সুরভী হাসনীন
উত্তর পীরেরবাগ, ঢাকা।
ভুতনগরঃ ভুবন জোড়া মায়া (পর্ব-দশ, এগারো)
পর্ব- দশ
সুলেমান প্রচন্ড বিস্ময়ে সামনে তাকিয়ে থাকে। চোখের সামনে মায়ের মতন অবয়বটাকে প্রথমে মা বলে ভুল হয়। তারপর সামলে নেয় নিজেকে। অস্পষ্ট স্বরে “আম্মা” ডাকে।
দিলারা ঘুরে তাকায়। নিজের সন্তানের চেয়ে বড় ধন দুনিয়ায় আর কিছু নাইরে দিলু -বড় হুজুর মাসুম আলীর কথাটা যেন সুলেমানকে দেখে, বড় বেশি বুকের মধ্যে বাজে। নিজের মেয়ের ঘর বাঁচাতে হুজুর সেদিন তার কাছে হয়েছিল শিশুর মত। জামাই মাছুম ঘরের কোনায় কাঁপছিল ঠকঠক।
অনেকক্ষণ পর মুখ খোলে দিলারা। সেদিন লালবাগের ওরস শরীফে যাওয়ার পর পুরো মাদ্রাসা খালি ছিল। হাজার চেষ্টা করেও দিলারা তার চুড়ান্ত সর্বনাশ ঠেকাতে পারে নাই। নাসিমা তার সই কেমন চুপসানো ছিলো অনেকদিন ধরে। দিলারাকে বিপর্যস্ত দেখার পর দুটো কিশোরী চিৎকার করে কেঁদেছিল অনেকক্ষণ।
মাছুমের হাত থেকে রেহাই পায়নি দিলারা। তারপর থেকে নিয়মিত তার কাছে নিজেকে বিকোতে হয়েছে বিনামূল্যে। আর সহ্য করতে পারেনি দিলারা। বড় হুজুরের কাছে সুযোগ পাওয়া মাত্র ছুটে এসেছিল তার কাছে। বড় হুজুর অবিশ্বাস করতে যেয়েও পারেননি। নিজের সন্তানের ঘর ভাঙনের আশংকায় হাতে ধরে অনুরোধ করেছিলেন কন্যাসম দিলারাকে। পাথর দিলারা একটা প্রস্তাব করে। তার আর মাছুমের বিয়ে দেবার জন্যে। নয়ত মহান আল্লাহর কাছে অপরাধী হয়ে থাকবে সারাজীবন।
বাতাস ছড়ানোর আগে ছড়ায় খবর। পোয়াতী মাছুমের স্ত্রী কাঁদতে কাঁদতে দিলারার দরজায় দাঁড়িয়েছিল। দিলারা নাসিমাকে জানিয়েছিল মাছুমের সাথে তার বিয়ের খবর। কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে গিয়েছিল মেয়েটা। চুপচাপ শুনছিল।
কিছুসময় পর হুজুরের ঘরে ডাক পরে দিলারার। তিরিশ হাজার নগদে পরিশোধ, দুই ভরি গহনায়, আর মাদ্রাসার লিখিত মালিকানায় দিলারার বিয়ে হয়ে যায় মাছুমের সাথে। পাথর দিলারার বাসর হয়নি সেদিন। বিয়ে শেষ হবার পর খাদিজা চিৎকার করে জানায় নাসিমা ফাঁস দিয়েছে।
ঝুলন্ত নাসিমাকে মাছুম নামায় যত ধীরে, তার থেকেও বোধহয় দ্রুততায় দিলারা বোঝে তাকে সরে যেতে হবে এখান থেকে। বড়হুজুর ডুকরে কেঁদেছিলেন সেদিন।
পর্ব – এগারো
সুলেমান বিস্ময় ঘোরে মায়ের ডাকে ফেরে। শক্ত গলায় দিলারা এই প্রথম খাদিজাকে হুকুম দেয়
-এই ঘর থেকা এখনি সরাও এগুলা। পরিষ্কার কইরা ফরাস বিছাও। আমি নামাজ পরুম।
দাঁত মুখ খিঁচিয়ে গাল দেয় লোকমান। এত দিনের জমানো কষ্টেই হয়ত সুলেমানের গায়ে অসুর শক্তি দেয়। ঘাড় ধরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকে লোকমানকে। দারোয়ান আটকানোর চেষ্টা করলে তাকেও ধাক্কায় সরায় সুলেমান। গেট খুলে বাইরে ছুড়ে মারে লোকমানকে।
নামাজ শেষে পুরো মাদ্রাসা ঘুরে বেড়ায় দিলারা। ছোটবেলার স্মৃতিরা এসে দুচোখে জমে। তারপর মুক্তো বিন্দু হয়ে টপটপ বেয়ে পরে গলদেশ বেয়ে। থেকে থেকেই অস্বস্তির চেয়ে স্বস্তি হয় বেশি। মনে হয় এই বুঝি নাসিমা হেঁটে বেড়াচ্ছে তার চারপাশ। একটা গভীর অনুভূতি দিলার মনে নাড়া দিয়ে যায়।
মাছুমের সাথে বিয়ের খবরে নাসিমা কেন আত্মহত্যা করবে?
ভাবতে ভাবতে পশ্চিম দিকের একতালা বারান্দায় কখন চলে গেছে দিলারা টের পায় না। হঠাৎ থমকে যায় দুটো শিশুর গল্পের স্বরে, কুসুম আর বেলায়েত। থেকে থেকে তাদের স্বরের সাথে আরো একটা স্বরের কথা শোনা যায়। অদ্ভুতভাবে চমকে ওঠে দিলারা।
বড় হুজুরের সাধনার সঙ্গী হয়েছে সে অনেক ছোটবেলা থেকে। বিশেষ কিছু চিহ্নের অধিকারিণী, তুলা রাশির জাতিকা, হাফেজ পিতার, অসূর্যস্পর্শী মায়ের প্রথম কণ্যা সন্তান। তার ভুল হবার কথা নয়। এ স্বর সেই জাতির, যার এক দিক অবাধ্য, আর অন্য দিকটি বেছে নিয়েছে সম্মান ও জ্ঞানার্জন।
এ স্বরটির মালিক নিতান্ত শিশু। তার এই মানব সন্তাবের সাথে সম্পর্কের উৎস দিলারা খুঁজতে ইচ্ছুক নয়। দূর থেকে এই জোড়া ভুবনের বন্ধুত্বের আলাপনে তার চোখ ভিজে আসে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বুক চিরে আসা শ্বাসের সাথে দোয়া পড়ে একমনে।
লোকমানের আজকে দিনটাই খারাপ। হুজুরের কাছে যাবার জন্য মোহাম্মাদপুরের বাসে উঠে সিটে বসতেই আকাশের চাঁদ হাতে পেলো। পাশের সিটে কম বয়সী একটা বোরখা পরা মেয়ে। খুব আস্তে আস্তে নিজের ডান হাতটা বুকের কাছে উঠিয়ে নিয়ে মেয়েটার দিকে হাত বাড়ায় লোকমান।
চমকে ওঠে মেয়েটা চকিতে তাকায় লোকমানের দিকে। ভাবলেশহীন লোকমান নিবিষ্ট মনে নিজের হাতের চাপ বাড়ায়। আহা, হুজুরের জন্যই সব খাসা জিনিষগুলো চলে যায়, তার কপালে সেই মরিয়ম। ভাবতে গিয়ে তীব্র আর্তনাদ করে লোকমান। ডান হাতের কব্জীর কাছে ধমনীটা মাঝ বরাবর ধারালো কিছুর আঘাতে কেটে গেছে ভয়ংকর ভাবে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে। সাদা পায়জামা পাঞ্জাবী ভিজে যায়। হায় হায় করে বাসের লোক জড়ো হয় তার পাশে।
লোকমান প্রাণপণে চেষ্টা করে পাশের মেয়েটাকে খোঁজার। নেই কোথাও, যেন ভোজবাজির মত অদৃশ্য হয়ে গেছে মেয়েটা। হয়ত নেমে গেছে ভিড়ের ফাঁকে। নাকি কোন মেয়েই ছিল না। সব তার ভ্রম লাগে। এত দ্রুত কোন মানুষ নামতে পারেকি?
সীমাহীন অতল অন্ধকারে তলিয়ে যেতে যেতে জ্ঞান হারায় লোকমান।
চলবে…
অচিনপুর ডেস্ক/ জেড. কে. নিপা