মেঘের খেলা ২০

বন্যা হোসেন
অটোয়া, কানাডা।

উপন্যাস: মেঘের খেলা ২০

জীবনে কি শুধু সাদা বা শুধু কালো বলে কিছু আছে? জীবনের জটিলতায় মানুষের আবেগ ঢেউয়ের মত সৈকতে আছড়ে পড়ে, বালিয়াড়িতে মিশে যায়। আবার ঢেউ জমাট বাঁধে, ছুঁড়ে ফেলে দেয় আবেগগুলোকে। আম্মা আশায় বুক বেঁধে এসেছিলেন যাতে সহজেই সুখী সম্পর্কে নেতিবাচক মতামত দেয়া যায়। শীলা তার ছেলেকে ছেড়ে গেলেও পরিবারটি বিদ্যায়, ধনে, মানে, আভিজাত্যে সমাজে প্রতিষ্ঠিত এবং সর্বোপরি তার বন্ধু পরিবার। সুখী সম্পর্কে কিছুটা ধারণা তার ছিলই। কিন্তু শেকড়ের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানাও তো জরুরী। ভাল করে না জেনে কিভাবে একজন মানুষকে জীবনসংগী করা যায় !

সুখীর জন্য এ বিরাট বড় পরীক্ষা। তার সততা দিয়ে সে নিজেকে উপস্থাপন করেছে। সততা আর বিনয় এ দুইটি মূল্যবান স্তম্ভ ছাড়া তার দেয়ার আর কিছু নেই। কিন্তু সৎ গুণাবলী আর সততা একজন মানুষকে কতদূর নিয়ে যেতে পারে! ফিরোজকে লুকিয়ে রেখে, বাবামায়ের কাছে মিথ্যে বলে সে নিজে প্রতারিত হয়েছে। এখন সততার লেবাস যে তাকে সামাজিক প্রতিষ্ঠা এনে দিচ্ছে তাও তো নয়।

সাদী, নাজমার বর অসীমের সাথে সন্ধ্যায় হাঁটতে বেরিয়েছে। জানুয়ারি মাস শেষ প্রায়, ঢাকায় শীত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। প্রকৃতিতে বসন্তের আগমনের ঘনঘটা, ধানমন্ডী ১৫ নম্বর ধরে সারি সারি অশোক গাছ ফুলে ফুলে ভরা। এ এলাকায় বসন্তের ফুলের পাগল করা সমারোহ, রকমারি গন্ধ আর বর্ণের হাজারো ফুল।
আজই জানালো অসীমকে আম্মার সাথে সুখীর দেখা হওয়ার কথা। অসীম শুনেছে আগেই নাজমার কাছে। সাদীর আম্মা এসম্পর্কে তাদের কিছু জানাননি, যদিও প্রতিদিনই দুই পরিবারে আসা যাওয়া চলছে । অসীমের মায়ের সাথে আম্মার প্রতিদিন একবার চায়ের আড্ডা হয়। কিন্তু আম্মা ঘুণাক্ষরেও তাদের জানতে দেননি এব্যাপারে। নাজমা এখনও আশাবাদী, এ জুটির সবচেয়ে বড় অনুরাগী সে।

অসীম খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে সাদীর মনের খবর নিতে চায়। সে সাদীকে বলে,
-আমাদের পরিচয় হয়েছে কবে? জুলাইতে? জুলাই থেকে জানুয়ারী এ ছয়মাসে যতটুকু চিনেছি তাতে আমার মনে হয়নি তুমি হালকা, তরল টাইপের লোক! তাই যদি হত তাহলে আমার বউ কবে তার প্রিয় বান্ধবীকে সাবধান করে দিত ! সমস্যাটা কোথায় সাদী? বিয়ে করতে আপত্তি কেন তোমার ?

-আমি …আমার ভয় হয় আবার সুখে গা ভাসাতে …আর রোহান? রোহানের কি ভাল লাগবে? ও যদি ভালভাবে না নেয়?
অসীম হাত রেখে সাদীর কাঁধে। রোহান উঠতি বয়সের কিশোর, সমস্যা করতেই পারে।
-এরকম ভাবাটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু রোহানেরও জীবন পড়ে আছে সামনে …সারাজীবন মায়ের স্মৃতি আঁকড়ে তো থাকবে না। শীলা তোমাদের দুজনের জীবনের একটা অংশ হয়ে থাকবে। কিন্তু তাই বলে ভবিষ্যতের চিন্তা করতে অসুবিধা কি!

-শ্রাবন্তীও বিয়ে করতে চায় না!
-আমি তো জানতাম ওটা তোমার এক্সকিউজ! অসীম টিপ্পনী কাটে। সাদীর পছন্দ হয়নি এ রসিকতা।
একটু থেমে আবার সাদী বলে, “পুরুষদের নিশ্চয়ই ঘৃণা করে শ্রাবন্তী!“
অসীম এবার দৃঢ়ভাবে বলে, “না, এটা সত্যি না। ও বাচ্চা নিয়ে একা থাকে, অনেক সাবধানে চলাফেরা করতে হয়। তার হাবভাবে সামান্য ভুলচুক হলে এ সমাজ তাকে ক্ষমা করবে না। তাই এত সতর্ক ওর চলাফেরা ! পুরুষরা আকৃষ্ট হয় …বেশীরভাগই ধান্ধাবাজ …তুমিও তো আকৃষ্ট হয়েছিলে শুরু থেকেই …পার্থক্য একটাই তুমি খচ্চর টাইপ নও।”
-আমি ডেট করতে চেয়েছি, কিন্তু তার মানে নয় যে ওকে ছুঁড়ে ফেলে দিতাম!
সাদী রুষ্ট হয় এতদিন পরও কেন সুখী রাজী হল না মেলামেশায়।
-সুখী একবার যে জীবন থেকে বের হয়ে এসেছে, সেখানে ওর জন্য ডেটিংয়ে রাজী হওয়া খুব সহজ নয়।
-আমিই বা কি করতে পারি …ও আমার অফিস কলিগ… আমাকে রিপোর্ট করে…এক ফ্রডকে বিয়ে করেছিল… সব বুঝতে তো আমারও সময় দরকার!
-আরে বস, উত্তেজিত হওয়ার কি আছে! শান্ত হও, শান্ত!
তারা হাঁটতে হাঁটতে বাড়ী ফিরে আসে। অসীম চিন্তায় মগ্ন ছিল ফেরার সময়। লিফটে ঢুকে তাকে বলে, “আমার মনে হয় কিছুটা বুঝতে পেরেছি …সুখীকে এড়িয়ে যাওয়া কঠিন, অন্যদিকে ওকে পাবার অদম্য ইচ্ছেকে প্রতিহত করতে বিয়ের প্রাচীর খাঁড়া করেছো তাই তো ? কিন্তু এখন এগুলোকে খোঁড়া যুক্তি মনে হচ্ছে না?“
অসীমের ব্যাখ্যায় সাদীর মনের ধন্ধ কিছুটা কেটে যাচ্ছে মনে হয়। সত্যিই তো, এভাবে সে আগে কেন ভাবেনি?
অসীমকে চা খাওয়াবে বলে নিয়ে এল নিজেদের ফ্ল্যাটে। ঘরে ঢুকেই মনে হল পায়েস জাতীয় কিছু রান্না করছে আম্মা। বাতাসে এলাচ, সুগন্ধী চালের সুবাস। সে রান্নাঘরে গিয়ে চা বানিয়ে আনে, টেবিলের উপর গরম পায়েসের বাটি, আম্মা বোধহয় এক্ষুনি নামিয়েছেন চূলা থেকে।
অসীমকে চা দিয়ে দুজনে বসেছে টিভির দিকে মুখ করে। আম্মা বের হয়ে এলেন ভেতর থেকে।
-কেউ আসবে নাকি আম্মা, হঠাৎ পায়েস রান্না করলেন?
সাদী একটু উদ্বিগ্ন আম্মাকে নিয়ে। আম্মার প্রেসার, সুগার দুইই বেড়েছে। হার্টে ব্লক ধরা পড়েছে, স্টেন্ট বসানো হবে কয়েকদিনের মধ্যে। আম্মার ছুটি বাড়ানো হয়েছে, আপাতত চাটগাঁ ফিরে যাবেন না সহসা।

-আন্টি আমাকে দাওয়াত দিবেন কিন্তু, কোন সুখবর আছে নাকি?
-তোমরাই বল আমাকে, কি সুখবর? আম্মা পালটা প্রশ্ন করেন, তিনি লক্ষ্য করেছেন সাদীর মুখে খুশীর ছোঁয়া ‘সুখবর’ শব্দের উচ্চারণে।
-আন্টি, চলুন আমরা বিয়ের কথাবার্তা চালাই।
সাদী আর চুপ করে থাকতে পারলো না।
-আমি তো সামনেই আছে …আমাকে বাদ দিয়ে কথা চালাচ্ছো? সাদী ইচ্ছে করেই ক্ষোভ প্রকাশ করে, আম্মা তাকে না জানিয়েই সুখীর সাথে দেখা করতে গিয়েছিল তার প্রতিবাদ হিসেবে ।
-ওর পছন্দের মেয়েটির সাথে দেখা করলাম সেদিন! আম্মা সাদীকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে অসীমের উদ্দেশ্যে বলে। এবার সাদী মুখের আরক্ত ভাব আর লুকাতে পারে না। তা দেখে অসীম তার পিঠ চাপড়ে নিজে হাততালি দিয়ে উঠে।
– মেয়েটা খুব শান্ত, গম্ভীর। আম্মা বলেন। সাদী সবজান্তার হাসি দেয়।
-আন্টি, বিয়ের পর সাদীর সাথে থেকে চটপটে হয়ে যাবে, দেখবেন।
-প্রব্যাবলি নট! সাদী স্মিত মুখে উত্তর দেয়।
আম্মা মনে মনে ভাবছেন সাদী কী বিয়ের প্রসংগে বললো নাকি সুখীর কোন পরিবর্তন হবে না বিয়ের পর তা নিয়ে মন্তব্য করলো।
সবার অগোচরে করিডোরের এক কোণে দাঁড়িয়ে রোহান সব শুনলো, টুঁ শব্দ না করে ঘুরে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।

মীরার সাথে ওয়াশিং মেশিন থেকে কাপড় বের করে নেড়ে দিচ্ছে সাদী ব্যলকনিতে। আম্মার শরীর খারাপ বলে মীরাকে ডেকেছে সাদী। সে তার দুই ছেলেকে নিয়ে এসেছে মিউনিখ থেকে দুমাসের জন্য। তার স্বামী মাসুম কিছুদিন পর আসবে। আম্মার স্টেন্ট লাগানো হয়ে গেছে, প্রাথমিক ধকল কাটিয়ে সেরে উঠেছেন অনেকটা। মীরা আসাতে রোহান খুব উত্তেজিত, যদিও তার স্কুল শুরু হয়েছে কিন্তু ঘরে ফিরেই বাড়ী ভর্তি লোক তার স্বাভাবিক প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে এনেছে। আম্মা রান্নার খালাকে বিভিন্ন খাবার বানানোর নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন ক্রমাগত তার তিন নাতির জন্য।
সাদী কাপড় ক্লিপে আটকে দিচ্ছে আর বোনের সাথে সুখী প্রসঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে। গতকাল সকালে সুখীর সাথে দেখা করেছে বাইরে। পুরো বিষয়টা নিজের মনে কয়েকবার ঝালাই করেও কেন যেন শান্তি পাচ্ছে না, কোন ভুল হয়ে গেল না তো! সে বলে ওঠে,
-কি অদ্ভুত!
-ভাই, কিছুই অদ্ভুত না… অফিসে একজনের সাথে দেখা হয়েছে …ভাল লেগেছে … তোমাকেও তার পছন্দ হয়েছে … আম্মার মনের দুশ্চিন্তাও কমবে এবার।
-সবই ঠিক …শুধু শেষেরটা ছাড়া!
-কেন? আম্মা কি চায় তুমি একা একা থাকো সারা জীবন! মীরা বালতি থেকে এক জোড়া গোলাপী মোজা বের করে তাকিয়ে থাকে, তার ছেলের সাদা মোজা গোলাপী কামিজের সাথে মিশে রঙ্গীন হয়ে গেছে।
-আম্মা পছন্দ করেনি শ্রাবন্তীকে, হয়তো মেনে নিচ্ছে!
-আর তুমি, ভাই?
-ঠিক জানি না আমি কি ফিল করি …ওর জন্য। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে সাদী, নিজের মন্তব্যে বিস্মিত হয় সে।
-ব্যস, আর কোন কথা না! এবার বিয়েটা করেই ফেলো!
সাদী ভেবে চলেছে গত ছ’মাসের কথা …সে টরন্টো থেকে ফিরে এলো দেশে ভাঙ্গা হৃদয়ে, সঙ্গে এক উদ্ধত কিশোর। আর এখন বিয়ে না করার ধনুর্ভংগ পণ ভাংতে হবে?

আর এসব কিছুর আগে যা ঘটেছিল —

তারা দুজনে শুক্রবারের সকালে হেঁটে যাচ্ছিল রমনায় ঋতুরাজ বসন্তের আগমনে বিকশিত প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে। শ্বেতশিমুলে বুলবুলি আর টিয়া পাখী নেচে উঠেছে। রক্তরাঙ্গা পলাশ ফুলে কাঠ শালিক দলের ছোটাছুটি আর খুনসুটি, মহুয়া ফুলে কাঠবিড়ালী কুটকুট করছে। কান পাতলে কোকিলের গানও যেন শোনা যায় মাঝে মাঝে, তার মানেই বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।

-তুমি আমাকে কিছু বলনি, কিন্তু আম্মার হয়ে আমি সরি বলছি! সাদী বলে ওঠে।
-সরি বলার মত কিছু হয়নি সাদী! হেসে বলে সুখী।

সাদী খুব সন্তর্পনে হাঁটছে, সুখীর থেকে একটু দুরত্ব বজায় রেখে যেন ছোঁয়া না লেগে যায়। আজ সুখী পরে এসেছে জিন্সের উপর হলুদ সবুজ প্যাটার্নের ফতুয়া, পিঠের উপর হালকা শাল জড়ানো। সকালের দিকটায় এখনও একটু ঠান্ডা থাকে। সুখীর মাথার উপর সানগ্লাস তার স্প্রিঙ্গের মত চুলকে বেয়াড়া হতে দিচ্ছে না। সাদী খাকী ট্রাউজারের উপর শার্ট পরেছে নৌ নীল রঙের।

কাল রাতে হঠাৎ সাদীর মেসেজে আজ সকালেই দেখা করার অনুরোধে সুখী বিস্মিত হলেও রাজী হয়ে যায়। ডে কেয়ারে ফোন করে অর্পাকে রাখার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করে সকাল সকাল সাদীর সঙ্গে রমনায় এল। সে কত বছর পর এল রমনায় মনে নেই। বহু আগে বাবা, মা, মাহীসহ এসেছিল, সেই শৈশবে। সাদীর সঙ্গে অনেকদিন ভাল করে কথাও হচ্ছে না। আম্মাকে নিয়ে সাদী ব্যস্ত হয়ে পড়লো, এর মধ্যে মীরাও চলে এসেছে, তাদের নিজেদের কথোপকথন হয় শুধু রাতে অল্প সময়ের জন্য।
আম্মার সাথে তার সাক্ষাতের ঘটনা সে উল্লেখ করেনি ইচ্ছে করেই। সাদীও কোন উচ্চবাচ্য করেনি।
-আমার জন্য দুশ্চিন্তা করে আম্মার শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
-সৌভাগ্যবান মানুষ আপনি! সুখী হেসে বলে।
-আমার কথা কিছু বলেছে আম্মা তোমাকে? সাদী ভীষণ কৌতুহলী।
-একটু আগে তো করুণা হচ্ছিল আপনার জন্য, এখন তো দেখি নিজেকে ছাড়া আর কোন ভাবনা নেই আপনার!
সাদী জোরে হেসে উঠলো।
-আম্মাকে তাই বলেছি যা সত্যি। আই লাইক ইউ!

সাদী থমকে দাঁড়িয়ে গেল। সুখীর মত শান্ত, গম্ভীর সৌম্য স্বভাবের মেয়ে কি করে আম্মার কাছে তাঁর ছেলেকে ভাল লাগার কথা অকপটে বলে! এত অপ্রত্যাশিত লাগে সুখীর মুখে, সে যদি উচ্ছল, চঞ্চল বাকপটু হত তাহলে বুঝতে সুবিধে হত!
সুখীর সারল্যে মুগ্ধ সে শুরু থেকেই, আজ আবার এই সরল আলাপনে তার আবেগগুলো মিক্সচারে মিল্কশেকের ফেনার মত বুদবুদ করে উঠছিল। হাঁটতে হাঁটতে তারা রমনা উদ্যানের পানির ট্যাংকের কাছে চলে আসে, যেখানে শতবর্ষের পুরনো মহুয়া গাছ দাঁড়িয়ে আছে। পাশেই আছে বকুল আর মিলেশিয়া —-গাছতলায় ঝরে পড়া মিলেশিয়ার বিছানা, পুরোটাই নীল। ঢাকায় এ সময়টা খুব মনোরম।
যদিও তার হৃদপিন্ড লাফাচ্ছে পরবর্তী প্রশ্ন করার জন্য।
-আম্মা কি বললো? তোমার কথা শুনে?
সুখীর মনে নেই। তবে তার চোখমুখ যে ভাল দেখাচ্ছিল না তা বুঝেছে। সাদীকে এত কথা বলে দুঃখ দেয়ার কোন অভিপ্রায় তার নেই। সাদী একটু পর বলে,
-একা থাকার জন্যই হয়তোবা …যে কথাগুলো আগে বলেছি তা ঠিক ছিল না আমি জানি!
-ডেটিং ?
সাদী মাথা নেড়ে স্বীকার করে। সে কিছুটা লজ্জিত।
-আম্মা এবং অন্যান্যরা মনে করে বিয়ে করা উচিৎ!

এবার সুখীর আঁতকে ওঠার পালা। হাতের তালু হিম হয়ে আছে অথচ মুখে গরম আভা। তারা এখন দাঁড়িয়ে আছে অপূর্ব বর্ণে আর গন্ধে মাতিয়ে রাখা বেগুণী রঙের ব্রুনফেলসিয়ার কাছে। কিছু পুরনো ফুল সাদা হয়ে ঝরে পড়েছে গাছের চারদিকে।
একথার উত্তর কি দেবে সুখী? এভাবে তাকে বিয়ের প্রস্তাব কেউ দেয়নি। ফিরোজের সাথে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করেছিল …একটা আংটি আর লাল কাতান শাড়ী কিনে দিয়েছিল। ফ্লার্টিং, টেক্সটিংয়ে ছিল দৈন্যতা, শরীরে নয়।

-বিয়ে করছেন? সে সরলভাবে জিজ্ঞেস করেই বুঝলো প্রশ্নটা কি উজবুকের মত হয়েছে।
সাদী লাজুক হাসি দিয়ে মাথা নাড়ায়। তারা পায়েচলা পথের একটি প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে, সাদী একটি পাথরখন্ডকে পাশ কাটানোর জন্য সুখীর বাম পাশে এসে অলস পায়ে হাঁটতে থাকে।

-হ্যাঁ, তোমার কি মত? এবার বেশ গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করে সাদী।
আচমকা সুখীর পায়ে এসে লাগে কোন ইটের টুকরো। সে একটু হোঁচট খায়, সাদী তার কনুইয়ে ধরে তাকে সোজা করে। সে বহুকষ্টে উত্তর দেয়,
-খুব ভালো।
-বিয়ে না করার ব্যাপারে তোমার মত কি আগের মতই?
হে মাবুদ! এমন কঠিন প্রশ্নের উত্তর সে কি করে দেয়? আরক্ত মুখে শুধু বললো,
-আমার রেকর্ড খুব খারাপ সাদী!
তারা এখন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। সাদী ব্যঙ্গ করে যে প্রশ্নটি করলো তার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না।
-কয়টা বিয়ে করেছো তুমি?
-এক। সুখীর কন্ঠ প্রায় শোনা যায় না, কিছু মাধবীলতা আর নীলমণি লতা ফুটে আছে নয়নাভিরাম রূপে… সেদিকে তাকিয়ে সে উত্তর দিল।
-আচ্ছা? ইচ্ছে করেই নাটকীয়তা করে সুখীকে আজ অপ্রস্তুত করে দিচ্ছে সাদী।
সুখী মুখের ভাব লুকোনোর জন্য মাথা নীচু করে এগোতে থাকে লালচে কমলা পুষ্পে সজ্জিত পলাশ গাছের দিকে। সাদী তার পাশাপাশি এগিয়ে এসেছে হাসিমুখে, পলাশের রূপে মুগ্ধতার আতিশয্যে উপযুক্ত সময়ে সঠিক এবং শেষ প্রশ্নটি সে করলো,

-আমাকে বিয়ে করবে? সহজ, সরল, বিনীত প্রশ্ন…আঙ্গুলে তুড়ি দেয়ার মত।

এক থোকা পলাশ কি করে যেন ঝরে পড়লো সুখীর ঘাড়ের উপর আড়াআড়িভাবে।

-বিয়ে? এখন?
সাদী তার কথা শুনে যখন পাগলের মত হাসতে শুরু করেছে। সে বেশ আত্মসচেতন হয়ে বললো,

-আজ? সাদী মাথা নেড়ে না বললো, কিন্তু প্রবল হাসির দমকায় কিছুক্ষন সময় লাগলো দম নিতে। নিজেকে সামলে আবার জানতে চাইল,
-হ্যাঁ? না?
সে অবশ্য সুখীকে প্রস্তাব দেয়া নিয়ে পরে রাতে অনেকবার মনে করেছে ঐ মুহূর্তে সুখীর অভিব্যক্তিগুলো তার মনের এলবামে গেঁথে রেখেছে। পরের দিন কাপড় মেলে দেয়ার সময় মীরাকে বলেছে।

-আমার বিশ্বাস হচ্ছে না এখনও! আপনি আমাকে প্রপোজ করলেন ! ঘাড় ঝাঁকিয়ে মাথা নাড়িয়ে চোখ বন্ধ করে বলে সুখী। কয়েক সেকেন্ড চলে গেল, এবার চোখ খুলেই প্রথম কথা তার,
-রোহান জানে?
-বাসায় বিয়ের কথা হচ্ছে রোহান জানে, শ্রাবন্তী!
প্রপোজ করার পর এই প্রথম শ্রাবন্তী বলে ডাকলো তাকে। সে কল্পনায় দেখতে পেল সাদী তাকে নাম ধরে ডাকছে যখন সে ব্যালকনিতে কাপড় মেলছে বা রান্নাঘরে কাজে ব্যস্ত ।
সুখী খুব চিন্তিতভাবে বললো, ‘’আমরা নিজেরাও জানি না, কি করছি! এটা কি ঠিক হচ্ছে সাদী?”

সাদীর হাত ধরলো ভর দেয়ার জন্য, তার ভাবখানা দেখে মনে হচ্ছে তাকে ব্যাংক ডাকাতি করতে আদেশ দেয়া হয়েছে। সাদী তার হাতটি হাতে ধরে আশ্বাস দিল নির্ভরতার, চেপে ধরলো।
-দুজন মানুষের দুজনকে ভাল লাগে …এই তো!
-আমি সিংগল প্যারেন্ট, আপনি বস, মাত্র ছ’মাস হল আমাকে চেনেন।
-আমিও সিঙ্গল প্যারেন্ট… আমি যেটুকু জানি আর দেখি …তা-ই যথেষ্ট! আত্মবিশ্বাসের সাথে উত্তর দেয় সাদী , সে নিজেও জানে না এত মনোবল আজ কোথা থেকে এল।
-আমি… আমি কিছু বলতে পারছি না! কান্না পেয়ে গেল সুখীর। সাদী তাকে হাত ধরে নিয়ে এল অপর প্রান্তে একটি খালি বেঞ্চিতে বসার জন্য। সুখীর খুব দুর্বল লাগছে। আবেগে, উৎকণ্ঠায় গলা শুকিয়ে আসছে। সামনে গাঁদা ফুলের বেড, অন্যদিকে নানা বাহারী গোলাপ ফুটেছে।
-আম্মা আমাকে তার ছেলের বউ হিসেবে দেখতে চান না সাদী! তার পরিবারের মান সম্মান, তাদের এক্সপেক্টেশন, সংস্কার, রীতি-নীতি…আমার তো এক মাহী থাকার মধ্যে…আর মাহীকে না জানালেও কোন ব্যাপার না! ও আর আমাকে নিয়ে মাথা ঘামায় না!

তারপরই সে মিষ্টি হাসি হেসে বলে,
-এত সুন্দর করে কেউ কোনদিন আমাকে প্রপোজ করেনি। একটু হেসে আবার বলে,
-আমি এমনভাবে বলছি যেন বহুলোক প্রপোজ করেছে… আজকের দিনটা কখনো ভুলবো না।
সে যেন ঠিক করে নিয়েছে সে শুনবে, বুঝে নিবে, পর্যালোচনা করে ফাইলে ক্লিক করে রেখে দিবে আর্কাইভে।
সাদী এতক্ষণ দাঁড়িয়ে তার কথা শুনছিল। এবার পাশে বসলো। বললো,
-তোমার কি মাহীকে ভয়?
-ভয় সবকিছুতে! আমরা জানি না একসাথে থাকতে গেলে কি হবে! আপনি চান না আম্মা আর মেয়ে খুঁজুক তাই হাতের কাছে আমাকে পেয়ে প্রস্তাব দিলেন! তাই না?
-তোমার এরকম মনে হল! কেন বল তো?
-আপনি কোনদিনও বিয়ে করবেন না থেকে রিলেশনশিপ রাখা থেকে সরাসরি বিয়েতে চলে এসেছেন! সন্দেহ হবে না আমার!
সাদীর গত কয়েক মাসের অনুভূতিকে সে সুন্দর তিনভাগে ভাগ করে আয়না দেখিয়ে দিল।
-রোহান এপ্রুভ করবে কিনা আমরা জানি না!
-শ্রাবন্তী, ওর দশ বছর বয়স! অস্থিরতার সাথে সাদী উত্তর দেয়।
সুখী লক্ষ্য করেছে সাদী কি অধৈর্য্য আর অস্থির হয়ে যায় তার আকাংখিত প্রত্যাশা পূরণ না হলে। তাকে রোধ করা মুশকিল।
আর সে এক পদক্ষেপ নিতে শতবার ভাবে। ভীরু, লজ্জিত, শংকিত …কোন স্বপ্ন সে দেখে না! নিজেকে এতদিন সান্ত্বনা দিয়েছে এই বলে যে প্রথম এবং শেষবারের মত তার হৃদয় একবারই ভেঙ্গেছে। কি করে কোত্থেকে সাদীর মত আশ্চর্য সুন্দর একজন মানুষ তার সামনে এসে দাঁড়ালো, তাকে পংকিলতা থেকে টেনে আলোর ছায়াপথে নিয়ে সঙ্গী হওয়ার অঙ্গীকার করলো।
-আম্মা মনে মনে শীলার সাথে আমার তুলনা করেছেন!
সুখীকে এতটা অপমানিত হতে হয়েছে ভেবে দুঃখ পায় সাদী। কিন্তু এই তুলনা চলতেই থাকবে। সে জানে, সুখীকে বিয়ের উপহার হিসেবে তা ধারণ করতে হবে।
-অফিস? …অফিসের কথা ভাবছি না আমরা … শাকিল? …সবাই কি বলবে?
-বিয়ে সবাই করে শ্রাবন্তী! সাদী আবার ব্যঙ্গ করে!
এবার সেও হেসে শোনায়, “জানি!”
-শ্রাবন্তী! তুমি কি আমাকে অবিশ্বাস কর?
-না! নাতো!
নির্নিমেষ চেয়ে আছে তারা একে অপরের দিকে…
এখন পর্যন্ত এ আলাপচারিতার একমাত্র সুফল হচ্ছে সাদী প্রতারক নয়! সে অবিশ্বাসী নয়!

চলবে…

অচিনপুর ডেস্ক / এসএসববি

https://ochinpurexpress.com/%e0%a6%ae%e0%a6%a8%e0%a7%8b%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%a4/%e0%a6%ae%e0%a7%87%e0%a6%98%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%96%e0%a7%87%e0%a6%b2%e0%a6%be-%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ac-%e0%a6%8a%e0%a6%a8%e0%a6%bf%e0%a6%b6/

Post navigation