মিসটেক ( শেষ পর্ব )

আহম্মেদ ইমতিয়াজ নীল
পান্থপথ, ঢাকা।

ধারাবাহিকঃ মিসটেক ( শেষ পর্ব )

পাঁচ.

সুফিয়া বসে আছে আদিলের সামনে, আদিল খুব ভালো করে লক্ষ্য করছে সুফিয়াকে। মহিলা কালো হলেও যথেষ্ট সুন্দরী, চেহারায় বুদ্ধির ছাপ আছে।

-সুফিয়া আশাকরি আপনি আমার সব প্রশ্নের ঠিকঠাক জবাব দিবেন, যদি মিথ্যা বলেন বা কিছু গোপন করেন এর পরিণতি কিন্তু ভালো হবে না। সুফিয়া আস্তে করে মাথা নাড়ে।

-কানা মজিদকে আপনি কিভাবে চিনেন ? আদিল খুব ভালো করে লক্ষ্য রাখছে, মহিলার মুখের এক্সপ্রেশন কেমন হয়।

-এই নামে আমি কাউকে চিনিনা স্যার। মহিলার কথাগুলো অনেক শুদ্ধ উচ্চারণের,স্থানীয় টান নাই।

-মিথ্যা বলে লাভ নাই সুফিয়া, আমাদের কাছে যথেষ্ট প্রমাণ আছে, আপনি কানা মজিদের সাথে কথা বলতেন নিয়মিত, আপনার মোবাইল কল রেকর্ডস তাই বলে।

-যাকে চিনিই না, তার সাথে কথা বলার প্রশ্নই উঠে না স্যার…সুফিয়া নির্বিকার। হয় মহিলা খুব চালাক আর না হলে নির্দোষ, ট্রিকটা কাজে লাগল না, আদিল এইবার অন্য রাস্তায় গেল।

-কানা মজিদকে চিনেন না মানলাম, কিন্তু এখন বলেন, রবিউলকে চিনেন? নাকি এর সাথেও চেনা পরিচয় ছাড়াই কথা বলেছেন ?

-চিনি স্যার, সম্পর্কে আমার দেবর হয়। সুফিয়া মাথা নাড়ে।

-আপনাদের দেবর-ভাবীর সম্পর্কটা একটু বেশিই আন্তরিক ছিল তাই না?

সুফিয়া উত্তর দেয় না, মাথা নীচু করে থাকে।

-চুপ থেকে কোনো লাভ নাই সুফিয়া, আপনাদের এই সম্পর্কটা আপনাদের পালিত ছেলেটিও দেখে ফেলেছিল, তাই ও পুকুরের পানিতে পড়লে ইচ্ছাকৃতভাবেই তাকে বাঁচাননি আপনি।
-‘মিথ্যা কথা স্যার, একদম মিথ্যা কথা…আমি আমার সাধ্য মতো চেষ্টা করেছি, আর হ্যাঁ, রবিউলের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল। আর এটা আমাদের ছেলেটি দেখেও ফেলেছিল, কিন্তু এর জন্য ওকে বাঁচাব না? আমিও ওকে আমার ছেলের মতোই দেখতাম।

-এটাই সত্যি সুফিয়া, আর আপনার দেবরের সাথে আপনার মেলামেশাটা যাতে সহজ হয়, তাই শাশুড়িকেও রাস্তা থেকে সরিয়ে দিলেন।

-না স্যার, আমি মানছি শাশুড়ির সাথে আমার সম্পর্ক ভালো ছিল না, কিন্তু তাকে খুন করব কেন?

-খুন করবেন এই জন্য, যাতে আপনাদের সম্পর্কটা ফাঁস না হয়ে যায়।

-আমি সত্যিই আমার শাশুড়িকে খুন করিনি স্যার, হ্যাঁ, আমার অন্য মানুষের সাথে সম্পর্ক ছিল। কিন্তু স্যার, আমি বাধ্য হয়েছি, আপনি হয়তো জানেন আমি আমার স্বামীর তিন নম্বর বৌ, আমার স্বামী শারীরিকভাবে অক্ষম, আগের দুই বৌ চলে গেছে এই জন্য।

-আগের দুই জন চলে গেছে, আপনি যান নি কেন?
-কোথায় যাবো স্যার, কোথায় যাবো আমি? আমার তো কেউ নাই, আমার জন্ম ইন্ডিয়ার বর্ডারের কাছে একটা গ্রামে, বাবা-মা কে আমি জানি না, এক ফুফু কিছুটা বড় হলে, কুষ্টিয়ার একটা বাড়িতে কাজে দেয় আমাকে, এরপর ঢাকায় একটা বাড়িতে কাজ করতাম আমি। আমার শাশুড়ির দূরসম্পর্কের ভাই হন ওই বাড়ির কর্তা, আমার শাশুড়ি ছেলের দুই বৌ চলে যাওয়ার পর আমাকে নিয়ে আসেন বৌ করে। সুফিয়া একটু থামে দম নেয়ার জন্য, -এই বাড়িতে তো আমার তিন বেলা খাবার জুটতো স্যার, তাই চলে যাবো কেন? আর কোথায় বা যাবো?

এই জন্যই হয়তো মহিলার উচ্চারণগুলো বেশ শুদ্ধ , আদিল মনে মনে ভাবে,
-আপনি এখন যেতে পারেন সুফিয়া। কিন্তু দরকার হলে আপনাকে আবার ডাকব।

সুফিয়া বের হয়ে যেতেই ইমরান ঢুকল আদিলের রুমে, -আমাদের জন্য একটা খারাপ খবর আছে স্যার, কানা মজিদ লুকিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার সময় বর্ডার গার্ডের গুলিতে সহযোগী সহ মারা গেছে।

-ওহ নো! এখন তো এই কেসটা সলভ করা অনেক কঠিন হয়ে গেল।
-‘কানা মজিদের কাছে একটা মোবাইল পাওয়া গেছে স্যার, ওইটার কল লিস্ট দেখি, কোনো লিড মিললেও মিলতে পারে।

ছয়.

আদিল খান গোমড়া মুখে বসে আছে তার রুমে। নাজমা বেগম মার্ডার কেসে তেমন কোনো ব্রেক থ্রু মিলছে না, কানা মজিদকে জীবিত ধরা গেলে হয়তো কিছু মিলত। জীবনের প্রথম খুনের কেস, কোথাও কিছু একটা মিস করছে মনে হয়। কাগজ কলম নিয়ে সবগুলো নাম লিখল আবার-

১.নাজমা বেগম (খুন হয়েছেন)
২.আসগার মিয়া (নাজমা বেগমের স্বামী )
৩.আমিনুল মিয়া (নাজমা বেগমের বড় ছেলে)
৪.আক্কাস মিয়া (নাজমা বেগমের ছোট ছেলে, ওমান থাকে)
৫.সুফিয়া ( নাজমা বেগমের পুত্রবধূ, আমিনুলের বৌ)
৬.রবিউল (আমিনুলের চাচাতো ভাই, সুফিয়ার সাথে সম্পর্ক আছে)
৭.সায়ীদ ( আমিনুলের ব্যাবসার পার্টনার )
৮.শেফালী( নাজমা বেগমের প্রতিবেশী, ওর ধারণা আসগার মিয়ার নাতিটি কে সুফিয়া ইচ্ছা করে বাঁচান নি)
৯.শেফালীর মা
১০.কানা মজিদ আর তার সহযোগী ( বিজেপিএর গুলিতে দুইজনই নিহত)
নাটকের চরিত্র আপাতত এই গুলোই, আক্কাস মিয়াকে হয়তো বাদ দেয়া যেতে পারে। ও ওমান থাকে। কিন্তু ওমান থেকেও তো মজিদের সাথে কন্টাক সম্ভব। তবে আক্কাস ওর মাকে মারবে কেন? মোটিভটা কি? সব প্রশ্ন এই এক জায়গায় এসে শেষ হয়ে যাচ্ছে।

মোটিভ??? কি হতে পারে, কেন মারবে?

সুফিয়া আর রবিউলের কাছে মোটিভ আছে একটা, কিন্তু কোনো প্রমাণ নাই। কানা মজিদের সাথে, এদের কোনো যোগসূত্র মিলেনি। নাজমা বেগম মার্ডার কেস কি অমীমাংসিতই থেকে যাবে ?

হঠাৎ ইমরান হন্তদন্তভাবে ঢুকল আদিলের রুমে।

-স্যার কানা মজিদের মোবাইল কল রেকর্ডস এসে গেছে, চমকে দেবার মতো একটা নম্বর মিলেছে। কানা মজিদ বেশ কয়েকবার কথা বলেছে এই নম্বরের মালিকের সাথে। এই কেসের ভাইটাল ব্রেক থ্রু।

ইমরানের হাত থেকে কল রেকর্ডস এর কাগজটা ছিনিয়ে নিল আদিল।

-তুমি ঠিকই বলেছ ইমরান, নাজমা বেগম মার্ডার কেস বোধহয় সমাধান করে ফেললাম আমরা, নাটকের অমীমাংসিত রহস্য তো এখন এই নম্বরের মালিকই ফাঁস করবে

সাত.

নাজমা বেগমের বড় ছেলে আমিনুলের ব্যাবসার পার্টনার সায়ীদ বসে আছে আদিলের সামনে। সায়ীদের ঠোঁটের কোনা কেটে গেছে, চোখ- মুখ ফোলা। উঠিয়ে নিয়ে আসার পর কিছুই স্বীকার করছিল না, তাই কনস্টেবলের ডান্ডার বারি ভালোই পড়েছে পিঠে। অনেক মার খাওয়ার পর এখন মুখ খুলেছে।

-সায়ীদ সাহেব, কানা মজিদের সাথে আপনার একাধিকবার কথা হয়েছে, যেদিন নাজমা বেগম খুন হয়, ঐদিন বিকালে আপনার আর কানা মজিদের মোবাইল কল লোকেশন ছিল নাজমা বেগমের বাড়ির সামনে। আমাদের কাছে লুকিয়ে লাভ নেই কিছু।
যদি আর মার খেতে না চান, তবে সব সত্যি কথা বলবেন, নাজমা বেগমকে মারার জন্য কানা মজিদকে আপনি টাকা দিয়েছিলেন ?

-হ্যাঁ স্যার।

-কিন্তু কেন ?

-আমি সমকামী স্যার, নাজমা বেগমের বড় ছেলে আমিনুল ছিল আমার পার্টনার। আগে প্রায়ই ওই বাড়িতে থাকতাম, কিন্তু সুফিয়ার সাথে আমিনুলের বিয়ে হওয়ার পর সেটা আর সম্ভব হয় না। আমিনুলের আগের দুইটা বৌ চলে গেছে, ভেবেছিলাম সুফিয়াও চলে যাবে, কিন্তু ও ওই বাড়িতে গেড়ে বসেছে।

-হ্যাঁ, কিন্তু এর মধ্যে নাজমা বেগম আসল কেন? তাকে মারলেন কেন?

-নাজমা বেগমকে তো আমি মারতে চাইনি স্যার, আমি চেয়েছিলাম সুফিয়া কে মারতে। ওকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিলে আমাদের মেলামেশার সুবিধা হত। ওই দিন বিকালে আমি কানা মজিদকে দেখিয়েও দিয়েছিলাম সুফিয়াকে। কিন্তু কানা মজিদ মিসটেক করে ফেলেছে, বিকালে সুফিয়া নীল শাড়ি পড়েছিল। রাতে নাজমা বেগম ও নীল শাড়ি পরে ঘুমিয়েছিলেন। সুফিয়ার বদলে ও নাজমা বেগমকে মেরে ফেলে, তাই ওর সব টাকা আমি দেই নাই। এই জন্য আমাকে ফোন দিত।

-মিসটেক তো আপনি করেছেন সায়ীদ, জীবনের সবচেয়ে বড় মিসটেক। যে সম্পর্কের কথা আমি বলছেন, সেটি আমাদের সমাজে নিন্দনীয়, ধর্মেও স্বীকৃত না। আর সেই ঘৃণ্য সম্পর্কের জন্য, একটা নিরীহ মানুষের জান নিয়ে নিলেন। এখন এই মিসটেকের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে, সারাজীবন জেল এ পচে।

শেষ

অচিনপুর ডেস্ক/ জেড.কে. নিপা

Post navigation