
সুরভী হাসনীন
উত্তর পীরেরবাগ, ঢাকা।
ভুতনগরঃ ভুবন জোড়া মায়া (পর্ব-আট ও নয়)
থেকে থেকে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে রুকসানার। জোরে কাশে। চুপ করতে গিয়ে আরো দমক ওঠে কাশির। কুসুম ও আজকাল এ ঘরে থাকছে। বড়হুজুর তাকে বিশেষ যত্নে রাখতে বলেছেন। পরীক্ষার চিন্তা করতে হবে না। পাশ করে এখানেই খাদিজা বু’র মত চাকরি করবে।সারাজীবনের ব্যবস্থা।
বই সামনে নিয়ে বসে চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে ওঠে। রুকসানা আপার জন্য কষ্ট হয়। গর্ভপাতের ঔষধের রিয়েকশন যেন কাটছে না। গত দুই দিনে হঠাৎ ই যেন বড় হয়ে গেছে কুসুম। নামাজে মন বসে না। আল্লাহর কাছে মুনাজাত করতে গেলে পাপাী মনে হয় নিজেকে।
খাদিজা স্নানঘরের দিকে ভয়ে ভয়ে আগায়। অনেকদিন আগে হাসিখুশি একটা মেয়ে নাসিমা, খিলখিল করে হাসত। খুব কথা বলত। সই ছিলো দিলারার। খাদিজা সহ্য করতে পারত না। দেখতে সুন্দর ছিলো দুই সই। সেখানে খাদিজা দেখতে একদমই ভালো না।
বড়হুজুরের জামাই, এখনকার হুজুর মাছুম ছিলো ছোট হুজুর। ছোঁক ছোঁক করত সারা দিন তাদের পেছনে। নাসিমার মৃত্যুটা স্বাভাবিক ছিলো না। গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল দিলারার যেদিন বিয়ে হল ছোট হুজুরের সাথে। অনেক টাকা দিয়ে ধামাচাপা দিলো বড়হুজুর। তাও পোস্টমর্টেম রিপোর্টে এল, তিন মাসের পোয়াতি ছিল নাসিমা। বড় হুজুর সে শোকে বিছানায় পড়লেন, আর উঠলেন না। দিলারাও কোথায় চলে গেল কেউ খোঁজ জানে না।
তবে একটা বিষয়ে খটকা লাগে। সে হলো জলজ্যান্ত সুলায়মান হুজুর। ছেলেটা এলো এক বৃহস্পতিবার। সারা রাত মাদ্রাসার বারান্দায় শুয়ে থাকল। পরের দিন শুক্রবারে বড় হুজুরের সাথে দেখা করতে গেল। হুজুরের সামনে দাঁড়ানো মাত্র হুজুর চমকে উঠেছিল। তারপর জিজ্ঞেস করল কি চায় ছেলেটা। সুলায়মান চাকরি চায়। বিনা বাক্য ব্যয়ে চাকরি হয়ে গেল ছেলেটার।
সেই নাসিমার মত কেউ হাসে চারপাশে আজকাল। সারা মাদ্রাসা দোয়া-বন্ধ করে দিয়েছিলেন বড় হুজুর নিজের মৃত্যুর দুদিন আগে। বিশ বছর ধরে ভালোই ছিলো মাদ্রাসার পরিবেশ। এখনকার হুজুর মাসুমের লালসার বলি সে নিজেও। সেই আয়েস বন্ধ ছিল এখানে। হঠাৎ করে এখানে আয়েশের এন্তেজাম শুরুর পর থেকে একের পর এক মৃত্যু মাদ্রাসার পরিবেশ বদলে দিয়েছে। পরপর তিনটা মৃত্যুতে মাছুম হুজুর নিজে বিচলিত।
বাসের দুলুনিতে হালকা তন্দ্রায় জড়িয়েছিল দিলারা। হেলপার ছেলেটা ভাংঙতি টাকা ফেরত দেয়নি। চাইতে গিয়ে মনে হলো দুই টাকা ছেলেটা রাখুক। টাকার হিসেবে জীবন চলে না। জীবন এক বিচিত্র বিষয়। কে কিসে খুশী হয়, কতটুকুতে খুশী হয়, তা জানার মালিক কেবলমাত্র উপরওয়ালা। আকাঙ্ক্ষা আর আশা-নিরাশার খেলায় মানুষ কখন হারায় তা মানুষ নিজেও জানে না। ভাবতে ভাবতে দিলারার চোখ ভিজে ওঠে। কালো ওড়নার খুটে চোখ মুছে হাঁটা শুরু করে বহু পুরাতন চির পরিচিত গন্তব্যের দিকে।
অজানা আশংকায় বাম চোখের নিচ লাফায় খাদিজার। লা ইলাহা ইল্লা আন্তা বিড়বিড় করেও রক্ষা হয় না। চাপা খিলখিল হাসিতে গোসলের জায়গা ভরে ওঠে। হিসহিসিয়ে একটা কিশোরী কন্ঠ তাকে প্রশ্ন করে অদৃশ্য লোক থেকে —
-খাদিজা, বইনরে তোর তো কুনু দিন ক্ষতি করি নাই। তয় তুই কেন মাছুম হারামজাদার লগে মিল্যা আমারে ধইরা লটকাই দিসিলি। মাছুম তরে বিয়া করব কইছিল?
অসাড় হয়ে আসতে থাকা শরীরে খাদিজা একদৃষ্টিতে সামনে তাকায়। একটা ক্ষীণ আলো তার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে কি সেই কথাই সত্যি? অপঘাতে মৃতদের আত্মা আটকে থাকে প্রতিশোধের আশায়, বদলার নেশায়?
পর্ব-নয়
রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে দিলারা গেটে ধাক্কা দেয়। দারোয়ান কেন আসছেন জিজ্ঞেস করতেই স্বভাববশত বড় হুজুর মাছুম আলীর নাম বলে ওঠে দিলারা। দারোয়ান নতুন, ভেবে নেয় এখনকার হুজুরের কাছে এসেছে।
-তিনি তো মাদ্রাসায় নাই মা জননী। সামনের শুক্কুরবারে আইব। আপনে তহন আইয়েন।
-লোকমান আছে? আমি হের কাছে যামু। দরজা খোল।
কিছুটা আদেশের সুরে বলে দিলারা। দারোয়াম দরজা খুলে দিলে ভেতরের বারান্দায় পা দেয় দিলারা। এখানে বাতাসে পঁচা গন্ধ ঘোরে। এখানে মৃতেরা জানান দেয় আগাম হুশিয়ারী। এখানে একদিন মানুষ জাতির কাছে পরাধীণ হয়েছিল যে, আজ সে পাপের ভারে মুক্ত।
আজকের বিকেলে একটা নাম না জানা পাখির ডাকে ঘুম ভেঙেছে কুসুমের। বেলায়েত একই সময়ে ঘর থেকে বেরোয়। বন্ধুটি আজ একবারো খবর নেয়নি। পাখির ডাকটা কেমন আপন লাগে।
বেলায়েতের কুসুমের সাথে দেখা হয় ছায়া ঘেরা বারান্দায়। দুটো প্রায় কাছাকাছি বয়সের কিশোর- কিশোরী যেন প্রাণ ফিরে পায়। কথায় কথায় কুসুম কাঁদে। বেলায়েতের অবিশ্বাস ঠেকে দুনিয়ার সব। মাছুম হুজুরের মত মানুষ! কেমন করে! তার ছোট মনে হাজার প্রশ্ন উঁকি দেয়। একটা সময় পাখির ডাক থামে। একলা পাখি আপন মনে ডেকে ক্লান্ত হয়ে হঠাৎ যেন উড়াল দেয় আকাশে। নিবিড় মনে দুজন কিশোর-কিশোরী কথা বলে যায় তাদের জীবনের।
বড় থালায় এক থাল ভাত, টমেটো ভর্তা, কলিজা ভুনা আর মুশুর ডালের বড়ি দিয়ে রুই মাছ রান্না করে এক খাদেমের বউ হুজুরের জন্য পাঠিয়েছিল। লোকমান বিসমিল্লাহ বলে খাওয়া শুরু করে। হুজুরের অনুপস্থিতিতে সেই মাদ্রাসার ইনচার্জ। খানা তো তারই প্রাপ্য।
সুগন্ধী লেবুর এক কোয়া চিপে ভাতের গ্রাস মুখে তুলে লোকমান। কাঁচা মরিচে কামড় দিতেই চোখের সামনে দিলারাকে দেখে। মুখ থেকে ভাত ঝুরঝুর করে ঝরে পরে। পাশে বাতাস করতে থাকা ছেলেটা হেসে দেয়।
-কুত্তার বাইচ্চা, চুপ, যা ইহান থিকা, বান্দির পোলা। খেঁকিয়ে ওঠে লোকমান।
-আহ্ , লোকমান অসময়ে আইছি। ভাত খাইতাছিলা। পোলাডার দুষ নাই। আমি ও বাইরের পোলাগো কথা শুনি নাই। ভিতরে আয়া পরছি।
লোকমান পায়জামার খুঁটে হাত মুছে উঠে দাঁড়ায়। প্রচন্ড ভয়ে অার বিস্ময়ে প্রথমেই মনে মনে দুটো গালি দেয় দিলারাকে।
-এই মাতারিডা এত্দিন পর কই থেকা আইল। কি মনে কইরা আইছে মাগীডা।
দিলারা হাসে, অনেকদিন পর প্রাণ খুলে দিলারা বেগম হাসে। সই নাসিমার কথা মনে হয়। নাসিমা যেন তার চারপাশেই আছে। দুই জগতের দুই বাসিন্দা দুই অসম বয়সী নারী, যেন টের পায় একে অন্যের আগমনীর। মৃতের বয়স বাড়ে না। কৈশোরে আটকে থাকা নাসিমা যেন পূর্ণ বয়স্ক দিলারাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে স্মৃতিঘেরা শৈশবে।
লোকমান ক্ষিপ্র হাতে পাঞ্জাবীর পকেট থেকে ফোন বের করে। মাছুম হুজুরকে এখনি জানাতে হবে। ঘাম ছুটছে লোকমানের। মাথায়, গলায়, হাতে, কানের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়া বিন্দু বিন্দু ঘামে তাকে আরও ভয়ার্ত দেখায়।
হাসি থামায় দিলারা। খুব আস্তে করে বলে,
-লোকমান, তুমি কি জানো এই মাদ্রাসার আসল মালিক আমি?
চলবে…
অচিনপুর ডেস্ক/ জেড. কে. নিপা