তাজমহল সম্পর্কে সাংঘাতিক বক্তব্য দেন, উত্তর প্রদেশের বিজেপি (ভারতীয় জনতা পার্টি) বিধায়ক সঙ্গীত সোম। তিনি বলেন, ‘তাজমহল ভারতীয় সংস্কৃতিতে কলঙ্কের চিহ্ন।’ তাজমহলের নাম বদলে ‘তেজো মহল’ করার দাবিও তুলেছেন বিজেপি সাংসদ তথা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা বিনয় কাটিয়ার। তার দাবি, ‘মন্দির ভেঙেই তাজমহল বানানো হয়েছিল।’ তিনি আরো বলেছেন “বিশ্বাসঘাতকরা’ এই তাজমহল তৈরি করেছে”। তার দাবি জয়পুরের রাজার জমি জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে সেই জায়গায় তৈরি হয়েছিল তাজমহল। কয়েকটি গোষ্ঠি তাজমহলকে শিব-মন্দির বলেও দাবি করে আসছিল। সম্প্রতি উত্তর প্রদেশের সরকারি পর্যটন সূচি থেকে তাজমহলকে বাদ দেয়া হয়েছে।
তাজমহলের ইতিহাস নতুন করে লেখার দাবিও জানিয়েছিলেন তিনি। আর ভিনয় কাটিয়ারই যে প্রথম জানিয়েছেন তা নয়। এর আগে ডানপন্থী ইতিহাসবিদ পিএন ওক ১৯৮৯ সালে প্রকাশ করা ‘তাজমহল: দ্য ট্রু স্টোরি’ বইতে এই সৌধকে ‘তেজো মহল’ বলে দাবি করেন। বইতে তিনি যুক্তি দিয়েছেন যে এটি ছিল আদতে একটি হিন্দু মন্দির এবং একজন রাজপুত শাসক এটি তৈরি করেন। সম্রাট শাহজাহান এটি দখল করে সেটিকে পরে তাজমহল নাম দিয়েছেন। ওকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা লেখক সচ্চিনানন্দ শেভডে বলেন, সরকারের উচিত ‘প্রকৃত সত্য’ উন্মোচনের জন্য একটি দল নিয়োগ করা। তাজমহল কোনো মুসলিম স্থাপত্য নয়। এটি আসলে একটি হিন্দু স্থাপত্য।
মিস্টার কাটিয়ার ও মিস্টার শেভডে উভয়েই যুক্তি দিয়েছেন যে তাজমহলের স্থাপত্যে অনেক হিন্দু স্থাপত্যের ছাপ রয়েছে। তাদের মতে, তাজমহলের শীর্ষে একটি অর্ধাকৃতি চাঁদ আছে। ইসলামিক স্থাপত্যে এই চাঁদটি সাধারণত বাঁকা থাকে। কিন্তু তাজমহলের চাঁদ বাঁকা নয়। এই চাঁদ আসলে হিন্দু দেবতা শিবের সঙ্গে সম্পর্কিত। এছাড়া এই সৌধ চূড়ায় একটি কলসও আছে। সেখানে আমের পাতা ও উল্টে রাখা নারকেলও আছে। এগুলো হিন্দু প্রতীক। ইসলামী সংস্কৃতিতে ফুল, পশুর প্রতিকৃতি নিষিদ্ধ। কিন্তু তারপরও তাজমহলে এসব ব্যবহার করা হয়েছে।
কিন্তু ভিনয়ের এই দাবির পক্ষে বিশ্বাসযোগ্য কোনো প্রমাণ নেই। বরঞ্চ ইতিহাসবিদদের বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, এমনকি ভারত সরকার পর্যন্ত মনে করেন, এই সৌধ ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্যের এক চমৎকার নিদর্শন। ভারতের সরকারিভাবে সংরক্ষিত ইতিহাস অনুযায়ী, মোগল সম্রাট শাহজাহান তাজমহল তৈরি করেছিলেন তার মৃত স্ত্রী মমতাজ মহলের স্মরণে।
ভারতের মোগল শাসকেরা এসেছিল মধ্য এশিয়া থেকে। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে তারা ভারত শাসন করে। মোগল শাসনামলে দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতবর্ষ জুড়ে ইসলামি শিল্পকলা ও সংস্কৃতির প্রসার ঘটে। শিল্পকলা ও স্থাপত্যের ব্যাপারে মোগলদের যে অনুরাগ, তার সবচেয়ে বড় নিদর্শন বলে গণ্য করা হয় তাজমহলকে। ভারতের প্রত্নতত্ত জরিপ বিভাগ তাজমহলকে বর্ণনা করেছে ‘মোগল স্থাপত্যকলার চূড়ান্ত নিদর্শন’ হিসেবে।
তাজমহল নিয়ে ভারত সরকারের যে ওয়েবসাইট আছে, তাতে বলা হচ্ছে, ‘ইসলামি স্থাপত্যকলার সঙ্গে ভারতের স্থানীয় স্থাপত্যকলার সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা সে সময়ের স্থাপত্যরীতির সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ এটি’।
ওদিকে ভারতের আগ্রায় একটি কট্টরপন্থী হিন্দু সংগঠন ‘রাষ্ট্রীয় বজরং দল’ নামে ওই দলের মহিলা নেত্রীরা তাজমহলের ভেতরে ঢুকে পূজা ও আরতি করেছেন, এমন কি তাজমহলের ভেতরের মসজিদে পবিত্র গঙ্গাজল ছিটিয়ে তারা সেটিকে শুদ্ধ করেছেন বলেও দাবি জানিয়েছেন। মীনা দিবাকর আরও বলেছেন, “পূজা আর আরতি করে আমরা আমাদের মন্দিরকে শুদ্ধ করেছি। আর আমরা যা করেছি তার পুরোটাই শান্তিপূর্ণভাবে – এখন কর্তৃপক্ষ কোনও ব্যবস্থা নিতে চাইলে আমরা তার মুখোমুখি হতেও তৈরি আছি।” প্রসঙ্গত, তাজমহল আসলে একটি শিবমন্দির ছিল বলে যারা দাবি করেন তাদের অনেকেই সেটিতে ‘তেজো মহল’ নামে অভিহিত করে থাকেন।
তাজমহলের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান, আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া (এ এস আই) বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলেছে, “জুম্মার দিন (শুক্রবার) ছাড়া অন্য কোনও দিনে ওই প্রাঙ্গণে নামাজ পড়া যাবে না।”
আগ্রার প্রভাবশালী মুসলিম ধর্মীয় নেতা মুফতি মুকাররম এ প্রসংঙ্গে বলেন, “আমি জানি না তাজমহলের ভেতরে ঠিক কি ঘটছে। কিন্তু এটুকু জানি, ওই মসজিদে নামাজ পড়া বন্ধ করে দেওয়ার কোনও এখতিয়ার আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের নেই! আগ্রার মুসলিমরা আবহমান কাল থেকে তাজমহলে নামাজ পড়ে আসছেন, কোনও দিন কোনও গণ্ডগোল হয়নি। মসজিদতো বানানোই হয়েছে নামাজ পড়ার জন্য, আর সেটা আমাদের সাংবিধানিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে!”
এবার তাজমহলে যে মন্দির ছিল না সে প্রসংঙ্গে জেনে আসি। ইতিহাসবিদ রানা সাফভি বলেন, “তাজমহলের ইতিহাস নতুন করে লেখার কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। সেখানে যে কখনো কোন মন্দির ছিল তার কোন প্রমাণ নেই।”
তাজমহল তৈরি হওয়ার আগে সেখানে হিন্দু শাসক জয় সিং এর একটি ‘হাভেলি’ (প্রাসাদোপম বাড়ি) ছিল। শাহজাহান এই হিন্দু শাসক জয় সিং এর কাছ থেকে হাভেলিটি কিনে নেন। এ নিয়ে একটি ‘ফরমান’ জারি করা হয়েছিল। সেটা এখনো আছে। এই ফরমানে দেখা যাচ্ছে মোগলরা তাদের বিভিন্ন চুক্তি এবং ইতিহাস রক্ষায় বেশ সচেতন ছিল।”
রানা সাফভি বলেন, ডাব্লিউ ই বেগলি এবং জেড এ ডেসাহাসের লেখা একটি বইতে এ সব দলিল সংকলন করা আছে।
এ সব বই পড়লে উপলব্ধি করা যায়, এ সব ভবন এবং সৌধের ইতিহাস কত ভালোভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এইসব বই পড়েই যুক্তি দিতে দেয়া যায় যে, তাজমহল তৈরি হয়েছে রাজা জয় সিং এর বাড়ির জমির ওপর এবং সেখানে কোন ধর্মীয় ভবন থাকার কোন উল্লেখ কোথাও নেই। আরেকজন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ হারবনস মুখিয়াও রানা সাফভির বক্তব্যের সাথে একমত।
সম্রাট শাহাজাহান যে, তাঁর স্ত্রীর স্মরণে তাজমহল নির্মাণ করেছিলেন এবং তা একটি মুসলিম স্থাপত্য- এ নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
চলবে…