পর্ব-৩: জানা-অজানায় ‘তাজমহল’

আরিফুর রহমান

সম্পাদক, অচিনপুর.কম

তাজমহলের ইতিহাসকে রীতিমত চ্যালেঞ্জ করে বসেন প্রফেসর পি.এন.অক (Professor P.N.Oak – Taj Mahal: The True Story) তার একটি গবেষণাধর্মী বইতে। এতদিন যাবত আমরা তাজমহল সম্পর্কে যা জেনে এসেছি তা অনেক বড় ভুল বলে তিনি দেখিয়েছেন। 

তিনি তাজমহলে নামকরন নিয়েই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তার মতে তাজমহল কোন ভাবেই মমতাজের নাম থেকে আসেনি। নামটি এসেছে “তেজ মহলয়” থেকে। তিনি দাবী করেন যে তাজমহল বেগম মমতাজ মহলের সম্মানে নির্মিত প্রেমের সমাধিস্থল নয়; বরং এটা প্রাচীন দেবতা শিব (যাকে আগে বলা হত “তেজ মহালয়”) এর মন্দির যেখানে আগ্রার রাতপুতরা পূজা অর্চনা করতেন। পরে মোঘল সম্রাট আকবরের দৌহিত্র সম্রাট শাহজাহান একে তাঁর মৃত স্ত্রীর স্মরণে স্মৃতিশালা হিসেবে গড়ে তোলেন।

রাজ পরিবারের অধীনে থাকায় সাধারণ মানুষের কাছে এ মন্দিরটি ছিল অচেনা। পরবর্তীতে মমতাজ মারা গেলে তাকে এখানে সমাহিত করা হয় এবং সাধারনের সামনে চলে আসে মন্দিরটি। আর তখনই মানুষের মুখে মুখে মমতাজ শাজাহানের প্রেম কাহিনী প্রচারিত হয়। ইতিহাস অনুসন্ধানে তিনি দেখতে পান যে শিব মন্দিরটি সম্রাট শাহজাহান অন্যায়ভাবে জয়পুরের মহারাজার (জয় সিং) কাছ থেকে দখল করেন। সম্রাট শাহজাহান নিজেই তাঁর নিজস্ব দিনপঞ্জীতেও (বাদশাহনামা) উল্লেখ করে গেছেন যে, জয় সিং এর কাছ থেকে আগ্রার এক চমৎকার প্রাসাদোপম ভবন মমতাজ মহলের সমাধিস্থলের জন্য বেছে নেয়া হয় এবং এর জন্য জয় সিংকে অনত্র জমিও দেয়া হয় সম্রাট শাহজাহানের পক্ষ থেকে। 

তাজমহল

“তাজমহল” নাম নিয়েও প্রফেসর  সংশয় প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, মোগল আমল এমনকি খোদ সম্রাট শাহজাহানের আমলেও দলিলাদি ও কোর্টের নথিপত্রে কোথাও “তাজমহল” নাম উল্লেখ নাই। আর তাছাড়া সে সময়ে কোন মুসলিম দেশে মুসলিম শাসনামলে কোন প্রাসাদ বা ভবনের নাম “মহল” রাখার প্রচলন ছিল না। এছাড়া “তাজমহল” নামটি এসেছে ‘মমতাজ মহল’ থেকে এ বিষয়টি তাঁর কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি। তিনি এর পেছনে কিছু  কারণ উল্লেখ করেন।

১৪তম সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মমতাজ মারা যান, মাত্র ৩৮ বছর বয়সে। বলা যায়, শাহজাহান নিজে মমতাজের মৃত্যুকে ডেকে এনেছিলেন, বোধহীনের মতো এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। গর্ভবতী মমতাজকে সঙ্গে নিয়ে তিনি যুদ্ধযাত্রা করেন। দুর্গম রাস্তা দিয়ে হাতির পিঠে বসে দীর্ঘক্ষণ চলার দরুন সময়ের আগেই মমতাজের প্রসববেদনা শুরু হয়। দীর্ঘ ৩০ ঘন্টার সেই প্রসবব্যথা শেষে সন্তান জন্ম দিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মমতাজ, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে।

যমুনার তীরে তখন তাজমহলের নির্মাণ কাজ চলছিল। এমন সময় সম্রাট শাহজাহান তার নিজের মেয়ে জাহানারার ভালবাসাকে জঘন্য উপায়ে কবর দিলেন। মুঘল পরিবারের মেয়েদেরকে বিয়ে করতে দেয়া হতো না। জাহানারা যার প্রেমে পড়েছিলেন শাহজাহান তাকে একেবারেই পছন্দ করেননি। কিন্তু বিদূষী জাহানারা প্রেমে অটল ছিলেন। তাঁর প্রেমিক লুকিয়ে তাঁর সাথে দেখা করতে আসতো। শাহজাহান একদিন মেয়ের প্রেমিককে আটক করতে সক্ষম হন। তারপর মেয়ের চোখের সামনেই মেয়ের সেই প্রেমিককে তক্তা দিয়ে দেয়ালের সাথে আটকে পেরেক গেঁথে গেঁথে খুন করেন ‘প্রেমের’ তাজমহলের নির্মাতা শাহজাহান।

এতকিছুর পরও জাহানারার পিতার প্রতি ভালবাসা এতটুকু কমেনি। তাজমহল নির্মাণের ৫ বছরের মাথায় শাহজাহান পুত্র আওরঙ্গজেব তাকে জোর করে বন্দি করে নিজেকে সম্রাট ঘোষনা করেন, একে একে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেন ক্ষমতার দাবিদার নিজের অন্য ভাইদেরও। শাহজাহানকে তাঁর জীবনের শেষ ৮ বছর আগ্রার দুর্গে গৃহবন্দি হয়ে থেকেই কাটাতে হয়, নীরবে দেখে যেতে হয় ক্ষমতার দখল নিয়ে পুত্রদের কাড়াকাড়ি। নিজে কীভাবে নিজের ভাইদের খুন করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন সেটা নিশ্চয়ই তখন তাঁর মনে পড়ছিল। বন্দি অবস্থায়ই তিনি মারা যান। 

বন্দি জীবনে কে ছিল শাহজাহানের সঙ্গী? তার মেয়ে জাহানারা যার প্রেমিককে শাহজাহান নৃশংসভাবে খুন করেছিলেন। জাহানারা স্বেচ্ছায় পিতার সাথে বন্দি হয়ে দুঃসময়ে পিতাকে সঙ্গ দিয়ে গেছেন। তাহলে প্রেমিক হিসেবে কে মহান? শাহজাহানকে কি আদৌ প্রেমিক বলা যায়? মমতাজের প্রতি তাঁর যে অনুভূতি ছিল সেটাকে কি মোহ ছাড়া আর কিছু বলার উপায় আছে? 

তাজমহলের অপূর্ব সৌন্দর্য্য ও কারুকার্যময়তায় অভিভূত হওয়া স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। কিন্তু তাজমহল নির্মাণের সাথে জড়িয়ে থাকা নির্মমতার ইতিহাসকে ভুলে যাওয়া মোটেই স্বাভাবিক কাজ নয়।

চলবে…

Post navigation