রূপকথা নয়(৬ষ্ঠ পর্ব)

তাবাসসুম নাজ
টরেন্টো, কানাডা।

উপন্যাস: রূপকথা নয় (৬ষ্ঠ পর্ব)

বীথি রাজা দিব্যজ্যোতি ও রাণী বন্যাশ্রীর রাজপ্রাসাদে আছে আজ কয়দিন হল। রাজা রণবিজয় ও রাণী উর্মিলার প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে আসবার পর তারা পুরো একদিন একরাত যাত্রা করে অবশেষে দূরদেশে এসে পৌঁছায়। পৌঁছে দেখে আরেক কান্ড! পুরো রাজ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। আগুনের মত চারিদিকে খবর ছড়িয়ে পড়েছে যে রাজার একমাত্র সন্তান, রাজকন্যা সুরমা, সিন্ডেরেলার বিয়ের ভোজ খেয়ে ফেরবার পথে দূর্ঘটনার কবলে পড়েছে। তারপর তার কি হয়েছে, তার কোনো হদিস নাই। কেউ বলে মারা গেছে, কেউ বলে নিখোঁজ হয়েছে। মোটমাট কথা সে ফিরে আসেনি। এ নিয়ে রাজ্যজুড়ে শোক। বয়স্ক বিজ্ঞ মহিলারা পুরা দোষটা অবশ্য সিন্ডেরেলার ঘাড়ে চাপিয়েছে।
বলেছে- ঐ মেয়েটাই অলক্ষুণে। ছোটবেলায় মাকে খেয়েছে, একটু বড় হতে বাবাকে খেয়েছে, আর এখন রাজকুমারী সুরমারও একই দশা হল।
অনেকে আবার রাজকুমার চার্মিং এর আয়ুষ্কাল নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছে।
সে যাকগে। এমন যখন অবস্থা, তখন বীথিকে সঙ্গে করে রাজকুমারী সুরমা যখন রাজদরবারে বসা শোকাচ্ছন্ন রাজা ও রাণীর সামনে উপস্থিত হল, তখন রাজা ও রাণী তো প্রথমে ভূত দেখার মত চমকে উঠল। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নিলেন রাণী বন্যাশ্রী। উড়ে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। তারপরে ‘কেন’ ‘কিভাবে’ ‘কি করে’ এসব প্রশ্নে মেয়েকে ব্যতিব্যস্ত করে তুললেন।
জবাবে রাজকুমারী সুরমা আঙ্গুল দিয়ে বীথিকে দেখিয়ে শুধু বলল- আমার ফেইরি গডমাদার। ও না থাকলে আমি সেইদিন মরেই যেতাম।
শুনে রাজা ও রাণী আরেক দফা মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপরে বীথি ওরফে ফেইরী গডামাদারের কাছে বারবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে থাকলেন।
সেইদিন থেকে বীথি রাজকীয় মর্যাদায় শানশওকতের সাথে রাজপ্রাসাদে আছে। তার মুখের কথা খসতে না খসতেই তার হুকুম তামিল করা হচ্ছে।

আজ বিকেলে সে রাজউদ্যানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চারিদিকে ফুলের সমাহার, অসংখ্য পাখি কিচিরমিচির করছে। পায়চারী শেষ করে বীথি এক পাথরের বেদীতে বসে ভাবনায় ডুবে গেল।
অবশেষে সে বুঝতে পেরেছে সে কোথায় আছে। সে আছে রূপকথার রাজ্যে প্রিন্সেস এন্ড দা পি গল্পের মধ্যে! কিভাবে এই ঘটনা ঘটল তার ব্যাখ্যা সে জানে না। যেভাবেই হোক সে এখানে চলে এসেছে। এখান থেকে ফিরে যাবার উপায় কি, তাও তার জানা নাই। তবে এসে পড়ে একটা ভালো কাজ সে করেছে। রাজকুমারী সুরমার বিয়েটা সে ঠেকিয়ে দিয়েছে। বীথি বুঝতে পেরেছে যে সে আসলেই রাজকুমারীর ফেইরী গডমাদার। রাজকুমারীর স্বার্থ দেখা তার কাজ। তাই সে সেটা করছে সেইদিন থেকে। ঐ সর্বনাশা বিয়ে বন্ধ করেছে। আর দূরদেশে এসে অবধি সে রাজকুমারীর উন্নতিসাধনে আদাজল খেয়ে লেগেছে। প্রথমে তো পড়েছে রাজকুমারীর শিক্ষাদীক্ষা নিয়ে। রাজকুমারীকে যে শিক্ষা দিয়ে বড় করা হয়েছে তা দেখে বীথি হাঁ হয়ে গেছে। কিভাবে বসবে, কিভাবে দাঁড়াবে, কিভাবে অভিবাদন গ্রহণ করবে, কাকে কি সম্বোধন করবে এগুলোর মধ্যে রাজকুমারীর শিক্ষা সীমাবদ্ধ। আর আছে পোষাক-আশাক। কোন উৎসব উপলক্ষে কোন পোষাকটা পরবে সেটা জানা যেন জীবনের মূল উদ্দেশ্য। রাজকুমারীর মাথা যে এসব হাল্কা জিনিস দিয়ে পরিপূর্ণ, সেজন্য তাকে খুব বেশী দোষ দিতে পারে না বীথি। তবে এবারে সে হাল ধরেছে। রাজকুমারীর শিক্ষার যে খামতি আছে, তা সে পূরণ করবার জন্য রোজ গ্রন্থাগার থেকে বই অর্ডার করেছে। তবে সে যে ধরনের বই খুঁজছে, তেমন বই তাদের কালেকশনে খুব বেশি নাই। কি আর করা। যা আছে তা দিয়ে কাজ চালাতে হবে। সে নিজেও মাঝে মাঝে রাজকুমারীকে পড়াতে বসাচ্ছে। তার মাথা থেকে প্রকৃত প্রেম, বিয়ে এসবের ভূত ঝেঁটিয়ে বিদায় করবার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। দেখা যাক কতদূর কি হয়?

রাজকুমারী সুরমার মনে অনেক দুঃখ। সে চেয়েছিল একজন ফেইরি গডমাদার। সিন্ডারেলার যেমন আছে। সিন্ডারেলার ফেইরি গডমাদার কি সুন্দর সিন্ডারেলাকে সুন্দর সুন্দর পোষাক পরিয়ে রাজপ্রাসাদের উৎসবে পাঠিয়ে দিয়েছিল। তাইতো সিন্ডারেলা রাজকুমার চার্মিং এর দেখা পেল, আর দেখা পেয়ে বুঝতে পারল যে রাজকুমার চার্মিং ই তার ট্রু লাভ- সাচ্চা পেয়ার। সেজন্যই তো সে ফেইরী গডমাদারের জন্য প্রার্থনা করেছিল। সেই প্রার্থনা তার পূরণ হয়েছে। কিন্তু একি! তার ফেইরী গডমাদারটা খুব ভালো সন্দেহ নাই। প্রথম দেখাতে তো তার জীবন বাঁচিয়ে দিল। কিন্তু বিয়ে, ট্রু লাভ এসব কথা শুনলেই কেন জানি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে। রাজকুমার অভীকের সাথে তার বিয়েতে কিছুতেই রাজী হল না। কিন্তু রাজকুমারী সুরমা নিশ্চিত যে রাজকুমারই হচ্ছে তার ট্রু লাভ। সেই ট্রু লাভের সাথে তাকে মিলিত হতে দিল না তার ফেইরী গডমাদার। রাজকুমারীর চোখে অশ্রু টলটল করে উঠল। উপরন্ত দিনরাত পড় পড় করে তাকে একদন্ড বসতে দিচ্ছে না। এত মোটা মোটা বই কি এত তাড়াতাড়ি শেষ করা যায়? পড়তে বসলেই তো তার ঘুম পায়। আর ঘুমালেই স্বপ্নে রাজকুমার অভীক চলে আসে। ইশ! রাজকুমার অভীক এখন কি করছে? সেও কি তার কথা মনে করছে? না কি করছে না? রাজকুমারীর মন বইয়ের থেকে সম্পূর্ণ সরে গিয়ে রাজকুমারের ভাবনায় বিভোর হয়ে গেল।

রানীমা বন্যাশ্রীর মনে সন্দেহ জেগেছে। সন্দেহটা তার চোখের মণি রাজকুমারী সুরমাকে নিয়ে। রাজকুমারীকে জীবিত অবস্থায় ফেরত পেয়ে তিনি যে কতবার, কতরকমভাবে শুকরিয়া আদায় করেছেন তার সীমা-পরিসীমা নাই। কিন্তু তার মনে ঘোরতর সন্দেহ যে রাজকুমারীর কিছু একটা হয়েছে। মায়ের চোখকে ধূলা দেয়া কি এত সহজ? রাজকুমারী ঠিকমত খায় না, ঘুমায় না, সাজসজ্জায় তার আগের মত মন নাই, কথায় কথায় তার চোখে জল এসে পড়ে। এগুলি কিসের ইঙ্গিত দেয়? হুহ! এগুলি কিসের আলামত তা তিনি খুব ভালো করে জানেন। তিনি নিজেই কি একসময়ে এসব উপসর্গে ভোগেননি? এখন বয়স বেড়েছে, বিবাহযোগ্য মেয়ের মা হয়েছেন বলে কি প্রথম প্রেমের সেই অনুভূতিগুলি বিস্মৃত হয়েছেন? কখনো না! রাজা দিব্যজ্যোতির দিকে তাকালে তিনি এখনো সেসব অনুভূতিতে উদ্বেল হয়ে ওঠেন। কি এক একটা দিন গেছিল সে সময়ে। শুধু অনিশ্চয়তায় ভরা। দিব্যজ্যোতিকে কি তিনি পাবেন, না পাবেন না? দিব্যজ্যোতি যে তার সাচ্চা পেয়ার- প্রকৃত প্রেম। কিন্তু সেই সাচ্চা পেয়ার পেতে তাকে অনেক ধৈর্য্য ধরতে হয়েছে। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে তবেই না তারা এক হতে পেরেছেন।

রানী বন্যাশ্রী পুরনো স্মৃতির মাঝে ডুবে গেলেন। সেসময় তিনি ছিলেন ১৬ বছরের এক সদ্যযুবতী, রাজ্যের সবচাইতে সুন্দরী, গুণবতী কন্যা। একদিন শখ করে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরতে বের হলেন, বনের মধ্যে পথ হারিয়ে শেষমেষ এসে পড়লেন এক কুটিরে। সেখানে তার দেখা হল চম্পার সাথে। কি সুন্দর ফুলের মত একটা মেয়ে। দুজনের বন্ধুত্ব হতে সময় লাগল না। কিন্তু চম্পার মত এমন একটা মেয়ে বনের মধ্যে একা কুটিরে কি করছে ভাবতে ভাবতেই চম্পার সাত ভাই সেদিনের মত কাজ শেষ করে ঘরে ফিরে এল। তারা সব কাঠুরে, বনের কাঠ সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালায়। এই সাতভাইয়ের সবচাইতে বড় ভাই হচ্ছেন দিব্যজ্যোতি। তখন অবশ্য তার নাম শুধু দিব্য ছিল। সিংহাসনে বসার পরই না সভাসদের পরামর্শে দিব্য নামের সাথে জ্যোতি লাগিয়েছেন। রাজাদের নাকি ভারিক্কী নাম ছাড়া মানায় না।
সেই শুরু। রাজকুমারী বন্যাশ্রী ও এক সামান্য কাঠুরে দিব্যর ভালবাসা। প্রথম দর্শনে দুজনে বুঝতে পেরেছিলেন যে দুজনে দুজনের ট্রু লাভ। একজন ছাড়া অন্যজন অসম্পূর্ণ। কিন্তু এই জালিম সমাজ কি সেটা সহজে মেনে নিয়েছিল? মোটেই না। সেজন্য তাদেরকে বহু পরীক্ষা, বহু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল। রাজকন্যা বন্যাশ্রী ধনুকভাঙ্গা পণ করেছিলেন যে দিব্যকে ছাড়া তিনি আর কাউকে বিয়ে করবেন না। আর সেই জেদ তিনি বজায় রেখেছিলেন। একসময়ে তার বাবা দূরদেশের রাজা দুজনের বিয়েতে সম্মতি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

ভালোবেসে তিনি এত জ্বালাযন্ত্রণা সহ্য করেছিলেন বলে রাজ্যের সব প্রেমিক-প্রেমিকাদের প্রেমের পথ সহজ করবার আজীবন ব্রত নিয়েছেন তিনি। রানীমা বন্যাশ্রীর কাছে কেউ এসে কেঁদে পড়লেই হল। তাদের প্রেমের পথ কঁন্টকমুক্ত করতে তিনি সর্বান্তকরণে সহায়তা করেন। কিন্তু যা মনে হচ্ছে, এখন তার ঘরেই প্রেমজ্বর ভালোমত জাঁকিয়ে বসেছে। রাজকন্যার ভাবভঙ্গী দেখে রাণীমা বন্যাশ্রীর মনে সন্দেহ যে রাজকুমারী সুরমা কারো প্রেমে পড়েছে। সেজন্য তিনি রাজকুমারীর খোঁজে রওনা দিলেন। মেয়ের সাথে একান্তে কথা বলা দরকার।

বীথি রাজউদ্যানে বসে বসে পরিকল্পনা করছে। কি কি উপায়ে রাজকুমারীকে গড়েপিঠে মানুষ করা যায়, মনে মনে তার একটা খসড়া করছে। হঠাৎ তার খেয়াল হয় যে সে একা না। একটা লোককে সন্দেহজনকভাবে রাজউদ্যানে ঘোরাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে। কে এই লোক? রাজপ্রহরীদের কড়া পাহারার মধ্য দিয়ে এই লোক এখানে ঢুকল কিভাবে? দেখে তো এইজগতের লোক বলেও মনে হচ্ছে না। কালো প্যান্টশার্ট, কালো বুট। এ ধরনের পোষাক দূরদেশের কোনো বাসিন্দাকে সে এপর্যন্ত পরতে দেখেনি। তাহলে কি চোর? চুরির মতলব নিয়ে সে পা থেকে মাথা পর্যন্ত কালো পরে ঘুরঘুর করছে? বীথি চট করে উঠে গিয়ে পাশের ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। ভাগ্যিস সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চোরটা তাকে দেখতে পায়নি। এদিক ওদিক তাকিয়ে বীথি একটা ভাঙ্গা ডাল পেয়ে সেটাই হাতে তুলে নেয়। এটা দিয়ে এই চোরকে শায়েস্তা করতে হবে। আপাতত আর কোনো উপায় তো দেখা যাচ্ছে না।

চোরটা কিছুক্ষণের মধ্যে এলোপাথাড়ি ঘোরাঘুরি করে একেবারে বীথির ঝোপের পাশে এসে পড়ল। লোকটার চালচলনই সন্দেহজনক। চুরি করবে তো রাজউদ্যানে কি? রাজপ্রাসাদে যায় না কেন? কথাটা মনে পড়তে নিজেকে আচ্ছাসে বকুনি দিল বীথি। কাজ আর পায় না সে, গেছে রূপকথার রাজ্যের বাসিন্দাদের কাজের পিছে লজিক খুঁজতে। এদের কোনো ঠিকঠিকানা আছে? একটা মেয়ে সত্যিকারের রাজকুমারী কিনা, তা জানতে যারা বিছানার মধ্যে মটরদানা গুঁজে দেয়, তাদের কাছ থেকে আর যাইহোক পরিষ্কার লজিক আশা করা যায় না। কিন্তু তারপরেও কথা থেকে যায়। হাজার হোক একটা চোর। কি করা যায় এখন একে? চেঁচিয়ে রাজপেয়াদাদের ডাকবে? কিন্তু তারআগেই যদি চোরটা তাকে আক্রমণ করে বসে? তার থেকে অতর্কিতে চোরটার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে চেঁচালে হয়ত ভালো হয়। আকস্মিক আক্রমণে চোরটা ভড়কে যাবে। সেই সুযোগে রাজপেয়াদারা এসে পড়ে একে পাকড়াও করে ফেলবে।

ভাবামাত্র বীথি রে রে করে গাছের ডাল হাতে চোরের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। চোরের পিঠে সপাৎ সপাৎ বাড়ি মারতে থাকে, সেই সাথে ‘চোর’ ‘চোর’ বলে গলা ফাটিয়ে ফেলে। চোরটা প্রাথমিকভাবে চমকে গেল ঠিকই কিন্তু পরমুহূর্তে ঘুরে দাঁড়িয়ে বীথির মুখ চেপে ধরে হিসহিস করে উঠে
– আমি চোর না। কে বলেছে আমি চোর?
‘চোর না’ লোকটা বিথীর হাত থেকে ভাঙ্গা ডাল কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
বীথি ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে
– তবে কে তুমি? এমন চোরের মত ঘুরঘুর করছই বা কেন?
– আমি চোরের মত ঘুরঘুর করছি না, ফেইরী গডমাদারকে খুঁজছি।
থমকে গেল বীথি। তার খোঁজে এই লোকের কি কাজ? এই লোককে তো সে কখনো দেখেনি।
সতর্কভাবে তাই সে বলে
– ফেইরী গডমাদারকে কেন খুঁজছ?
– তার কাছে নিয়ে যাও, তাকেই জানাবো।
বিরক্ত হয় বীথি। আচ্ছা ধুরন্ধর লোক তো! মুখে বলে
– কিন্তু তুমি কে না জেনে তো নিয়ে যেতে পারছি না।
– আমি ধ্রুব। রাজকুমার অভীকের ফেইরী গডফাদার।
আকাশ থেকে পড়ল বীথি। এইটা আবার কি জিনিস? মুখে বলে
– এতদিন ফেইরী গডমাদারের কথা জেনে এসেছি। এখন নতুন জিনিস শুনলাম। গডফাদার আবার কি? ইটালিয়ান নাকি? মাফিয়াদের কেউ?
বিরক্ত হয় ধ্রুব। আচ্ছা ফাজিল মেয়ে তো!
– মাফিয়া টাফিয়া কেউ না আমি। বললাম তো রাজকুমার অভীকের ফেইরী গডফাদার। রাজকুমারী সুরমার ফেইরি গডমাদারের সাথে একটা জরুরী আলোচনা আছে। সময় নষ্ট না করে তার কাছে নিয়ে চল আমাকে।
বুঝতে আর কিছু বাকী থাকে না বীথির। এই ধ্রুব না কে এসেছে রাজকুমার অভীকের হয়ে সুপারিশ করতে, দুজনের বিয়েটা যাতে হয় এই উদ্দেশ্য নিয়ে। হওয়াচ্ছি বিয়ে, মনে মনে ভাবল বীথি। ঐ গরুছাগলের মত মেয়ে বাছাই করা রাজকুমারের সাথে রাজকুমারী সুরমার মত একটা ফুলের মত মেয়ের বিয়ে? সে বেঁচে থাকতে নয়!
তাচ্ছিল্যভরে তাই সে উত্তর দেয়-
– ফেইরী গডমাদার একজন অত্যন্ত ব্যস্ত মহিলা। কারো সাথে দেখা করবার তার সময় হবে না। বিশেষ করে রাজকুমার অভীকের হয়ে সুপারিশ করতে আসা ফেইরি গডফাদারের সাথে তো নাই-ই। সে রাজকুমারীকে গড়েপিটে মানুষ করবার ব্রত নিয়েছে। রাজকুমারী এখন বিয়ে করবে না।
– তুমি কি করে বুঝলে যে আমি রাজকুমারের বিয়ের সুপারিশ করতে এসেছি?
ভুরু কুঁচকে সন্দেহের চোখে তাকায় ধ্রুব
– দাঁড়াও, দাঁড়াও। তুমিই কি তাহলে রাজকুমারীর ফেইরী গডমাদার? না হলে এতকিছু জানলে কি করে?
– সেটা হতেও পারি, আবার নাও হতে পারি। সে জেনে তোমার কাজ নাই। শুধু এটুকু জেনে রাখো যে রাজকুমারীর বিয়ে কিছুতেই ঐ অসভ্য রাজকুমারের সাথে হবে না। রাজকুমারী চিনতে যে মটরদানার আশ্রয় নেয়, তার বাড়িতে রাজকুমারী সুরমা পা ধুতেও যাবে না। বিয়ে তো বহু পরের কথা!
– আহা, সেটা তো আর রাজকুমার করেনি। রানী উর্মিলার কাজ ছিল সেটা।
– একই কথা । তারমানে পুরা গুষ্টি ধরে পাগল এরা! বিপদে পড়ে এক মেয়ে আশ্রয় চাইল, তার বিছানায় কিনা মটরদানা গুঁজে দিল। আশ্চর্য কথা!
– রাজকুমার অভীক মোটেই পাগল না, সে একজন সাচ্চা প্রেমিক। আর প্রেমিক বলেই সে রাজকুমারী সুরমার প্রকৃত প্রেম।
– হুহ! সাচ্চা প্রেমিক না আর কিছু! বিশ্ব প্রেমিক বল! রূপকথার রাজ্যে কোনো মেয়ে আর দেখতে বাকি রাখে নাই। যেন কাঁচাবাজারে গিয়ে আলুপটল বাছতে বসেছে। বেছে বেছে যখন তলানীতে এসে ঠেকেছে, তখন রাজকুমারীর দিকে চোখ গিয়ে পড়েছে!
প্রচন্ড বিরক্ত হল ধ্রুব। যা মনে করেছিল, তার থেকেও কঠিন চীজ দেখি এই ফেইরী গডমাদার! কিন্তু তাকে তার কাজ হাসিল করতেই হবে।
বিরক্তি চেপে সে বলে
– তোমার অবগতির জন্য জানাচ্ছি, রাজকুমার কোনদিন কাঁচাবাজারে যায়নি। তাই আলুপটল বাছাবাছির প্রশ্নই উঠে না। হ্যাঁ, স্বীকার করছি যে রাজকুমার অনেক মেয়ে দেখেছে। সেজন্য আমি তাকে তীব্রভাবে তিরস্কার করেছি। কিন্তু রাজকুমারীকে দেখে সে বুঝে গেছে যে রাজকুমারীই হচ্ছে তার ট্রু লাভ। এখন বিয়েই তাদের একমাত্র পথ। একজন ফেইরী গডমাদার হিসাবে তুমি কিভাবে এই বিয়ের বিরোধিতা কর?
আগুন হয়ে গেল বীথি। বলে
– বিরোধিতা করি কারণ আমার কাজ রাজকুমারীর দিকটা দেখা। সেজন্য আমি রাজকুমারীর সবধরণের উন্নতির ব্যবস্থা করেছি। শিক্ষাদীক্ষা, আত্মিক উন্নতি সব। তোমারও উচিৎ তোমার রাজপুত্রের উন্নতি সাধন করা। তুমি তোমার কাজ ঠিকমত করোনি বলেই না সে একটি আস্ত অকালকুষ্মান্ডে পরিণত হয়েছে। আর কিসের এত বিয়ে বিয়ে? বিয়েই কি জীবনের একমাত্র কাজ নাকি?
এবারে রাগ করতে গিয়েও হেসে ফেলল ধ্রুব। বীথির ক্ষিপ্তমূর্তি দেখে সে সত্যিই মজা পেয়ে যায়।
বলে
– না, বিয়েই একমাত্র কাজ না। জীবনে করবার মতো আরো বহু কাজ আছে। তবে এটা কিনা রূপকথার রাজ্য। এখানে সবকথার শেষ কথা হচ্ছে বিয়ে।
‘অতঃপর তারা সুখে শান্তিতে বাস করিতে লাগিল’ কি পড় নাই কখনো?
– তুমিই পড়। আমার এত সময় নাই, আমি চললাম। রাজকুমারীর পড়াশুনা কতদূর হল গিয়ে দেখি।
ধ্রুবর হঠাৎ করে না জানি কি হয়ে গেল। এই মেয়েটি চোখের সামনে থেকে চলে যাবে শুনে কেমন যেন একটা অদ্ভুত শুন্যতা তাকে চেপে ধরে।
সে পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলে
– কিন্তু তোমার সাথে কথা তো শেষ হল না। তোমার সাথে আবার কবে দেখা হবে?
বলা বাহুল্য, বীথি সে প্রশ্নের উত্তর দিল না।

চলবে…

https://ochinpurexpress.com/%e0%a6%ae%e0%a6%a8%e0%a7%8b%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%a4/%e0%a6%b0%e0%a7%82%e0%a6%aa%e0%a6%95%e0%a6%a5%e0%a6%be-%e0%a6%a8%e0%a7%9f%e0%a7%ab%e0%a6%ae-%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ac/

অচিনপুর ডেস্ক /এসএসববি

Post navigation