হরর থ্রিলার “প্রতিবিম্ব”
শারমিন সুলতানা চৌধুরী
নিউ ইস্কাটন, ঢাকা।
প্রতিবিম্ব : ৪
কাগজটা হাতে নিয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অতনু। এ কিভাবে সম্ভব? নিশ্চয় কেউ মজা করেনি তার সাথে। কে ই বা করবে, এখানে আছে কে! পুরোনো কোন চিঠি? কিন্তু লাল রঙটা তো রক্তের। রন্টু করছে নাতো এমন?
আপাতত আয়নাটা ঢেকে দিলো অতনু। রন্টুকে ঢুকতেও মানা করলো স্টাডিতে। অর্কও যেন না আসে, খেয়াল রাখতে বললো।
কিন্তু সে কেন বাম হাতে করছে সব কিছু? গল্পে যেমন দেখা যায়, হঠাৎ আঘাত লেগে সব বদলে যায়, তেমন কি কিছু হলো নাকি! চিবুকের তিলও বদলেছে দিক! মনে হয়, যেন আয়না দেখছে সে! আয়না…আয়না…
কি অদ্ভুত, আয়না! আবারো…? তাহলে কি এটা আমি, না আমার প্রতিবিম্ব? ধ্যাত… কি সব ভাবছে সে। সায়েন্স ফিকশন পড়ে আরো কি সব মাথায় আসছে তার। পুরো মহাবিশ্বের বাইরে দিয়ে ঘুরে আসে যদি কোন বস্তু, তার সবকিছু বিপরীত হয়ে যায়। সে কখন আবার এমন অঘটন ঘটালো, কাউকে বলতেও পারবে না। এসব বললে নির্ঘাত পাগলা গারদে পাঠিয়ে দিবে।
রাতে খেয়ে নিজের রুমেই চলে গেলো অতনু। অর্ককে ঘুম পাড়াবে। আজ আর স্টাডিতে যাবে না। তার নিজেরও আসলে আয়নাটা একটা নেশা হয়ে গেছে। ওটাকেই প্রেমা ভেবে কথা বলে যাওয়া। নাহ! এসব বাদ দিতে হবে। বাস্তবে ফিরতে হবে তাকে। অর্কের জন্য প্রেমাকে ভুলে যেতে হবে।
রন্টুটা ঠিক মত রাতের খাবারও খায়নি। কিছুতেই থাকতে চাইছে না। অতনু ভাবছে, ক’দিন অর্কের খালামণিকে এসে থাকতে বলবে। শামা, প্রেমার ছোট বোন। অর্ক খুব পছন্দ করে শামাকে। প্রেমার ছ’বছরের ছোট। ক’দিন ও এসে খেয়াল রাখুক সব।
ঘুমিয়ে পড়লো অতনু আজ একটু তাড়াতাড়িই কত রাত হয়েছে জানে না। আচমকা চিৎকারে ঘুম ভেংগে গেলো। রন্টু? চিৎকার করছে কেন? দৌড়ে রুম থেকে বের হলো অতনু। নাহ্, রন্টু ওর রুমে নেই। বাথরুমেও না। কই গেলো? দারোয়ানকে ডাকলো অতনু। না, সেও কাউকে বের হয়ে যেতে দেখেনি। ছাদেও কেউ নেই। কই গেলো ছেলেটা? কেউ নেই গ্রামে ওর। না বলে কই পালাবে এত রাতে?
হঠাৎ কি মনে হতে স্টাডিতে ঢুকলো অতনু। চাদরটা সরিয়ে দিলো আয়নার উপর থেকে। অস্ফুট আর্তনাদে ছিটকে সরে এলো পেছনে।
প্রেমা! না, এ কিভাবে প্রেমা হয়! প্রেমার অবয়ব শুধু। রক্তাক্ত, অদ্ভুত চাহনী। এই হাসিও প্রেমার নয়। কি হচ্ছে এসব? রন্টু কই?
প্রেমা হাসছে। কি যেন বলছে বিড়বিড় করে। অর্ক… অর্ক… অর্ক আমার!
প্রেমার থেকেও পেছনে। যেন ছায়া একটা। না, এ তো ছায়া নয়, প্রতিবিম্ব! আরেকটা প্রেমা! কেমন ঘোলাটে দৃষ্টি ওর। কাঁদছে। এগোতে চাইছে, পারছে না।
সামনের প্রেমাটা হাত বাড়ালো বাইরে। ছুঁয়ে দিতে চায় যেন অতনুকে। জ্ঞান হারালো অতনু।
প্রতিবিম্ব : ৫
কতক্ষণ ধরে সে এভাবে পড়ে আছে? অতনু জানে না। ধড়মড় করে উঠে দেখে ভোর হয়ে গেছে। চাদরটা আবারো আয়নার উপরে। তাহলে কি ভুল দেখলো সব? রন্টু? আবারো সব রুম খুঁজে দেখলো অতনু। নাহ, কোথাও তো নেই।
একা একাই সব গুছিয়ে নিলো সে। অর্ককে স্কুলে দিয়ে অফিসে যাবে। এক্সাম শেষ আজ। এরপর ক’দিন ওকে নানার বাড়িতে দিয়ে আসবে। দুদিন তার একটু একা থাকা প্রয়োজন। রন্টুকেও খুঁজতে হবে। একটা দিন সময় যাক। নিজে নিজে কোথাও চলে গেলে নিশ্চয় এর মধ্যেই ফিরে আসবে। কিন্তু ওর সব কিছুই এখানে। কিছু না নিয়ে যাবেই বা কেন!
অফিসে গিয়ে জরুরী কাজগুলো সেরে ছুটি নিলো অতনু। অর্ককে স্কুল থেকে নিবে। রাস্তায় জ্যাম। পৌঁছাতে একটু দেরি হলো।
ওর ক্লাস টিচার বেশ অবাক হয়েই তাকালেন,
“একটু আগেই তো নিয়ে গেলেন…”
“মানে? কাকে নিয়ে গেছি?” অতনু আকাশ থেকে পড়লো যেন।
“আপনার বাচ্চাকে। অর্ককে নিয়ে গেলেন তো”
আর কিছুই বললো না অতনু। ক্লাস রুমটা এক নজর দেখে ছুটে বের হয়ে গেলো সে। টীচারকে বলে লাভ নেই। এসব কে বিশ্বাস করবে। কই খুঁজবে অর্ককে সে? অসহায় বোধ করছে অতনু। কি ক্ষতি করেছে সে কারো? কেন এমন হচ্ছে!
স্কুলের মধ্যেই বাচ্চাদের কিছু রাইড আছে। ছুটে ওদিকটায় গেল অতনু। অর্ক খেলছে। ছুটে জড়িয়ে ধরলো ওকে অতনু।
“কি হলো,বাবা? আমার ক্যাডবেরি বাবল কই? “
“দিব রে, তুই চল”
“ওমা, কি বল? পাওনি? আনতেই তো গেলে।ক্যান্টিনে আছে তো”
“তুই চল, অর্ক। তোকে শামা খালামণির কাছে নিয়ে যাবো” গাড়িতে উঠে অতনু বললো।
“কিন্তু বাবা..”
“কিন্তু কি…তুইতো পছন্দ করিস যেতে ওখানে।অভ্র আছে ওখানে। খেলতে পারবি। শামা বলেছে ওরও এক্সাম শেষ”
“মা মানা করেছে যেতে”।
জোরে ব্রেক কষলো অতনু। অর্ক ভয়ে তাকালো বাবার দিকে..
“মানে? কে মানা করেছে?”
“মা…দুদিন আগে বললো এ বাসা ছেড়ে না যেতে।আমাকে টয় দিবে মা। স্টাডিতে খেলতে বলেছে”
“কখন দেখেছিস মা কে?”
“আমিতো প্রায়ই দেখি। রন্টুতো বিকেলে ঘুমিয়ে পড়ে, হি হি হি…। মা ইতো থাকে তখন।”
“অর্ক শোন, মা নেই। তুই ভুল দেখেছিস। তুই নানার বাসায় চল।”
“যাহ্, বাবা, তুমি পঁচা। মা আছে, দেখতো। আমরা খেলি। আমরা সেদিন নতুন খেলা খেলেছি। মা না জানো, আমাকে একটু করে কামড়ে দিয়েছে। মাকে আমি বলেছি,”তুমি কি পাপ্পি ডগ?”
ভয়ে হাত পা কাঁপছে অতনুর। কি বলছে এসব অর্ক। সে কিছুই জানতো না, কেন!
“জানো, মা বলেছে, আমাকে একটা সুন্দর জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাবে। ওখানে সবসময়ই আমি মাকে পাবো”।
“অর্ক শোন। তুই আমাকে ছাড়া কোথাও যাবি না।”
“ওমা! মা ইতো, বাবা! বাবা, তুমি কি এখন সারাদিন চুল আচঁড়াও?”
“কেন?”
“তুমি একটু আগে অন্যরকম লাগছিলে।”
বুঝে গেলো অতনু। অর্কের কাছে সে আসেনি। সেই এসছে, তার প্রতিবিম্ব! সত্যিই কি তাই? নাকি কেউ তারমতো করে সেজে আসলো। একই চেহারার নাকি ৭ জন মানুষ থাকে। দ্বিতীয়জন কি চলে আসলো! কিন্তু সে অর্ককে কিভাবে চিনবে?
অর্ককে নানার বাসায় নামালো সে। শামাকে বুঝিয়ে বললো দু’দিন সে আসবে না। অর্কের জামা-কাপড়, খেলনা দিয়ে যাবে বিকেলে।
বাসার সামনের পার্কটায় বসলো অতনু। সে আর প্রেমা আগে এখানে প্রতিরাতেই হাটতে আসতো। কাল সে দু’জন প্রেমাকে দেখেছে একজন রক্তাক্ত, আরেকজন কাঁদছিলো। সামনের জন আর অন্যজনের মধ্যে কিছুতো একটা পার্থক্য ছিলো। কী, সেটা ভেবে পেল না অতনু। আসল প্রেমা কে তাহলে? এদের একজন..?
প্রেমা বেঁচে আছে তাহলে অন্য কোথাও? অন্য কোন জগতে?
প্রতিবিম্ব : ৬
ধীর পায়ে হেটে বাসায় ঢুকলো অতনু। ঝড় চলছে মস্তিষ্কে । তাকে এই রহস্যের সমাধান করতেই হবে। এই দুই দিনেই ৪৮ ঘন্টার মধ্যে রন্টুকে ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রেমা কোথায় জানতে হবে। কিভাবে করবে তা সে জানে না। এটুকু জানে, সব রহস্য ওই আয়নাতেই।
স্টাডিতে সন্ধ্যে পর্যন্ত সময় কাটিয়ে দিলো অতনু, ঠায় দাঁড়িয়ে, আয়নার দিকে তাকিয়ে। নাহ্, কেউ নেই। যখন প্রেমাকে দেখেছিল, তখন আয়নাটা কেমন একটা টানেলের মতো মনে হয়। তার ওপাশে যেন আরেকটা জগত। রহস্যে ঘেরা আলো আধারি।
কী ভেবে স্টাডিতে প্রেমার শেল্ফটার দিকে তাকালো। ওর প্রিয় বইগুলোতে ধুলো জমেছে। বইগুলো ছুঁয়ে দেখলো অতনু। সমরেশ, সুনীল, প্রথম আলো, গর্ভধারিণী, কিরীটী, ভুতের গল্প, আর। আর বইটা বের করে নিলো অতনু। মলাট দেওয়া। কিন্তু বই না, ডায়েরী। পাতা উল্টিয়ে গেলো অতনু…
অনেক আঁকিবুঁকি। অর্ক এঁকেছিলো হয়তো। আরো যখন ছোট ছিলো। রবীন্দ্র সংগীত, প্রিয় মুভিগুলোর নাম। এইতো, রেখে দিতে গেলো অতনু, তখুনি চোখ গেলো লেখাটার দিকে।
“আমি অতনু কে কি বলবো? আমি জানি না তুমি কে..”
মানে কি? কি বুঝাতে চেয়েছিলো প্রেমা? ওর আমাকে কিছু কি বলার ছিলো?
“স্বপ্ন যখন সত্যি হয়ে যায়, সত্য তুমি কেন স্বপ্ন হয়ে রও!”
মনটা খারাপ হয়ে গেলো অতনুর..প্রেমা তাকে কিছু বলতে চেয়েছিলো। আর সে বুঝতেও পারেনি। ওর মনে গভীর কোন কষ্ট ছিলো। কিছুই বলে গেল না।
এলোমেলো পায়ে স্টাডিতে ঢুকলো অতনু। আয়নাটার সামনে দাড়ালো। অনেক ক্ষীণ একটা আলো দেখা যাচ্ছে। হালকা নীল শাড়ি..এলোমেলো চুল..মুখটা চুলের আড়ালে..আঁকাবাঁকা হেটে এগিয়ে আসছে কেউ। শক্ত হয়ে দাড়ালো অতনু।
আরো এগিয়ে আসছে মেয়েটা। এত এলোমেলো কেন! প্রেমা? কাছে এগিয়ে এলো আরো। ব্যথা পাচ্ছে কেন হাটতে ও? নাকি অতনুকে বিভ্রান্ত করছে?
হঠাৎই ছুটে এলো সামনের দিকে। যেন আয়না ভেদ করে বের হয়ে আসবে। পারল না। বসে পড়লো হার মেনে।
চুলগুলো সরালো। চোখ তুলে তাকালো প্রেমা! তার প্রেমা! এই চোখ কিভাবে সে ভুলতে পারে? আংগুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখছে। যেন আয়নাটা ইশারা করছে কি? কিছু বলছে? কাছে গেলো অতনু।
বিড়বিড় করে কিছু বলছে প্রেমা। অনেক কষ্টে। কান পাতলো আয়নায় অতনু।
“অর্ককে বাঁচাও…”
“কি বলছো প্রেমা? বুঝি না যে।
“অর্ককে বাঁচাও, তুমি যেই হও। আমার অর্ককে বাঁচাও, প্লিজ।”
“আমি যেই হই, মানে? আমি অতনু, তোমার হাসব্যান্ড, তোমার অতনু।”
“না, তুমি অতনু না, তুমি আমার আয়নার মানুষটা”
“মানে? আমি অতনু না, মানে!”
“তুমি সব ভুলে গেছো। আয়নার ওপারে গেছো যে। তুমি অতনু নও। অর্ককে বাঁচাও। প্লিজ ওকে বাঁচাও।”
“কার কাছ থেকে বাঁচাবো?” কি বলবে অতনু বুঝতে পারছে না।
“অতনুর কাছ থেকে বাঁচাও। মেরে ফেলবে ওকে।” নিশ্বাস ফেলতে পারছে না যেন প্রেমা।
“ওকে ও মেরে ফেলবে। অর্ককে। যেমন আমায়….”
অচেতন হয়ে গেল প্রেমা। উঠে দাড়াল নাম না জানা মানুষটা, কে সে?
(চলবে)
অচিনপুর ডেস্ক/আ.সীমা