
তাবাসসুম নাজ
বিভাগ সম্পাদক, অচিনপুর.কম
আপনি যদি নিয়মিতভাবে হাজিরা দেন, তবে অনুপ্রেরণা দেবীর দেখা একদিন না একদিন মিলবেই। অর্থাৎ অনুপ্রেরণা এলে তবে লিখবেন এমন মনোভাব না রেখে নিয়মিতভাবে লিখে যান, একসময় না একসময় লেখা ভালো হবেই। বিখ্যাত ও স্বীকৃতি পাওয়া লেখকেরা তাই বলেছেন, তাদের দৈনন্দিন অভ্যাসেও তেমনটা দেখা যায়।

নামকরা বাচ্চাদের বই শার্লট’স ওয়েব এর লেখক ই বি হোয়াইট বিশ্বাস করেন, “একজন লেখক যদি আদর্শ পারিপার্শ্বিকতার অপেক্ষায় থাকে, তবে এক অক্ষর লিখবার আগেই তার মৃত্যু ঘটবে।” হোয়াইট লিখবার সময় কখনো গান শুনতেন না কেননা তাতে নাকি তার মনোযোগ নষ্ট হত। কিন্তু তিনি লিখতেন বাড়ির সবচাইতে গন্ডগলি জায়গায়, তার লিভিং রুমে। সেখানে সবসময় লোক চলাচল করছে, ফোন বাজছে, অন্যেরা কথা বলছে— এর মাঝেই তিনি লেখা চালিয়ে যেতেন। বাড়ির লোকেরাও তাকে পাত্তা দিত না, আস্তে কথা বলবার প্রয়োজন অনুভব করত না, তাতে হোয়াইটেরও তেমন অসুবিধা হতনা। একেবারে অতিষ্ঠ লাগলে অবশ্য মাঝেমধ্যে “দুত্তরি” বলে অন্যত্র উঠে যেতেন।

এ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস এবং ওল্ড ম্যান এন্ড দা সী এর লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে এর কথা শুনুন, “আমি যখন কোন বইয়ের কাজে হাত দেই, তখন ভোরের আলো ফোটবার সাথে সাথে লিখতে বসি, প্রতিদিন। সেসময় কেউ আমাকে বিরক্ত করে না।”

হারুকি মুরাকামির বক্তব্য, নভেল লিখবার সময় আমার রুটিনটা এরকম— ভোর ৪টায় উঠি, ৫/৬ ঘন্টা লিখি। দুপুরের দিকে আমি ১০ কিলোমিটার দৌড়াই বা ১৫০০ মিটার সাঁতার কাটি। রাত ৯টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ি। প্রতিদিন এক রুটিন, কোনো ব্যাতিক্রম নাই। রিপিটেশন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। রিপিটেশন একটা আবেশের সৃষ্টি করে, সেখান থেকে সৃজনশীলতার উৎপত্তি ঘটে।

বেস্ট সেলিং লেখক স্টিভেন কিং কি বলেন? যিনি ৪০ বছরের ক্যারিয়ারে ৫০টির বেশি বই লিখেছেন। তিনি বলেছেন,
“আমি প্রতিদিন লিখি, ৩/৪ ঘন্টা। আমার লক্ষ্য প্রতিদিন ৬ পৃষ্ঠার মত লেখা।
সকালে উঠে এক কাপ চা নিয়ে ৮টা/ ৮।৩০টার দিকে লিখতে বসে যাই। একই চেয়ারে বসি, আমার পেপারগুলি সব একভাবে সাজানো থাকে, মিউজিক চালিয়ে দেই। এরমাঝে আমি লিখতে আরম্ভ করি।”

প্রথম আফ্রিকান আমেরিকান বেস্টসেলিং লেখিকা মায়া এঞ্জেলো বলেন— ৫।৩০ এর মধ্যে উঠে পড়ি। ৬টার মধ্যে কফি নিয়ে বসি আমার স্বামীর সাথে। দুজনের কফি শেষ হলে ৬।৩০টার দিকে সে কাজে চলে যায়, আমিও আমার লেখায় বসি। ৭টা থেকে ২টা পর্যন্ত লিখা চালিয়ে যাই।

নোবেল প্রাইজ বিজয়ী জন স্টাইনবেকের মতামত,
১। ৪০০ পৃষ্ঠা লিখতে হবে সেকথা ভুলে যাও, প্রতিদিন একপাতা করে লেখ।
২। বারবার কাটাকাটি না করে যা মনে আসে তাই একাধারে লিখে যাও। পুরাটা লেখা হলে তবেই সংশোধনে বসবে। বারবার কাটাকাটি করলে লেখা এগুবে না।

আরেক নোবেল প্রাইজ বিজয়ী এলিস মুনরোর বক্তব্য, “প্রতিদিন সকালে লিখি, সপ্তাহের সাতদিনের সাতদিন। ৮টা থেকে ১১টা। আমার নির্দিষ্ট কোটা আছে, সেই সংখ্যক পাতা লিখি প্রতিদিন।?”

সাইমন ডি বভিউ, ফ্রেঞ্চ লেখিকার দৈনন্দিন সমাচার, “সকালে চা খাই, এরপর ১০টা থেকে ১টা কাজ করি। এরপর বন্ধুদের সাথে দেখা করি। বিকাল ৫টায় আবার কাজে বসে ৯টা পর্যন্ত লিখি। বিকালবেলায় নতুন করে কাজে বসতে তেমন কষ্ট হয় না।”

পুলিতজার প্রাইজ পাওয়া লেখক জন আপডাইক যে সমস্ত দিনে লেখা কলমে আটকে থাকত সেসব দিনেও লেগে থাকতেন, হাল ছাড়তেন না। ইনিও প্রতি সকালে লেখেন।

লিও টলস্টয়, যিনি ওয়ার এন্ড পীস ও এনা কারেনিনার মত অনবদ্য উপন্যাস রচনা করেছেন, তিনি বলেন, কোন ব্যাতিক্রম ছাড়াই প্রতিদিন আমাকে লিখতে হবে। যাতে রুটিনের বাইরে চলে না যাই। তার রুটিন: প্রতি সকালে দুইটা সিদ্ধ ডিম দিয়ে প্রাতঃরাশ। তারপর বিকাল ৫টা পর্যন্ত লেখা। শেষেরদিকে তিনি দুপুরের খাবার খেতে আরম্ভ করেন, ২/৩টার দিকে। সকালের নাস্তায় কথা তেমন বলতেন না, চায়ের কাপ হাতে নিয়ে স্টাডীতে অদৃশ্য হয়ে যেতেন। রাতের ডিনারের আগে তার দেখা পাওয়া যেত না। একা একা কাজ করতেন। তার স্টাডীতে কারো ঢোকবার অনুমতি ছিল না।

টম সয়ার ও হাকেলবেরী ফিনের লেখক মার্ক টয়েনের দিনলিপি এমন হত: সকালে পেটপুরে নাস্তা খাওয়া, স্টাডীতে লেখার কাজ, ৫টায় ডিনার। তার পরিবারে কেউ স্টাডীতে ঢুকে তাকে বিরক্ত করত না, তবে প্রয়োজন পড়লে ঘন্টা বাজিয়ে তাকে ডাকা হত।

এ টেল অফ টু সিটিজ ও ক্রিস্টমাস ক্যারল এর লেখক চার্লস ডিকেন্সের প্রাত্যহিক জীবন রুটিনে ঠাসা ছিল। তার ছেলে জবানীতে বলেন, শহরের কোন ক্লার্ক নিষ্ঠা ও শৃঙ্খলার দিক দিয়ে তাকে হারাতে পারবে না। এত একঘেয়ে, এত গতানুগতিক, এত সময়নিষ্ঠ, এত নিয়মিত ছিলেন তিনি। ৭টার মধ্যে উঠতেন, ৮টার মধ্যে ব্রেকফাস্ট, ৯টার মধ্যে স্টাডীতে চলে যেতেন। ২টা পর্যন্ত সেখানে থাকতেন। এরপর আমাদের সাথে লাঞ্চ করতেন ঠিকই কিন্তু একটা ঘোরের মধ্যে যেন রয়ে যেতেন। আমাদের সাথে কথা বলতেন খুব সামান্য। তারপর আবার ফিরে যেতেন। সাধারণত প্রতিদিন ২০০০ শব্দ লিখতেন। কিন্তু যখন লেখার ঝোঁক চেপে যক, তখন এর দ্বিগুণ লিখতেন। কখনো কখনো আবার কিছু লিখতেন না কিন্তু স্টাডীতে বসে থাকতেন, কাগজে আঁকিবুঁকি কাটতেন বা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতেন। দুপুরে ঠিক দুইটার সময় বেরিয়ে পড়তেন, ২/৩ ঘন্টা হেঁটে আসতেন।

সবশেষে বলি এন্থোনি ট্রলোপের কথা যিনি তার লেখক জীবনে ৪০টির বেশি বই লিখেছেন। তিনি ঘড়িধরে প্রতি ১৫ মিনিটে ২৫০ শব্দ লিখতেন। তাতে প্রতিদিন ১০ পাতা লেখা হত, বছর শেষে ৩টা নভেল।
অচিনপুর ডেস্ক / আর