প্রতিবিম্ব (পর্ব ১০)

শারমিন সুলতানা চৌধুরী
নিউ ইস্কাটন, ঢাকা।

উপন্যাস: প্রতিবিম্ব (২১তম পর্ব)

যুগ টা ডিজিটাল, তার একটা সুবিধা নেওয়া যাক। ইন্টারনেট থেকে ডাক্তারের কন্ট্যাক্ট নাম্বারটা যদি পাওয়া যায়! যদিও চান্স খুব কম, ব্যক্তিগত নাম্বার নিশ্চয় দেওয়া থাকবে না..তাও চেষ্টা আর কি!

যা ভেবেছিলাম, ওনার সহকারী ফোন ধরলেন। জানালেন, স্যার ব্যস্ত। আজ রাতেই একটা কনফারেন্সে যাচ্ছেন জোহানসবার্গ!

আমি নিরুপায়। পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর, এরপর যদি ওনাকে না পাই, এই সমস্যার সমাধান আমি কখনোই করতে পারবো না। উনি ছুটিতে থাকবেন এরপর! কি যে করি!

কিছু না ভেবেই বলে ফেললাম,
“আমি ওনার পেশেন্ট! আমার নাম অতনু”
“কি? কি বললেন?”
“আমি অতনু”
“আপনাকে তো স্যার-ই খুঁজতেসে,কই হারালেন?”
“ব্যস্ত ছিলাম। স্যারের নাম্বারটা দিবেন? জরুরি দরকার যে!”
“স্যার-ই বলে দিয়েছেন, আপনাকে নাম্বার দিতে, যদি আপনি ফোন করেন, যেন সরাসরি ওনার নাম্বার দেই”
“খুব উপকার হয় তাহলে!”

ঈশ্বরের কৃপা! একটু তো আশার আলো দেখালেন…

আমি প্রফেসর মোরশেদকে ফোন করলাম…

“হ্যালো, স্যার। আমি অতনু…”
“অতনু মানে নারকোলেপ্সির প্যাশেন্ট?”

কি বলবো, ভেবে পেলাম না, উনি মেডিক্যাল টার্ম বলছেন, নিশ্চয় অতনু এটা জানে দেখেই!

“স্যার। আপনার সাথে আমার জরুরি কথা আছে। আমি কি সন্ধ্যেতে দেখা করতে পারি?”
“আজ তো একটু তাড়াহুড়ো! তুমি এখন চলে এসো”

ডাক্তার অতনুকে তুমি করে বলেন, তার মানে বেশ পরিচিত!

“আমি একটু বাড়িতে এসছিলাম, স্যার। ঢাকায় পৌছাতে যদি দেরি হয়, তাই”
“আচ্ছা। এখন বলো, আমার আজ ছুটি তো! সময় আছে হাতে। তুমি হঠাৎ উধাও হয়ে গেলে কেন? গত দুবছর তোমাকে দেখিনি”
“স্যার। আপনাকে আমি সত্যটুকুই বলতে চাইছি। আপনি কি একটু সময় নিয়ে শুনবেন?”
“হুম, বলো।”
“আমি অতনু নই।”
“মানে? তাহলে মিথ্যে বললেন কেন?”
“স্যার, আমি অয়ন। আমি পুরোটাই অতনুর মতো দেখতে, আমি অতনুর বাসাতেই থাকি। আমি নিশ্চিত নই, কিন্তু যতটুকু মনে হচ্ছে, আমি আয়নার ওপার থেকে এসছি”
“ওহ! তোমার সেই আয়না! আবারও সেই একই কথা বলছো তুমি,অতনু”
“মানে?”
“এর আগেও এসব বলেছিলে! তোমার অস্তিত্ব পরাবাস্তব জগতে, তুমি এখানকার নও।কিংবা তুমি দু লজগতেরই, তোমার সেই ক্ষমতা রয়েছে!”
“স্যার, আমি অয়ন, সত্যিই বলছি”
“তোমাকে আমি খুঁজেছি অনেক। তুমি খুব ব্রিলিয়ান্ট একজন মানুষ, অতনু! তবে তোমার এমনেশিয়া হচ্ছে, স্মৃতি হারাচ্ছো। আবারও কি নিজের ইচ্ছেমতো ওষুধ খাচ্ছো?”

“স্যার। আমি দেখা হলে সব বলবো। আপনি কি আমাকে একটু বলবেন, অতনুর কি হয়েছিলো?”

“আবারও শুনবে? তোমার তো এই সমস্যাটা বেড়েছে তাহলে। ”
“জ্বী। তাও বলুন, স্যার।”

“তোমার এক্সিডেন্টটায় সিভিয়ার হেড ইনজুরি ছিলো। ইনজুরি এক্সটেনসিভ ছিলো। ফ্রন্টাল রিজিওন আর প্যারাইটালে বেশি। মানে, ব্রেইনের সামনের দিকটায়। তোমার মধ্যে এক ধরনের পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার গ্রো করে। তুমি আমার কাছে এসেছিলে, তোমার ঘুমের নিয়মটা ছিলো উল্টে। এটাকে আমরা স্লিপ ডিপ্রাইভেশন ডিজঅর্ডার অথবা নারকোলেপ্সি বলি। আমি ধরে নেই, তোমার ইনজুরির জন্যই এটা হয়েছে, তুমি রাতে ঘুমাতে পারতে না, আর দিনে হঠাৎ করে ঘুমিয়ে পড়তে। আমি তোমাকে মোডাফিনিল প্রেসক্রাইব করি। তুমি অনেক বুদ্ধিমান, তাই আমাকে নানারকম প্রশ্ন করতে। আমিও মজা পেতাম,কারণ, তোমার আইকিউ সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বেশি উপরে।”
এ যেন গল্প শুনছি আমি…

জিজ্ঞেস করলাম, “তারপর?”
“খুব গল্প শুনছো, মনে হচ্ছে। শোনো, আমি ফিরবো ইউরোপ ট্যুর দিয়ে, অনেক দিনের জমানো ছুটি কাজে লাগাই। তুমি এক মাস পর আমাকে পাবে, আবার।”
“স্যার,এই ওষুধটার জন্য এমন হলো?”
“নাহ। মোডাফিনিল এর রিএকশন এমন নয়। তুমি জানতে চেয়েছিলে, নারকোলেপ্সির জন্য আর কি কি ওষুধ আছে? আমি এমফেটামিনের নাম বলেছিলাম। কিন্তু এখন এটা অনেক দেশেই নিষিদ্ধ। এটা ব্রেইনকে উত্তেজিত করে, তোমাকে সাময়িক আনন্দে রাখে, হাইপারএক্টিভ করে ব্রেইনকে। সমস্যা হলো, ওভারডোজে সাইকোসিস ডেভেলপ করে। আমার মনে হয়, তাই হয়েছিলো”
“কিন্তু আয়নার ব্যাপারটা?”
“তোমার বাসার আয়না নিয়েই বলতে। এমনিতে সারা রাত ঘুম হতো না তোমার। আয়নাটা নিয়েই পড়ে থাকতে তো! তবে তোমার একটা ক্ষমতা আছে, ম্যাজিশিয়ানদের মতো। তুমি যা দেখাতে চাও মানুষকে,তাই দেখাতে পারো। ”
“বুঝিনি স্যার”
“সেবার তোমার কাউন্সেলিং এর সময় কি যেন নিয়ে তোমার মতের সাথে মিল হয়নি আমার। তুমি আমার টেবিলে কুমীর নিয়ে আসলে, মানে আমাকে তাই দেখালে। আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম, হা হা হা। এখনো পারো? ”

“স্যার,আমি সত্যি বলছি। আমি অয়ন। অতনু আসলেই অনেক ক্ষমতা রাখে”
“সবকিছুরই ব্যাখ্যা হয়”
“স্যার, আপনি হয়তো জানেন না, ও ওর বাবা-মা-বোনকেও মেরে ফেলেছে”
“এটা ও আমাকে বলে ফেলেছিলো। আমরা অনেক সময় অবচেতন মনের কথা জানতে কিছু সেশন করি। তখন ও বলেছিলো। আমি ধরে নিয়েছিলাম, সেটা ইনজুরির জন্য ওর মেমোরি লস হয়েছে, আর হয়তো হ্যালুসিনেশনও হয়! আর দেখো তোমার ক্ষমতা, আমি ধরেই নিয়েছি, তুমি অতনু নও। গুড শট”
“স্যার,আর কি কি বলেছে অতনু?”
“আরে, সব কি মুখস্থ নাকি? দাঁড়াও দাঁড়াও, আমাদের ওই কনভারসেশন রেকর্ড করা আছে তো। আমার ল্যাপটপে। ছেলে কেমন আছে?”
“স্যার, আমি আসছি আপনার বাসায়। আমার রেকর্ডিং গুলো দরকার। অর্ক কে বাঁচাতে”
“কেন? কি হয়েছে?”
“স্যার, আমি ৬টার মধ্যে আপনার বাসায় আসছি। প্লিজ, ঠিকানাটা দিবেন?”
“আচ্ছা, দিচ্ছি মেসেজে, আসো তাড়াতাড়ি। আমার ফ্লাইট বারোটায়। ফ্যামিলি গেছে উত্তরা, বাচ্চাদের নানার বাড়িতে। আমিও বের হয়ে যাবো তোমার সাথে দেখা করে”

ঢাকায় পৌছে যেন উদ্ভ্রান্ত হয়ে গেলাম আমি। সময় আছে এক ঘন্টা। কিভাবে পৌঁছাবো?

ঠিক ছয়টায় প্রফেসর মোরশেদের বাসায় ঢুকলাম আমি। চারদিকে অন্ধকার, উপরে একটা রুমে লাইট জ্বলছে। স্বাভাবিক, এক মাসের জন্য দেশের বাইরে যাচ্ছেন, আরেকটু দেরি হলে পেতামই তো না।

আলোর উৎস লক্ষ্য করে দোতলায় উঠে এলাম আমি। স্টাডিরুম! অনেক বই, সাইক্রিয়াট্রির। কিন্তু প্রফেসর কোথায়?

বিশাল এক আয়না ওনার টেবিলের পাশে কে রেখেছে, কে জানে?

তাড়াহুড়ো করে এগোতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম।

আমার পাশে পড়ে আছেন প্রফেসর মোরশেদ।

শরীরের অর্ধেক টা আয়নার ওপাশে…

আমি আয়নার দিকে তাকালাম। ওপাশে ল্যাপটপ টা দেখা যাচ্ছে…

অতনু তুলে নিলো ল্যাপটপ টা…

আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো…

লাইটার টা বের করে আগুন ধরিয়ে দিলো ল্যাপটপে…

“তোমার চেয়ে এগিয়ে অনেক আমি। ভুলে যাও কেন তুমি একটা প্রতিবিম্ব মাত্র!”

অট্টহাসিতে চারদিকের নিঃস্তব্ধতা যেন হারিয়ে ফেললো নিজেকে!

আর আমি?

প্রতিবিম্ব! কিই বা করতে পারি!

#প্রতিবিম্ব: পর্ব ২২:

আমার আর কোন উপায়ই রইল না। আমি জানতেও পারব না, অতনুকে হারিয়ে দেবার উপায়। আমি অর্ককে বাঁচাতে পারব না। প্রেমাকেও ফিরিয়ে আনতে পারব না। আর নিজের পরিচয়টুকু? আমি তা নিয়ে ভাবছিই না, নাহয় পরিচয় ছাড়াই বাঁচলাম, তাও অর্ক বেঁচে থাকুক! প্রেমা ফিরে আসুক!

পুলিশ এসছে। আমিই খবর দিয়েছি। আরো বিপদে পড়লাম, আমাকে নানা প্রশ্ন, অথচ আমি কে, আমি তাইই বলতে পারছি না। নিজেকে অয়ন মূখার্জী বলতে গেলে আমাকে পাসপোর্ট, ভিসা দেখাতে হবে! আমার আয়নার ব্যাখ্যা বুঝি আইনের লোকরা শুনবেন? তাই আপাতত আমি অতনুই!

এতটা নৃশংসভাবে মেরে ফেললো ডাক্তারকে। ওর চিকিৎসা করতেন ভদ্রলোক। কি যত্ন নিয়েই না দেখেছেন অতনুকে। অবশ্য অতনু যেখানে নিজের বাবা-মা-বোনকেই মেরে ফেলেছে, কিংবা অর্ককে হত্যা করতে চাইছে, সেখানে ইনি তো কেউই নন!

পুলিশ জানাল আমার শহর ত্যাগ করা আপাতত নিষেধ। আমি মনে মনে হাসলাম। আমি এই শহরের কেউ নই, এটা কেউ জানে না। আমিও জানি কি?

এখন আমার গন্তব্য কোথায়? খুব ইচ্ছে করছে, একটু জিরিয়ে নেই। প্রেমার সাথে কথা বলি। আচ্ছা, ও কি জানে, আমি হেরে যাচ্ছি?

ইচ্ছে করছে আয়নাটার কাছে গিয়ে একটু বসি, যদি প্রেমা আসে। না, এখন সেই সময় নেই। অর্ককে দেখি না আজ কদিন হয়ে গেলো। যদি অতনু ওর কোন ক্ষতি করে থাকে! নাহ, মনে হয় না, তাহলে অতনু আমার পিছনে পড়ে থাকত না। আমি অর্কের কাছে যাবো।

শামা খেলছিলো অর্ক আর অভ্রের সাথে। ভালোই হয়েছে অভ্র -অর্ক সমবয়সী হওয়াতে, অর্ক ঝামেলা করেনি খুব একটা।

আমাকে দেখে শামা হাসলো আহারে, ও যদি জানতো, ওর রূপ ধরে আরেকটা শামা কি সব করেছে!

আমাকে দেখে এগিয়ে এলো অর্ক।

“বাবা, কেমন আছো? কোথায় ছিলে?”
“এই তো রে, বাসাতেই। কাজ অনেক ছিলো অফিসে, তাই আসতে পারিনি।”
“তুমি গ্রামে গিয়েছিলে?” সরাসরি তাকালো অর্ক,
“নাহ! তুই তো জানিস, আমি অলস একটু। অফিস থেকে এসে ঘুমিয়েছি”
“তুমি অলস, অতনু নয়”

আমি অবাক হয়ে তাকালাম অর্কের দিকে। কি বলছে অর্ক?

“তুমি অতনুদের বাড়ি গিয়েছিলে?”
“তুই কিভাবে জানিস?”
“আমি দেখেছি।”
“মানে?”
“আমি দেখতে পাই, সব। দূর থেকেও।”
“কি দেখতে পাস তুই?”
“সব! অতনুকেও, মাকেও”
“তুই প্রেমাকে দেখিস?”
“হুম, আমি আয়নার ওপারে দেখি”
“আর ওই যে প্রেমার মতো আসে আরেকজন?”
“ওটা অতনু”
“তুই জানিস?”
“হুম, ও দেখায় আর তুমি দেখ”
“তুই কিভাবে বুঝলি?”
“আমি আমার মতো করে দেখি তাই। ওর ইচ্ছেমতো আমি দেখবো কেন?”
“ও তোর বাবা। তুই নাম ধরে ডাকিস কেন?”
“ও মাকে নিয়ে গেছে তাই”
“তুই দেখেছিস?”
“না। আমি জানি, ও জানে সেটা”
“তুই সাবধানে থাক। ও তোর ক্ষতি করতে পারে”
“ও চেষ্টা করেছে। পারেনি, পারবেও না”
“কেন?”

হাসলো অর্ক। একটা শিশুর দুষ্টুমি তে ভরা হাসি।

“তুমি জানো, আমি সামনে থাকলে ও আয়না থেকে বের হতে পারে না। এই জগতে ও আমাকে কিছুই করতে পারবে না। এজন্যই মাকে মারে, যেন মা আমাকে ওই জগতে নিয়ে যায়।”
“কিন্তু তোকে মেরে ওর কি লাভ?”
“এই যে, আমি থাকলে ও এই জগতে আসতে পারছে না। তোমাকেও পাঠিয়েছে এই জন্য। কিন্তু তুমি এসে দেখ, আমার বাবা হয়ে গেলে।

জানো, আমার একটা বাবা দরকার ছিলো”

আমি জড়িয়ে ধরলাম অর্ককে।

“আমি তোর কোন ক্ষতি হতে দিব না।”
“কিভাবে? অতনু তোমার চেয়ে অনেক শক্তিশালী ”
“কিভাবে ওকে হারিয়ে দেওয়া যায়?”

মনে পড়ে গেলো অতনুর মায়ের কথা। বলেছিলেন, শুধু অর্ক জানে, কিভাবে অতনুকে হারিয়ে দিতে হবে।
“অর্ক, কি করি বলতো? কিভাবে জিতে যাবো আমরা?”

“অতনুকে এই জগতে ফিরতে দেওয়া যাবে না” দৃঢ় কন্ঠে বললো অর্ক।

“কিভাবে আটকে রাখবো অতনুকে? তোকে কিভাবে বাঁচাবো আমি?”

খিলখিল করে হাসলো অর্ক।

“বাবা! তুমি বোকা…আমি বাঁচাবো তোমাকে!”

চলবে…

https://ochinpurexpress.com/%e0%a6%ae%e0%a6%a8%e0%a7%8b%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%a4/%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%ae%e0%a7%8d%e0%a6%ac-%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ac-%e0%a6%a8%e0%a7%9f/

অচিনপুর ডেস্ক /এসএসববি

Post navigation