসি ফুটে উঠল।
বীথি প্রশ্ন করে
-তুমি ঠিক আছ তো, রাজকুমারী?
ঘাড় হেলিয়ে বাচ্চাদের মত জবাব দেয় রাজকুমারী সুরমা -হ্যাঁ। তুমি?
– আমিও ঠিক আছি।
– তোমাকে ভালোভাবে দেখাশোনা করা হচ্ছে তো?
– হু। তুমি রাজকুমারী, তোমার ঘরের শানশওকত তো আলাদা হবারই কথা। আমাকে যা দেয়া হয়েছে তা দিয়ে আমার চলবে।
রাজকুমারী সুরমা এবারে অভিমানে ঠোঁট ফোলায়
-তুমি তখন কেন আমাকে ওকথা বলতে দিলে না?
– কোন কথা? অবাক হয় বীথি।
– ঐ যে, আমি যখন তোমার পরিচয় দিচ্ছিলাম। কেন বললে যে তুমি আমার সহচরী। তুমি আসলে তো আমার ফেইরি গডমাদার। তা না হলে কেন আমাকে এই ঝড়জলের মধ্যে এমন হাত ধরে বিপদ থেকে রক্ষা করবে? তুমি না থাকলে আমি আজ মরেই যেতাম।
-উফ! আবার এক কথা? এই ফেইরী গডমাদারের ভুত যে কবে এই মেয়েটার মাথা থেকে যাবে! বীথি কঠোর হতে গিয়েও পারে না। কেন জানি রাজকুমারী সুরমার উপর একটা মায়া পড়ে গেছে তার। বয়সে বাড়লেও মনে মনে একটা বাচ্চাই রয়ে গেছে। মমের সাথে কোথায় যেন মিল পায় ওর। আর সেজন্য বীথির মনে হয় যে রাজকন্যাকে রক্ষা করবার দায়িত্ব তার। কিন্তু তাই বলে ফেইরী গডমাদারের তকমা সে নিতে রাজী না।
কোমলভাবে বীথি এবারে বলে- আমি সত্যি তোমার ফেইরী গডমাদার না, রাজকুমারী। তুমি এই চিন্তা মাথা থেকে দূর কর।
রাজকুমারীকে খুব দুঃখিত দেখায়। কিন্তু পরমুহূর্তেই তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলে- রাজকুমারকে কেমন দেখলে?
– রাজকুমার? রাজকুমার ছিল নাকি?
– সেকি, তুমি লক্ষ্য করনি? সে তো রাজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। লম্বা, সুঠাম, গৌরবর্ণ, মাথাভর্তি কোঁকড়ানো কালো চুল…… রাজকুমারীর ঠোটে সলজ্জ হাসি ফুটে ওঠে।
ভ্রু কুঁচকে যায় বীথির। বলে- রাজকুমারী, আমরা ঝড়বৃষ্টির মধ্যে আধমরা হয়ে আশ্রয়ের খোঁজে আসলাম আর তুমি তার মধ্যে এতকিছু দেখে ফেললে? বলিহারি তোমাকে বাবা!
– হুম দেখলাম তো। রাজকুমার আমার দিকে তাকিয়ে হেসেছিল।
– এইটুকু সময়ের মধ্যে তোমরা তাকাতাকি হাসা-হাসিও করলে?
– হু। করলাম তো।
বীথি আর কি বলবে। এই সব বাজে কথায় মন দেবার তার সময় নাই। সে এখন মাথায় সাপ বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাসায় ফিরে যাবে কিভাবে এইটাই তো সবচেয়ে বড় চিন্তা।
রাজকুমারী আবার সলজ্জে প্রশ্ন করে- তুমি কি মনে কর রাজকুমার সেই জন?
বীথি বাড়ি ফিরে যাবার কথা ভাবছিল। অন্যমনস্কের মত বলল- কোন জন?
– ঐ যে, আমার ট্রু লাভ, সত্যিকারের ভালোবাসা।
আবার এক কথা! এই মেয়ের মাথাভর্তি খালি ট্রু লাভ, বিয়ে, রাজকুমার আর সুখে শান্তিতে বাস করিতে লাগিল। এই মেয়ে কি বাস্তব জীবনে আদৌ থাকে?
বিরক্ত হয়ে বীথি বলে- রাজকুমারী, যাকে একপলকের জন্য দেখলে, সে তোমার ট্রু লাভ হয়ে গেল? ট্রু লাভের মানে জানো তুমি?
– সত্যিকারের ভালোবাসা হলে তো একপলকই যথেষ্ঠ, তাই না?
উফ! এই মেয়েকে বুঝিয়ে কোনো লাভ নাই।
বীথি তাই এবারে কড়াভাবে বলে
-রাজকুমারী, আমি অনেক ঝামেলা পার করে এখন একটা নরম বিছানার সন্ধান পেয়েছি। ঘুমে আমি ঢলে পড়ছি। আমি চললাম ঘুমাতে। তুমি তোমার ট্রু লাভ নিয়ে থাকো।
বলে আর দাঁড়ায় না। নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। আর তার পর মুহূর্তে তার দুচোখে ঘুম নেমে আসে।
চলবে…
https://ochinpurexpress.com/%e0%a6%ae%e0%a6%a8%e0%a7%8b%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%a4/%e0%a6%b0%e0%a7%82%e0%a6%aa%e0%a6%95%e0%a6%a5%e0%a6%be-%e0%a6%a8%e0%a7%9f-%e0%a7%a8%e0%a7%9f-%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ac/
অচিনপুর ডেস্ক /এসএসববি