বন্যা হোসেন
অটোয়া, কানাডা।
উপন্যাসঃ মেঘের খেলা (পর্ব-সতেরো)
দুটো দিন প্রবল জ্বরে প্রায় বেহুঁশ পড়ে রইল সুখী। চোখ বুঁজে টের পাচ্ছিল সাদী মাথার পাশে বসছে বার বার, রফিক আর মিতা উদ্বিগ্ন স্বরে তাকে নিয়েই কথা বলছে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল তাকে। অর্পা এসে তাকে আদর করে গেল। সবই কেমন অলীক। ছেঁড়া ছেঁড়া কুয়াশার আড়ালে যেন দূরের কোনও জগত। শুক্রবার সারাদিন কেটে গেল। শনিবার সকাল থেকে জ্বর কমে এল। ধীরে ধীরে উঠল বিছানা থেকে। টলমল পা, মাথা দুলছে … মনে হচ্ছে পৃথিবীটা দুলছে। বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় বসল। এই প্রথম ঘরটা ভাল করে দেখল। এটা সাদীর বাসার তৃতীয় বেডরুম সম্ভবত। এই কামরায় সে আগে কখনো আসেনি। বিছানাটি ঘরের ঠিক মধ্যেখানে, উঁচু ম্যাট্রাসের খাট। বিছানার চাদরের সাথে ম্যাচিং কম্বলের কভার, একরঙা নীল পর্দা, বেডসাইড টেবিলে আর্টিস্টিক ল্যাম্প। খাটের দুপাশে মেঝেতে পুরু ম্যাট, দড়ির তৈরী। বিশাল জানালা ভেদ করে শীতের সকালের সূর্য এসে কিরণ ছড়াচ্ছে।
একে একে মনে পড়ে গেল গত দুদিনের টুকরো স্মৃতি। সাদী আর রোহানের আচমকা আবির্ভাব এবং ওকে জোর করে নিয়ে আসা এবাড়ীতে। মিতা এসে অর্পা আর রোহানকে নিয়ে গেছে তার বাড়ী আবার রাতে নিয়ে এসেছে। রান্নার খালা তার জন্য স্যুপ, পাতলা খিচুড়ী রান্না করে খাওয়াল। আর একটি মেয়ে এসে ঘরদোর মুছে, বিছানা বদলে ঠিকঠাক করে গুছিয়ে গেল। এত আরাম আয়েশে মনে হচ্ছে ফাইভ স্টার হোটেলে আছে সে। মনে মনে কুন্ঠায়, লজ্জায় এতটুকু হয়ে আছে। মিতা না জানি কি ভাবছে, আর তো কোন রাখঢাক রইল না। ওদের কারো আচরণেই এতটুকু অসঙ্গতি ছিল না, কাজেই বোঝার উপায় নেই।
প্রায় দুদিনের না খাওয়া, প্রচন্ড ক্ষিধে পেয়েছে আজ। উঠে গেল করিডোর পেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে। কোন সাড়াশব্দ নেই, রান্নার খালাটিও নেই। এখানে ওখানে খুঁজে হাতড়ে চা বানাল, রুটি টোস্ট করে কামরায় চলে এল। আধাশোয়া হয়ে ধীরে ধীরে খাবারটুকু শেষ করে ঔষধ খেয়ে নিল। দরজায় সাদীকে দেখা গেল গোসল সেরে মাথা মুছছে, ঝকঝকে হাসি মুখে। ঘরে ঢুকে বিছানার কাছে এসে সুখীর কপালে হাত রাখল। মুখে বললো
-নাহ, জ্বর নেই।
সুখী হাঁটু ভাঁজ করে পায়ের উপর থুতনী রেখে বসেছিল। সামান্য হাসি দিয়ে বলল‘-বাচ্চারা কোথায়?
সাদী জানাল, মিতা এসে নিয়ে গেছে ওদের একটু পর আসবে।
সাদী চেয়ার টেনে বিছানার কাছে এসে বসে। সুখীর কাছে এই বাড়ী, আরাম-আয়েশ, সাদীর সান্নিধ্য সবকিছুতে নিজেকে করুণার পাত্রী মনে হচ্ছিল। সাদী কপালগুণে কি দক্ষ কাজের লোক পেয়েছে যারা সময়মত এসে সব কাজ করে দিয়ে চলে যায়। রফিক/মিতা আর নাজমা/অসীমের মত বন্ধু যারা তাকে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রেখেছে। সে একটুক্ষণ ভেবে সাদীকে বলে,
– এখানে এত যত্নে আছি আমার অভ্যাস খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
সাদী সোজা হয়ে বসল, স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইল সুখীর দিকে। বলে,
-কি সমস্যা হচ্ছে তোমার?
-আপনার এখানে সবকিছু যেন ম্যাজিকের মত হয়ে যায়। কাজের মহিলারা ঠিক সময়মত এসে প্রতিদিন কাজ করে যায় …পরিষ্কার ঘর, টাটকা রান্না, নাজমা-মিতা তো আছেই! আমার আছে এক খালা যে কোন কাজে আসে না, কাজের মহিলাও তার ইচ্ছেমত আসে।
-এক্সচেঞ্জ করতে চাও? এ বাড়ীটা তুমি নিয়ে নাও…
সুখী হেসে বলে,
-কি লাভ …অফিস যেতে এখান থেকেও একই ঝামেলা হবে!
-গাড়ীটাও রেখে দাও তুমি!
-হা হা …একেই বলে খেতে দিলে বসতে চায়, বসতে দিলে শুতে চায়!
-তুমি কখনোই অন্যের জিনিষ দাবী করবে না নিজের বলে, তা কি আমি জানি না ! গম্ভীরস্বরে বলে সাদী।
-অত আস্থা নেই আমার নিজের উপর!
চোখ নামিয়ে নেয় …সে অন্যের স্বামীকে নিজের বলে গ্রহণ করেছিল … ফিরোজকে তো চুরিই করেছিল তার প্রথম স্ত্রীর কাছ থেকে, না জেনে হলেও চুরি তো চুরিই।
পরপর হাঁচি দিল অনেকগুলো। হাঁচির প্রকোপে মাথা যেন ছিঁড়ে আসে। দুজন তাকিয়ে থাকল একে অপরের দিকে অপলক নয়নে। শব্দ শোনা গেল করিডোরে মিতার। সাদী ভাবলেশহীন নির্বিকার মিতার উপস্থিতিতে। মিতা ঘরে ঢুকেই বলে উঠল
-উঠে গেছ ? বাঃ, বেশ ভাল দেখাচ্ছে তো আজ চেহারাটা! এই তো এখন দ্রুত সেরে উঠবে।
সাদীর দিকে তাকিয়ে বলল, আমি খাবার নিয়ে এসেছি …বাচ্চারাও খেয়েছে!
-থ্যাঙ্কস মিতা …বলে সুখী কান্না শুরু করল…অঝোর ধারায় নামছে চোখের পানি।
সাদী খুব ধীরে উঠে চলে গেল ঘর ছেড়ে, মিতাকে বসার সুযোগ করে দিয়ে। মিতা প্রশ্ন না করাতে সুখী স্বস্তির শ্বাস ফেলল। হাতের পিঠে চোখ মুছে আবার হাঁচি দিল।
-হঠাৎ এত কান্না পেয়ে গেল …আয়াম সরি মিতা! অভ্যাস নেই …এত আরাম আয়েশ পেয়ে …মনে হচ্ছে তোমাদের সবাইকে খুব জ্বালাচ্ছি। আফটার অল সাদী আমার বস্ …তার থেকে এত সুবিধা নেয়া ঠিক না!
-সাদীকে নিয়ে একেবারেই ভেবো না …সে বস-এমপ্লয়ি সম্পর্ককে মর্যাদা দেয়! দৃঢ়ভাবে বলে মিতা।
-আসলে গত চার বছরে একা চলতে অভ্যাস হয়ে গেছে … কারো উপর নির্ভর করতে হয়নি …এজন্যই ইমোশোনাল হয়ে পড়েছি।
– কাঁদো কাঁদো। কাঁদলে ভাল লাগে …আমিও মাঝে মাঝে কাঁদি তো!
-তোমার কিসের অভাব? জানো, আমার বাড়ী যাওয়ার কথা সামনের সপ্তাহে …আর এই দেখ আমি অসুস্থ হয়ে বসে আছি!
-আচ্ছা ! ওখানে কে কে আছেন? তোমার মা-বাবা ওখানে থাকেন?
মিতার একথায় সুখীর দুচোখে টসটসে অশ্রুতে পূর্ণ হয়ে গেল।
-নাহ,কেউ নেই। মা-বাবা দুজনেই মারা গেছেন।
তার ফোঁপানির সাথে মিতা নিজেও যুক্ত হয়েছে। তার চোখেও প্রবল বর্ষণ। দুজন অনাত্মীয় নারী কি এক আত্মিক বন্ধনে নিজেদের মনের দুয়ার মেলে ধরেছে।
-মিতা …প্লিজ আমাকে ভুল বুঝো না …আমি সাদীকে কোন ফাঁদে ফেলতে চাই না। আমার ট্র্যাক রেকর্ড ভাল না …মানুষ ভুল বুঝতেই পারে!
-ছিঃ ছিঃ …কি বলছ বল তো ? কে এসব ভাবতে যাচ্ছে! কান্নাটা একটু থামাও তো! শোন, তোমাকে একটা কথা বলি …আমার মায়ের সাথে বহু বছর কথাও হয় না …দেখাও হয় না।
-কেন? কি হয়েছে ?
-বাবা-মায়ের বনে না …মা চলে গেছে বাবাকে ছেড়ে …আমাদের কারো সাথে যোগাযোগ করে না …অনেকের জীবনেই অনেক কথা থাকে …বুঝেছ ! উপর থেকে দেখতে যতটা সরল মনে হয়, জীবনটা অত সরল নয় ! এখন উঠে পড় …কিছু খাও …নরম খিচুড়ি এনে দিই, খাও?
-আমার রুচি নেই, মিতা। কিছু খেতে ইচ্ছে করে না।
তক্ষুনি সাদী প্রবেশ করাতে মিতা তার স্বভাবসুলভ কৌতুক মিশ্রিত কন্ঠে বলে,
-শোন, তাড়াতাড়ি সুস্থ হও! সাদীকে দেখে বোঝা যায় না …পাক্কা হিসেবী কিন্তু …ঘর বেশীদিন দখল করে রাখলে ভাড়া দাবী করতে পারে! বলেই জোরে হেসে ওঠে।
-একদম ঠিক! স্মিত হেসে সায় দেয় সাদী।
সুখী ক্লান্তিতে চোখ বুঁজে।
পরদিন ঘুম ভাঙ্গল খুব ভোরে। ঘড়িতে দেখে ৫ঃ৩০টা বাজে। ফ্রেশ হয়ে কাপড় বদলে রুম থেকে বের হল। রোহানের ঘরে উঁকি দিল। বিছানায় অর্পা ঘুমাচ্ছে রোহানের স্টার ওয়ার্স টি শার্ট পরে, রোহান পাশে একটা ছোট ডিভানে। রোহানের শার্টে মেয়েটাকে খুব কিউট লাগছে। কিছুক্ষণ বসল মেয়ের পাশে, সংক্রমণের ভয়ে আদর করা গেল না। রোহানের জন্য নতুন কয়েকটা কমিক্স বানিয়ে দিল।
রান্নাঘরে গিয়ে চা বানিয়ে সামনের বড় ব্যালকনিতে এল। শীতের ভোরে ফিনফিনে পাতলা ধুসর কুয়াশার মাঝে মসলিনের নেকাব সরিয়ে যেন উঁকি দিচ্ছে নানা রঙের গাঁদা, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা,অ্যাস্টর আর বাহারী গোলাপের সমাহার। এত সুন্দর একটা নিজস্ব ভুবন সৃষ্টি করে রেখেছে সাদী!
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে গতকাল শোনা মিতার কথাগুলো ভাবছিল। মায়ের সাথে অনেক বছর কথা না বলে থাকা কি সম্ভব হত তার পক্ষে!না অসম্ভব! বাবার সাথে সে কথা বলেনি অনেকদিন। বাবা নিজেই কথা বন্ধ করেছিল …ফিরোজের ব্যাপারটা জানাজানি হওয়ার পর বাবার সাথে প্রচন্ড কথা কাটাকাটি হয়েছিল …তিক্ততায় মন ব্যথিয়ে ওঠে! সে অভিযোগ করেছিল বাবার অতিরিক্ত শাসনের ব্যূহ ভেদ করতেই ফিরোজের মত লোকের সংস্পর্শে এসে সে মুক্তির আনন্দ পেয়েছিল!
পিছনে পায়ের শব্দে ফিরে তাকায়. সাদী এসেছে হাতে দুটো পশমী শাল নিয়ে। সুখীকে একটি শালে জড়িয়ে নিজেও গায়ে দিল অন্যটি। সুখী বলল
-তুমি উঠে গেলে কেন এত ভোরে?
সাদীর হৃদয়ে রক্ত চলকে ওঠে যতবার সুখীর কন্ঠে ‘তুমি’ শোনে। সুখী তার মুড অনুযায়ী আপনি বা তুমি ব্যবহার করে। কিন্তু এই এখনকার ‘তুমি’তে দূরত্ব কিছুটা কমেছে মনে হয়।
কজন অসুস্থ রুগীর দেখভাল করার দায়িত্ব আমার! বলে সুখীর সামনের চেয়ারটিতে বসল।
-এ সময়টায় কি নীরব, শান্তিময় লাগছে ঢাকা শহরটাকে!
-হুম। দেখলাম রোহানের রুমে তোমার সকালের আর্ট! শ্রাবন্তী, তোমার হিউমার সেন্স এবাভ এভারেজ!
-শুধু কাগজে কলমে! সুখীর ঠোঁটে আলতো হাসির ছোঁয়া।
-এত লুকিয়ে রাখ কেন নিজেকে? তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সাদীর, যেন এফোঁড় ওফোঁড় করে দেখছে।
-এত প্রশ্নের উত্তর নেই আমার কাছে!
-তুমি কি এখনও আমাকে বন্ধু ভাবো না?
-বন্ধু না ভাবলে কি আসতাম এখানে?
-তুমি বুঝেছো তো আমি কি বলতে চাইছি?
সুখী একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সাদীর মুখের দিকে। তারপর বলে,
– তোমার ভাগ্য ভাল, তোমাকে ঘিরে আছে কিছু হৃদয়বান মানুষ …তারপরও ভালবাসার মানুষকে হারানোর কষ্ট তোমার চোখে মুখে …
-অস্বীকার করছি না!
-আমার পরিস্থিতির জন্য আমি নিজে দায়ী …প্রেম, বিয়ে , বাচ্চা, ফিরে আসা … সবকিছু! তোমার দুর্ভাগ্যের জন্য তুমি নিজে দায়ী নও!
-তোমার কি দোষ? লোকটাকে তুমি জানতে না! অতীতকে আঁকড়ে আর কতদিন শ্রাবন্তী!
-তারপরও আমার ভুলটা তো আস্বীকার করতে পারি না। ঘরের মানুষরা সবাই আমাকেই দায়ী করে!
সাদী কিছুটা রেগে গেল সুখীর এই নেতিয়ে পড়া কন্ঠে,
-তারা তো বোঝে না কতটা কষ্ট লাগে!
নীরবতায় বয়ে যায় খানিকটা সময়!
-তুমি আবার মনে করতে যেও না যে আমি তোমাকে চাই বলেই ভদ্রতা করছি !
সাদীর মুখে আচমকা এমন কিছু আশা করেনি সুখী! সে বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে।
-যাই মনে কর না কেন আমি সত্যিই চাই তোমাকে! সে সুখীর হাত ধরে নিজের মুষ্টিতে নিয়ে চেপে ধরে।
-অফিসে কেউ জানে না কিছু…আমি চাই না মানুষ আমাদের নিয়ে কথা বলুক …কাল সকালে আমি
চলে যাব।
-কে কি বলে, বলুক! হু কেয়ার্স!
-সাদী বহু অপমান আর ঘেন্না সয়েছি…এখন আর এমন বোকামী করতে চাই না যে নিজের কাছেই নিজেকে নোংরা লাগে …বলতে বলতে কেঁদে ফেলে সুখী।
-আমার সাথে বন্ধুত্ব করাটা বোকামী? সাদীর কন্ঠে অভিযোগ।
-সহানুভূতি আর করুণাকে বন্ধুত্ব বলে না! ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে সুখী।
সেদিনটি বেশ ভালই কেটে গেল। সাদী বলেছিল মিতা -রফিকের বাসায় যাওয়ার কথা। সুখী নিজের সিদ্ধান্তে অটল, সে কোথাও যাবে না। দিনের বাকী সময়টা তারা গল্প করে কাটিয়ে দেয়। সাদী তার পরিবারের নানা গল্প করে, সুখীও ছেলেবেলার অনেক স্মৃতি মনে করে। সুখী আর অর্পা আছে বলে রোহান সারাদিন তাদের আশেপাশেই ঘোরাফেরা করে …সাদী হাসে। পরদিন অফিসের পর সন্ধ্যেয় সাদী নামিয়ে দিয়ে আসে মা-মেয়েকে তাদের আবাসস্থলে। বাপ-ব্যাটা নানা অজুহাতে তাদের রাখতে চাইলেও সুখীর পক্ষে আর এক মুহূর্ত এখানে থাকা সম্ভব নয়। সাদীকে মনে মনে অনেক কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে। মুখে ধন্যবাদ বলতে সংকোচ হচ্ছে, বকা খাওয়ার ভয়ও আছে। অর্পা পুরো পথ কাঁদতে কাঁদতে ফিরেছে। এই তিনটি দিন স্বপ্নের মত কেটে গেল তাদের চারজনের জীবনে। আত্মীয়স্বজন সবার অলক্ষ্যে কয়েকটি দিনের জন্য ‘ঘর ঘর খেলার’ পালা শেষ হয়ে গেল। আবার আপন ভুবনে নিজস্ব নিয়মে ফেরা। সাদী অভিমানে বেশী কিছু বলল না! সাদী ভাবছে সে ইগোয়িস্ট বা অহংকারী। সাদীকে রাতে অনেক চিন্তাভাবনার পর টেক্সট করল সে, “ভাল করে ভেবে দেখলাম আমি কোনভাবেই আপনার যোগ্য নই।” যেন সে বুঝে ফেলেছে নারী পুরুষের সম্পর্কের প্রধান শর্তটি এবং তার বোঝাটাই চূড়ান্ত!
সাদীর উত্তর এল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে,
“হ্যাঁ, সব বুঝে ফেলেছ দেখেই তো এখান থেকে পালানোর জন্য পাগল হয়েছিলে!”
সাদী এত বুঝতে পারে কেন তাকে…নিজের মনকে ফাঁকি দেয়াটাও ধরতে পেরেছে।
এক সপ্তাহ পর সুখী ছুটিতে যাচ্ছে। তার এখনও কাশি আছে, এক একবার কাশি শুরু হলে বুক ছিঁড়ে আসতে চায়। কাজের ব্যস্ততা তো আছেই, তার উপর সাদী সেদিনের পর থেকে কোন কথাই বলে না, দেখা হলে অচেনা লোকের মত পাশ কাটিয়ে চলে যায়। অথচ অন্যদের সাথে গায়ে পড়ে কথা বলছে। এহেন অপমান আর কত সহ্য হয়, যদিও সে নিজেই প্রকারান্তরে বলে দিয়েছে সাদীকে রাস্তা মাপতে, অবহেলা আর এড়িয়ে যাওয়া মেনে নিতে তার কষ্ট হচ্ছে! তাই সেদিন মিটিংয়ের পর সবাই চলে গেলে সুখী ইচ্ছে করেই একটু বেশী সময় অপেক্ষা করল সন্ধি করার বাসনা নিয়ে। সাদী ল্যাপটপের দিকে মনযোগ আর কোথাও কিছু দেখছে না।
ইতস্তত করে বলেই ফেলল শেষ পর্যন্ত সুখী, ” আমার একটা হেল্প দরকার।” সাদী একবার মুখ তুলেই আবার অখন্ড মনোযোগে সামনের স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে থাকল।
-একটা ব্যাগ আপনার কাছে রেখে যেতে চাই। নাজমা এলে ওকে দিয়ে দিলেই হবে।
সাদী স্ক্রীন থেকে মুখ না তুলেই বলে,
-কত বড় ব্যাগ?
ভাবখানা এমন যেন ব্যাগের আকৃতির উপর নির্ভর করছে রাখা যাবে কি -না! সেদিনের পর থেকে এত মেজাজ খারাপ হয়ে আছে তার, মেয়েটা মনে করে ওকে করুণা করা হচ্ছে! এখন থেকে অত সদয় হওয়ার দরকার নেই।
এমন আজব প্রশ্ন সুখীর প্রত্যাশায় ছিল না। তারপরও সে হাতের ফাইল টেবিলের উপর রেখে দুই হাত প্রসারিত করে মাপ বোঝানোর চেষ্টা করল।
-অফিসের পর পৌঁছে দিবে?
সুখী একটু থমকে গিয়ে মাথা হেলিয়ে সায় দেয়। আশা করেছিল সাদী নিজেই নিয়ে যাবে।
-খালাও যাচ্ছে নাকি?
-না! খালাকে কিছু বিশ্বাস নেই, এজন্যই কিছু দরকারী জিনিষ বাসায় রাখতে চাই না!
সাদী মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করে। ব্যস, এইটুকুই …আর কোন কথা হল না।
সুখী আশা করেছিল সাদী অফিস থেকে ফেরার পথেই নিয়ে যাবে।
সাদী আশা করেছিল সুখী তার মান ভাঙ্গাবে।
বিকেলে কাজ থেকে ফিরেই সে কিছু টুকটাক গোছগাছ সেরে সুটকেস সাদীর বাসায় পৌঁছানোর জন্য তৈরী হচ্ছে এমন সময় সাদী আর রোহানের আবির্ভাব। সুখী সাদীকে দেখে একটুও হাসল না। মুখে বলল,”আমিই তো যাচ্ছিলাম, আপনি এলেন কেন?’’
সাদীও মুখ শক্ত করে উত্তর দিল,”জানি।”
রোহান এসেই অর্পাকে জানিয়েছে তারা পিজ্জা কিনতে যাবে। অর্পা মহাখুশীতে মায়ের অনুমতি ব্যতিরেকেই জুতো পরে তৈরী বের হওয়ার জন্য। সুখী এবার বেঁকে বসল। ভেতর থেকে সুটকেস এনে রাখল সাদীর সামনে। সাদী সুটকেস নিয়ে উঠে দাঁড়াল, সুখীও দরজা বন্ধ করার জন্য প্রস্তুত।
রোহান আর অর্পা ততক্ষণে ঘরের বাইরে, সাদী বের হবার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে, মুখ ফিরিয়ে বলল, “তুমি না এলে আমি অর্পাকে পৌঁছাতে আসব না বলে দিচ্ছি।”
অপ্রত্যাশিত এই হুমকিতে চটকা খেয়ে যেন সোজা হয়ে দাঁড়াল সুখী। দ্রুত ভিতরে গিয়ে হাতব্যাগ নিয়ে এসে রওনা হল সাদীর সঙ্গে।
খালার চেহারাটা হল পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য দেখার মত!
সাদীর বাসায় রান্না হচ্ছে, টাটকা রান্নার সুঘ্রাণ ক্ষুধা বাড়িয়ে দিল। বাচ্চারা পিজ্জা খেয়েই গেইম খেলতে বসে গেল। রান্নার খালা গরম গরম ঝাল সব্জির পাকোড়া ভেজে দিল চায়ের সাথে। জ্বরের পরে সুখীর মুখে সেগুলো অমৃতের মত লাগছিল।
সুখী একবার শুধু বলেছিল, “থ্যাঙ্কস।” সাদী তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে, “শাট আপ, শ্রাবন্তী।”
খেতে বসে সাদী অফিসের নানা প্রকল্প নিয়ে কথায় মেতে উঠল। সুখী কিছুতেই সাদীকে হারাতে পারবে না কথায়। তার অনর্গল কথা বলা, তার বিভিন্ন অভিব্যক্তি, বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানের পরিধি …সুখী মুগ্ধ থেকে মুগ্ধতর হচ্ছিল। এখান থেকে পালানো দরকার … নিজের অজান্তেই আবার মূর্খামী করে বসতে পারে, তখন আর পিছু হটার পথ থাকবে না। খাওয়া শেষ করার পর প্রায় জোর করেই ঘুমন্ত অর্পাকে নিয়ে চলে আসার জন্য উঠে দাঁড়াল। আর এক মুহূর্ত থাকলে সে নিজেকে আর ……অগত্যা সাদী বেজার মুখে তাদের পৌঁছে দিয়ে বিদায় জানাল।
পরদিন সকালে রওনা দিয়ে তার বাবা-মায়ের স্মৃতি সম্বলিত বাড়ীটিতে পৌঁছাতে তিনঘন্টা লেগে গেল ট্র্যাফিক জ্যামের কারণে। পাশের বাসার আন্টি দুজন লোক ঠিক করে দিয়েছেন তাকে সাহায্য করার জন্য বাড়ীঘর গুছাতে। সামান্য নাস্তা খেয়েই লেগে পড়ল কাজে। অর্পাকে আন্টি নিয়ে গেলেন তার সঙ্গে। কিছু কিছু আসবাবপত্র বিলিয়ে দিবে ঠিক করেছে। এত ভারী সব জিনিষ কোথাও টেনে নেয়াও কঠিন। মা-বাবার একান্ত ব্যক্তিগত কিছু জিনিষ ছাড়া সবই বিলিয়ে দেবে। বাড়ীর সব বই স্থানীয় একটি স্কুলের লাইব্রেরীতে দিবে আগেই কথা হয়ে আছে।
কিছু স্মৃতি বেদনাদায়ক, যত ঘাঁটানো হয় তত বেদনা বাড়ে। পুরনো ট্রাঙ্কে বাবা মায়ের বিয়ের কিছু জিনিষ পাওয়া গেল, দাদা-দাদীর হাতে লেখা কিছু চিঠি,কি করবে সুখী এগুলো নিয়ে, ফেলে দেয়াও অসম্ভব, বাইরের লোক কি পুরোন, বিবর্ণ, মূল্যহীন এসবের মর্ম বুঝবে। কাজ করা বাদ দিয়ে সে এসব নাড়াচাড়া করে কাঁদতে বসল। মাকে লেখা বাবার চিঠি নিয়ে বসল একদিন রাতে অর্পা ঘুমিয়ে পড়ার পর। বাবা তিনমাসের জন্য থাইল্যান্ড যাওয়ার পর চিঠিগুলো লেখা হয়েছে। মায়ের প্রতি ভালবাসা, আকুতি, মাহীর জন্য চিন্তা, অনাগত সন্তানের জন্য স্নেহ সব ফুটে উঠেছে চিঠিগুলোতে। বোঝা গেল, সুখী ছিল তখন মায়ের পেটে। আজ তারা নেই বলেই চিঠিগুলো পড়তে পারছে। রান্নাঘর খালি করতে গিয়ে বারবার মনে হচ্ছে মা কলতলায় বসে মাছ কুটছে বঁটিতে। বাবা পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে। বা মা রান্না করছে, বাবাকে মাংসের টুকরো বাটিতে তুলে দিচ্ছে সেদ্ধ হয়েছে কিনা পরখ করার জন্য। ফিরে গেল আবার সেই শৈশবে যখন সুখী ছিল পবিত্র, নিষ্কলঙ্ক, ত্রুটিহীন।
রাতে সাদীকে ফোন করল কয়েক মিনিটের জন্য। মনে হল একাকী তার মন খারাপ। সুখীরও সারাদিন পরিশ্রম আর স্মৃতিচারণের ভারে নিমজ্জিত হয়ে মন ভারী ছিল।
সে লক্ষ্যই করেনি সাদীর আনমনা ভাব। সাদীর অবস্থা শোচনীয়। কর্মব্যস্ত দিন কাটানোর পর ঘরে এসে দেখা যায় রোহান নেই। নাজমারা এখনও ফিরে আসেনি নেপাল থেকে তাই সে প্রতিদিন চলে যায় রফিকের বাসায়। সারাদিন ওখানে সময় কাটিয়েও বাসায় আসতে তার আপত্তি। একদিন ঘরে ফিরে দেখে রান্নার মহিলাটিও আসেনি। অন্ধকার ঘরে কিছুক্ষণ বসেছিল ভুতের মত। রাতে সুখীর টেক্সট আসা বন্ধ। চারদিকে পরিচিতরা বেড়াতে যাচ্ছে ছেলেমেয়ের স্কুল ছুটি বলে। আম্মা আসবে কয়েকদিন পর, একাকিত্ব তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। আগে একটা সময় ছিল শীলার কথা প্রতিদিন মনে পড়ত। আজ মনে করে দেখল, অনেকগুলো দিন চলে গেছে সে শীলাকে মনে করেনি। নিজেকে অপরাধী মনে হয়, কোন কারণ নেই তবুও, একরাতে সে রফিকের সাথে এনিয়ে আলাপ করে , ‘’ শ্রাবন্তীর কথা চিন্তা করতে আর ভাবতে গিয়ে শীলাকে একেবারে ভুলে যাচ্ছি! এটা ঠিক হচ্ছে না! এতগুলো বছর কিভাবে হুট করে ভুলে যাই!’’
একথার উত্তরে রফিক আর কি বলতে পারে …সে নিরুত্তর।একসময় বলে,
-আজ শীলা বেঁচে নেই বলে তুই হয়তো এমন ভাবছিস যাক , এ ব্যাপারটা তোর একেবারেই ব্যক্তিগত, কিন্তু সুখীর কথা চিন্তা করার মাঝে কোন পাপ আছে বলে মনে করি না। মেয়েটা একা থাকে, একা নিজের ঘর-দোর সামলাতে গেছে, এত শান্ত আর ভদ্র, দুনিয়াটা নোংরা মানুষে ভর্তি বলেই চিন্তা হয় এটাই স্বাভাবিক।
-থ্যাঙ্কস রফিক!
-তো, কেমন আছে সে?
-আছে ভালই! খুব ব্যস্ত বাড়ী খালি করতে!
-অবাক হয়ে যাই মেয়েটার প্রাণ শক্তি দেখে, কিভাবে পারে মেয়েটা! মিতা তো বলল তেমন কেউ নেই আত্মীয়স্বজন! যাই বলিস, আজকাল এমন মেয়ে দেখা যায় না। মাথা উঁচু করে মেয়েকে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে, অনেকেই এমন অবস্থায় ডিপ্রেশনে তলিয়ে যায়, সুইসাইড করে, শি ইজ সাম্থিং এলস ম্যান!
তিনদিন পর অফিস থেকে এসে দেখে নীচে কেয়ারটেকারের কাছে দুটি ঝুড়ি রেখে গেছে কেউ তার নাম করে। ঠিকানায় নাম দেখে বুঝল সুখী পাঠিয়েছে! উপরে এনে দেখে ঝুড়ি ভর্তি জলপাই, বড়ই, ডালিম আর নকশীপিঠা। ফোন বের করে ছবি তুলতে গিয়ে দেখে সুখী তাকে গাছ ভর্তি জলপাইয়ের ছবি পাঠিয়েছে, সেও ঝুড়ির ছবি তুলে পাঠিয়ে দিল। সুখী লিখল,
-ঠিক হয়নি বোধহয় এখন ফল পাঠানো, আম্মা এলে কি মনে করবে?
-কেন, কোন কলিগ আমাকে ফল পাঠাতে পারে না? যেখানে কিছু নেই সেখানে তুমি উচিত অনুচিতের কথা ভাবো, আর যখন আমি বলি আমাদের মধ্যে কিছু একটা আছে তখন তুমি আমাকে বুঝিয়ে দাও কিছু নেই!
-এভাবে বললে আমার নিজেকে অপরাধী মনে হয় সাদী !
-আম্মা এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না! খুব দৃঢ়তার সঙ্গে বলে সাদী।
কিন্তু আম্মাকে বুঝতে টের দেরি আছে সাদীর। আম্মারা যে প্রতিটি খুঁঁটিনাটি নিয়ে মাথা ঘামায়! আম্মাকে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে এলে তিনি ঘরে ঢূকেই সারা বাড়ী ঘুরে রান্নাঘরে গিয়ে আগের দিন আসা ফলের ঝুড়ি আবিষ্কার করলেন। তার প্রশ্ন,
-তুই কি ফলের বাগান কিনেছিস, নাকি?
-সুখী আন্টি পাঠিয়েছে! রোহান উত্তর দিয়ে দিল সাদীর হয়ে।
আম্মা চারদিকে তাকিয়ে দেখে, ঘর গুছানো, পরিস্কার, ঝকঝকে, তকতকে। চূলায় কিছু একটা রান্না হচ্ছে। রান্নার মহিলাটি আশেপাশেই আছে। দেখে বোঝা যায় না এবাড়ীতে কোন মহিলা নেই।
-সুখী আন্টি কে?
-আমার টিমে কাজ করে আম্মা! সাদী নির্লিপ্ত গলায় বলার চেষ্টা করে।
-সুন্দর নাম!
সাদী গাড়ীতেই জিজ্ঞেস করেছে আম্মার কতদিন থাকার প্ল্যান। কিন্তু আম্মা এখনও কিছু জানাননি। অথচ রোহান জিজ্ঞেস করাতে ওর কানে কানে বলে দিল, ‘’এক মাস।” রোহান একমাস! একমাস! বলে খুশীতে লাফাচ্ছে, সাদী ভাবছে আম্মা একমাস থাকলে সে সুখীর সাথে কথা বলবে কিভাবে। এতদিন ধরে সে চেয়েছে আম্মা এসে থাকুক তাদের সাথে কিন্তু এখন সত্যিই খুব একটা খুশী হতে পারছে না।
এদিকে সুখী মুখে যত কথাই বলুক তার অবস্থা তথৈবচ। পর পর দুদিন রোহানের কমিক স্ট্রিপের কোন উত্তর পায়নি। রোহান দাদীর কাছ থেকে পাওয়া নতুন গেইম নিয়ে খেলতে ব্যস্ত দিনরাত। সাদীও টেক্সটের উত্তর দেয়নি। সে নিজেও অত্যন্ত ব্যস্ত ছিল। শেষ দুদিন তার নাওয়া খাওয়ার সময় ছিল না।
ভাড়া গাড়ীতে ফিরে আসছিল মোহাম্মদপুর, কি মনে করে বলল ধানমন্ডীতে সাদীর বাড়ীর ঠিকানা। গাড়ী দাঁড় করিয়ে রাখল, ক্লান্ত অর্পাকে নিয়ে উপরে উঠে গেল খোঁজ নিতে কেন বাপ-ব্যাটা তার মেসেজের প্রতিউত্তর দেয়নি। সম্পূর্ণ ভুলে গেছে আম্মার উপস্থিতির কথা। আম্মা দরজা খুলে দেখল অগোছালো, পরিশ্রান্ত, বিধ্বস্ত এক সুখীকে।
সে বলল, ‘’রোহান নেই?”
-ও তো খেলতে গেছে, আপনি কে?
-আমি সুখী …সুখী শ্রাবন্তী ! বলেই তার উপলব্ধি হল উনি সাদীর মা।
এদিকে অর্পার ঘুম পেয়েছে, ক্ষুধা পেয়েছে আর পুরো সপ্তাহ সে মায়ের সঙ্গ কদাচিৎ পেয়েছে … আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে মাকে লাগিয়ে দিল দুই ঘা হাতের উপর। মেঝেতে বসেই কান্না জুড়ে দিল। আম্মা এত ছোট বাচ্চার দুর্বিনীত আচরণে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। শত হলেও তিনি একজন শিক্ষয়িত্রী। কিছুটা নীচু হয়ে ঝুঁকে অর্পাকে বললেন,
-মায়ের সাথে কখনো অমন করতে হয় না!
অর্পা যা কখনোই করে না, তাই করে বসল। আম্মার কথা শুনে সে না না না বলে চিৎকার করে উঠল। সুখী লজ্জায় এতটূকু হয়ে গেল। লিফটের দরজা খুলে সাদী বের হয়ে এল। তার চেহারা হল রাতের আলোয় রাস্তার বিজ্ঞাপনের বোর্ডের মত খুশীতে ঝলমলে।
আম্মা এবার দ্রুত সুখীকে চিনে নিতে পারলেন। ফলের ঝুড়ি- অর্পা-কমিক্স -রোহানের কাছে দেখা ছবি সব পরপর জোড়া লাগিয়ে নিলেন সহজেই।
সাদী অর্পার কাছে বসে নীচু হয়ে হাত ধরতেই বাচ্চাটা সুখীকে অবাক করে একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার কোলে। মনে হচ্ছে সাতদিন পর বাবার দেখা পেয়েছে সে !
আম্মা তাদের ঘরে ঢুকতে অনুরোধ করলেন। সুখী লজ্জিত, মেয়ের বেয়াদবিতে অনুতপ্ত, বেচারা মুখে বললো ‘’আন্টি আমরা আজ যাই, পরে আসবো।”
-একটু বসে যাও! চা খাও! বলতে বলতেই তিনি ঘরে ঢুকে গেলেন এবং সুখী অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঢুকতে বাধ্য হল।
আম্মা দ্রুত ঘরে ঢুকেই রান্নাঘরে গিয়ে প্লেটে করে বিস্কিট নিয়ে এলেন। রান্নার মহিলাটিকে চা করার নির্দেশ দিলেন। সেও তাকে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে বলল, “দেখা হইছে আপনার সাথে আফা।” আম্মা ভাবলেন,
‘’ওহ, তাহলে সবাই এই সুখীকে চেনে!”
আম্মা অর্পাকে বিস্কিট দিতে গেলে সে সাদীর কোল থেকেই চেঁচিয়ে উঠল। আম্মা মনে মনে খুব বিরক্ত বাচ্চার ব্যবহারে। সাদী বলে উঠল,
-বেচারী টায়ার্ড …ঘুম পেয়েছে!
সুখী লজ্জায় অস্বস্তিতে একটা বিস্কিট হাতে নিয়ে কোনরকমে বের হয়ে এল নীচে ট্যক্সি দাঁড়িয়ে আছে এই অজুহাতে। সাদী নীচে এসে এগিয়ে দিল তাকে। সাদী ফিরে এলে আম্মা অর্পা সম্পর্কে মন্তব্য করতে শুরু করলেন। সাদী শুধু বলল,
-আম্মা ওর মাত্র পাঁচ বছর!
-তাতে কি! রোহান কখনো এমন করেছে? নাকি মীরার ছেলেরা করে এমন?
-আপনাকে চেনে না তো, ঐজন্য চিৎকার দিল!
-আরে, বাচ্চা জেদ করলেই অত পাত্তা দিতে হয় না! আমরাও বাচ্চা মানুষ করেছি!
-আম্মা, আপনি একটু বেশীই ওভার রিএক্ট করছেন!
-হ্যাঁ, তুইও একটু বেশীই উদারতা দেখাচ্ছিস!
আম্মা কোনদিনই কাউকে ছেড়ে কথা বলেননি। তিনি মানুষ গড়ার কারিগর, কাজেই ভুল-ত্রুটি তার চোখেই পড়ে সর্বপ্রথম!
চলবে…
অচিনপুর ডেস্ক/ জেড. কে. নিপা