পর্ব-৬: জানা-অজানায় ‘তাজমহল’

আরিফুর রহমান

সম্পাদক, অচিনপুর.কম

শাহজাহানের রাজত্বকালকে ঐতিহাসিকগণ মুঘল যুগের স্বর্ণযুগ বলে অভিহিত করেছেন। অদৃষ্টের নির্মম পরিহাসে তাঁর রাজত্বকালের শেষের দিকে তার সন্তানদের মাঝে উত্তরাধিকার বিষয়ক দন্দ্ব মুঘল তথা সমগ্র মুসলিম ভারতের ইতিহাসে একটি কলংকময় ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। এ কারণে সম্রাট শাহজাহানের শেষ জীবন হয়ে উঠেছিল হৃদয়বিদারক ও মর্মান্তিক। চলুন তাহলে জেনে আসি, কি ঘটেছিল তখন?

১৬৫৭ খ্রস্টাব্দে শাহজাহান গুরুতর পীড়ায় অসুস্থ হলে এক পর্যায়ে গুজব রটে যে, সম্রাট শাহজাহান জীবিত নেই। অবশ্য পরে তিনি জীবিত আছেন জানা গেলেও, তাঁর পুত্রগণের মধ্যে সিংহাসনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। মুঘল সিংহাসন লাভের সুষ্ঠু উত্তরাধিকারী নীতির অভাবেই শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে সংঘটিত গৃহযুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল। বাবর, হুমায়ন, আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান সকলেই প্রতিদ্বন্দ্বী আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সংঘটিত সংঘর্ষে জয়লাভ করে সিংহাসন লাভ করেছিলেন। সম্রাট শাহজাহান তার পিতা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন, জাহাঙ্গীর করেছিলেন তার পিতা আকবরের বিরুদ্ধে। কাজেই উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব শাহজাহানের পুত্রগণের মধ্যে সংঘটিত হওয়া ছিলো অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা মাত্র।

মমতাজ মহলের ছিল ৪ পুত্র:

সর্বজ্যেষ্ঠ পুত্র দারা শিকোহ ইসলাম ও হিন্দুত্ববাদের মধ্যে মিল থাকা রহস্যময় ভাষা খুঁজতে অনেক শ্রম দেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ৫০ উপনিষদ ১৬৫৭ সালে সংস্কৃত থেকে পার্সিয়ান এ অনুবাদ করেন, যাতে মুসলিম বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় পড়তে পারে। তার অনুবাদকে শিক-ই আকবর (The greatest mystery) বলা হয়। দারা শিকোহ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত পাঠাগারটি গুরু গোবিন্দ সিং ইন্দ্রপ্রস্থ ইউনিভার্সিটি, কাশ্মীরি গেট, দিল্লী, এর ভূমিতে এখনো আছে, আর এখন ভারতীয় পুরাতত্ব বিভাগ কর্তৃক জাদুঘর হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে সংস্কারের পরে।

দ্বিতীয় পুত্র সুজা ছিলেন বাংলার শাসনকর্তা। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন রাজনীতিবিদ ও যোদ্ধা হলেও বাংলার আবহাওয়া তাকে আয়েশী, দুর্বল ও স্থবির করেছিল। উত্তরাধিকার সংগ্রামে শাহ সুজা ছিলেন আওরঙ্গজেবের শেষ প্রতিদ্বন্দ্বী। 

তৃতীয় পুত্র আওরঙ্গজেব ছিলেন সর্বাপেক্ষা অধিক শক্তিশালী ও প্রতিভাসম্পন্ন। তাঁর নিষ্কলুস চরিত্র ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের অকুণ্ঠ সমর্থন লাভে সহায়তা করেছিল। তিনি বিদ‘আত ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। নিজে গান-বাজনায় দক্ষ হওয়া সত্ত্বেও তা শোনা ত্যাগ করেন। পৌত্তলিক ও বিদ‘আতী উৎসবাদি বাতিল করেন। রহিত করেন শির নত করা এবং মাটিতে চুমু খাওয়া। যা পূর্বতন রাজন্যবর্গের জন্য করা হত। বিপরীতে তিনি ইসলামী সম্ভাষণ-বাক্য তথা ‘আসসালামু ‘আলাইকুম’-এর মাধ্যমে অভিবাদন জানানোর নির্দেশ দেন। 

চতুর্থ পুত্র মুরাদ ছিলেন গুজরাটের শাসনকর্তা। অত্যধিক ভোগবিলাসী ও মদের প্রতি আসক্ত হওয়ায় তিনি আওরঙ্গজেবের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছিলেন।

শাহজাহানের দারার প্রতি অন্ধ স্নেহ ও পক্ষপতিত্ব এ দ্বন্দ্বের অন্যতম কারণ ছিল। দারা নামে মাত্র পাঞ্জাবের শাসনকর্তা থাকলেও তিনি আগ্রায় অবস্থান করে রাজকর্মে পিতাকে সাহায্য করতেন। শাহজাহান সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করেও স্বহস্তে রাজ্যভার গ্রহণ না করে দারাকে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করার মানসে আওরঙ্গজেবকে দাক্ষিণাত্যের সুবাদার থেকে বঞ্চিত করেন এবং বিজাপুর ও গোলকুন্ডা বিজয় করার সুযোগ থেকেই বঞ্চিত করেন। শাহজাহানের অসুস্থতার সুযোগে দারা সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করে ভ্রাতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তিনি আওরঙ্গজেবের অধীনস্থ সকল সুযোগ্য সেনাপতিকে রাজধানীতে ডেকে পাঠান। আওরঙ্গজেবের পুত্রের সাথে সুজার কন্যার বিবাহতেও, দারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সর্বাপেক্ষা যোগ্যতম ভ্রাতা আওরঙ্গজেবের প্রতি ঈর্ষাপরায়ন হয়ে দারা শাহজাহানের কর্ণ বিষাক্ত ও মন ভরাক্রান্ত করে তোলেন। ফলে সম্রাট পুত্রদের পরস্পরের প্রতি উস্কানিমূলক পত্র প্রেরণ করে পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তোলেন।

১৬৫৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সর্বপ্রথম বাংলার শাসনকর্তা সুজা স্বাধীনতা ঘোষণা করে নিজ নামে খুৎবা ও মুদ্রাঙ্কন করে সসৈন্য আগ্রা দখল করতে অগ্রসর হন। ১৬৫৭ সালের ডিসেম্বর মাসে মুরাদও নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করেন। সুচতুর আওরঙ্গজেব এসময় কোনো পদক্ষেপ গ্রহন না করে সুযোগের প্রতীক্ষায় থাকেন। যা হোক, ১৬৫৮ সালে বাহাদুর গড়ের যুদ্ধে সুজা দারা কর্তৃক প্রেরিত বাহিনী দ্বারা পরাজিত হয়ে বাংলায় পলায়ন করেন। এ অবস্থায় আওরঙ্গজেব বুরহানপুর থেকে সসৈন্য যাত্রা করে উজ্জয়নীর নিকট মুরাদের সাথে বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। এ দুঃসংবাদে ক্ষিপ্ত হয়ে দারা তাদের বিরুদ্ধে ৫০ হাজার সৈন্য নিয়ে স্বয়ং অগ্রসর হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সামুগড়ের যুদ্ধে দারা সম্পূর্ণ পরাজিত হন। এরপর আওরঙ্গজেব সরাসরি অগ্রসর হয়ে রাজধানী আগ্রা অধিকার করে পিতাকে আগ্রার দুর্গে নজরবন্দী রেখে স্বহস্তে শাসনভার গ্রহণ করেন।

শাহজাহানকে তাঁর জীবনের শেষ ৮ বছর আগ্রার দুর্গে গৃহবন্দি হয়ে থেকেই কাটাতে হয়। এখান থেকেই সম্রাট শাহজাহান অপলক চোখে তাকিয়ে থাকতেন তাজমহলের দিকে । এখানেই তার মৃত্যু হয়। স্ত্রী মমতাজের পাশে তাজমহলেই শাহজাহানকে সমাধিত করা হয়।

সমাপ্ত

Post navigation