তাবাসসুম নাজ
টরেন্টো, কানাডা।
উপন্যাস: রূপকথা নয় (পর্ব ৭)
রাজকুমারী সুরমা খোলা বই সামনে রেখে গালে হাত দিয়ে বিভোর হয়ে রাজকুমার অভীকের কথা ভাবছে। উফ, কি হ্যান্ডসাম রাজকুমার অভীক!
হঠাৎ শুনতে পায় কে যেন ডাকছে
– রাজকুমারী! রাজকুমারী!
চমকে ঘাড় ঘুরাতেই দোতলার লাইব্রেরীর জানালায় রাজকুমার অভীককে দেখতে পেয়ে তার হৃদপিন্ড ধড়াস করে উঠল। সে কি জেগে আছে না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে?
রাজকুমার অভীক আবার ডাকে
– রাজকুমারী, তুমি কি শুনতে পাচ্ছ?
তার স্বপ্ন তাহলে সত্যি হয়েছে। রাজকুমার অভীক সত্যি সত্যি এসেছে।
রাজকুমারী একছুটে জানালার পাশে গিয়ে রুদ্ধশ্বাসে বলে
– রাজকুমার অভীক, তুমি এসেছ?
-হ্যাঁ, রাজকুমারী সুরমা, আমি এসেছি। তুমি কেমন আছ?
-আমি ভাল নাই।
ঠোঁট ফুলিয়ে রাজকুমারী জবাব দেয়।
-তুমি কেমন আছ?
-আমিও ভাল নাই, একদম ভালো নাই।
কাতরভাবে বলে রাজকুমার অভীক।
রাজকুমার ভালো নাই শুনে রাজকুমারীর চেহারায় সন্তুষ্টির ছাপ দেখা গেল। রাজকুমারী এবারে অভিমানভরে বলে
– আমি এতদিন হল আসলাম। আর তোমার আজ আসবার কথা মনে পড়ল!
ঢোঁক গিলে রাজকুমার তাড়াতাড়ি জবাবদিহি করে
– না না। আগেও একবার এসেছিলাম, কিন্তু তোমার দেখা পাইনি, রাজকুমারী।
হাম্পটি ডাম্পটির অক্কা পাওয়া বা তার মাচা ভেঙ্গে পড়ে যাওয়ার কথা রাজকুমার একেবারেই তোলে না। কি দরকার এসব প্রসঙ্গ তুলে নিজের ইমেজ নষ্ট করা!
-ওহ!
দুঃখিত দেখায় রাজকুমারীকে। – আমি নিশ্চয় পড়াশুনা করছিলাম তখন। ফেইরী গডমাদার বলেছে আমার অনেক পড়াশুনা করতে হবে, নিজের চিন্তার পরিধি বাড়াতে হবে। বিয়ে করা চলবে না। মনমরা হয়ে কথাটা শেষ করে রাজকুমারী।
শুনে রাজকুমার অভীককে ততোধিক উদ্বিগ্ন দেখায়।
-বিয়ে করা চলবে না? কিন্তু রাজকুমারী, আমি তো তোমাকে বিয়ে করতে চাই। তুমি আমার ট্রু লাভ- সাচ্চা প্রেম। তুমি ছাড়া আমার এ জীবন ধূ-ধূ মরুভূমি।
রাজকুমারীর গালে রক্তিমাভা দেখা দেয়। লাজুক হেসে সে বলে
– সত্যি বলছ? আমিই তোমার ট্রু লাভ?
-সত্যি, সত্যি, সত্যি। আমি কসম খেয়ে বলছি, রাজকুমারী।
রাজকুমারকে খুবই উদগ্রীব দেখায়। এবারে রাজকুমার জানতে চায়
– আর তুমি? তোমার ট্রু লাভ কে?
ঠোঁটে দুষ্টু মিষ্টি হাসি নিয়ে রাজকুমারী মাথা নীচু করে। আধো আধো স্বরে বলে
– আবার কে? তুমিই আমার ট্রু লাভ। মনে মনে তোমাকেই আমি স্বামী বলে মেনে নিয়েছি!
শুনে রাজকুমার পারে তো ভিমরি খায়। ভাগ্য ভালো থাকায় গতদিনের মত দোতলা থেকে পড়ে গেল না, কিন্তু তার হৃৎপিন্ড লাফ দিয়ে তার মুখে এসে পড়ল। নিজেকে সে ধরে রাখতে পারবে কিনা সন্দেহ।
ঘড়ঘড়ে গলায় সে বলে
– সত্যি বলছ, রাজকুমারী?
– সত্যি, সত্যি, সত্যি।
রাজকুমারী তার ভালোবাসা কবুল করাতে রাজকুমারের মনে প্রভূত সাহস এসে পড়ে।
সে বুক ফুলিয়ে বলে
– তুমি আমাকে ভালবাসো, আমি তোমাকে ভালবাসি। এখন আর কেউ আমাদের বিয়ে ঠেকাতে পারবে না। এবারে আমাদের বিয়ে হবেই হবে।
কাঁদোকাঁদো হয়ে রাজকুমারী বলে
– ফেইরী গডমাদার পারবে। সে তো এই বিয়ের একদম বিপক্ষে। সে তোমাকে দুচোখে দেখতে পারে না!
অসহিষ্ণু দেখায় রাজকুমার অভীককে। বলে
– উফ, এই ফেইরী গড মাদার! এর কি খেয়েদেয়ে আর কোনো কাজ নাই ? আমি ওর কোন বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছিলাম? আমার পিছে সে এমন হাত ধুয়ে পড়ে গেল কেন?
তারপরে একটু ঠান্ডা হয়ে বলে
– যাক, এনিয়ে চিন্তা কোর না। তোমরা চলে যাবার পর আমার ফেইরী গডফাদার এসে পড়েছে। সে বলেছে আমাদের সবরকম সাহায্য করবে। তারজন্যই আজ আমরা এখানে এসেছি। আমার ফেইরী গডফাদার এই মুহূর্তে তোমার খান্ডারনী ফেইরী গডমাদারের সাথে কথা বলছে। তুমি আশা হারিয়ো না রাজকুমারী, সে ঠিক একটা না একটা ব্যবস্থা করে ফেলবে।
-সত্যি বলছ রাজকুমার? সত্যি আমাদের বিয়ে হবে?
-সত্যি বলছি রাজকুমারী। তোমার আমার মিলন কেউ ঠেকাতে পারবে না।
রাজকুমারী সুরমার দুইহাত ধরে রাজকুমার অভীক অঙ্গীকার করে।
ঠিক সেই মুহূর্তে লাইব্রেরীতে ঢোকেন রানীমা বন্যাশ্রী। ঢুকে তিনি যে দৃশ্য দেখতে পান তা দেখে তার অজ্ঞান হবার জোগাড়। কোথাকার এক ছেলে তার আদরের রাজকুমারীর হাত ধরে বলছে
– তোমার আমার মিলন কেউ ঠেকাতে পারবে না!
শুনে রানীমা বন্যাশ্রীর আদি অকৃত্রিম মাতৃরুপ জেগে উঠল। তিনি যে প্রেমের পক্ষ নিয়ে সারাজীবন লড়াই করেছেন সেটা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে চিলচিৎকার করে উঠলেন
– কে? কে? কে ওখানে? এই ছেলে, তুমি কে? কোথা থেকে আসছ? রাজকুমারীর হাত ধরেছ, এত বড় সাহস তোমার কি করে হল?
রাজকুমার অভীক পারে তো সেই মুহূর্তেই যতজোরে সম্ভব পালিয়ে যায়- সাচ্চা পেয়ার-টেয়ারের কথা ভুলে গিয়ে। কিন্তু রাজকুমারী তার হাত চেপে ধরে রেখেছে, তাকে ছাড়ছে না।
রাজকুমারী মায়ের মুখোমুখি হয়ে কাঁদোকাঁদোভাবে বলে
– মা, ও ছেলে না! ও হচ্ছে রাজকুমার অভীক। রাজা রণবিজয় ও রাণীমা উর্মিলার একমাত্র সন্তান। আমি যখন সিন্ডেরেলার বিয়ে খেয়ে ফিরবার পথে দূর্ঘটনার কবলে পড়ি, তখন এদের রাজপ্রাসাদেই আশ্রয় নেই।
শুনে রানীমা বন্যাশ্রী অপেক্ষাকৃতভাবে শান্ত হয়ে বলেন
– ও আচ্ছা। তুমি রাজকুমার? তো জানালার বাইরে এমন চোরের মত দাঁড়িয়ে আছ কেন? এসো ভিতরে এসো, আলাপ করি তোমার সাথে।
ভয়ে ভয়ে রাজকুমার অভীক জানালা টপকে ঘরে ঢুকলে রানীমা তাকে বসতে ইঙ্গিত করে প্রশ্ন করেন
– কি জন্য রাজকুমারীর সাথে দেখা করতে এসেছ?
-রাণীমা, আমি কি খোলাখুলি কথা বলতে পারি আপনার সাথে? ইয়ে, মানে এখানে প্রেমের কথাও থাকবে! তাই লজ্জা পাচ্ছি!
উদারভাবে রাণীমা বন্যাশ্রী বলেন
– তোমার কোনো ভয় নাই। তুমি নিঃসংকোচে তোমার মনের কথা আমাকে বলতে পারো। আমি সারাজীবন প্রেমের পক্ষ নিয়ে কাজ করে এসেছি। বল, তোমার কি প্রবলেম?
-রাণীমা, আমি রাজকুমারী সুরমাকে বিয়ে করতে চাই। সে আমার ট্রু লাভ- আসল প্রেম।
রানীমা বন্যাশ্রী এবারে মেয়ের দিকে তাকালেন। তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন
– আর রাজকুমারী কি বলে? সেও কি তোমাকে বিয়ে করতে চায়?
আরক্তমুখে রাজকুমারী সুরমা জানায়
– হ্যাঁ মা, আমিও রাজকুমারকে বিয়ে করতে চাই। সেও আমার ট্রু লাভ- সাচ্চা পেয়ার।
-তাহলে তো কোনো সমস্যা আমি দেখতে পাচ্ছি না। দুজনে দুজনকে ভালোবাসলে বিয়েটা তো স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। তুমি তোমার বাবামাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে বল, রাজকুমার।
-রাণীমা, আমার বাবামা তো বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর জন্য একপায়ে খাড়া। কিন্তু সমস্যা করেছে রাজকুমারীর ফেইরী গডমাদার। সে কিছুতেই এই বিয়েতে রাজী হচ্ছে না।
-ওহ!
একটু দমে যায় রানীমা বন্যাশ্রী, ফেইরী গড মাদারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়াটা বিপদজনক। ওদের নানারকম ক্ষমতা থাকে। তাছাড়া ফেইরী গডমাদার রাজকুমারীর জীবন বাঁচিয়ে দিয়ে তাদের আজীবন ঋণের জালে জড়িয়েছে। এখন সে যদি এনিয়ে আপত্তি করে থাকে তো তার বিরুদ্ধাচারণ করা একটু মুশকিলের কথাই বটে।
-ফেইরী গডমাদার আপত্তি করেছে? তাহলে বোধহয় এ বিয়ে হচ্ছে না। তার কথার বিরুদ্ধে যাবার ক্ষমতা আমাদের নাই। দুঃখিতমুখে রাণীমা বলেন।
শুনে রাজকুমারী সুরমা ফিচফিচ করে কাঁদতে শুরু করে। রাজকুমারের মুখের অবস্থাও তার থেকে খুব একটা বেশি ভালো হল না।
একমাত্র কন্যার চোখের জল দেখে রানীমা বন্যাশ্রীর বিগলিত হতে বেশিক্ষণ লাগল না।
তিনি তাড়াতাড়ি সান্তনার সুরে বলতে থাকে
– আরে, আরে, আবার কাঁদে কেন? বোকা মেয়ে কোথাকার। আচ্ছা, আচ্ছা আমি দেখছি কি করা যায়। আমি ফেইরী গডমাদারের সাথে না হয় কথা বলে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করব, কেমন?
-সত্যি করবে তো, মা? রাজকুমারী কাঁদতে কাঁদতে জানতে চায়।
-হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি কথা দিচ্ছি সুযোগ বুঝে আমি তার সাথে কথা বলে তার মত বদলানোর চেষ্টা করব।
শুনে রাজকুমারের মুখে স্বস্তির ছাপ ফুটে ওঠে।
সেও বলে
– আজ আমার সাথে আমার ফেইরি গডফাদার এসেছে। এই মুহূর্তে সে ফেইরী গডমাদারকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। আপনারা দুজনে মিলে যদি বোঝানোর দায়িত্ব নেন, তো আমরা একটা আশার আলো দেখতে পাই।
রাজকুমারের কথা শেষ হতে না হতেই ঘরের মধ্যে যেন বজ্রপাত হল। বীথি ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকে রাজকুমারের দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে তেড়ে ওঠে
– কোনো আশার আলো দেখার চান্সই নাই তোমার! তোমার এত সাহস! নিজের গডফাদারটিকে আমার পিছে লেলিয়ে দিয়ে শখ মিটেনি, এখানে এসে রাণীমা আর রাজকুমারীর কাছে নাকী কান্না কাঁদছ? লজ্জা করে না তোমার, বদ কাহিকা?
বীথির যুদ্ধংদেহি মুর্তি দেখে রাজকুমার সাথেসাথে সিঁটিয়ে ওঠে। এক মুহূর্ত দেরী না করে কোনোমতে জানালা টপকে পালাতে গিয়ে আবারো দোতলা থেকে পড়ে গিয়ে সে এক বিশ্রী অবস্থার সম্মুখীন হয়।
দেখে বীথি তাচ্ছিল্যভরে বলে
– ঠিকমত পালাতেও পারে না। একে দিয়ে হবেটা কি? অপদার্থ একটা!
চলবে…
https://ochinpurexpress.com/%e0%a6%ae%e0%a6%a8%e0%a7%8b%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%a4/%e0%a6%b0%e0%a7%82%e0%a6%aa%e0%a6%95%e0%a6%a5%e0%a6%be-%e0%a6%a8%e0%a7%9f%e0%a7%ac%e0%a6%b7%e0%a7%8d%e0%a6%a0-%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ac/
https://ochinpurexpress.com/%e0%a6%ae%e0%a6%a8%e0%a7%8b%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%a4/%e0%a6%b0%e0%a7%82%e0%a6%aa%e0%a6%95%e0%a6%a5%e0%a6%be-%e0%a6%a8%e0%a7%9f%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ac-%e0%a7%ae/
অচিনপুর ডেস্ক /এসএসববি