মা

শারমিন সুলতানা চৌধুরী
নিউ ইস্কাটন, ঢাকা।

ছোটগল্প: মা

আমি কাজল। গল্প টা ঠিক আমার নয়। গল্পটা একটা অদ্ভুত গন্ধ নিয়ে। অবাক হলেন তো? কি করবো, বলুন! এই অদ্ভুত গন্ধটা যে আমাকে ছেড়ে যায় না এক মুহূর্তও!

আমার জন্ম একটা সরকারী হাসপাতালে, গন্ধটা প্রথম সেখানেই পাই। চারদিকে অনেক শব্দ, হরেক রকম অজানা গন্ধের ভীড়ে একটা অদ্ভুত গন্ধ! আমাকে সেই গন্ধের কাছে দেওয়া হয়, আমি বুঝি, এই গন্ধটা আমার আপন, একদম শুধু আমার। এটা অবশ্য আমি ন’ মাস ধরেই বুঝে গেছি।

এই গন্ধটাকে আমি ‘মা’ বলে ডাকি। তার আলাদা একটা নাম আছে, পেশা আছে। কিন্তু আমার কাছে সে শুধুই ‘মা’। আমার সেই গন্ধটা,একদম আপন তো!

আমি তখন ছোট্ট। মা কাজ শেষে ফিরেছেন, ঘেমে নেয়ে একাকার। এপ্রনটাও ময়লা বেশ। কিন্তু মা তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। চট জলদি স্নান সেরে মা ঢুকে গেলেন আমার খাবারের আয়োজন করতে।আমি খেলাম, বাবাও। এরপর বাবার চায়ের তেষ্টা, আমাদের কারো খেয়ালও নেই, মায়ের গায়ে একটা কেমন খিদে খিদে গন্ধ! আমি টের পেতাম, বলতাম না।

মা বিশ্রাম নিতেন না। নিজের গায়ের ক্লান্ত গন্ধটাকে যেন কাছে ঘেষতে দিতেন না। দিন গেলো,বছরও। আমার গন্ধটায় ভাগ বসাতে আরেক জন ছোট্ট মানুষ এলো বাসায়। কিন্তু গন্ধটা কিন্তু আমার কাছেই রয়ে গেল। মায়ের গন্ধ বুঝি ভাগ করা যায়?

মা যেন কেমন বুড়িয়ে গেলেন।চুল পেকে গেলো, চোখের কোণে কালি। সাজেন না, চাকরিতে কাজের চাপও বেশি।অসুস্থই হয়ে পড়লেন ক্লান্তি তে…

সেই ক্লান্ত গন্ধটা বাবাকে দূরে নিয়ে গেল। বাবা অন্য কোথাও হয়ত আনন্দ গন্ধটুকু খুঁজে পেলেন। আমি আসলে তখন খুশিও হয়েছিলুম একটু। এই গন্ধটা আবার আমাকে বেশি সময় ছুঁয়ে দিবে। আমি আর কাউকে খুঁজতাম না।

কিন্তু মায়ের গন্ধটা কেমন দুঃখ দুঃখ হয়ে গেলো। মা হাসেন না আর, নিজেকে আরো কাজে ডুবিয়ে দিলেন। অবসর নেই, আমাদের দিকেও মনোযোগ বাড়িয়ে দিলেন। তখন বুঝিনি, এখন বুঝি, কষ্ট ভুলতে গন্ধটা কেমন পাগল হয়ে গিয়েছিলো!

না, মা বেশিদিন আর কষ্ট পাননি। তার দায়িত্ব যেন ছিল, আমাকে দেখে রাখা। আমি বড় হয়ে গেলাম, মা চলে গেলেন।

কিন্তু কি আশ্চর্য! গন্ধটা আমায় এক মুহূর্তের জন্যও একা হতে দেয়না।

এখন আমার গায়েও একটা গন্ধ আছে, আমার মেয়ে সেটা পায়। নিশ্চয় পায়, আমি জানি।

এখন আমি চারদিকে সেই গন্ধ খুঁজি। ইট ভেংগে দিনে ১০০টাকা পাওয়া মায়ের মাঝে,কিংবা স্কুটিতে যে বাচ্চাকে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে! চা বাগানের পিঠে বাঁধা সন্তানের দিকে তাকিয়ে হাসা মায়ের মাঝে কিংবা সারা রাত নিজেকে অচেনা মানুষের কাছে বিক্রি করে যখন সকালে সন্তানের চুলে তেল লাগিয়ে দেয় মেয়ে টা…আমি গন্ধটা পাই। আমার গন্ধটা আমাকে আঁকড়ে ধরে আমি মায়ের কবরের কাছে যাই। খুব গল্প করি…

মা বলেন,
“কি রে, পিকু তোকে বুঝিয়ে দিয়েছে গন্ধটা?”
আমি হাসতে হাসতে বলি,
“হুম, মা।”

মা একটা হাসি হাসি গন্ধ নিয়ে বলেন,
“আমি থাকতে বুঝিসনি তো?”
“না, মা। একদম না”
“ভাবিস না, ও-ও বুঝবে পরে”

আমি জানি, মা। পিকুও বুঝবে।

যখন ওর গায়ের গন্ধটা, অন্য কেউ বুঝবে; সেদিন ও আমার গন্ টা বুঝে নিবে।

তখন আমি থাকি বা না-ই থাকি!

মা তো হারিয়ে যায় না কখনো,গন্ধটা যে রয়ে যায়!

অচিনপুর ডেস্ক /এসএসববি

Post navigation