মেঘের খেলা (পর্ব-একুশ)

বন্যা হোসেন
অটোয়া, কানাডা।

উপন্যাসঃ মেঘের খেলা (পর্ব- একুশ)

সেদিন বাড়ী ফেরার পর থেকে বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল সুখীর মুখটি, কেমন হয়েছিল দেখতে তার নিজের চেহারাটি তখন! আয়নার সামনে উচ্চারণ করল শব্দগুলো আবার, “আমাকে বিয়ে করবে?’’ বারবার, অনেকবার বলছে …বলতে গিয়ে মুখের পেশীর টান, ঠোঁটের ভংগিমার পরিবর্তন, হালকা হাসির ছোঁয়া সব লক্ষ্য করতে গিয়ে উদ্ভট এক ভাবনা এল মাথায়। শীলার জন্য কি এত আবেগ ছিল? কেন যেন মনে হয় শ্রাবন্তীকেই খুঁজছিল সারাজীবন ধরে! অস্থির পায়ে পায়চারী করল কিছুক্ষণ বেডরুমে, শীলার প্রতি অন্যায় হয়নি তো? তার নিজের জানামতে সে কখনো অবহেলা করেনি সত্য, কিন্তু আজকের মত অনুভব আর উন্মাদনা ছিল না শীলার জন্য!

সুখীর সাথে কল্পনায় সংসার খেলায় নিমজ্জিত সাদীর হঠাৎ খেয়াল হল সে এখনও রোহানের সাথে কথা বলেনি …মুখ থেকে হাসি মুছে গেল। রোহান সকাল থেকেই পিকনিকে গেছে রফিকদের সাথে। সে লিভিং রুমে এসে চিন্তিত মুখে পায়চারী করছে আবার রোহানের রুমে গিয়ে শীলা আর রোহানের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকল।

আম্মা বুঝতে পেরেছেন ছেলের মনোভাব ঘরে ফেরার পর পরই। আম্মা মুখে কিছু বলেননি, সাদীও কিছু জানায়নি। দুপুরের খাওয়ার সময় যখন তাকে বারবার খেতে বলছিলেন সে অনীহা প্রকাশ করছিল। সুখীকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে যেতে হয়েছিল, কারণ তারা দুজনেই না খেয়ে বের হয়েছিল সকালে। সে আম্মাকে জানায় পরে খাবে। আম্মা তাকে সুখীর কথা জিজ্ঞেস করেন।
-দেখা হল সুখীর সাথে?
সে মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়, সঙ্গে উজ্জ্বল হাসি। আম্মার নজর এড়ায়নি ছেলের উদ্ভাসিত মুখ।

-বাসায় কথা হচ্ছে জানিয়েছো? সাদীর হৃদপিন্ড এখন দ্রুতগামী ট্রেনের মত ছুটে চলেছে।
-আম্মা, সেদিন যখন ওকে নিয়ে শিল্পকলায় গেলেন তখনই তো বুঝে গেছে যে বাসায় আলোচনা হচ্ছে।
-ওটা তো আর্ট শো দেখতে গিয়েছি।
আম্মার জন্য সুখীর ফেলে আসা অতীতের কালো অধ্যায় মেনে নেয়া আসলেই কষ্টকর! কিভাবে এ মেয়েকে ছেলের বউ করবেন। তিনি মনে মনে প্রার্থনা করছেন যেন সুখী নিজে থেকেই সরে দাঁড়ায়।
-আজকে কি কথা হল তা নিয়ে আর আপনার জানার কি প্রয়োজন, আপনি তো আগেই দেখা করে এলেন?
সাদীর কথায় আম্মা একেবারে জব্দ। ধরা পড়ে গেছেন তিনি, সাদীকে না বলে সুখীর সাথে দেখা করেছেন, এখন অস্বস্তিতে আর কথা বাড়ালেন না। বরং বললেন ,
-সে কি জানে, আমরা যে রোহানকে এখনও কিছু বলিনি? ইচ্ছে করেই যেন কিছুটা নেতিবাচক হাওয়া ঢূকাতে চাইলেন সমগ্র পরিস্থিতিতে।
-আম্মা, শ্রাবন্তী আমার প্রস্তাব মেনে নিলেও বলেছে আমরা যেন রোহানের সাথে কথা বলি।
-’আমরা’ মানে তুমি আর সুখী? বিমর্ষ কন্ঠে বললেন আম্মা।
-নাহ, আমি আর আপনি!

রোহান বুঝছে কিছু একটা ঘোট পাকাচ্ছে বড়রা, কিন্তু কি তা জানে না। সাদী আর মীরা শনিবারে ব্যলকনিতে কাপড় মেলে দেয়া শেষ করে নিজেরা আলাপ করছে। রোহান এসে সরাসরি প্রশ্ন করে,‘’ড্যাড ফুপিরা কেন এসেছে? ‘’
সাদী আর মীরা চমকে তাকায়। মীরা চোখ কপালে তুলে বলে,
-আমরা আসবো না তোদের দেখতে? চলে যাব পিচকু? সাদী কথা খুঁজছে, কি উত্তর দেয়া যায়!
রোহান বড় হচ্ছে, লুকোচুরি আর চলবে না। আবার বলে উঠেছে,’’ড্যাড , টেল মি।”
-দাদীর শরীর খারাপ! তাই এসেছে! আমাদেরকে অনেক দিন দেখেনি সেটাও একটা কারণ!
রোহানের মুখ দেখে মনে হল সে এই উত্তরে সন্তুষ্ট হয়নি!
-কী হয়েছে? কিছু একটা তোকে ভাবাচ্ছে! আমাকে বল !
-তুমি কি আমাকে দাদীর সাথে চিটাগাং পাঠিয়ে দিতে চাও? এসব প্ল্যান করছো ফুপির সাথে?
-ওহ …না…না …না …বাবা …একেবারেই না! রোহানকে হাত ধরে তার পাশের চেয়ারে বসাল।
-ড্যাড, তুমি না বলেছিলে যখন কোন ফ্যামিলি ডিসিশন নিতে হয় তখন ফুপী আসে দেশে !
-হ্যাঁ, বলেছি! তোর তো ভাল মনে আছে! সাদী হাসে।
আম্মা চা নিয়ে এসে উঁকি দিলেন ব্যালকনিতে, সাদী চোখের ইশারায় তাকে চলে যেতে বলে। মীরা টবের পরিচর্যা করার নাম করে আড়ি পেতে শোনে বাপ ছেলের কথোপকথন।
– স্কুলটা ভাল লাগছে রোহান?
-ড্যাড! ভাল লাগছে ! শুধু গরম ভাল লাগে না! ড্যাড আমি এখানেই কলেজে পড়বো। আমি আর অর্ক এক কলেজে পড়বো।
-ওহ, খুব ভাল তো! আমি তো শুনলাম অর্ক নাকি খামারবাড়ী চালাবে ওর দাদুবাড়ীতে, অনেক গরু ছাগল পালবে! মাছের চাষ করবে পুকুরে!
-নাআআআ! এমন কিছু বলেনি অর্ক! চেঁচিয়ে বলে রোহান।
-ভাই! মীরাও শাসন করে সাদীকে।
-ওহ, মনে পড়লো! অর্ক যাবে ট্রেকিংয়ে হিমালয়ে। তারপরে নেপালেই থেকে যাবে নেপালি মেয়ে বিয়ে করে!
-ড্যাএএড! এবার রোহান গলা আর একটু চড়াল!
-ওকে! ওকে! একটু মজা করছিলাম! অবশ্যই অর্ক আর তুমি এক কলেজে পড়তেই পারো।

মনে মনে ভাবছে যে কোনভাবে ছেলেকে রাজী করাতে হবে! সে একজন দুর্বল, ভীরু মানুষ ছেলের ব্যাপারে। পিতৃস্নেহ আর ভালবাসার যাঁতাকলে পড়ে পিষ্ট হচ্ছে তার বুভুক্ষু হৃদয়… ভালবাসা শব্দটি মনে হতেই তার মুখে উষ্ণতার পরশ লাগে, ছেলের কাছে মুখ লুকিয়ে অন্যদিকে তাকায়। গলা পরিষ্কার করে আবার সে শুরু করে, রোহানকে যে জানাতেই হবে সুখীর ব্যাপারে।
-তাহলে কি দাঁড়াল, তোর এখানে ভাল লাগছে, স্কুল ভাল, বন্ধুরা ভাল, তাই তো?
-আমরা এখানেই থেকে যাব ড্যাড!
-তুই যদি চাস থাকবি! আমার কাজটাও খারাপ না! আপাতত অন্য কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নেই! ইচ্ছে করে এখানে কাজের প্রসংগ টেনে আনে …মনের কথা আর রয় না গোপনে!

-ড্যাড আই লাইক শাকিল আংকেল …আই লাইক শবনম …জামান আংকেল! রোহান অফিসের যাদেরকে চেনে তাদের নাম বলা শুরু করেছে দেখে দুরু দুরু বুকে কাষ্ঠ হাসি দিয়ে সাদী বলে,
-উমম…অফিসের আর কাকে তুই চিনিস?
-ওহ , ভাল লাগে রওশন আন্টি আর আসাদ আংকেলকে!
-অর্পাকে ভাল লাগে না?
সবচে’ কঠিন প্রশ্নটি করতে গিয়ে বুকের ধুকপুকানি আরো বেড়ে গেল। মীরা ফুল গাছ পরিচর্যার বাহানা বাদ দিয়ে পালিয়ে বাঁচল, বাকীটুকু শুনতে তার সাহস পাচ্ছে না।
রোহান মিষ্টি হেসে মাথা নেড়ে সায় দিল। সাদীর বুকের পাথর নামতে শুরু করেছে।
-আই লাভ দেম! সুখী আন্টি এন্ড অর্পা আমার বেষ্ট ফ্রেন্ডস! আর মিতা আন্টি, রফিক আংকেল, নাজমা আন্টি, অসীম আংকেল! সব পছন্দের মানুষদের নাম বলা প্রায় শেষ!
-আচ্ছা? অর্পাকে কেন ভাল লাগে?
যেন ধীরে ধীরে বড়শিতে গেঁথে নিচ্ছে শিকার এমনভাবে এগুচ্ছে সাদী। সে এডভারটাইজিং কোম্পানীতে কাজ করে জানে কিভাবে ধীরে ধীরে কথার যাদুতে ধরে রাখতে হয় ক্লায়েন্ট! সেই থিওরী ছেলের উপর চালিয়ে দেখা যাক কতটুকু সফলকাম হওয়া যায়। সুখীর কথা তো আর সরাসরি জিজ্ঞেস করা চলে না।
-অর্পাটা খুব কিউট ….কিন্তু খুব ছোট!
-হ্যাঁ , ছোট হলে কি হবে …একসাথে তো সব গেইম খেলিস দেখি!
-ও যদি বড় হত তাহলে আর ওকে পছন্দ করতাম না। মেয়েরা শুধু মেকাপ আর ফ্যাশন করে!
-সুখী আন্টি কোন মেকাপ দেয় না, ফ্যাশন করে না!
সাদী তাকে মনে করিয়ে দিল। রোহান কিছুটা থমকে গিয়ে মনে করার চেষ্টা করলো। সে অতটা লক্ষ্য করেনি যতটা তার বাবা দেখেছে ! রোহান মাথা দুলিয়ে সায় দিল। সাদী এবার দ্রুত জাল গুটিয়ে আনার চেষ্টায় আছে। বলে উঠলো ,
-একজনকে পাওয়া গেল যে মেকাপ করে না!
-অর্পা মেকাপ পছন্দ করে , ঠোঁটে লিপ শাইন লাগায়! চোখ ভঙ্গী করে বলে রোহান।
সাদী ছেলের মুখে লিপ শাইন শুনে হো হ করে হেসে ওঠে। এবার রোহান নিজেই ধরা দেয়। সে বলে,
-সুখী আন্টি খুব ভাল!
-ভাল লাগে আন্টিকে? কোমল স্বরে জানতে চায়, বুকে তো হাতুড়ি পড়ছে।
-উম্ম …ইয়াহ…সুখী আন্টি কি মজার রান্না করে …ফুচকা, পাস্তা, ব্রাউনি, ইয়াম…! জিভ চেটে শব্দ করলো রোহান।
-যাবি নাকি আন্টির ওখানে খেতে?
খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চায় সাদী। আচমকা এই প্রশ্নে রোহান ভ্যাবাচেকা মুখ করে, বিস্মিত হয়ে মাথা নাড়ে ,’’উমম…না মানে …বলেছে? যেতে?’’ লাজুক রোহান।
-এখানেও এসে বানিয়ে দিতে পারে! সাদী প্রস্তাব রাখে ছেলের কাছে।
-আসবে আন্টি?
-বলতে পারি। এবার রোহান উত্তেজিত হয়ে বলে,
-তাহলে অনেকগুলো রান্না করবে বড় হাঁড়িতে! রোহানের চোখ মুহূর্তেই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ।
-অথবা এখানে থেকেই রান্না করতে পারে! শেষ সূতোটা ছেড়ে দিল সাদী।
-এখানে? আমাদের সাথে থাকবে? রোহানের চেহারা মুহূর্তেই বদলে গেল। তার চোখে ফুটে উঠলো এক অদ্ভুত অজানা শঙ্কা না কি তার নিজস্ব জগতের বাইরের কাউকে আপন করে নেয়ার প্রতি অনীহা ঠিক বোঝা গেল না! সাদী দুর্বল্ভাবে মাথা নাড়ায়,

-আই ডোন্ট লাইক ইট দ্যাট মাচ!

রোহান স্পষ্টভাবে মতামত জানিয়ে বের হয়ে যায়! সে ছোট হলেও এটুকু বোঝে সুখী আন্টি তাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য রান্না করে খাওয়াবে তাদের বাড়ীতে এসে এটা বাস্তবসম্মত নয়। মনে পড়েছে আজকাল প্রায়ই দাদীর মুখে শোনা যায় ‘বিয়ে’ নিয়ে আলোচনা। সে নিজের ঘরে ফিরে এসে কমিক স্ট্রিপের কাছে এগিয়ে যায়, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে। আবার বের হয়ে দৌড়ে দরজা খুলে চলে যায় অর্কর বাসায় কাউকে কিছু না বলে!
সাদী দুর্বল, শ্লথ পায়ে ঢুকে রান্নাঘরে। আম্মা আর মীরা সেখানে কিছু করছিল। তাকে দেখে দুজনেই মুখ তুলে তাকায়। মীরা এগিয়ে আসে কাছে, ধীরে ধীরে বলে,
-কি বলে ভাই? কথা হল?
-হিন্ট দিলাম। পুরোটা বলিনি, তাতেই মনে হল পছন্দ হয়নি এই আইডিয়া! স্খলিত, ভঙ্গুর কন্ঠ সাদীর। আম্মা তাকে চায়ের কাপ দেন, আবার নতুন করে বানিয়ে এনেছেন।
-আবার আরেকদিন বললেই হবে!
-আম্মা আমি এখানে ৬ মাস থাকতে পারবো না! মীরা অসন্তুষ্ট হয় আম্মার ধীরে চল নীতিতে।
-তো, তুই কি চাস, এক সপ্তাহের মধ্যেই বিয়ের ব্যবস্থা করতে?
সাদী মা-বোনের কথায় আরও সংকুচিত হয়ে যায়। সে চায় তাৎক্ষণিক ফলাফল, দ্রুত সিদ্ধান্ত!
বোনের সাহায্যের প্রত্যাশায় আশাবাদী হয়ে মীরাকে বলে রোহানের সাথে কথা বলতে। আম্মা ছেলের ভেংগে পড়া মুখ দেখে মোটেই আনন্দিত নন! তিনি নিজের চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কাপে মুখ আড়াল করে বলেন, ‘’ কি বললো রোহান?”
-এমনি কথা হচ্ছিল, বললাম যে পাস্তা এত পছন্দ তাহলে আমরা রোজ বানানোর ব্যবস্থা করতে পারি!
আম্মার হৃদয় ভেংগে গেল। রোহান পাস্তা পছন্দ করে কবে থেকে? পাস্তা একটা খাবার হল? মুখে বলে,
-তো? তারপর কি হল? মীরা প্রশ্ন করে।
-বললো , ‘ আই ডোন্ট লাইক ইট দ্যাট মাচ! ‘’
-ওহ! এটা কোন সিরিয়াস কিছু না! মীরা মন্তব্য করে। আম্মার পছন্দ হয় না মেয়ের কথা, তিনি রোহানের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মীরা ভাইকে আশ্বাস দেয় সে কথা বলবে রোহানের সাথে।
রোহান তাদের কথাবার্তার মধ্যে দৌড়ে আসে। দাদীকে জিজ্ঞেস করে অর্ক তাদের সাথে খেতে পারে কিনা আজ রাতে। আম্মা খুশীমনে সম্মতি জানান নাতিকে!
-তুমি চকলেট পুডিং বানাবে দিদু?
-বানাবো! আর কিছু? মীরার আর তর সইছিল না! সে মাঝখান থেকে বলে উঠলো ,
-আম্মা পাস্তা? পাস্তা বানাও প্লিজ! আম্মা এবার নিরুত্তর, রোহান ফুপির দিকে তাকিয়ে বলে,
-আম্মা,পাস্তা বানাতে পারে?
-হ্যাঁ, ‘আম্মা’ পাস্তা বানাতে পারে! মীরা দিদুকে আম্মা সম্বোধনের জন্য মুখ ভেঙ্গিয়ে বলে।
রোহান ইতস্তত করছে কিছু বলার জন্য সাদী টের পেল। সাদীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-সুখী আন্টি সবচে’ ভাল পাস্তা বানায়! সাদী বুক ভরে শ্বাস নেয়।
-পাস্তা বানানো সোজা! আমি পারি বানাতে! আম্মা বলেন। তার মন্তব্য অগ্রাহ্য করে রোহান তার বাবাকে বলে, ‘ড্যাড বলবে আন্টিকে নিয়ে আসতে?…শুধু ফুপির জন্য!’
নির্দেশ দিয়েই সে দৌড়ে আবার বের হয়ে যায় অর্কর কাছে।
রাতে মীরা নিজের ছেলেদের ঘুম পাড়িয়ে রোহানের কাছে আসে। রোহানকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে। রোহান কানাডা যাওয়ার আগে কত রাত তার সংগে ঘুমিয়েছে। তার চুলে হাত দিয়ে আদর করে ছোটবালার গল্প করছিল। রোহান তাকে বাংলাদেশে থাকতে অনুরোধ করে। দেয়ালে অনেক ড্রয়িং ঝুলছে রোহানের আঁকা, একদিকে সেই বিখ্যাত কমিক স্ট্রিপ যা সুখীর হাতে তৈরী। সে মিউনিখ থেকে আসার পরই দেখেছে, হাস্যরসে ভরপুর। এই শিল্পকর্মের যে স্রষ্টা সে নিঃসন্দেহে গুণী মানুষ।
রোহানের কপালে চুমু খেয়ে সে বলে,”বড় হয়ে কি আর্টিস্ট হবি নাকি পিচকু?”
-জানিনা …হাই তুলে আবার বলে….থেকে যাও এখানে ফুপি!
-চেষ্টা করবো। এখনই কথা দিচ্ছি না কিন্তু ! হঠাৎ রোহান বলে উঠলো,
-ফুপি, মামের গন্ধ তোমার গায়ে! মীরা স্তব্ধ হয়ে যায়। রোহানই আবার বলে,
-তুমি যে পারফিউম লাগিয়েছো, আমার মামের ঐটা পছন্দের ছিল!

বেচারা খুব করুণ গলায় স্মরণ করে মাকে। মীরা আবার ওকে জড়িয়ে ধরে, তার চোখে পানি চলে এসেছে। এতটুকু ছোট বয়সে ছেলেটা মাকে হারিয়েছে। যদিও শীলা ভাবী যা করেছিল সেজন্য সে অনেক আগেই ভাবীকে মন থেকে হটিয়ে বিদায় করেছে। কিন্তু সে রোহানের মা, এখন বেঁচে ও নেই …রোহানের কথা চিন্তা করে বুক ফেটে চৌচির হয়ে যায়। তার নিজের দুটি বাচ্চার কথা মনে হয়, আজ যদি তার কিছু হয়ে যায় তাহলে বাচ্চাগুলি কি করবে! আরও বেশী কান্না পায়। সে পিছনে হাত বাড়িয়ে আর একটি বালিশ নিয়ে চোখের উপর চেপে ধরে যাতে রোহান দেখতে না পায় তার অশ্রুভেজা চোখ।
-যদি এমন হত, আমি তোমার বুকে মুখ লুকিয়ে আছি চোখ বন্ধ করে, যখন চোখ খুলবো …দেখবো মাম এসেছে! রোহান চোখ-মুখ উজ্জ্বল করে বলে।
মীরা বহুকষ্টে নিজের কান্না থামিয়ে প্রসংগটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়,
-আমিও এমন চাই …চোখ যখন খুলবো তখন আর আমি মিউনিখে থাকতে চাই না ! কি মজা হত তাহলে!
-এজন্যই বলছি, তুমি আর যেও না! এখানে থেকে যাও আমাদের সাথে ফুপি!
এবার রোহান একটু সরে গিয়ে শুয়ে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকে।

মীরা তার পরবর্তী প্রকল্পে হাত দেয়।
-চল, আমরা এমন কাউকে খুঁজে বের করি যে মা (দ্রুত নিজেকে সংশোধন করে নেয়) এমন একজন যে কিনা তোমার বন্ধুও হবে আবার এবাড়ীতেও থাকবে।
-বেবি-সিটারের মত? …চোখ বন্ধ করে সে বলছে।
-উমম…উমম..ঠিক অমন না …তোমাকে জড়িয়ে ধরবে, গল্প করবে, গান শোনাবে!
-টেইলর সুইফট?

মীরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছিল….রোহানও ফুপির সাথে হাসিতে যোগ দেয়। দুজনে মিলে খুব হাসে। হাসি থামিয়ে মীরা বলে,’’ এমন কেউ যদি হয় যে ড্যাড এর গার্লফ্রেন্ড হবে?”
-হি ইজ ওল্ড! রোহান ঘাড় ঘুরিয়ে উত্তর দেয়।
-হুম, জানি। আমাদের একজনকে খোঁজা দরকার যে ড্যাডের সমবয়সী!

রোহান এবার সম্পূর্ণ সজাগ উঠে বসেছে, মৃদু হাসছে।
-তুমি খুঁজে বের করবে?
-তুমি চাইলে খুঁজবো! মীরা জানে না এই আলোচনা তাকে শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে যাবে!
-আমার দিদু আর অর্কর দিদু ছাড়া আর কোন বুড়ো মহিলাকে জানি না। রোহান চিন্তিত মুখে বলে।
মীরা ভাতিজার দিকে তাকিয়ে থাকে, তার হাসি পাচ্ছে আবার , গলা কেশে নেয়।
-ওহ…আরেকজন আছে …সুখী আন্টির বাসায় …আন্টির আন্টি … যে সারাদিন শুধু খায় !
মীরার কোন ধারণা নেই সুখীর খালা সম্পর্কে। সে প্রশ্ন করে, ,
-উনার দাঁত আছে তো ?
-অনেক …সে ইইইইই করে দেখালো …ওঁর দাঁতগুলো নোংরা, সব চুল সাদা…বসে থাকে আর খায় ।
-উম্ম…চল অন্য কাউকে…উম্মম …মীরা ইতস্তত করছে বলবে কি বলবে না, সাহস করে বলেই ফেলে।
-উমম, সুখী আন্টি কেমন?
-শি ইজ নট ওল্ড! রোহান বেশ জোর দিয়ে বলে …তোমার মত!
-কলেজের ছাত্রী নাকি সুখী আন্টি? মীরা ইচ্ছে করেই কৌতুক করে!
-নাহ…আন্টির মেয়ে আছে …অর্পা … হেসে মাথা নেড়ে বলে …আন্টিইই…ভাল…আই মিন নট ওল্ড!
-হুমম, তাহলে কি করা …তোমার ড্যাড তো বুড়ো …যে সারাদিন খায় ঐ মহিলাকেই……সে-ই মনে হয় পারফেক্ট হবে! মীরা ধীরে ধীরে বলে যায়।
রোহান চিন্তা করতেও ভয় পাচ্ছে , সুখী আন্টির খালাকে ড্যাড বিয়ে করবে?

বোন আর ছেলে যখন রাত দশটায় কথা বলছে রোহানের রুমে, আম্মা শুয়ে পড়েছেন, মীরার বাচ্চারা আগেই ঘুমিয়েছে, সাদী চুপিচুপি হেঁটে গাড়ীর চাবি নিয়ে বেরিয়ে গেল, সুখীর আবাসস্থলে। বেল বাজাতেই সুখী আইহোলে নজর দিয়ে দরজা খুলে দিল। সে আশ্চর্য হয়ে ভাবছে, কি এমন হল যে এই সময়ে সাদীর তার সাথে দেখা করতে এল। অর্পা আর খালা ঘুমিয়েছে। রাতের নির্জনতায় নিষিদ্ধ কিছু করার প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যায় সে কথা সুখীর চেয়ে ভাল আর কেউ জানে না। সাদী তাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হাতে ধরে এনে বসায় সোফায়, সে নিজেও পাশে বসে ঘনিষ্ঠভাবে।
-এত রাতে কি হল সাদী? সাদী তার হাত নিয়ে খেলা করতে করতে বলে,
-কেন? আসতে পারি না?
-তা বলিনি! কাল অফিস আছে!
-হুম! আজ তো আম্মা পাস্তা বানালো , খারাপ বানায়নি …রোহানের অবশ্য তোমারটাই বেশী পছন্দ!
-ও, এই কথা বলতে আসা হয়েছে !
তাকে ধীরে ধীরে জড়িয়ে ধরছে সাদী, সে মানা করছে না। গালে, গলায়, ঘাড়ে ছোট ছোট চিহ্ন রাখছে সোহাগের। সুখী জড়তা কাটিয়ে সাদীর ঘাড়ে মাথা রাখলো। মুখ তুলে বললো,
-আমাকে কেন খেতে ডাকলে না?
-আমি ডাকলে আসতে তুমি? সুখী জোরে শ্বাস ফেলে।
-আমি বুঝি শ্রাবন্তী! আম্মা আর তোমার বোঝাপড়াটা যে ঠিকমত হচ্ছে না সেটা না বোঝার মত বোকা না আমি! আমাকে না বললেও বুঝতে পারি!
সুখী আম্মার নাম শুনে আড়ষ্ট হয়ে গেল, সাদীর স্পর্শ থেকে সরে যেতে চাইলো। সাদী আরও জোরে নিজের সাথে চেপে ধরে রাখে শক্ত করে, তাকে সতর্ক করে দেয় ,
-যখন আমি ছেড়ে দেব, তখনই তুমি ছাড়া পাবে তার আগে না!
-তুমি এত বস মার্কা …অফিসে বস বলে কি ঘরেও বসগিরি দেখাবে?
উত্তর না দিয়ে সুখীর নরম ঠোঁট দুটো দখল করে নিল যতক্ষণ তার তৃষ্ণা না মেটে। একপর্যায়ে সম্পূর্ণ ছেড়ে দিল, সুখী সোফায় মাথা কাত করে হেলান দিয়ে বসে।
-আমরা দুজনে দুজনকে চাই … কিন্তু এভাবে কিছু হবে না সাদী! আমরা টিন এজার না! এভাবে সবাইকে লুকিয়ে রাতের বেলা এখানে আসা আম্মাও ভাল চোখে দেখবেন না!
-আমাদের বয়স ও ৮০ হয়নি! তুমি তো নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চাও …সবার আড়ালে …কোন সমস্যা হলেই সেখান থেকে পালাতে চাও …লড়াই করে জিতে নেয়ার মানসিকতা তোমার নেই!

সাদী হতাশ, ক্ষুব্ধ, বিরূপ নিজের উপর, আম্মার উপর …সুখীর প্রতি অমোঘ আকর্ষণ …রোহান… সব রাগ চেপে ছিল, সুখীর মুখে এত নীতিকথা শুনতে তার ভাল লাগে না। এখানে এসে সে স্নেহশীল বাবা আর দায়িত্বশীল পুত্রের পদবীটি থেকে অব্যাহতি চায়। আর এত লুকোছাপাও তার সইছে না। দায়িত্ব, কর্তব্য সে বোঝে, পালনও করতে চায়। যেদিন সুখী রাজী হয়েছে তাকে বিয়ে করতে সেদিন থেকেই সে সুখীকে নিজের সবচেয়ে আপন ভাবছে, তার প্রতি কর্তব্য অনুভব করে। অল্পবয়সীদের মত সবাইকে লুকিয়ে প্রেম করা তার পোষাবে না। আংটি না পরালেও সুখীকে নিজের বাগদত্তাই সে ভাবে। পারিবারিক আচার, সংস্কারগুলো মানতে হয় বলেই ইচ্ছে থাকলেও তাড়াহুড়ো করতে পারছে না।
-সাদী …দায়িত্বহীন কিছু করা আমাদের মানায় না! তাড়াহুড়োরই বা কি আছে!
-তোমার ভরসায় থাকলে আগামী বিশ বছর ধরে দশ মিনিটের জন্য আসবো এখানে! তুমি তো তাই চাও!
-এত ছেলেমীর কি আছে …আমাদের দুজনের বাচ্চা আছে …আমরা…আমি এডভেঞ্চার আর করতে চাই না!
-সবাই ফিরোজ না! ক্রুদ্ধ সাদী রাগে গরগর করতে করতে বলে।
-সবাই শীলাও না … আমিও কোন আদর্শ মেয়ে না!
-তুমি ভাবছো আমি আদর্শ মেয়ে খুঁজছি!
-তুমি …তোমার পুরো পরিবার খুঁজছে!
সুখীও আর সহ্য করে না। আম্মার সাথে সাক্ষাতের অপমানের জ্বালা ঢেলে দেয় সাদীর উপর।
সাদী কোন কথা না বলে দরজা খুলে বেরিয়ে যায়!

চলবে…

https://ochinpurexpress.com/%e0%a6%ae%e0%a6%a8%e0%a7%8b%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%a4/%e0%a6%ae%e0%a7%87%e0%a6%98%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%96%e0%a7%87%e0%a6%b2%e0%a6%be-%e0%a7%a8%e0%a7%a6/

অচিনপুর ডেস্ক/ জেড. কে. নিপা

Post navigation