তাবাসসুম নাজ
টরেন্টো, কানাডা।
উপন্যাস: রূপকথা নয়(পর্ব ৯)
বীথির মুখের অবস্থা দেখে তার মনের ভাষা স্পষ্ট পড়তে পারল ধ্রুব।
গম্ভীর হয়ে বললো
– তোমার ভয় পাবার কিছু নাই, আমার অন্য কোনো অভিসন্ধি নাই। মেয়েদের সাথে জবরদস্তি করা এমনিতেই আমার পোষায় না।
শোনামাত্র আগের ফর্মে ফিরে যেতে বীথির এক সেকেন্ডও লাগলো না। বলে
– কিন্তু নিজের পোষ্যটিকে আমার নিষ্পাপ রাজকুমারীর উপরে গছাবার চেষ্টা করতে তো তোমার ক্লান্তি দেখি না।
ধ্রুবর মুখে হাসি ফুটে উঠল। সে ইচ্ছা করেই এ প্রসঙ্গটা তুলেছিল যাতে বীথির মন অন্যদিকে ঘুরে যায়।
এবারে সে তর্কের সুরে বলে- সেটা আলাদা কথা। ওরা দুজনে দুজনের জন্য যথার্থ, দুজনে দুজনের ট্রু লাভ।
-ট্রু লাভ না হাতি!
গজগজ করে বীথি।
– ঐ অপদার্থ রাজকুমার আর রাজকুমারী সুরমা?
-অপদার্থ হোক আর যাই হোক, সে সত্যি রাজকুমারীকে ভালোবাসে। আর যতটা অপদার্থ তুমি তাকে মনে করছ, ততটা সে না। তুমি আসলে ওকে দেখতেই পারো না।
-হুহ।
তাচ্ছিল্যের শব্দ করে বীথি।
তবে সে একটু ধাক্কাও খায়। সত্যি কি সে রাজকুমারের প্রতি অবিচার করছে? পরমুহূর্তে তার নির্বিচারে মেয়ে দেখার কথা মনে পড়তে মনটা কঠিন হয়ে উঠে। যা করছে বেশ করছে সে! কিছুতেই সে এ বিয়ে ঘটতে দেবে না!
প্রসংঙ্গ পাল্টানোর জন্য এবারে সে বলে
– ঐ কুটিরে কে থাকে? ভয়ঙ্কর হাসিটাই বা কার ছিল?
মোমবাতিটাকে সাবধানে মাটিতে বসিয়ে দিয়ে ধ্রুব বলতে থাকে
– ও হচ্ছে রিফাত ডাইনী। দূরদেশের বহু পুরনো বাসিন্দা। এমনিতে খুব ভালোমানুষ, কারো সাতেও নাই, পাঁচেও নাই। নিজের মনে একা একা থাকে। কিন্তু ওর ঐ এক দূর্বলতা মিষ্টি। ওর মিষ্টিতে কেউ হাত দিলে ওর মাথা খারাপ হয়ে যায়।
-ডাইনী?
আশ্চর্য হয়ে বলে বীথি।
– ডাইনীরা তো ভয়ঙ্কর হয়। ছোট ছোট বাচ্চা আটকে রাখে। আর একে তুমি ভালো বলছ কি করে?
-ডাইনী প্রজাতিরা দুই ভাগে বিভক্ত। সাদা ডাইনী আর কালো ডাইনী। তুমি যাদের কথা বলছ, তারা হচ্ছে কালো ডাইনী। আর রিফাত পড়ে সাদা ডাইনীদের মধ্যে। এরা মানুষের অপকার করে না, বরং সময় সময় এদের কাছ থেকে অনেক উপকার পাওয়া যায়।
-ও আচ্ছা। তাহলে এই রিফাত ডাইনী হচ্ছে সাদা ডাইনী যে মিষ্টি পাগল? ওর মিষ্টিতে হাত দিলে ওর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়?
বীথি বিশ্বাস করবে কি করবে না ভেবে পায় না। ধ্রুব কি তাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছে?
-হু, কারণ আছে অবশ্য। মিষ্টি সে খায় মনের দুঃখ ভুলে থাকার জন্য, স্ট্রেস কমানোর জন্য। শান্তভাবে বলে ধ্রুব।
-তাই? কেমন দুঃখ? খুব কৌতুহল হয় বীথির।
-রিফাত ডাইনীর স্বামী হচ্ছে আসিফ জাদুগর। ভালোবেসে দুজনের বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু আসিফ জাদুগরের পায়ের তলায় সর্ষে, সে এক জায়গায় বেশীদিন থাকে না। চারিদিক ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। যারজন্য রিফাত ডাইনী আর আসিফ জাদুগরের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। মানে তারা বিবাহিত ঠিকই কিন্তু একসাথে থাকতে পারে না। এনিয়ে রিফাত ডাইনীর মনে খুব দুঃখ। সেই দুঃখ ভুলে থাকবার জন্য সে একনাগাড়ে মিষ্টি খায়।
-ওহ!
কথাটা শুনে মন খারাপ হয়ে গেল বীথির। রিফাত ডাইনীর প্রতি সে একধরনের মমতা অনুভব করে। বেচারা! ভালোবাসার কাছে মানুষ বারবার পরাজিত হয়।
পরমুহূর্তেই বীথি চমকে উঠে। কি ভাবছেটা কি সে এসব? কখন থেকে সে এত আবেগপ্রবণ হয়ে উঠল? এক ডাইনী আর তার জাদুকরের দুঃখের প্রেমকাহিনী শুনে সে এতটা দুর্বল হয়ে গেল কেন?
শক্ত হাতে নিজেকে দমন করবার চেষ্টা করে, কথা ঘোরানোর জন্য ধ্রুবকে প্রশ্ন করে
– তুমি এতকিছু জানলে কিভাবে?
-আমি চারিদিক ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করি। ঘুরে ঘুরে সবার সাথে কথা বলি, তাদের জীবনযাত্রা খেয়াল করি। একবার রিফাত ডাইনী আমার জীবন বাঁচিয়েছিল। সাপের কামড় খেয়ে আমি মরতে বসেছিলাম। তখন এই রিফাত ডাইনীই শিকড় বাকড় কিসব সিদ্ধ করে আমার ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দেয়। তাতে সাপের কামড়ে মরবার হাত থেকে বেঁচে যাই। সে সময় সে আমাকে তার জীবনের কথা বলেছে একটু একটু করে।
-ওহ!
আবারো বলে বীথি।
পরিবেশটা কেমন জানি ভারী হয়ে আসে হঠাৎ করে। হালকা করার জন্য ধ্রুব কৌতুক করে প্রশ্ন করে-
-তা তোমার ছাত্রীর পড়াশুনা হচ্ছে কেমন? কি কি পড়াচ্ছ ওকে?
সত্য কথাই বলে বীথি
– পড়াশুনা আসলে খুব বেশী এগোচ্ছে না। প্রথম কথা তো লাইব্রেরীতে খুব বেশী বই নাই। মানে কাজের বই। যত রাজ্যের আলতু ফালতু বই দিয়ে লাইব্রেরী ভরা। তারপরে রাজকুমারীর নিজের আগ্রহ খুব বেশি না। আমিই ধরে বেঁধে যতটা পারি পড়াই। আবার কিছু কিছু জিনিস তো পড়ানোর কোনো মানে হয় না। যেমন ইতিহাস বা ভূগোল। এগুলো তো এ রাজ্যের জন্য প্রযোজ্য হবে না। কথাটা বলে ফেলে বীথি চুপ করে যায়। খুব বেশী বলে ফেলেছে কি সে?
ধ্রুবর চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ম হয়ে গেল। সে বলল
– ইতিহাস আর ভুগোল এ রাজ্যের জন্য প্রযোজ্য না? তবে কোন রাজ্যের জন্য প্রযোজ্য, বীথি?
ধ্রুবর মুখে নিজের নাম শুনে বীথি চমকে উঠে। চট করে নিজেকে সামলে নেয় সে। ধ্রুব উত্তরের অপেক্ষায় তারদিকে তাকিয়ে আছে দেখে সে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকায়, জবাব দেয় না। এমনিতেই সে অনেক বেশী বলে ফেলেছে। তার জানা ইতিহাস আর ভুগোল যে এরাজ্যের জন্য প্রযোজ্য না সেটা সে ধ্রুবকে জানাতে চায় না। কি দরকার জানিয়ে? খালি খালি বিপদ ডেকে আনা। তাছাড়া বিশ্বাসই বা করবে কেন ধ্রুব যে সে এখানকার বাসিন্দা না। কিভাবে এখানে চলে এসেছে সেটা সে নিজেও জানে না। আর এসে যখন পড়েছে, তখন ফিরে যাবার রাস্তা তার জানা নেই।
বীথি প্রশ্নের উত্তর দিল না দেখে ধ্রুবর ঠোঁটে কেমন অদ্ভুত এক হাসি ফুটে উঠল। পরমুহূর্তে সে তার ঝোলা কাছে টেনে নিয়ে উৎফুল্লভাবে বলতে শুরু করে
– যাক, আজ রাতটা এখানেই যখন আমাদের কাটাতে হবে তখন হাতপা ছড়িয়ে আরাম করে বসা যাক।
শুনে বীথির দৃষ্টি যে শংকিত হয়ে উঠল বুঝতে পারল ধ্রুব। কিন্তু সেটাকে উপেক্ষা করে আগের মতই উৎফুল্লভাবে বলে
– তোমার কথা জানি না কিন্তু এত দৌড়াদৌড়ি করে আমার কিন্তু খুব ক্ষুধা পেয়েছে। দেখি আজ আমার ঝোলা থেকে কি বের হয়? সেটা দিয়েই রাত্রের খাবার সারতে হবে।
শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বীথি। ছিঃছিঃ সে খামোখাই ধ্রুবকে সন্দেহ করছিল।
আগ্রহভরে সে বলে
– সত্যি কি তোমার কাছে খাবার আছে? আমার তো প্রচন্ড ক্ষিধে পেয়েছে।
ধ্রুবর ঝোলা থেকে বের হল- একটা রুটি, একচাকা চীজ, কয়েকটা আপেল আর চামড়ার তৈরী মটকা ভরা পানি। খুঁজে পেতে একটা দোমড়ানো মোচরানো থালাও বের করল সে।
ইম্প্রেসড হয়ে বীথি বলে
– বাব্বাহ! তুমি তো একেবারে প্রস্তুত হয়েই বের হয়েছিলে দেখি। খাবার দাবার, থালা, মোমবাতি সব তোমার ঝোলা থেকে বের হচ্ছে।
-হু, বললাম না তোমাকে, আমি ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করি। কখনো কখনো দিনের পর দিন ঘুরে বেড়াই। তাই তৈরী থাকতেই হয়।
ধ্রুব অবশ্য এটা উল্লেখ করে না যে সে ইদানীং দূরদেশে রাজপ্রাসাদের আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বীথির সাথে দেখা হয়ে যাবার আশায়। সেই সন্ধ্যার পর থেকে সে কিছুতেই মন থেকে তাকে ঝেড়ে ফেলতে পারছে না।
একটুকরো চীজ আর রুটির একটা অংশ ছিঁড়ে থালায় সাজিয়ে সে বীথির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে
– নাও। রাতের খাবারে এর থেকে আর ভালো কিছু জুটবে না তোমার।
-যে খিদে লেগেছে তাতে এই আমার কাছে অমৃত। বলে হেসে হাত বাড়িয়ে থালা নিতে গিয়ে বীথি আর্তনাদ করে উঠে।
আঁতকে উঠে ধ্রুব
– কি হল?
-আমার হাত। প্রচন্ড ব্যাথা করছে।
-সর্বনাশ! ফুলেও গেছে দেখি।
সত্যি সত্যি বীথির হাত অনেকখানি ফুলে গেছে। আর এত ব্যথা যা নাড়াতেই পারছে না।
-পাথরে আছাড় খেয়ে পড়বার সময় হাতে ব্যথা পেয়েছিলাম, কিন্তু তখন খেয়াল করবার মত অবস্থা ছিল না । এখন দেখি সাংঘাতিক অবস্থা।
– কই দেখি। থালাটা নামিয়ে রেখে বীথির হাত ধরে পরীক্ষা করতে থাকে ধ্রুব। সাবধানে পরীক্ষা করে অবশেষে সে বলে- খারাপভাবে মচকে গেছে। আপাতত কিছু করার নাই হাতটাকে বিশ্রাম দেয়া ছাড়া।
-কেমন করে বুঝলে হাত মচকেছে? ভাঙ্গতেও তো পারে! অবাক হয় বীথি।
-ভাঙ্গলে এতক্ষণে তোমার চিৎকারে আমার কানে তালা লেগে যেত। তাই ভাঙ্গেনি, মচকেছে শুধু। মৃদু হেসে ঠাট্টা করে ধ্রুব।
-তাই? তুমি এত জানো কিভাবে?
একটু ইতস্তত করে ধ্রুব। তারপরে কথা ঘুরিয়ে বলে
– এখন এই হাত নিয়ে তো তুমি কিছু করতে পারবে না। খাবে কিভাবে?
ধ্রুব তার কথার উত্তর দিল না দেখে অসন্তুষ্ট হল বীথি। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কিছু একটা লুকাতে চাইছে। কিন্তু যে বলতে চায় না তাকে বারবার খুঁচিয়ে তার দাম বাড়ানো বীথির কুস্টিতে নাই।
তাই বলে
– বা হাত দিয়ে চেষ্টা করে দেখি।
-বেশ। আবারো থালাটা এগিয়ে দিল ধ্রুব।
কিন্তু দেখা গেল বাহাত দিয়ে খাওয়া সত্যি কঠিন। রুটি ছেঁড়া যাচ্ছে না, চীজ ভাঙ্গা যাচ্ছে না, আর পানি তো মুখের থেকে গায়ের মধ্যে পড়ল বেশি।
দেখেশুনে ধ্রুব বলে
– পারবে না তুমি খেতে। যদি অভয় দাও তো একটা প্রস্তাব আমি দেই।
কাঁদোকাঁদো মুখে বীথি বলে
– কি?
তার সত্যি প্রচন্ড খিদে পেয়েছে।
-তুমি যদি কথাটাকে খারাপভাবে না নাও তবে আমি তোমাকে খাইয়ে দিতে পারি।
তারপর বীথির মুখের অবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি বলে
– না, মানে তাহলে কিছুটা খাবার তোমার পেটে যাবে। এখন তো কিছু খেতেই পারছ না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বীথি বলে
– আচ্ছা।
এছাড়া কোনো উপায় তো আর সে দেখছে না। আর ধ্রুবকে দেখে মনে হচ্ছে সিরিয়াসলি তাকে সাহায্য করতে চাচ্ছে, ফাজলামি করছে না। নিজেকে ধমকায় বীথি
– সাহায্য করতে চাচ্ছে কি, সাহায্য তো করেছেই। একবার রিফাত ডাইনীর কোপের হাত থেকে তাকে বাঁচিয়েছে, আর একবার খোক্কসের পেটে যাবার হাত থেকে। এখন ওকে অবিশ্বাস করা ঠিক হবে না।
ধ্রুব প্লেট হাতে এগিয়ে আসে। রুটি চীজ ছিড়ে বীথির মুখে তুলে খাইয়ে দিতে থাকে। কেন জানি বীথির ব্যাপারটাতে সংকোচ হল না। বরং মনে হল এর থেকে স্বাভাবিক ব্যপার আর কিছু হতে পারে না।
খাওয়াতে খাওয়াতে ধ্রুব প্রশ্ন করে
– তুমি আজ রাজপ্রাসাদের বাইরে বের হলে কি মনে করে?
খাবার গিলে নিয়ে বীথি উত্তর দেয়
– রাজকুমারীর খোঁজে বেরিয়েছিলাম। তাকে রাজপ্রাসাদ, রাজউদ্যানে কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তোমার রাজকুমার আবার তাকে ভাগিয়ে নিয়ে গেছে কিনা সেটা দেখার জন্য বাইরে বেরিয়েছিলাম। গুণের কোনো ঘাটতি নাই তো তার!
ফিকফিক করে হাসতে থাকে ধ্রুব
– তুমি সত্যি সত্যি ওকে একেবারেই দেখতে পারো না। এতটা খারাপ কিন্তু না সে। মাথায় বুদ্ধি কম এটা স্বীকার করছি। না হলে এমন আজগুবি বিয়ের শর্ত দেয় কেউ? দিয়ে তো এখন নিজের ফাঁদে নিজেই পড়েছে। যাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসে তাকে বিয়ে করতে পারছে না। কিন্তু রাজকুমারীকে ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মত অবিবেচকও সে নয়।
প্রতিবাদ করার জন্য বীথি মুখ খুলতেই ধ্রুব তাতে চীজ রুটি ঠেসে দিয়ে বলে
– হয়েছে, আর কথা না। তাড়াতাড়ি খেয়ে শেষ কর। আমারো তো খিদে লেগেছে। খুবই লজ্জিত হয় বীথি। তাড়াতাড়ি খাবার শেষ করতে যায় দেখে ধ্রুব আবার বলে
– এত তাড়াহুড়া করে খেও না তো। বিষম খাবে।
বেশ! একবার তাড়া দেয়, একবার বকা দেয়। বীথি কই যাবে?
বীথিকে খাইয়ে দিয়ে, নিজের খাবার শেষ করে অবশিষ্ট খাবার ঝোলায় তুলে ফেলে ধ্রুব। ততক্ষণে রাত বাড়ার সাথে সাথে ঠান্ডাও বেড়ে গেছে। নিশাচর প্রাণীর সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে গুহার বাইরে।
খুঁজে পেতে ঝোলা থেকে একটা পাতলা কম্বল এবারে বের করল ধ্রুব। ভাঁজ খুলে বীথির গায়ের উপর মেলে দিয়ে বলে
– ভালোমত জড়িয়ে নাও। রাতে অনেক ঠান্ডা পড়বে।
-আর তুমি?
-একটাই ছিল। আমার লাগবে না।
মনটা খুঁতখুঁত করতে থাকে বীথির। এখনি শীত শীত লাগছে, এই গহীন জঙ্গলে রাত যত বাড়বে শীতও তত বাড়বে। এই বেচারার কম্বল গায়ে দিয়ে সে আরামে ঘুমাবে আর সে ঠান্ডায় কাঁপবে? কিন্তু উপায়ই বা কি?
কম্বলটা ভালোমত গায়ে জড়িয়ে নেয় বীথি। পাতলা হলেও বেশ ওম আছে কম্বলটায়। আরাম পেয়ে গভীর শ্বাস ফেলে বীথি।
ধ্রুব প্রশ্ন করে
– মোমবাতি কি নিভিয়ে দেব না জ্বালানো থাকবে?
সসংকোচে বীথি বলে
– জ্বালানো থাকলে কি অসুবিধা হবে? চারিদিকের অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দে আমার কেমন ভয়ভয় করছে।
গম্ভীরভাবে ধ্রুব বলে
– ভয়ের কিছু নাই। তুমি ঘুমাও, আমি জেগে আছি।
-তুমি ঘুমাবে না?
-না, আমি পাহারা দেব। সংক্ষেপে বলে ধ্রুব।
-সারারাত?
-হু, ঘুমাও এবার। ভয়ের কিছু নাই।
এবারে বীথি সমস্ত সংকোচ ঝেড়ে ফেলে বলে
– তুমি চাইলে আমার সাথে কম্বল ভাগ করে নিতে পার।
-বল কি?
চোখ কপালে উঠে যায় ধ্রুবর।
– হঠাৎ আমার প্রতি এত বিশ্বাস? সন্ধ্যা থেকে তো আমাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছিলে। যেন আমি যে কোনো মুহূর্তে তোমার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি।
-দেখ, বাজে কথা বলবে না কিন্তু।
ঝাঁঝিয়ে ওঠে বীথি। তারপরে বলে
– এইটা তো সিম্পল লজিকের কথা। কম্বল একটা, মানুষ দুইটা। একজনের শীতে কাঁপবার কোনো প্রয়োজন আছে?
-সিম্পল লজিক? সেটা কি জিনিস? তুমি আসলে কোন জায়গার মানুষ, বলতো?
মনে মনে জিভ কাটে বীথি। আবার! আবার সে এমন সব প্রসঙ্গ তুলছে যার অস্তিত্ব রূপকথার রাজ্যে নাই। যার জন্য ধ্রুবর মনে সন্দেহ দেখা দিচ্ছে।
রাগ দেখিয়ে তাই সে কথাটাকে চাপা দেবার চেষ্টা করে
– আমি খালি বলছি যে শীত থেকে বাঁচার এটাই উপায়। বাকিটা তোমার ইচ্ছা। আমি তো এখন কম্বল মুড়ি দিয়ে আরাম করে ঘুমাবো।
নড়েচড়ে বসে আরামদায়ক একটা অবস্থান নেবার চেষ্টা করে বীথি। শক্ত মেঝেতে সেটা অবশ্য পাওয়া গেল না, তার উপরে আছে হাতের ব্যাথা।
ধ্রুবকে বারবার বলতে হল না। সে উঠে এসে বীথির পাশে একটা সম্মানজনক দূরত্ব রেখে কম্বলটা টেনে নেয়। ভাগ্যিস কম্বলটা যথেষ্ট বড়। ধ্রুব বোধহয় কম্বলটাকে মাটিতে বিছিয়ে কিছু অংশ গায়ে দেয়। বীথি চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করে।
ভোরের প্রথম আলো তীর্যকভাবে গুহার মুখ গলে ধ্রুবর চোখের উপর পড়তেই সে সজাগ হয়ে ওঠে। সারারাত জেগে পাহারা দিয়ে ভোররাতের দিকে তার চোখ লেগে এসেছিল। এখন জেগে উঠে সোজা হয়ে বসতে গিয়ে টের পায় তার কাঁধে বীথি মাথা রেখে গুটিসুটি মেরে ঘুমাচ্ছে। নিশ্চয় ঘুমের মধ্যে চলে এসেছে। দেখে মায়া হয় ধ্রুবর। বেচারা! কাল থেকে একের পর এক মেয়েটা শক খেয়েছে। প্রথমে রিফাত ডাইনীর হাসি, তারপরে খোক্কসের তাড়া। সবশেষে তাকেই কি কম ভয় পেয়েছিল নাকি সে? যদিও মুখে যথাসম্ভব প্রকাশ না করার চেষ্টা করেছে। বীথিকে প্রথমদিন দেখেই এক অদ্ভুতরকম আকর্ষণ অনুভব করেছিল ধ্রুব। কেন জানি তাকে দেখে মনে হয়েছিল জন্মজন্মান্তরের চেনা। ধ্রুব হাত বাড়িয়ে বীথির কপালের উপর এসে পড়া চুলগুলি সরিয়ে দেয়। উঠে পড়া দরকার, আর বেশীক্ষণ ওর পাশে থাকলে নিজেকে সামলানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। সতর্কভাবে বীথির মাথাটা সরিয়ে উঠবার চেষ্টা করতেই বীথির চোখ মেলে তাকায়। আধোঘুমের মধ্যে প্রথমে সে কিছু বুঝতে পারে না। পরমুহূর্তেই ধ্রুবকে এত কাছে দেখে আতংকিত মুখে তীরের মত সোজা হয়ে বসে। বীথির কান্ড দেখে প্রচন্ড রাগ হয় ধ্রুব। এই মেয়েটার মনে বিশ্বাস এত কম কেন? পুরাটা সময় সে একজন প্রকৃত ভদ্রলোকের মত আচরণ করেছে। তারপরও এই মেয়ের মনে বিশ্বাস সে জাগাতে পারল না!
উঠে দাঁড়িয়ে গম্ভীরভাবে ধ্রুব বলে
– ভোর হয়ে গেছে। এবারে আমরা রওনা দিতে পারি।
শুনে বীথিও উঠে দাঁড়ায়
– চল।
রাজপ্রাসাদে হুলুস্থুল পড়ে গেছে। রাজকুমারীর ফেইরী গডমাদার গতকাল থেকে নিখোঁজ। জানতে পেরে রাজকুমারী সেই থেকে একটানা কেঁদে চলেছে। রাজারাণীর মুখও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। একি অলক্ষুণে ব্যাপার! গেল কই ফেইরী গডমাদার!
সভাষদের সাথে আলোচনা করে রাজা যখন চতুর্দিকে লোক পাঠাবেন বলে ভাবছেন, তখন ধ্রুবকে সঙ্গে করে বীথি রাজদরবারে প্রবেশ করল। তাকে দেখে রাজকুমারী সুরমা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে। বাকিরাও একসাথে হুলুস্থুল জুড়ে দেয় ‘কোথায় গিয়েছিলে’ ‘কি হয়েছিল’ করে।
কিন্তু বীথি কারো প্রশ্নের জবাব দেয় না।
শুধু বলে
– আমি এই মুহূর্তে খুব ক্লান্ত। আমার এখন বিশ্রামের প্রয়োজন। আমি আমার ঘরে চললাম।
হ্যাঁ হ্যাঁ, অবশ্যই অবশ্যই। সবাই একসাথে হাঁ হাঁ করে উঠলো।
কিছুদূর গিয়ে বীথি ফিরে দাড়ালো
– রাজা দিব্যজ্যোতি ও রাণী বন্যাশ্রী, আমি রাজকুমারীর সাথে রাজকুমার অভীকের বিয়েতে সম্মত হয়েছি। তোমরা বিয়ের আয়োজন শুরু করে দাও।
পুরা রাজদরবার স্তম্ভিত হয়ে চুপ করে থাকে। সেই নিস্তব্ধ রাজদরবারে বীথি কয়েকপলক ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে নিজের ঘরের দিকে রওনা দিয়ে দেয়। ধ্রুবর ঠোঁটে ফুটে উঠল এক অদ্ভুত হাসি।
চলবে…
https://ochinpurexpress.com/%e0%a6%ae%e0%a6%a8%e0%a7%8b%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%a4/%e0%a6%b0%e0%a7%82%e0%a6%aa%e0%a6%95%e0%a6%a5%e0%a6%be-%e0%a6%a8%e0%a7%9f%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ac-%e0%a7%ae/
https://ochinpurexpress.com/%e0%a6%ae%e0%a6%a8%e0%a7%8b%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%a4/%e0%a6%b0%e0%a7%82%e0%a6%aa%e0%a6%95%e0%a6%a5%e0%a6%be-%e0%a6%a8%e0%a7%9f-%e0%a6%b6%e0%a7%87%e0%a6%b7%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ac-%e0%a7%a7%e0%a7%a6/
অচিনপুর ডেস্ক /এসএসববি