মেঘের খেলা (পর্ব ২২)

বন্যা হোসেন
অটোয়া, কানাডা।

উপন্যাস: মেঘের খেলা (পর্ব ২২)

ঋতুরাজ বসন্তের দেখা মিলতে না মিলতেই আচমকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কখনো সামান্য ভারী, কখনো ইলশেগুঁড়ি। ছুটির দিনগুলোতে এমন বৃষ্টি হলে মন উদাস হয়ে যায়। কত কি ভাবনারা আসে, বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে হয়। অসময়ের বৃষ্টিতে ভেজা মানেই অসুস্থ হওয়া। আকাশের কালচে ধুসর রঙ দেখতে ভাল লাগছিল না।

সুখী সাধারণত ছুটির দিনে মেয়েকে নিয়ে একবার কোথাও বের হয়। কোন পার্কে, মলে বা বাইরে খেতে যায়। আজ আকাশের চেহারা দেখে বাইরে যাওয়ার ইচ্ছেটা এমনিতেই মরে গেল। নাশতা করে রান্নার প্রস্তুতি নিল। দুপুরের জন্য ইলিশ মাছ বের করে রেখেছিল —মাছ ভাজা আর ঘি দিয়ে গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত অর্পাও খুব পছন্দ করে !
সকালে ঘুম থেকে উঠেই মা মেয়ে মাথায় তেল দিয়েছিল। রান্নাটা শেষ করেই গোসল করবে। এর মধ্যে চলে গেল ইলেকট্রিসিটি। হাঁড়িতে পানি গরম করে অর্পাকে নিয়ে অন্ধকার বাথরুমে বসিয়ে গোসল করানো আরেক হ্যাপা। সে কিছুতেই টুলের উপর বসবে না, অন্ধকার বাথরুমে যাবে না। সুখীও বিরক্ত হয়ে লাগিয়ে দিল কয়েক ঘা পশ্চাতদেশে। কাঁদতে কাঁদতেই অর্পার গোসলের পালা সাঙ্গ হল।

রোহানের কথা মনে পড়লো, মীরার বাচ্চাদের অনেক ছবি পাঠিয়েছে। সুখী ইচ্ছে করেই রোহানের সঙ্গে যোগাযোগ কম করছে আম্মা আসার পর থেকে। আজ এই মেঘলা দিনে ও বাড়ীতে কি হচ্ছে জানতে ইচ্ছে করে। সবাই কি একসাথে টিভি দেখছে সোফায় গুটিসুটি হয়ে! রান্নার খালা সবার জন্য মজাদার নাশতা বানাচ্ছে, হাসিতে, আড্ডায় সময় কাটাচ্ছে ! তার কথা কি একবারও মনে পড়েছে সাদীর! এক সপ্তাহ আগে সেই যে শনিবার রাতে রাগ করে উঠে চলে গেল তার পর থেকে আর কথা হয়নি। অফিসে দেখা হলেও সাদী ভাব করেছে যেন তাকে চেনে না। সুখীও অপেক্ষা করে আছে তার রাগে ভাঙ্গার। ওকে যতটুকু চিনেছে, রাগ কমলে নিজেই যোগাযোগ করবে।

এমন বৃষ্টির দিনগুলোতে নিজের ছেলেবেলার কথাও মনে পড়ে যায়। ভিতরের বারান্দায় বসে তারা সাপ-লুডু খেলতো সবাই মিলে। মা এসব দিনে ঝাল ঝাল মশলা পিঠে বা নকশী পিঠে করতেন চায়ের সাথে। কখনো পাটিসাপটা করতেন। শীতের সময় প্রায় প্রতিদিন সকালেই পিঠা খাওয়া হত। হঠাৎ আজ তার পিঠে বানাতে ইচ্ছে করছে।
মনে করে দেখলো বাড়ী থেকে নিয়ে আসা অনেকগুলো নকশী পিঠে এখনও খাওয়া হয়নি। সেগুলো ভেজে গুড়ের সিরায় ডুবালেই মজাদার পিঠে খাওয়া যায়। যেই ভাবা সেই কাজ, ঝটপট তৈরী করে পিঠেগুলো। দুপুরের খাওয়ার পর সে সাপ-লুডু ছাড়াও কিছু বোর্ড গেম বের করে নিয়ে আসে। অর্পাকে নিয়ে খেলবে। অর্পা মার খাওয়ার পর এখনও চোখ-মুখ লাল করে বসে আছে। আইপ্যাডে ডিজনি মুভি দেখছে। সাপ-লুডু খেললো মায়ের সাথে কিছুক্ষণ। আদিবার মা মেসেজ করেছে, অর্পা যেন তাদের বাড়ীতে খেলতে যায় বিকেলে। একদিকে ভালই হয়েছে, ছুটির দিন মেয়েটা বন্ধুদের সাথে কাটালে ভালই হবে। খালা ঘুমিয়ে পড়েছে টিভি দেখতে দেখতে। অর্পাও কখন শুয়ে পড়েছে। সুখী টিভি বন্ধ করে চলে এল মেয়ের পাশে।

শুয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখছে, বৃষ্টি কমছে, বাড়ছে। বেডসাইড টেবিলের উপর রাখা ফোনে টুং করে শব্দ হল মেসেজ আসার।
হাত বাড়িয়ে দেখে সাদীর মেসেজ, ‘’একবার হাই-হ্যালো বলতে কি খুব কষ্ট হয়।“
সে উত্তর না দিয়ে উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। এক পশলা বৃষ্টি বাতাসের ধাক্কায় গাছের উপর যেন পানির চাদরে ঢেকে দিল।
সাদী এবার ফোন করলো, -শ্রাবন্তী?
-সাদী!
-রাগ তো অনেক হল। এক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে!
-তুমি সেদিন কিছু না বলে বের হয়ে গেছ! অফিসে তিনদিন লিফটে আমাকে দেখে, লিফট ছেড়ে দিলে! সুখী একে একে সব মনে করিয়ে দেয়।
-রাগ হলে তুমি উল্টোপাল্টা কিছু কর না?
-না!
-তাহলে কখন কর? সুখী এবার হাসে।
অল্প কিছু কথা হল। মানভাঙ্গা হল সাদীর । এখন আর বৃষ্টিটাকে অত খারাপ লাগছে না সুখীর। কথা বলার সময় ও প্রান্তে বাচ্চার কান্না শোনা যাচ্ছিল। পরিবারের সবাইকে নিয়ে কি মজাই না হচ্ছে ও বাড়ীতে! একটু পর এল সাদীর টেক্সট। সাধারণ টুকিটাকি কথা হল। সুখীর সকাল, দুপুর কেমন কাটলো সে জানতে চায়। সাদী খুব আগ্রহী মীরার সাথে সুখীর পরিচয় করিয়ে দিতে। কাজের দিনেই প্ল্যান ঠিক করে লাঞ্চে মীরাকে ডাকবে, কিন্তু সুখীর প্রায় প্রতিদিন কয়েকটা মিটিং থাকাতে সে পরিকল্পনা আর ফলপ্রসু হয় না।
সুখী পরিবারের কাঙ্গাল! পারিবারিক পরিবেশে হাসি, ঝগড়া, দ্বন্দ্ব, কলহ, আড্ডা, খুনসুটি সব মিলিয়ে যে সবার মাঝে অপূর্ব সুন্দর মেলবন্ধন… সাদীকে তার হিংসে হয়! এত সুন্দর পরিবারের আবহে বাস করা কি সৌভাগ্যের! তার একমাত্র পরিবার মাহী …যার সংগে কোন আত্মিক যোগাযোগ নেই। সাদী তাকে লোভাতুর করে তুলেছে ক্রমশ, কেউ জানে না অমন ভালবাসার বন্ধনে জড়িয়ে থাকা একটি পরিবারের আকাঙ্ক্ষা তার বহুদিনের।
সাদী তাকে জানায়, আজ মীরা অনেক শিঙাড়া বানিয়েছে। সুখী এই প্রথম তার ইচ্ছের কথা প্রকাশ করে, তার দাবী জানায় সাদীর কাছে,
-আমার শিঙ্গাড়া কোথায়? সাদী অনেকক্ষন উত্তর দেয় না। সুখী আবার অর্পার পাশে গিয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখে আর ভাবে কোথা থেকে আকাশে বৃষ্টি আসে! সাদীর উত্তর আসে,
-যদি শিঙ্গাড়া নিয়ে আসি তাহলে কি দেবে আমায়?

অর্পাকে তার বন্ধুর বাসায় নামিয়ে দিয়ে সুখী যায় তার টেইলরের কাছে সেন্ট্রাল রোডে। অর্পার আর তার কিছু কাপড় জমে গেছে বানাতে দেয়া দরকার। পথে যেতে যেতে আবার সাদীর মেসেজ, সে রওনা দিয়েছে। সুখী বাড়ীতে নেই শুনে ঠিক করেছে দর্জির দোকানের কাছেই আসবে দেখা করতে। গাড়ীতে বসে অপেক্ষা করছিল। সুখী উঠে বসতেই শচীণ দেব বর্মণ গেয়ে উঠলেন,

বর্ণে, গন্ধে, ছন্দে গীতিতে হৃদয়ে দিয়েছ দোলা
রংগেতে রাংগিয়া রাংগাইলে মোরে
এ কী তব হরিখেলা।।

সুখী গান শুনেই হাসিমুখে মাথা দুলিয়ে নিজেও গুণ গুণ করছিল। সাদী মৃদু হেসে শব্দ কমিয়ে দেয় সুখীর গান শোনার জন্য, সুখী লক্ষ্য করেনি। সে জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে শচীনের সাথে গলা মিলিয়ে যাচ্ছে। সাদী এই প্রথম জানলো সুখী এত ভাল গাইতে পারে। গানের শব্দ অনেক কমিয়ে দেয়াতে খেয়াল হল সুখীর। মৃদু হেসে চুপ করে গেল! সাদী একেবারে হায়হায় করে উঠলো,
-একি! চুপ করে গেলে কেন! ভালই তো লাগছিল!
সুখী মিষ্টি হেসে বলে, আমার খুব প্রিয় গান!
-তোমার গানের গলা এত ভাল কখনো তো শুনিনি!

সুখী লজ্জা পায়।
-ছোটবেলায় আমি আর মাহী দুজনেই গান শিখেছি। অনেক বছর শিখেছি। এখন আর চর্চা করি না। অর্পাকে শিখাচ্ছি ইদানিং।
-কেন চর্চা কর না? নিজের ভালবাসার জিনিষগুলির চর্চা আমাদের সবার করা উচিৎ। আমার ডাবল খুশী, না চাইতেই বোনাস পেয়ে গেলাম।
এরমাঝেই আম্মার ফোন এসে গেল। আম্মা অনর্গল নির্দেশ দিয়ে গেলেন বিভিন্ন টুকিটাকি জিনিস কিনে নেয়ার জন্য। সুখী সিঁটিয়ে বসে রইলো, আম্মার কথা শুনে। সাদী হু হা করে শুনে যাচ্ছে, কিছুটা বিরক্তও মনে হচ্ছে। আম্মার কথার পাশাপাশি আবহ সংগীত হিসেবে বাচ্চার কান্না, চিৎকার ভেসে এল। ফোন রেখে দেয়ার পর সুখী তার সহজাত রূপে ফিরে এল।
-বাজারের লিষ্ট?
-হুম! বাসা তো না, মনে হয় চিড়িয়াখানা! বাসায় তিন বাচ্চা, অর্ক। আরও যোগ হয়েছে এক মামাতো ভাইয়ের দুই ছেলে। সবমিলে হৈচৈ…আমার মনে হয় সুন্দরবন পালিয়ে যাই!
-আম্মা কি যেন চার প্যাকেট দুধ কিনতে বললেন?
-ওহ, হ্যাঁ! ভাল কথা মনে করিয়ে দিলে …বাচ্চাগুলো মনে হয় দুধ দিয়ে গোসল করে এত দুধ লাগে প্রতিদিন!

গাড়ী গুলশান এলাকার দিকে যাচ্ছে দেখে সুখী বিস্মিত হয়ে তাকায় সাদীর দিকে।
-এদিকে কোথায়?
-আমাকে কফি খাওয়াবে তুমি! কর্তৃত্বের সুর সাদীর গলায়।
বলতে বলতেই সে গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলের পাশে একটি কফিশপে পৌঁছে গেল। গাড়ী থেকে নেমে বুঝলো এত পশ কফিশপে কখনো আসেনি সে। নাম হচ্ছে, ক্রেম দ্যা লা ক্রেম (বেস্ট অব দ্যা বেস্ট)। জাপানিজ স্টাইল সুন্দর ইন্টিরিয়র আর আলো-আঁধারির এক মোহময় পরিবেশ কফি প্রেমিকদের জন্য সাজিয়ে রাখা। সাদী কোণের দিকে টেবিলে গিয়ে বসে সুখীকে নিয়ে। সাদী চাইছিল সুখী তার পাশেই বসুক, বেশ প্রশস্ত সোফা চেয়ার, অনেকটা জায়গা আছে। কিন্তু সুখী তার উল্টোদিকে গিয়ে বসে। সাদী মাথা নেড়ে বিরক্তি দেখায়।
-তোমার মধ্যে কি একটুও রোমান্টিসিজম নেই?
-আছে তো! বেশ অনেক আছে!
-কোথায়? একটু বল তো!

সাদী অর্ডার দেয় ট্রিপল চকলেট ফাজ কেক আর সিনামন ক্রিম কেক আর দুজনের জন্য কফি। তার পক্ষে সম্ভব হল না বেশীক্ষণ দূরে বসে থাকা। সে কফির কাপ তুলে সুখীর পাশে গিয়ে গা ঘেষে বসে। সুখীর কেক খাওয়া অবলোকন করে, তার প্রতিটি কাজের মতই শৈল্পিক ছোঁয়া আছে খাওয়ার মধ্যেও । সুখী মিটিমিটি হাসে। সাদী অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর হঠাৎ বলে ওঠে,
-তোমার থেকে বেশীদিন দূরে থাকতে পারছি না …সকাল থেকে বৃষ্টির মধ্যে শুধু ভাবছিলাম কখন দেখা হবে ! সাতদিন কথা না বলে কষ্ট পেয়েছি!
অন্তরঙ্গ পরিবেশে চকলেট কেক খেতে খেতে এমন সুমিষ্ট ভালবাসার কথা শুনতে কার না ভাল লাগে! সে কিছু না বলে বুকের ধুকপুকানি নিয়ে পেছনে হেলান দিয়ে বসে থাকে। প্রায় ঘন্টাখানেক তারা এদিক ওদিক দেখে সময় কাটায়, কোন কথা ছাড়া। সাদীর মত বাকপটু লোক আজ চুপচাপ। সে অনেক কিছু বলতে চায়, কিন্তু তাদের সম্পর্কটা কোন দিকে এগুচ্ছে না। আম্মা কি প্ল্যান করছেন তিনিই জানেন। সুখীকে কিছু বলে লাভ নেই, তারপরও সুখীর আলগা আলগা ভাব তার পছন্দ হয় না!
-মীরা কবে ফিরে যাচ্ছে?
-খুব শিগগীর না! তার কথার ঝাঁজে হতাশা আর বিরক্তি শুনে সুখী হেসে ফেলে।
– তাড়াতাড়ি চলে গেলে তোমার কি লাভ?
-জানি না, ও থেকেও কোন লাভ হচ্ছে না।
-এটা গাড়ী কেনার মত ব্যাপার না সাদী ! কয়েকদিন শো রুমে গিয়ে দেখার পর একদিন পছন্দ করে কিনে নিলে!
সাদী বিরস মুখে বসে থাকলো। তারপর আবার বলে,
-বিয়ে নিয়ে তো আমার বেশী আপত্তি ছিল!
সুখী মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়।
-হ্যাঁ …সব সত্যি! কিন্তু এটাও সত্যি আমি একা থাকি একটা বাচ্চা নিয়ে …তুমি এখনও রোহানের সাথে কথা বলনি … তোমাকে বিয়ে করা মানে পুরো পরিবারকে বিয়ে করা।
-তুমি কি ভয় পাচ্ছ…আমার পরিবারকে?
-তুমি নিজের মত করে তোমার মনের মধ্যে সব গুছিয়ে নিয়েছ …কোন কিছুই তোমার কাছে বাধা মনে হচ্ছে না!
-শ্রাবন্তী, আম্মা ঢাকায় থাকবেন না!
-তার থাকা না থাকায় কি এসে যায়?
প্রকৃপক্ষে, আম্মা ঢাকা বা চাটগাঁ যেখানেই থাকুন না কেন তিনি যদি এ সম্পর্কেই না রাজী হন তাহলে দূরে গেলে আর কাছে থাকলেই বা কি!
নাজমা সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছিল আড়াল থেকে, সে ভেবেছিল এ ব্যাপারটা সাদীর পরিবার নিজেরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে একটু জোরালো ধাক্কা না দিলে আর চলছে না। সাদীর বোন মীরা এসেছে, আরও আত্মীয়স্বজন আসা যাওয়া করছে …তার আশা ছিল এসময়ে সুখীকে তারা বাসায় ডাকবে …অন্তরঙ্গ পরিবেশে সুখীকে জানার চেষ্টা করবে! কিন্ত সে আশায় গুড়ে বালি! আম্মার আপত্তিই বেশী, কিন্তু কে বলবে যে উনি একজন অত্যন্ত চমৎকার মহিলা। অত্যন্ত বন্ধুবৎসল, অমায়িক, সৎ মনের মানুষ …এ ক’দিনে সে যা দেখেছে! সুখীকে ওঁরা জানে না বলেই হয়তো এত সংকোচ!

অসীম আর নাজমার বিয়ে বার্ষিকী সামনে। এবারের আয়োজন একটু বড় করেই করছে নাজমারা। সুখী আর অর্পাকে নেয়ার জন্য গাড়ী পাঠিয়েছে নাজমা। খালারও দাওয়াত, কিন্তু অন্য সময়ের মত এবারও যেতে রাজী হয়নি। বিয়ের দিনটি চলে গেছে আগেই, শুক্রবার সবাইকে ডেকে উদযাপন করা হচ্ছে। সুখীর জন্য শুক্রবার যেন খুব তোমার দ্রুত চলে এল। সে জানে, ওখানে সাদীর পুরো পরিবারের সংগে দেখা হবার সম্ভাবনা! নাজমা জানিয়ে দিয়েছে রাতে ওখানেই থাকতে হবে। সাদীর আম্মা আবার কি ভেবে বসেন সে-ই উৎকণ্ঠায় চলে গেল আগের রাতটি নির্ঘুম।
অনেক ভেবেচিন্তে নাজমারই দেয়া একটি শাড়ী বের করে পরার জন্য। ধুসর, রুপালী আর ঘন নীলের সমন্বয়ে অপূর্ব সুন্দর শাড়ীর সাথে আজ হাই হিল পরেছে, সামান্য রুপোর গয়না, ঠোঁটে লিপ গ্লস, চোখে লাইনার ! নাজমা তারপরও কথা শোনাবে, কেন সে যোগীর বেশে এসেছে! এইটুকু সাজ তার জন্য অনেক। অর্পার সামনে এসে দাঁড়ালো সাজ শেষ করে। মেয়ে দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে। তাকে পরানো হয়েছে ক্রিম রঙের প্রিন্সেস ড্রেস!

সুখী আর তার রাজকন্যা পৌঁছে গেল সময়মতই অনুষ্ঠানস্থলে। বাড়ীর ছাদের অর্ধেকটা জুড়ে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে আর বাকী অংশে বাগান, ওখানেও ছোট ছোট টেবিল পেতে বসার ব্যবস্থা আছে। তারা নাজমার ফ্ল্যাটে না গিয়ে সরাসরি উপরে চলে এল। লোকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে গল্প করছে, শুকনো স্ন্যাক্স পরিবেশন করা হয়েছে। অর্পাকে দেখে ছুটে এল অর্ক, সুখীকে হাসি দিয়ে অর্পাকে নিয়ে চলে গেল ভিতরে। নাজমা বা অসীম বা অন্য পরিচিত কারো সাথে এখনও দেখা হয়নি। অনেকেই তাকে ঘুরে ফিরে দেখছে, সে মুখে নার্ভাস হাসি নিয়ে ক্রমশ এগিয়ে যেতে থাকে ভেতরের দিকে।

আম্মা এগিয়ে এসেছেন তাকে দেখে, ঠিক তার বরাবর হেঁটে আসছেন দেখে সুখীর হৃৎকম্প শুরু হল। একেই বলে যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়, নতুবা কেন এখানে এসেই প্রথম পরিচিত বলতে আম্মাকেই দেখতে হবে। নাহ, সাদীর আম্মার নিশ্চয়ই চিলের নজর, সুখী ভাবছে! তিনি বোধহয় আরও কিছু কথা শোনাবেন তাই অপেক্ষা করছিলেন ! তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সামান্য হাসি দিয়ে বললেন,
-চমৎকার লাগছে তোমাকে!
সুখী সালাম দিয়ে সম্বোধন করতে ভুলে গেছে, আম্মার কথায় সে লজ্জিত মুখে মৃদু হাসলো। আম্মা ভেবেছেন সুখী বোধহয় তাকে ভুলে গেছে।
-তুমি বোধহয় আমাকে চিনতে পারোনি?
-অবশ্যই চিনেছি আন্টি! সাদীর মা-কে কি কখনো ভোলা সম্ভব সুখীর পক্ষে?
তাদের কথা আর বেশী এগুলো না। মীরা তার ছোট ছেলেকে নিয়ে এল আম্মার কাছে, সে চিৎকার করছে। আম্মার কাছে তার ছেলেকে ধরিয়ে দিয়েই ঘুরে তাকালো সুখীর দিকে।
-শ্রাবন্তী? সুখী?
সুখী মাথা নেড়ে বলে,
-জ্বি,সুখী শ্রাবন্তী আমার পুরো নাম!
মীরা একগাল হেসে বলে,
-আমি মীরা!
তার হাসিতে সাদীর হাসি, কিছুটা রোহানের মুখাবয়ব চোখে পড়ে। সুখী নিজে থেকেই বলে
-অর্পাকে নিয়ে গেছে অর্ক ওদিকে কোথাও!
-ওহ! ইউ আর টূ কিউট! সুখী হঠাৎ লজ্জা পায়।
-সাদী আই মিন ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছে?
হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করে মীরা! সুখী আরক্তমুখে মাথা নেড়ে জানায় এখনও নয়। আড়চোখে আম্মাকে দেখে নেয়, আম্মা বাচ্চার কান্না থামাতে ব্যস্ত।

মীরা তার সঙ্গে গল্প জুড়ে দেয়, বোঝাই যায় সাদী তার বোনের সম্পর্কে মিথ্যে বলেনি। মীরা খুব প্রাণবন্ত, হাসিখুশী, উচ্ছল, দেখতেও বেশ মিষ্টি। মীরার সাথে কথায় কথায় জানা হয়ে যায় ওরা দুজন কে কবেকার ব্যাচ, কে কোথায় পড়াশোনা করেছে। মীরার ছেলের কান্না থেমেছে, তাই আম্মাও কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছেন। ছোট ছেলেটি সুখীর দিকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে দেখছে, হাত নেড়ে সুখীর হাতের রুপোলি পার্সটা ধরতে চাচ্ছে। সুখী হাত বাড়িয়ে দেয় কোলে নেয়ার জন্য, বাচ্চাটিও চট করে তার কোলে চলে আসে। মীরা কি করছো কি করছো করে বাঁধা দেয়ার আগেই তার পুত্র সুখীর কোলে। মীরা বলে,
-তোমাকে এত সুন্দর লাগছে, ১০ মিনিটেই তোমার শাড়ী নষ্ট করে দিবে।
-ইটস ওকে, মীরা!
আম্মা বলেন বয়োসচিত গাম্ভীর্য ও বিনয়ের সাথে ,
-চলে যেও না হুট করে, ঘরে আসবে!
সুখী কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়ায় নার্ভাসভাবে! মীরা সুখীর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে বলে উঠে,
-আম্মার কিছু কুইজ আছে তোমার জন্য! সে হেসে পরিবেশ হালকা করতে চায়।
-মীরা! আম্মা ধমক দিলেন মীরাকে রসিকতার জন্য!
-সরি! সরি! কোন কুইজ না সুখী! এমনি মজা করছিলাম!
সাদী আর অসীমকে দেখা যায় হেঁটে আসছে তাদের দিকে, সঙ্গে আরও একজন। সাদীর মুখে চিরচেনা প্রশস্ত হাসি। সুখীও তাকে দেখে এতক্ষণে স্বাভাবিকভাবে হাসতে পারে! আম্মা পেছন থেকে দুজনকেই খেয়াল করেছিলেন। একে অপরের দিকে তাকিয়ে দরাজ হাসি দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ নামিয়ে নেন।
মীরা আম্মার হাত ধরে সরিয়ে নিয়ে এসে ফিসফিস করে বলে,
-আম্মা, তুমি খুব সুন্দরভাবে কথা বলেছো! এভাবেই চেষ্টা কর! আমরা সবাই জানি, এত সহজ নয়, তারপরও চেষ্টা করতে দোষ কি!
সাদী, অসীম আর অসীমের বন্ধু জয় এর সাথে কথা বলতে বলতেই নাজমা চলে এল। ওদের সাথে আলাপে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সুখী।

মীরা ওদিকে সাদী আর সুখীকে একসঙ্গে দেখতে দেখতে বলে, -আম্মা, মেয়েটা খুব মিষ্টি! এত সিম্পল!
এতদিন সুখীর কথা শুনেছে, কিন্তু আজ পরিচিত হয়ে বুঝতে পারছে এই মেয়েটির
মধ্যে বিশেষ কিছু আছে। সুখীকে দেখে কেন যেন সে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছে।
আম্মা মীরার কথা অস্বীকার করতে পারেন না …এই বোধোদয় তাকে আরও বেশী আহত করে।

সুখী এসেছে রোহানকে নিয়ে কেএফসিতে, রোহান তার মুখ লুকাতে চাচ্ছে মাথার হ্যাটের আড়ালে। নাজমাদের অনুষ্ঠানের পর সাদীর চাচা, চাচীসহ কিছু আত্মীয়স্বজন এসেছেন, সাদী সবাইকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে যায় এবং সুখী- অর্পাও আমন্ত্রিত হয় সবার সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য। তার ঠিক এক সপ্তাহ পর সুখী এসেছে রোহানকে নিয়ে।

রোহান মিল্কশেক ধরেনি এখনও, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, চিকেন ফ্রাই সবই পড়ে আছে সামনে।
-কোন ডেজার্ট নেবে? সুখী জানতে চায়।
রোহান শুধু মাথা নাড়ায়, সে ভদ্র, তবে অখুশী। রোহান বিয়ে সংক্রান্ত ব্যাপার বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।

তাদের বন্ধুত্ব ছিল অকৃত্রিম, অমলিন। সেদিন নাজমার ওখানে সে সুখীকে দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে, তার আর্ট টিচার কি বলেছে, ফুপি কি কি আর্টের সরঞ্জাম এনেছে তার জন্য …সব সুখীকে জানানো জরুরী ছিল। তার রঙ পেন্সিল সুখীকে ব্যবহার করতে দিয়েছে।
একবার তারা খুব বাজে ফুচকা কিনেছিল, রোহান তার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছিল! অর্পা যখন ছেলেদের মত ভাব ভঙ্গী করে বা রোহানকে নকল করে সে খুব হাসতো।
সাদী রান্না করার সময় সে মেসেজ পাঠাতো বা ছবি পাঠাতো বাবা কতটা গলদঘর্ম হচ্ছে রান্না নিয়ে সে কথা জানাতে!
নাজমার অনুষ্ঠানে সে সুখীর আঁচল ধরে পেঁচিয়ে নিজের হাত ঢুকিয়ে রাখছিল যেভাবে সে তার মায়ের আঁচল ধরে পেঁচাত! তারা একসাথে সেদিন পাশাপাশি বসে খেয়েছে, রোহান তাকে কাঁচা মরিচ এগিয়ে দেয়, আর গুণতে থাকে কতক্ষণ সুখী পানি না খেয়ে থাকতে পারে।
সে ছাদের একপ্রান্তে নিয়ে গিয়ে সুখীকে কতগুলো পোকা দেখায়, সেগুলো হাতে নিয়ে তাদের নড়াচড়া দেখায়। সুখী বলে,
-এটা নিশ্চয়ই ছেলে, তাই তোমাকে পছন্দ করে!
-তুমি কেমন করে জানো এটা ছেলে?
একেবারে ছেলেদের মতই প্রশ্ন! সুখী জোরে হেসে ওঠে। সুখী বলে,
-আসলেই জানি না! চল, এখন ওদিকটাই যাই! এখানে অন্ধকার!
-রাতের বেলা এই পোকাগুলোকে দেখতে ভাল লাগে!
-আমার অন্ধকারে ভয় লাগে রোহান!
-আন্টি, আমি আছি না! ভয় পেও না! কোন মনস্টার নেই!
সুখী হাসে।
সামনে বসা রোহানকে দেখে দুসপ্তাহ আগের কথাগুলো মনে পড়ছিল। সে জিজ্ঞেস করে,
-স্কুল কেমন চলছে রোহান? ক্লাস সিক্স ভাল লাগছে?
-সোশ্যাল স্টাডিজ আমার ভাল লাগে না! হিস্টরি লাইক করি না।
রোহান এতক্ষণ পর একটা কথা বলে।
-তাই? তুমি রাজা, রাণীদের স্কেচ এঁকে দেখতে পারো! মনে থাকবে, শেখাও হবে!
রোহানের চোখমুখ আলোকিত হয়ে ওঠে।
সুখী নিজের ব্যাগ থেকে নোটবুক বের করে, পেন্সিল তার সাথেই থাকে। একটি পৃষ্ঠায় সে আকবর আর বীরবলের স্কেচ করে। রোহান অখন্ড মনযোগে তাকিয়ে আছে। শেষ করার আগে আকবরের শেরওয়ানীতে মণিমুক্তা বসিয়ে দেয়, পাগড়ীতে জ্বলজ্বলে রুবী।
-আমি এটা নেই? রোহান খুব বিনয়ের সাথে প্রশ্ন করে।
সুখী আনন্দের হাসি হাসে। কাগজটি নোটবুক থেকে ছিঁড়ে এগিয়ে দেয় রোহানের দিকে।
-মিল্কশেক খেয়ে নাও! এবার একটু গম্ভীরভাবে বলে সুখী।

রোহানের মুখে স্ট্র। সুখী আশ্বাস দেয়,
-আমি আর তুমি …আমরা সবসময় বন্ধু থাকবো রোহান!
রোহান এবার জোরে টান দেয় স্ট্রতে শব্দ করে, সুখীর মুখের দিকে না তাকিয়েই বলে,
-সো, ডাজ দ্যাট মিন ইউ আর ম্যারিয়িং মাই ড্যাড!

চলবে…

https://ochinpurexpress.com/%e0%a6%ae%e0%a6%a8%e0%a7%8b%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%a4/%e0%a6%ae%e0%a7%87%e0%a6%98%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%96%e0%a7%87%e0%a6%b2%e0%a6%be-%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ac-%e0%a6%8f%e0%a6%95%e0%a7%81%e0%a6%b6/

অচিনপুর ডেস্ক /এসএসববি

Post navigation