মেঘের খেলা(পর্ব ২৩)

বন্যা হোসেন
অটোয়া, কানাডা।

উপন্যাস: মেঘের খেলা (পর্ব ২৩)

জীবনের প্রতি পদে পদে হিসেব মিলানো কঠিন! যখন মনে করি হিসেব মিলে গেল তখনি হিসেবটা জটিল হয়ে যায়। যখন ভাবি হিসেব মিলবেই না, তখনই হিসেবটা অনেক সহজ হয়ে যায়।

আম্মা ভেবেছিলেন স্বামী মারা যাবার পর তাঁর ছকে বাঁধা গোছানো জীবনে নিজের স্বাধীনতা বজায় রেখে চলবেন। কে জানতো, জীবন তার সাথে এমন রসিকতা করবে। সাদীর জন্য দ্বিতীয়বার পাত্রী খুঁজতে নামতে হবে বা পুনর্বিবাহের ব্যবস্থা করতে হবে!

চাটগাঁ থেকে চাচা, চাচী এলেন ডাক্তার দেখাতে, সেসময়েই সুখীর সাথে সবার দেখা সাক্ষাৎ হওয়ার একটা ব্যবস্থা করে ফেলে সাদী। এক শনিবারে সে সবাইকে নিয়ে যায় বনানীর ‘’যাত্রা বিরতি‘’ রেস্টুরেন্টে মধ্যাহ্ন ভোজনে। সুখীও যোগ দেয় তাদের সাথে অর্পাকে নিয়ে।

চাচা-চাচী আম্মাকে খুব ভাল করে চেনেন এবং যথেষ্ঠ শ্রদ্ধাও করেন…তারা বুঝেছেন আম্মা সুখীকে ভাল করে জানার জন্য যেমন কৌতুহলী অন্যদিকে ভয়ও পাচ্ছেন! এ সম্পর্ক রোহানের যদি পছন্দ না হয় তাহলে সাদীর বিয়ে করার দরকারই বা কী! পরস্পরবিরোধী বহু কিছু ভাবছেন তিনি।

চাচা-চাচীর সুখীকে ভাল লেগেছে। চাচী নরম ধাঁচের অমায়িক মানুষ। সারাজীবন তাঁর বড় জার ব্যক্তিত্বের আলোতে স্তিমিত হয়ে থাকলেও কোনদিন তাঁদের কোন সমস্যা হয়নি। নিজের ছেলের মতই সাদীকে ভালোবাসেন। ফেরার পথে গাড়িতে চাচা শুরু করেন,
-ভাবী, আমার মেয়ে খুব পছন্দ!
আম্মা মাথা নাড়েন। এবার চাচী বলেন,
-খুশীর কথা ভাবী! তুমি কেন মন ভার করে আছো? কি যেন নাম বাচ্চাটার ‘অর্পা’ নাকি? পুতুলের মত বাচ্চাটাকে দেখে তো আমার টাপুর টুপুরের কথা মনে পড়ে গেল। ওরা যখন এই বয়সী ছিল কি রকম বাকবাকুম করতো মনে আছে?

আম্মার চোখ অশ্রুসিক্ত। আজ সাদীর বাবা বেঁচে থাকলে এই কঠিন দায়িত্বভার তাঁর সাথে ভাগ করে নেয়া যেত। চাচীর কথা শুনে মনে পড়লো মীরার ছোট ছেলের হাতে ধাক্কা লেগে গ্লাসের পানি আম্মার শাড়ীতে পড়ে যায়। ছোট্ট অর্পা প্লেটের সামনে রাখা দুটো ন্যাপকিন দিয়ে একনিষ্ঠভাবে মুছে দিচ্ছিল। কেউ তাকে বলেনি এই কাজ করতে, স্বতস্ফুর্তভাবে নিজেই এগিয়ে এসেছে। আম্মার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল,
-লক্ষ্মী বাচ্চা! পুতুল একটা!
-একদম পুতুল! ভাবী মেনে নাও, রাজী হয়ে যাও! চাচা এবার বলেন।
-রোহানকে দেখেছো তোমরা? কি রকম মুখ বানিয়ে রাখে?
-দেখো ভাবী, রোহান বাচ্চা ছেলে! কি বোঝে? ভাবছে মা নেই, আরেকজন আসছে মায়ের জায়গা দখল করতে! ওর কথায় সাদী সারাজীবন বসে থাকবে? দশ বছর পরে রোহান নিজেই ঘরের বাইরে চলে যাবে, জীবনের প্রয়োজনে। ততদিন পর্যন্ত সাদী শুকনা মুখে বসে থাকবে !
চাচ একটু থেমে আবার বলেন,
-তুমি যদি চাও রোহানকে আমাদের সাথে রাখতে পার, সেটাও করা যায়!
-নাহ, তা করা যাবে না! সাদী রোহানকে ছাড়া বাঁচবে না।
–বাঁচা মরার কথা বাদ দাও। কি যেন মেয়েটার নাম ‘’শুকসারি’’… মেয়েটাকে আমার পছন্দ হয়েছে।
এতক্ষণ মীরা চুপ করে ছিল, বয়স্কদের কথা শুনে আর সম্ভব হল না তার পক্ষে চুপ থাকা।
-চাচ্চু, চাচী, কতবার করে বললাম বাচ্চাটার নাম অর্পা। আর তোমরা বলছো অল্প! চাচ্চু নিজের মত নাম ঠিক করে বসে থাক… যাকে অত পছন্দ হয়েছে তার নামটা তো বলবে ঠিক করে …ওর নাম সুখী , সুখী …শুকতারা না!
-এই দেখো চুলবুলি মেয়েটা কেমন ঝগড়া করতে এল। শুকসারি বলেছি…তুই তো নাম বদলে দিলি শুকতারা!
সবাই হাসিতে ফেটে পড়েন, আম্মাও বিমর্ষ ভাব কাটিয়ে হাসিতে যোগ দেন! চাচী আম্মাকে জিজ্ঞেস করেন ,

-মেয়েটার কে কে আছে বাড়ীতে?
-ওর বাবা-মা মারা গেছেন! এক ভাই কানাডা থাকে… আত্মীয়স্বজনের সাথে ভাল সম্পর্ক নেই!
বাসায় পৌঁছে চাচা বলেন ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে,
-ভাবী সামনে অনেকগুলি ব্যাপার আছে। পাভেল(চাচার ছেলে) কয়েক মাসের জন্য লন্ডন যাবে মে থেকে প্রায় ডিসেম্বর পর্যন্ত, মীরাও সামনের মাসে চলে যাবে মিউনিখ, রিয়ার (পাভেলের বউ) একটা ট্রেনিং শুরু হওয়ার কথা…এই তো বুঝলে… সামনের মাসের শুরুতেই বিয়ের তারিখ করা যায়!
–একেবারে সোনার বাংলা ট্রেন…এত দ্রুত ছোটার কি হল!
-ছেলের পছন্দ, আমাদের সবার পছন্দ, মেয়ের কেউ নেই… তুমিই বললে, তাহলে দেরী কিসের?
চাচা সবগুলো কারণ একের পর এক সাজিয়ে যুক্তিবাদী আম্মাকে যুক্তিতে ধরাশায়ী করে ফেলেন।
হঠাৎ চাচী বলে উঠেন,’’সুখী কি রাজী বিয়েতে?”

ফোনটা এল তখন, যখন সুখী কাপড় মেলে দিচ্ছিল ওয়াশিং মেশিন থেকে বের করে। সে এক অত্যাশ্চর্য স্বপ্নের ভুবনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, সাদীর পরিবারের সাথে গতকালের মধ্যাহ্ন ভোজনের স্মৃতি মনে করে। মুখ টিপে হাসছিল নিজের মনে।
খালার পরোপকারী সখীরা মিলে বসার ঘরে আজ আড্ডা বসিয়েছে। চা, আড্ডা আর কূটনামি চলছে হরদম। কাপড়ের বালতি নিয়ে ব্যালকনিতে যাওয়ার সময় চোখাচোখি হল। কেউ কাউকে কিছু বললো না।

সুখীর ভাবনারা আবার ফিরে যায় রেস্টুরেন্টে …সবাই এত আন্তরিক, ভদ্র আর মিশুক ! সাদী প্রকৃতই ভাগ্যবান এত সদাহাস্যজ্জ্বল পরিবারের ভাগীদার সে। হিংসে হয় সাদীকে। সহজ, সাধারণ কথাবার্তায় পরিবারের সবার প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন ফুটে ওঠে। সাদীর আম্মা সম্পর্কে তার বিচার ভুল ছিল — দেবর আর জা তাঁকে অত্যন্ত ভালোবাসেন। নিজের ছেলে আর নাতিকে নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তাই হয়তো তাঁকে কঠোর করেছে সুখীকে নির্বাচনের ব্যাপারে। অন্য যে কোন মানুষ হলেও একই কাজ করতো।
পুরো পরিবার সারাক্ষণ এ ওর পিছনে লাগছে …খুনসুটি, অট্টহাসি, কৌতুকে ভরপুর। অর্পার আর তার নিজের জন্য এমন একটি পরিবারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, হাসি-কান্নায়, ভালোবাসায় সামিল হতে পারা আকাশের চাঁদ পাওয়ার সামিল। বোঝা যায়, সাদী মাথা ঠান্ডা করে কর্মলক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা কোথা থেকে পেয়েছে।
এসব ভাবতে ভাবতেই চাচীর ফোন এল। সুখী হঠাৎ বুঝতে পারেনি কে ফোন করেছে। নিজের পরিচয় দিলেন।
-ব্যস্ত ছিলে ?
-জ্বী না, আন্টি !
-ভাবলাম। -ওর বাবা -মা মারা গেছেন ! এক ভাই কানাডা থাকে …আত্মীয়স্বজনের সাথে ভাল সম্পর্ক নেই !
বাসায় পৌঁছে চাচা বলেন ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে,
-ভাবী সামনে অনেকগুলি ব্যাপার আছে। পাভেল(চাচার ছেলে) কয়েক মাসের জন্য লন্ডন যাবে মে থেকে প্রায় ডিসেম্বর পর্যন্ত, মীরাও সামনের মাসে চলে যাবে মিউনিখ, রিয়ার (পাভেলের বউ) একটা ট্রেনিং শুরু হওয়ার কথা …এই তো বুঝলে … সামনের মাসের শুরুতেই বিয়ের তারিখ করা যায় !
–একেবারে সোনার বাংলা ট্রেন…এত দ্রুত ছোটার কি হল !
-ছেলের পছন্দ, আমাদের সবার পছন্দ, মেয়ের কেউ নেই… তুমিই বললে।…তাহলে দেরী কিসের ?
চাচা সবগুলো কারণ একের পর এক সাজিয়ে যুক্তিবাদী আম্মাকে যুক্তিতে ধরাশায়ী করে ফেলেন।
হঠাৎ চাচী বলে উঠেন,’’সুখী কি রাজী বিয়েতে”?

ফোনটা এল তখন, যখন সুখী কাপড় মেলে দিচ্ছিল ওয়াশিং মেশিন থেকে বের করে। সে এক অত্যাশ্চর্য স্বপ্নের ভুবনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, সাদীর পরিবারের সাথে গতকালের মধ্যাহ্ন ভোজনের স্মৃতি মনে করে। মুখ টিপে হাসছিল নিজের মনে।
খালার পরোপকারী সখীরা মিলে বসার ঘরে আজ আড্ডা বসিয়েছে। চা, আড্ডা আর কূটনামি চলছে হরদম। কাপড়ের বালতি নিয়ে ব্যালকনিতে যাওয়ার সময় চোখাচোখি হল । কেউ কাউকে কিছু বললো না।

সুখীর ভাবনারা আবার ফিরে যায় রেস্টুরেন্টে …সবাই এত আন্তরিক, ভদ্র আর মিশুক ! সাদী প্রকৃতই ভাগ্যবান এত সদাহাস্যজ্জ্বল পরিবারের ভাগীদার সে। হিংসে হয় সাদীকে। সহজ, সাধারণ কথাবার্তায় পরিবারের সবার প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন ফুটে ওঠে। সাদীর আম্মা সম্পর্কে তার বিচার ভুল ছিল — দেবর আর জা তাঁকে অত্যন্ত ভালোবাসেন। নিজের ছেলে আর নাতিকে নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তাই হয়তো তাঁকে কঠোর করেছে সুখীকে নির্বাচনের ব্যাপারে। অন্য যে কোন মানুষ হলেও একই কাজ করতো।
পুরো পরিবার সারাক্ষণ এ ওর পিছনে লাগছে …খুনসুটি, অট্টহাসি, কৌতুকে ভরপুর। অর্পার আর তার নিজের জন্য এমন একটি পরিবারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, হাসি-কান্নায়, ভালোবাসায় সামিল হতে পারা আকাশের চাঁদ পাওয়ার সামিল। বোঝা যায়,সাদী মাথা ঠান্ডা করে কর্মলক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা কোথা থেকে পেয়েছে।
এসব ভাবতে ভাবতেই চাচীর ফোন এল। সুখী হঠাৎ বুঝতে পারেনি কে ফোন করেছে। নিজের পরিচয় দিলেন।
-ব্যস্ত ছিলে?
-জ্বী না, আন্টি!
-ভাবলাম। কাল বেশী কথা হল না সবার মাঝে, আজ একটু কথা বলি!
-ঠিক আছে আন্টি! আমি কাপড় মেলে দিচ্ছি ব্যালকনিতে, কাল থেকে আবার অফিস। ছুটির দিন ছাড়া এগুলো করার সময় পাই না!
-এই সময় কাপড় ধুচ্ছ, বিকেল বেলা?
-জ্বী আন্টি! অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলাম!

-সাদীর ব্যাপারে তোমার মতামত কি মা? বিয়ের ব্যাপারে ভেবেছো কিছু?
চাচী ভণিতা না করে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন। অপ্রস্তুত সুখীর হাত থেকে ফোন ছিটকে পড়ে কমলা রঙের বালতিতে।
ভীরু গলায় বলে, হ্যালো !
-আমি ভাবলাম লাইন কেটে গেল… সাদীকে পছন্দ তো? আমরা বিয়ের তারিখ নিয়ে কথা বলি?
সুখী আবেগে ফিসফিস করে শুধু বলে, উম…হুম !

চাচী জানালেন, আম্মা মাহীর সাথে কথা বলতে চান। সুখীর অভিভাবক স্থানীয় কেউ উপস্থিত থাকলেই আম্মার দুশ্চিন্তা হয়তো কেটে যেত! চাচীর কথায়ও সেরকম আভাস পেল সুখী।

সাদীর সাথে ভবিষ্যত কাটানোর প্রত্যাশা নিঃসন্দেহে আনন্দদায়ক। এই আনন্দের পথ পেরোতে অনেক ছোট ছোট বাধা বিঘ্ন আসবে …তাও সত্যি। পুরো সফর হবে রোলার কোস্টার রাইডের মত। একবার উঠেছিল সে আর নাজমা …চিৎকার করতে করতে সুখী গলা ফাটিয়েছিল। পেটে অদ্ভুত অসাড় অনুভূতি, বুকের ধুকপুক, নিজের গলা থেকে বেরুনো পিলে চমকানো চিৎকারে মস্তিষ্কে রক্তের কলতান শুরু হয় আর শরীরটাকে মনে হয় নরম তুলতুলে ময়দার দলা। অসাড়, অনুভূতিশূন্য, জড় …এই উত্তেজক আস্বাদ নেয়ার অনুভূতির সাথে কোন কিছুর তুলনা হয় না।
ক্রমাগত প্রশ্নের আক্রমণে সুখী প্রায় বিধ্বস্ত, কিন্তু উত্তর যাচ্ছে না। মাহী বলেই যাচ্ছে।
-তুই একসাথে এত কথা বললি ভাই ! আমি উত্তর কি দিব ?
সুখী একটু হালকাভাবে মাহীর কৌতুহলকে নিরস্ত করতে চাইলো।
-দেখ, এখন কোন রসিকতা করবি না! ফ্যামিলির সবাই জানুক তখন বুঝবি মজা!
-কোন ফ্যামিলির কথা তুই বলিস? যারা আমাকে ত্যাগ করলো ফিরোজের বউ বাচ্চার কথা জানার পর?
–তুই আমাকে কেন বলিস নাই? বিয়ের কার্ড ছাপানোর পর জানাতি? আগের বারের মত? লজ্জা করে না তোর? আগের বারও তুই বাবা-মাকে না জানিয়ে করেছিস? এত নির্লজ্জ তুই?
-এমন কোন কাজ করিনি যে লজ্জা পেতে হবে! মনে রাখিস, আমি অর্পার মা! একা মেয়েকে বড় করছি।
-হ্যাঁ, সেজন্যই তো জুটেছে আরেকজন ছেলের বাপ!
-কেন? শুধু অবিবাহিত পুরুষেরাই বিয়ে করে? বিবাহিতরা করে না?
-কোন পুরুষ কি করে আমি জানি না! আই কেয়ার এবাউট ইউ!
-ওহ! খুব ভাল! শুনে খুশী হলাম! গত পাঁচ বছরে এটা টের পাইনি!
-কেন আমরা টেলিফোনে কথা বলি না?
-ভাই-বোনের সম্পর্ক শুধু ফোনে…
আর বলতে পারলো না সুখী কান্নার দমকে।
-তুই কি চাস আমি সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে আসবো? শুধু তোর আশেপাশে ঘোরাফেরা করার জন্য?
-নাহ! তুই তোর মতই থাক! অন্য কেউ আমার পাশে আসতে চাইলে সেটা নিয়ে তোর বলবার কিছু নেই!
-হ্যাঁ! খুব ভাল করে তো জানি তোর পাশে থাকার ব্যাপারটা! আর বলতে হবে না ! খালা? খালা কি জানে?
-না জানে না!
-কি? তোর সাথে না থাকে? এত অসম্মান করিস?
-খুব সম্মান দেখাচ্ছিস! নিয়ে যাবি তোর কাছে খালাকে?
ওপ্রান্তে গলা খাঁকারি আর কাশির শব্দ পাওয়া গেল। সুখী আবার বলে,
-না, নিশ্চয়ই!
-খালার কি হবে? খালাকে কি করবি? তুই না উনাকে নিয়ে এসেছিস? অবশ্য তোর সাথে কথা বলে লাভ কি? সারা জীবন নিজেরটা বুঝলি? নিজের বাবা-মাকে কোনদিন সম্মান করিস নাই, তুই আর খালাকে কি সম্মান করবি? আমিই বা কে তোর কাছে?
-তোর কথা না ভাবলে নাম্বার কেন দিতে গেলাম ওদের? আর খালা? খালার কথা তুই কতটুকু জানিস বা কেয়ার করিস? তাকে না জানালেই অসম্মান করা হয়ে গেল?
সুখী কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। মাহী কিছুটা শান্ত হয়।
-দ্যাখ, এই লোকটাকে তুই জানিস না …তোর বস …এও তো ম্যারেড হতে পারে! ভাল করে না জেনে আবার…
-তুই ধরেই নিলি যে আমি আবার ভুল করবো? সুখী স্খলিত কন্ঠে বলে।
-এরা কারা? কিছুই ত জানি না এদের সম্পর্কে! চাটগাঁর মানুষের সাথে আমাদের কখনোই কোন সম্পর্ক তৈরী হয়নি। তুই কিভাবে পারবি? পরের বাচ্চাও মানুষ করতে হবে!
-ভাই! তুই কি আসলে আমাকে নিয়ে ভাবিস! এত যে কথা বললি? আমি খেয়াল করেছি যখনই আমার কোন ভাল খবর দেই, তুই সহ্য করতে পারিস না! কেন?
মাহী নীরব হয়ে যায়। একটু চুপ থেকে বলে।
-তুই ভাল করে ভেবেছিস?
-তুই আমাকে সাপোর্ট করবি না? আমাদের বাবা -মা নেই, কেউ আমাদের খোঁজ নেয় না…আমরা দু’ভাইবোন কি একজন আরেকজনের জন্য খুশী হতে পারি না?
-আমার সাথে তো সবার যোগাযোগ আছে!
-তাহলে? তোর তো সব কিছু আছে! বউ , বাচ্চা, ভাল চাকরি, কানাডায় থাকিস, আত্মীয়স্বজন সবাইকে নিয়ে তোর খুশী থাকার কথা, আনন্দে থাকার কথা! তুই কেন সবসময় এত ঝগড়া করিস?

সেদিনের পর আর কথা হয়নি মাহীর সাথে। বুধবার সন্ধ্যায় অর্পাকে এসে নিয়ে গেল আদিবার মা। ও বাড়ীতে কারো জন্মদিন! খালা বসে টিভি দেখে। সুখী রান্না শেষ করে শাওয়ার নিতে ঢুকলো বাথরুমে …আবার বৃষ্টি হচ্ছে আজকে। সাবান মুখে লাগাতে লাগাতে ভাবছিল মাহীর সাথে সেদিনের কথোপকথন। মাহীকে জিজ্ঞেস করা শেষ প্রশ্নের উত্তর সে পায়নি। মাহী আর কথা বাড়ায়নি। সিংকের উপরের আয়নাতে দেখা যায় উল্টোদিকের দেয়ালে জানালার কাঁচে বৃষ্টির ঝাপটা এসে লাগছে। ঘষা কাঁচে বৃষ্টির ছোঁয়া কেমন ভৌতিক লাগে।
মাহীকে টেক্সট করেছিল আজ সকালে, জানতে চেয়েছিল যদি কিছু হয়… মানে বিয়ে সক্রান্ত… তাহলে সে আসতে পারবে কি না! উত্তর পায়নি এখনও। বিয়ে শব্দটা লিখতে পারেনি চেষ্টা করেও!
ওদিকে সাদীদের দিক থেকেও আর কোন সংবাদ নেই। সাদী ভীষণ ব্যস্ত অফিসে তা সে জানে।
রোহানকে সে আগের মতই কমিক স্ট্রিপ পাঠায় নিয়মিত। কিন্তু যেদিন রোহান তাকে জিজ্ঞেস করেছিল সাদীকে বিয়ের ব্যাপারে তারপর থেকে রোহান আর পাঠায় না।
রোহানকে উত্তর দিয়েছিল সততার সাথে, মিথ্যে না বলে। সে বলেছিল,
-রোহান আমি জানি না, আসলেই জানি না!
কিন্তু ছেলের সে উত্তর পছন্দ হয়নি। সুখী ভাবছিল, এমন যদি হত যে রোহানের পছন্দ হয়নি তার উত্তর কারণ সে চায় সুখী বিয়ে করুক তার বাবাকে! কিন্তু তা তো নয়! রোহান আরও বলেছিল,
-এরপর কি তুমি আমাদের সাথে থাকবে?
তার চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন! সুখীর নিজেকে ফাঁসীর আসামী মনে হচ্ছিল। সে বহুকষ্টে চোখে খুশীর ঝিলিক লুকিয়ে সতর্কতার সাথে বলে,
-ওরকম কিছু যদি হয়…উম…তাহলে হ্যাঁ।
রোহান অস্থির হয়ে গেল মুহূর্তেই, তার পানির গ্লাস মুখে দিয়ে ঢকঢক করে চুমুক দিল।
-ক্যান উই গো হোম নাও?
-শেষ করবে না?
-নো! সরি! মুখ তুলে ভীরু চোখে তাকালো।
-ইটস ওকে! অর্পাও এমন করে, শেষ করতে পারে না।
অর্পার কথায় হালকা হাসির ছোঁয়া দেখা গেল রোহানের মুখে। সে বললো,
-অর্পা ভুল ইংলিশ বলে!
-তুমি শেখাবে?
-ইফ ইউ ম্যারি হিম..?
-যদি না করি…শেখাবে না? সুখী আবারও সতর্ক হয়।
আর উত্তর দিল না রোহান। শব্দ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। চেয়ারে ঝুলিয়ে রাখা সুখীর কালো ব্যাগ তুলে তার হাতে ধরিয়ে দিল।
ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে নামিয়ে দিল, লিফট পর্যন্ত সাথে গেল …আর সাহস হল না উপরে গিয়ে পুরো পরিবারের সাথে দেখা করার।
হতে পারে, ওরা সবাই আশাবাদী যে সে কোন যাদুমন্ত্রবলে রোহানের সম্মতি আদায় করে নিতে পারবে।
বা, হতে পারে ওরা সবাই ভাবছে সুখী নিজেই পিছিয়ে যাবে।
সুখী নিজের আবেগকে শাসনে রাখতে গিয়ে অনেক অদ্ভুত পরিস্থিতির কথা ভাবে মনে মনে, যেন আশাহত হলে তার দুঃখ কম হয়!
বাথরুমের দরজা খুলে বের হয়ে এল, ঘর অন্ধকার …ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেল আচমকাই বেডরুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে। সুখীর নিজেকে হিন্দী সিনেমার হিরো মনে হচ্ছিল যেন সে চুপিচুপি ভিলেনের গুহাতে ঢূকেছে।তার পরনে লাল পালাজ্জো প্যান্ট আর লম্বা নাইট শার্ট, মাথায় তোয়ালে।
পেঁচানো।ঘুটঘুটে অন্ধকার লাগছে চারদিকে! বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ারে একটি টর্চ থাকে, হাতড়ে সেটি বের করে আলো জ্বেলে দেখতে গেল ওদিকে খালা কোথায়। খালা কোথাও নেই! ওহ! চলে এলো আলো আজ খুব তাড়াতাড়ি। এ কি! বাইরের দরজা খোলা কেন?
ঠিক সে মুহূর্তে সাদী এসে ঢুকলো খোলা দরজা দিয়ে।সুখী একেবারে ভুত দেখার মত চমকে উঠেছে। যেন সেই একটু আগের কল্পনার ভিলেন। দৌড়ে চলে এল বেডরুমে কিছু না বলে, দরজার পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সাদী পায়ে পায়ে এসে ঢুকলো। সুখী ফিসফিস করে বলে উঠেছে, ‘’মাগো‘’!
-মা না সাদী! সাদী বলে। সুখী হেসে ওঠে তার কথা শুনে। আরও কাছে এগিয়ে এসে তার হাত ধরে নিয়ে আসে কাছে। তাকিয়ে দেখে তাকে, ওর গলায় নাক রেখে জড়িয়ে ধরে।
-এত বৃষ্টিতে গোসল করলে ঠান্ডা লাগবে! সুখী হেসে ওঠে, সে বলে,
-বৃষ্টিতে করিনি, বাথরুমে করেছি!
সাদী তাকে মন খুলে হাসতে দিল, দেখল তাকিয়ে সুখীর প্রাণখোলা হাসি।
দুজনেই তৃষ্ণার্ত। মরুভূমিতে পানি খুঁজতে বের হয়েছে, এমন অনুভূতি হচ্ছিল কয়েকদিনের অদর্শনের পর।
-তিনদিন পর পানির সন্ধান পেলাম, আমি তো ভাবিইনি পানি পাওয়া যাবে।
সাদী নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরেছে, সুখী মুখ উঁচু করে তৃষ্ণা মিটিয়ে নিচ্ছে। টলটলে ঠান্ডা মিষ্টি পানি। মুখ ভরে পান করলো সুখী। সাদী লক্ষ্য করছে, সুখী বড্ড তাড়াহুড়ো করছে।
-দুজনের জন্যই যথেষ্ট আছে, তোমার হয়ে গেলে আমি একটু নেব। বলে সাদী।
-আমার কখনোই শেষ হবে না।
জিভে মিষ্টি কিসের স্বাদ! সুখী উঃ করে ওঠে, সাদী এত অস্থির হয়ে গেল কেন …
ওহ, মনে পড়েছে …বলেছিল ওকে পানির ভাগ দিতে।পায়ের আঙ্গুলে ভর করে সাদীর পিঠে হাত রাখলো।
-আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না, আমাকে এক চুমুক দিতেই হবে !
অতঃপর যখন তৃষ্ণা মিটে গেছে …পানি গড়িয়ে পড়ছে চিবুক থেকে গলায়, সাদী ঠোঁট দিয়ে শুষে নিচ্ছে প্রতিটি জলকণা, আজ একটুও ভয় লাগছে না ।

চলবে…

অচিনপুর ডেস্ক /এসএসববি

Post navigation