বন্যা হোসেন
অটোয়া, কানাডা।
উপন্যাসঃ মেঘের খেলা (পর্ব- পনেরো)
মিতার উদ্দেশ্য অনেকটাই সফলকাম হয়েছিল বলা যায়। সে চেয়েছিল সাদীর আত্মীয়স্বজন আর রোহানের নানা-নানীর ভাবনার মালমশলা যোগাতে। সাদী আর রোহানকে নিয়ে তাদের সবার আলোচনা শুধু দুঃখ বেদনার কাব্য। সুখীকে এই চিত্রপটে এনে উপস্থাপন করলে সবার মধ্যে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া হওয়া স্বাভাবিক এবং ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সংমিশ্রণে ইতিবাচক কিছু ফলাফল বেরিয়ে আসতে পারে। ফলাফল নেতিবাচক অর্থাৎ সুখীকে যদি সাদীর পরিবার অপছন্দ করে তাহলেও সাদীর জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হবে সুখীর ব্যাপারে।
রফিক পরিচয় করিয়ে দেয় সুখীকে বাকী মেহমানদের সাথে। আরও দুটি বন্ধু পরিবার ছিল। পুরোন স্টাইলের চারতলা বাড়ীর একতলা দোতলা নিয়ে রফিকের পুরো পরিবারের বসবাস। পুরোন ধাঁচের বাড়ী বলেই হয়তোবা রুমগুলো অনেক বড়, বিশাল বারান্দা, লতানো মাধবীলতার ঝাড় দোতলা পেরিয়ে তিনতলায় পর্যন্ত উঠে গেছে।
মিতা বাড়ী ঘুরে দেখায় তাকে। হামিদা তাকে দেখে স্কুলের মেলাতে পরিচিত হওয়ার কথা বলেন অন্যান্যদের। রফিক সবাইকে জানায় সুখীর অসাধারণ সৃজনশীল প্রতিভার কথা। হামিদা আর আনোয়ার বিস্মিত হয় যখন তারা জানতে পারে রোহানের দেয়ালে টাঙানো কার্টুন কাহিনী ‘মফিজ মোমো’ সুখীর তৈরী। এবং তার রান্নায় পারদর্শীতার কথাও জানিয়ে দেয় রফিক। সুখী এত লোকের সামনে এভাবে তার পরিচিতি দেয়াতে লজ্জিত। সে বলে,
-এরপর কোন জব ইন্টারভিউতে গেলে আপনাকে নিয়ে যাব রেফারেন্স হিসেবে ।
-আইল বি গ্ল্যাড টু ডু দ্যাট!
হামিদা জানতে চায় কি করে মিতাকে চেনে সুখী। সাদীর ঘরে পরিচয় হয়েছিল সে জানায়। সাদী তার বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করার পাশাপাশি বাচ্চাদের দিকে নজর রাখছে। সোফায় বসে বা দাঁড়িয়ে কেউ তারা একে অপরের দিকে চোরাচোখে দেখছে না, দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা নেই। সাদীকে খুব প্রাণোচ্ছল আর প্রাণবন্ত লাগছিল এবাড়ীর পরিবেশে। শ্বশুর-শাশুড়ির নৈকট্যে সে যেন অনেকটা ভারমুক্ত … ওঁদের প্রতি বাক্যে সাদীর নাম উচ্চারিত হয়! ভাবতে আশ্চর্য লাগে, শীলা এদেরই কন্যা ছিল! সাদীকে তারা নিজের ছেলের মত ভালোবাসেন, তারপরও তাদের মেয়ের সাথে বিচ্ছেদ কেউ ঠেকাতে পারেনি। কি বিচিত্র দুনিয়া!
ডিনারে মিতা অনেক আয়োজন করেছে। বড়দের জন্য একরকম, ছোটদের জন্য ভিন্ন। অর্পার কাঁটাযুক্ত মাছ খাওয়া দেখে সবাই খুব অবাক। খাওয়ার পর আরও অনেক আড্ডা হল। বাচ্চারা লুকোচুরি খেলা শুরু করে দিল একতলা দোতলা মিলিয়ে। রাত বারোটার দিকে রফিকের গাড়ীতে ড্রাইভার নামিয়ে দিয়ে এল সুখী আর তার মেয়েকে। সাদী আর রফিক তাকে গাড়ী পর্যন্ত এসে বিদায় জানাল।
সাদীরা তাদের ঘরে ফিরে এল আরও ঘন্টাখানেক পর। হামিদা ভিতরে গেছেন। রোহানও তার রুমে। আনোয়ার সাহেব হঠাৎ সাদীকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলেন,
-তোমাকে পছন্দ করে …মেয়েটা?
সাদীর গলায় মনে হচ্ছিল কিছু আটকে গেছে। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা! সে শুধু জিজ্ঞেস করল,
-জ্বী?
এবার আরও স্পষ্ট করে বললেন আনোয়ার সাহেব।
-তোমার কলিগ সুখী কি তোমাকে পছন্দ করে?
সাদী বুঝতে পারছে না কি উত্তর দিবে! মনের মধ্যে তন্নতন্ন করে খুঁজছে বিভিন্ন আলামত যা দিয়ে বোঝা যায় সুখীর তার প্রতি আসক্তির কথা। তারা খুব সন্তর্পণেএকে অন্যকে এড়িয়ে গেছে। সাধারণ গল্প আড্ডা ছাড়া সরাসরি কোন কথা হয়নি তাদের। কোন ক্লু তো পাওয়া গেল না! তাহলে! কি করে তাঁর এমন ধারণা হল?
-কেন জিজ্ঞেস করছেন? সাদী মনের উত্তেজনা যতটা সম্ভব শান্ত রেখে জানতে চাইল।
-আমার মনে হল। তিনি চশমা খুলে হাই তুলতে তুলতে জবাব দিলেন।
সাদী উতলা হয়ে আছে, কিন্তু সেটা মুখে প্রকাশ করা মুশকিল। তাই আবার বলল,
-আপনার কেন এমন মনে হল? উনি কি কিছু বলেছেন …?
-আরে নাহ…ওসব কিছু না। স্মিত হেসে বললেন আনোয়ার।
সাদী একাধারে উৎসুক কারণ জানতে, অন্যদিকে তার বেশী ঔতসুক্য দেখানোও ঠিক নয়! আর শ্বশুরের যতই প্রিয়পাত্র সে হোক না কেন আর বেশী জানতে রুচিতে বাঁধে।
ঠিক সে সময়ে সাদীকে এ অবস্থা থেকে রেহাই দিতেই রোহানের উপস্থিতি বড়ই কাম্য ছিল। কাঁদো কাঁদো গলায় বলছে তার পা ব্যথা! ঘুমাতে পারছে না। সাদী ব্যস্তসমস্ত হয়ে উঠে যায় ছেলের পিছু পিছু তার ঘরে। আনোয়ারও আসে পিছু পিছু।
-হবে না? পায়ের আর দোষ কি? ছয় ঘন্টা ধরে খেলছো …নন স্টপ!
অনেকটা সময় ধরে রোহানের পা টিপে দেয়া হল। রোহান ঘুমিয়ে গেছে। আনোয়ার বললেন,
-তুমি বেশ যত্ন করতে পারো বাচ্চাদের।
– ছেলে বলে রোহানকে আমি বুঝি সহজে। সামান্য হেসে উত্তর দেয় সাদী।
-সুখীর মেয়ে অর্পার সাথে কথা বলতে দেখলাম তোমাকে!
সাদীর বুকের ভিতর মনে হয় কা-বুম করে ধাক্কা লাগল। ওটা দেখেই কি এই উপসংহারে এলেন তিনি! সে শুধু মুখে বলল,
-বাচ্চাটা খুব কিউট।
এর মধ্যে হামিদাও এসেছেন ঘরে। রোহান ইতিমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে। হামিদা এসে কার্টুন এর গল্পটা দেখেন ভাল করে ..বিস্মিত হন সুখীর প্রতিভায়। মেয়েটা মেধাবী বোঝা যায়।
-মেয়েটা আর্টিস্টিক! হামিদা বলেন।
-হ্যাঁ, শুনেছি শ্রাবন্তী আসার পর ‘স্বকীয়তা’ দুবছর বেস্ট ক্রিয়েটিভ এওয়ার্ড পেয়েছে।সাদী বলে উঠল। তার দিকে আনোয়ার সাহেব কৌতূহলী চোখে দেখলেন।
হামিদা জিজ্ঞেস করেন সাদীকে,
-ওর মা না খালা কার কথা বলল ওর সাথে থাকে … নিয়ে এল না তো!
-খালা থাকে। যতদূর শুনেছি মা-বাবা বেঁচে নেই।
-ডিভোর্সী?
-উম… ওরকমই!
এরপর আর বেশী কথা হল না। তাঁরা ঘুমাতে গেছেন তাঁদের জন্য বরাদ্দ গেস্ট রুমে। স্বামী-স্ত্রী গল্প করছেন আজকের সন্ধ্যা নিয়ে। আনোয়ার খুলে বলেন স্ত্রীকে সাদীর কাছে তিনি কি জানতে চেয়েছেন!
হামিদা অবাক হয়ে তাকান স্বামীর দিকে। তিনি জিজ্ঞেস করেন,
-কি উত্তর দিল সাদী?
-সে তো আকাশ থেকে পড়ল!
-তুমিই বা কেনো ওকথা জানতে চাইলে?
-আরে মেয়েটাকে এগিয়ে দিতে রফিক আর সাদী বাইরে যাচ্ছিল আমি দরজার পাশ দিয়ে বারান্দায় যাচ্ছিলাম। স্পষ্ট শুনলাম সাদী বলল,
-কল করবে তো পৌঁছে? মেয়েটা উত্তরে বলে,
-টেক্সট না?
-না! সাদী বলে। তো আমি কিছু ভুল বলেছি নাকি! আমার হিসেব ঠিকই আছে। বুড়ো মানুষের চোখ হলে কি হবে যা দেখি ঠিক দেখি!
সাদীর এই পরিবর্তন কিন্তু তারা মন থেকে মেনে নিতে পারলেন না। যদি শীলা আজ বেঁচে থাকতো তাহলেও তো সাদী নতুন জীবনসংগী বেছে নিত। তাহলে আজ কেন বুক ভেঙ্গে যায় ভাবতে সাদী আর রোহানের জীবনে নতুন কেউ আসবে। হামিদা একেবারেই মানতে রাজী নন। তিনি ভাবছেন এমন কিছু হলে তারা আর ইচ্ছেমত রোহানকে দেখতে আসতে পারবেন না। যদিও তিনি জানেন এধরণের চিন্তা স্বার্থপরতা! তারপরও এ স্বার্থপরতা করতে তার আপত্তি নেই। আনোয়ার সাহেব তাকে বোঝান সাদীর এমন কি বয়স হয়েছে যে সে সারাজীবন একা একা ছেলে পালবে! তার স্ত্রী তাকে ভয় দেখান সৎ মায়ের..যেন যে কোন সুন্দর স্বভাবের মেয়ে সৎ মা হলেই অত্যাচার শুরু করে স্বামীর আগের ঘরের সন্তানদের সাথে। হামিদাকে বোঝানোই কষ্টকর যে সাদীর মাত্র ৩৮/৩৯ বছর বয়সেই সে কেন একাকী থাকবে। সত্যিই যদি সুখীকে সে চায় তাহলে এক্ষেত্রে তাদের সর্বোত সহযোগিতা করা উচিত।
সাদীর মা তাদের ঘনিষ্ঠ পারিবারিক বন্ধু। তাঁর কাছ থেকে যতদূর শুনেছেন সাদী বিয়েতে আগ্রহী নয়। গত ছ’মাসে ওর মনোভাবের পরিবর্তন তো হতে পারে। আনোয়ার সাহেব ভাবেন, মেয়েটাকে বরং একটু যাচাই করে নেয়া যাক! তারা যেহেতু আরও কয়েকটা দিন এখানে আছেন কাজেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করা যায়! এই ভেবেই তিনি পরদিন রোহানের থেকে সুখীর নাম্বার নিয়ে তাকে ফোন করে বসলেন!
সুখী ছিল বাজারে। সুপার শপ থেকে বাজার করে মিষ্টির দোকানে যাচ্ছিল। অর্পা বায়না ধরেছে লাড্ডু খাবে। এই সময়ে আর যা-ই হোক সাদীর শ্বশুরের ফোন একেবারেই অপ্রত্যাশিত। তার কথাবার্তা হল এরকম,
-হ্যালো!
-হ্যালো সুখী…আমি আনোয়ার …রোহানের নানা!
সুখীর বুঝতে একটু সময় লাগে। কে আনোয়ার! তারপরই সে বলে,
-জ্বী আংকেল! কেমন আছেন?
-এই তো আছি! তুমি কি ব্যস্ত?
-আংকেল বাজার করে এখন মেয়ের আবদার মেটাতে মিষ্টির দোকানে এসেছি। লাড্ডু তার খুব পছন্দ।
-আমিও আসি খেতে? লাড্ডুর নাম শুনে আমারও খেতে ইচ্ছে করে!তোমার আন্টি দেয় না খেতে!
সুখী হেসে দেয় এই ছেলেমানুষী কথায়!
-আংকেল আসুন প্লিজ!
-শুনেছি তুমি নাকি দুনিয়ার বেস্ট ফুচকা চটপটি বানাও! একবার খেতে তো হয়!
-হা হা।
-নাহ …আমি মজা করছি তোমার সাথে!
-রোহান কি করছে আংকেল?
-অর্ক এসেছে, খেলছে ওরা।
-ওহ!
-সাদীর কথা জানতে চাইলে না!
সুখীর বুকের ভিতর দড়াম দড়াম করে হাতুড়ি পড়ছে। সে কিছু বলতে পারল না।
-কথা বল, দিচ্ছি সাদীকে।
-আংকেল…এখন কথা বলার…আই মিন কোন টপিক নাই!
-কথা শুরু করলেই টপিক পেয়ে যাবে!আনোয়ার হেসে বলে।
-আংকেল আমি চটপটি পাঠিয়ে দিব।
-বাসায় ডাকবে না আমাদের?
-উম…। আসুন …সুখী দ্বিধান্বিত! সত্যিই আসতে চায় নাকি, সে ভাবছে …!
সুখীর অস্বস্তি আর দ্বিধা দেখে মনে হচ্ছে এই সম্পর্ক শুধু একজন বস আর অধঃস্তনের নয় … এর চাইতে বেশী কিছু। ভাবেন আনোয়ার।
-সাদী বস হিসেবে কেমন?
-খুব ভাল আংকেল। খুব স্মার্ট আর কন্সিডারেট!
-আচ্ছা!
এবার সুখী নিজের থেকে আরও কিছুটা যোগ করে,
-উনি তো বাবা হিসেবেও অসাধারণ! যেভাবে ছেলের যত্ন করে …আমার পরিচিত কাউকে এমন দেখিনি!
আনোয়ার যেন এই অতিরিক্ত তথ্যের অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি নিশ্চিতভাবেই ধরে নিলেন অফিসিয়াল সম্পর্কের বাইরে আরও কিছু আছে …।
সে রাতে সুখী ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমের মধ্যে ভাবছিল কি করে ভদ্রলোক তাকে সাদীর সাথে কথা বলতে জোর করছিলেন …তাকে কথার ফাঁদে ফেলে কিভাবে আগামী শুক্রবার দাওয়াত আদায় করে নিলেন। মুখে বলেছেন শুধু চা খাবেন কিন্তু কিছু আয়োজন তো তার করতে হবে! সে কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে অন্য কোন প্রয়োজন আছে কিনা তার! তিনি জানালেন, সেদিন যাদের সাথে রফিকের বাসায় পরিচিত হয়েছেন সবাইকে ফোন করে কুশল বিনিময় করছেন! বেশ দাবী নিয়ে বললেন, ‘’কখন আসবো শুক্রবার?”
সুখী বাধ্য হয় বলতে, ‘’৬টায় আসলে অসুবিধে হবে আংকেল? ‘’
তিনি হেসে সম্মতি জানান।
পরদিন সকালে অর্পা কিছুতেই স্কুল বাসে যেতে রাজী নয়। ওকে স্কুলে পৌঁছে অফিসে যেতে দেরী হয়ে যায়। সকাল ৯টায় মিটিং, সে বিশ মিনিট পর ঢোকে মিটিং রুমে। সবাইকে দুঃখিত বলে মিটিংয়ে অংশ নেয়। মিটিং শেষ হলে সে ইচ্ছে করেই দেরী করে …সবাই বের হয়ে গেলে সাদীর কাছে গাড়ীর লোন নেয়া প্রসঙ্গে অফিস কি সাহায্য করতে পারে তা জানতে চায়। সাদী চিন্তিত হলেও যথাসম্ভব তার সব উত্তর দেয়। সুখী সব শুনে চলে যাওয়ার জন্য বের হতে গিয়েও ঘুরে তাকায়,
-উম…আপনার ফাদার ইন ল …রোহানের নানা ফোন করেছিলেন… আমি ঠাট্টা করে বলেছি আসতে … সিরিয়াস কোন ব্যাপার না…
-মানে, আমি যে শুনলাম ফুচকার দাওয়াত!
সুখী মনে মনে আতংকিত! মেনুও জানা হয়ে গেছে!
-উনি ফোন করেছিলেন খবর নিতে …কথার পিঠে কথা হচ্ছিল …সিরিয়াস কিছু না …
-তো সিরিয়াস কথা কিভাবে বলতে হবে? সাদী চেয়ারে গা এলিয়ে বলে।
সুখীর মনের ভিতর অদ্ভুত আলোড়ন হচ্ছে। তোলপাড় চলছে, কি যে হতে যাচ্ছে …পরিস্থিতি যেন তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। সে কোন উত্তর না দিয়ে দ্বিধানিত কন্ঠে কিছু বলার চেষ্টা করলেও উম…আ … ছাড়া আর কিছু বের হয় না। সাদী আবার তাকে বলে,
-শ্রাবন্তী…উইল ইউ অর ওন্ট ইউ ফিড আস?
সে কোনরকমে মাথা নাড়িয়ে পালিয়ে আসে।
পুরো সপ্তাহ আর তাদের বেশী কথা হল না, দেখা হয়েছে অফিসে সামান্য সময়ের জন্য। তবে ইদানিং রোহানের সাথে তার যোগাযোগ আরও বেড়েছে। স্কুল থেকে ফিরেই টেক্সট করে নানা জোকস পাঠায়, মেমে পাঠায় …তার সুখীর আর্ট নিয়ে খুব আগ্রহ…কোন সফটওয়্যার সে ব্যবহার করে তা নিয়ে কৌতুহল …। সকালে ইমোজী দিয়ে টেক্সট করে অর্পার কথা জানতে চায় …সুখীও অনেক ইমোজী ডাউনলোড করে ১০ বছরের কিশোরের সাথে পাল্লা দিতে। প্রায়ই অর্পার সাথে কথা বলে …নতুন কোন কার্টুন গল্প তৈরী করে সুখীকে তাক লাগিয়ে দেয়।
শুক্রবার সে ঠিকে কাজের মহিলাকে নিয়ে ঘরদোর সাফসুতরো করে। খালা বেশ অবাক হয়। কিছু অনর্থক কথা বলে বিরক্তির উদ্রেক করে। তবে আশার কথা, সে নাকি আজ সন্ধ্যেয় থাকবে না। প্রতিবেশী বান্ধবীদের সাথে কোন ইসলামী আলোচনায় যাবে। সুখী মনে মনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। সে চটপটি, ফুচকা ছাড়াও কিছু ভারী নাশতার আয়োজন করে। লুচি, আলুর দম, বেগুন ভাজা, মাংস, সালাদ, গুড়ের পায়েস …।
তারা সময় মতই হাজির হয়ে যায় সদলবলে। আসার সময় নাজমার ছেলে অর্ককেও নিয়ে এসেছে। সাদী বিশাল বড় গোলাপের তোড়া এনেছে। এত বড় তোড়া সুখী তার জীবনে কখনো দেখেনি। কিন্তু সে নিজে না দিয়ে হামিদার হাতে দেয় সুখীকে দেয়ার জন্য। চকলেট, মিষ্টি, অর্পার জন্য খেলনা নিয়ে এসেছে তারা।
এত গোলাপ, এতগুলো ফুল একসাথে হাতে নিয়ে আলতো করে ছোঁয় সুখী ফুলের পাপড়িতে। হাতে হালকা জলবিন্দুর স্পর্শ লাগে, হিম হিম ঠান্ডা ফুলের সৌরভে পুরো ঘর যেন মৌ মৌ করছে। সে আঃ বলে তৃপ্তির শ্বাস নেয়। আনোয়ার আর তার স্ত্রী ব্যালকনির দরজা খুলে বাইরে গিয়ে দাঁড়ান। সুখী গোলাপের ভুবন থেকে হঠাৎ ধরিত্রীতে নেমে এলে তার খেয়াল হয় এত বড় ফুলদানী নেই তার ঘরে। সে হেসে সাদীকে জানায়।
-বিরাট একটা সমস্যা, তাই না?
সুখীর দিকে অপলক নেত্রে তাকিয়ে সাদী উপভোগ করে তার চেহারার আরক্ত রুপান্তর।
হামিদার সহায়তায় লুচি ভেজে অন্য সব খাবারসহ পরিবেশন করল। পারিবারিক কিছু গল্প হল, সুখীর বাবা-মায়ের, ভাইয়ের কথা হল। সাদী দেখল সুখী পেছন থেকে ছবি তুলছে অর্পার আর হামিদার। অর্পা, রোহানের নানীর হাত ধরে তাদের ফ্ল্যাট ঘুরে দেখাচ্ছিল। তাদের শরীর বাদ দিয়ে শুধু দুজনের ধরা হাতের ছবি সে তুলেছে। এ নিয়ে প্রশ্ন করলে সে থমকে যায়, কিন্তু কোন সংকোচ ছাড়াই উত্তর দেয়,
-অর্পার নানীর সাথে এমন করে হাত ধরা কোন ছেলেবেলার ছবি নেই …ভাবলাম ওর নানী থাকলে এরকম কিছু হত নিশ্চয়ই …নানীর হাত ধরে হাঁটছে অর্পা।
এমন উত্তর সাদী আশা করেনি। মায়া হয়, সহানুভূতি হয়, দুঃখও হয়। অপরিচিতা একজন বয়স্কার সাথে ছবি তুলে রাখছে মেয়ের জন্য …সে যদি ভবিষ্যতে প্রশ্ন করে দেখাতে পারবে …অন্যদিকে ছবিটি এমনভাবে তুলেছে যাতে হামিদার পরিচয়ের গোপনীয়তা বজায় থাকে।
খাওয়ার পর বাচ্চাদের খেলা শেষ হচ্ছিল না, এদিকে দুটি ১০/১১ বছরের ছেলের জন্য এ ফ্ল্যাট বেশ ছোট …কারণ তারা ফুটবল প্র্যাক্টিস শুরু করেছে এই সংকীর্ণ করিডোরেই। সাদী দুই ছেলে আর অর্পাকে নিয়ে নীচে চলে যায় …হামিদাও যায় তাদের সঙ্গে।
সুখী আর আনোয়ার সাহেব ব্যালকনীতে গিয়ে দাঁড়ায়। অর্পার উপর নজর রাখছে সুখী। টুকটাক কথা হয় তাদের হাউসিং নিয়ে। তারপর যেন থলে থেকে বেড়াল বের হয়ে এল। অকপটে সরাসরি প্রশ্ন আসে সুখীর দিকে ধাবিত হয়ে,
-তুমি সাদীকে পছন্দ কর, মা?
সে বুঝতে পারছিল না কোথায় তাকালে তার মুখ দেখে মনের ভাব আন্দাজ করা যাবে না! নীচের দিকে তাকিয়ে মেয়েকে দেখে বুকের ধুকপুকানি কিছুটা কমানোর চেষ্টা করল। গলা পরিস্কার করে বলে,
-বস হিসেবে খুব ভাল মানুষ!
-এরকম কিছু তুমি আগেও বলেছ! আনোয়ার মৃদু স্বরে উত্তর দেয়।
সুখী তার দিকে মুখ তুলে তাকায়। সুখীর চেহারায় বিভিন্ন অভিব্যক্তির পরিবর্তন এত দ্রুত হচ্ছে …তার চোখে আলোর ছটা, গালে রঙের বদল, কোমল মোলায়েম চেহারাটি মুহূর্তেই চিন্তিত এক মা, নারী থেকে যেন ভালোবাসায় সিক্ত তরুণীতে রূপান্তরিত হয়ে গেল বিদ্যুৎ চমকানোর মত দ্রুত গতিতে। এমন প্রশ্ন তাকে কেউ করেনি …সে কাউকে পছন্দ করে কি-না … যখন ফিরোজকে বেছে নিয়েছিল, ফিরোজের ইচ্ছে আর যৌবনের তাড়নায় গা ভাসিয়ে দিয়েছিল।
এ ব্যাপারগুলো তার কাছে একেবারে নতুন। সে তৈরী করে নিজেকে উত্তর দেয়ার জন্য। ধীরে ধীরে মুখ খোলে,
-আংকেল কত ধরনের মানুষ আমাদের জীবনে আসে, চলে যায়, অনেককে আমরা পছন্দ করি। কিন্তু এর মানে নয় যে, পছন্দের সব মানুষকে নিয়ে আমরা ভাবি।
-তো আমার প্রশ্নের উত্তর কি হল …হ্যাঁ তো?
-আংকেল, আপনি আমাকে মাত্র এক সপ্তাহ হল জানেন …সে ধীর লয়ে নিজের কথা বলার সিদ্ধান্ত নেয় নির্ভয়ে চোখে চোখ রেখে …!
-অর্পার বাবাকে আমি বিয়ে করেছিলাম ভালোবেসে …জানতাম না সে আগেই বিয়ে করেছে …ছেলেমেয়ের বাবা… যখন জানতে পারি অর্পা তখন পেটে …আমি চলে আসি…অর্পা বাবাকে দেখেনি কখনো …
সুখীর মুখের স্বীকারোক্তি শুনে আনোয়ার সাহেব যেমন স্তম্ভিত হন তেমনি মনে মনে তার সৎ সাহসের প্রশংসা করেন। বাহাদুর মেয়ে বটে!
-সুখী …তুমি অর্পার মা আর বাবা। তোমার সাহসের প্রশংসা করছি!
আনোয়ারের কথায় এমন কিছু ছিল …হয়তোবা গত পাঁচ বছরে এত স্নেহ করে কেউ তার সঙ্গে কথা বলেনি…প্রশংসা করা তো দূরে থাক…অনেকেই সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।
-থ্যাঙ্কস আঙ্কেল!
-সাদী জানে? কিছু বলেছ?
সে মাথা নাড়ায়। আকর্ণ গোলাপী আভা সে টের পাচ্ছে। কি করে সে বলে… সাদী জানে … সেও তো চুম্বনে সাড়া দিয়েছে …যেভাবে সে পরম নির্ভরতায় বুকে মাথা হেলিয়ে দেয় …সাদী খুব ভাল করেই জানে তার ভাললাগার কথা।
সে অনেকটা অভিযোগের সুরে শুরু করে, ‘’সাদী এখনও শীলাকে ভালবাসে …ওদের আলাদা হয়ে গেলেও…বা এখন যখন শীলা বেঁচে নেই …’’
বলেই নিজেকে সামলে নেয়। শীলার বাবাকে সে এসব কি বলছে!যেন সে বলতে চাইছে কিভাবে আপনি আশা করেন যে আপনার মেয়ে জামাই অন্য মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাবে!
আনোয়ার লক্ষ্য করলেন সুখী নিজের আকর্ষণের কথা উহ্য রেখে সাদীর শীলার প্রতি ভালবাসাকে ব্যাখ্যা করছে।
আবার বলে ওঠে সুখী, ‘’ তাছাড়া আমার পরিবারের কেউ নেই…মা -বাবা নেই …ভাই টরন্টোতে …দেশে খুব কম আসে!
মনে মনে ভাবছে, আমার মত এতিম, নিঃস্ব, অবহেলিত স্বত্তার কি কোন জায়গা আছে সাদীর নিশ্ছিদ্র বন্ধনের ভালবাসার পরিবারে! আচ্ছা, পৃথিবীতে কয়জন শ্বশুর তার মেয়ে জামাইর জন্য পাত্রী খুঁজে!শূন্য জন! আঙ্কেল একটা সাধারণ মেয়ে সুখী শ্রাবন্তীকে নিয়ে কেনইবা এতটা ভাবছে! সে তো এতটা মূল্যবান নয়!
সুখীর প্রতিটি কথার সারমর্ম তিনি নিজের মত করে করলেন …সে এত কথার মাঝে একবারও বলেনি সাদীকে পছন্দ করে না বা সাদী তার উপযুক্ত নয়! সে বারংবার ঘোষণা করছে সে সাদীর জন্য যথার্থ নয়! সুখী এবার বলে,
-আমার কাজটাকে আমি খুব পছন্দ করি….ঢাকায় থাকতে আমার ভালই লাগে …যদিও তেমন কেউ নেই। আংকেল আমি রোহানকে খুব স্নেহ করি …অর্পাও খুব পছন্দ করে …
বলেই সে হাসে,
-রোহান মনে হয় শীলার মত হয়েছে …আমি তো শীলাকে জানিনা …রোহানকে দেখে বুঝি!
মেয়ের কথায় আনোয়ারের মন বিষণ্ণ!
-তোমার খারাপ লাগলো? আমি এভাবে জানতে চাইলাম!
-নাহ, আংকেল! খারাপ লাগলে কি আমি উত্তর দিতাম! সে একটু কৌতুক করার চেষ্টা করে।
-আপনারা থাকছেন তো! আর কিছুদিন পরই স্কুল ছুটি হচ্ছে!
আনোয়ার মাথা নাড়ায়। সুখী চিন্তিত হয়ে বলে,
-আপনারা থাকলে রোহানের জন্য খুব ভাল হয়!
রোহানকে নিয়ে তুমি খুব ভাব, তাই না ! ওর মা নেই বলে …
-জ্বী আঙ্কেল! খুব কষ্ট হয় ওর জন্য …
আনোয়ার সাহেব খুব ধীরে শ্বাস ফেললেন। তার চেহারায় প্রশান্তি। তিনি এখন জানেন তার করণীয় কি!
সুখী নিজের কাজ গুছিয়ে নেমে যায় নীচে। রোহানের নানা আগেই নেমে গেছেন। সাদী বাচ্চাদের নিয়ে ফুটবল খেলছে। কিন্তু রোহানের এক লাথিতে ফুটবল অন্ধকারে কোথাও খুঁজে পেল না। সাদী তার গাড়ীর চাবি দেয় অর্ক আর রোহানকে…গাড়ীতে একটা বল থাকার কথা। সে সুখীর দিকে তাকিয়ে হাঁটা শুরু করে একটু ফাঁকা দেখে…বয়স্ক দম্পতি অন্য দিকে অর্পাকে নিয়ে ব্যস্ত। সুখী তার পিছন পিছন যায়।
-বাবার সাথে কি কথা হচ্ছিল?
-উম…উনি জানতে চাচ্ছিলেন আমি আপনাকে পছন্দ করি কিনা!খুব নরম স্বরে বলে সুখী।
-আর তুমি কি বললে? খুব খারাপ লোক…হিটলারের মত!
-খারাপ লোক কেন বলতে যাব? বলেছি খুব ভাল বস আপনি ….
তারা হাঁটতে হাঁটতে গেটের কাছাকাছি চলে আসে। কয়েকটি বস্তির ছেলেকে দেখা যায় রোহানের বল নিয়ে খেলছে। সাদীকে দেখেই তারা চিনতে পারে বলের মালিককে। নিজেদের মধ্যে পাস করে সাদীকে পাস দেয় বলটি। সাদী একমুহূর্তের জন্য বিচার বিবেচনা হারিয়ে ফেলে। এই সেই ক্ষণ যখন সিদ্ধান্ত নিতে হয় নিজের সন্তানের ভালবাসার জিনিস বনাম কিছু একই বয়সী সুবিধাবঞ্চিত গরীব শিশুর আনন্দের খোরাক হতে পারা! ক্ষণিকের দোলাচলে সামান্য দিশেহারা হয় সে! পরমুহূর্তেই ছুঁড়ে দেয় বলটি সেই বালকের দিকে যে তাকে পাস দিয়েছিল। আনন্দ আর উল্লাসে ফেটে পড়ে ছেলের দল। সুখী হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে,
-কি হল এটা? এখন রোহানকে কি বলবেন?
-আমরা দুজনেই বলবো …অনেক খুঁজেছি …পাইনি …ব্যস, শেষ!
নিজেদের অজান্তেই এই প্রথম তারা রোহানকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য যৌথভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয় মিছে বলার জন্য। আর এই মিথ্যের বেসাতিতে নিজেদেরকে ‘আমরা’ বানিয়েছে নিজেদের অলক্ষ্যেই!
চলবে…
অচিনপুর ডেস্ক / জেড. কে. নিপা