পর্ব-১: জানা-অজানায় ‘তাজমহল’

আরিফুর রহমান

সম্পাদক, অচিনপুর.কম

ইতিহাসখ্যাত একটি প্রেম কাহিনী আছে যা সাক্ষ্য হয়ে পৃথিবীর বুকে আজও মাথা উঁচু করে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, তা হল মুঘল সম্রাট শাহজাহানের অমর সৃষ্টি “তাজমহল”। এটি পৃথিবীর একটি অদ্বিতীয় নিদর্শন, যার গায়ে লেগে আছে একটি মিষ্টি প্রেমের গল্প।

শাহজাহান তখনও পনের বছরের শাহজাদা খুররম। আগ্রার বাজার দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ-ই এক পরমা সুন্দরীর দিকে চোখ পড়তেই মনে গেঁথে গেল চিরতরে। যাকে বলে, LOVE AT FIRST SIGHT। সুন্দরীর নাম আরজুমান্দ বানু বেগম, বয়স তারও ছিল পনের। তাদের দুজনের যখন বিয়ে হয় তখন অবশ্য রাজনৈতিক কারণে শাহজাহান আগেই পারস্যের রাজকন্যার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ। তাই শাহজাহানের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবেই ঘরে আসতে হয় আরজুমান্দকে। আর এই আরজুমান্দ বানুই হলেন শাহজাহানের ‘মমতাজ’।

১৯ বছর সুখী সংসার চলতে চলতে একবার সন্তান প্রসবের সময় মৃত্যু হয় মমতাজের। আর তাতে শাহজাহান এতোই কষ্ট পান যে, তিনি সাত দিন সাত রাত কিছু খাননি, ঘর থেকেও বেরও হননি। সাত দিন পর শাহজাহান যখন বের হলেন, তখন তার চুলের রং ধূসর হয়ে গেছে, ফ্যাকাসে মুখ দেখে মনে হচ্ছিল যেন ৬০ বছরের বৃদ্ধ। বের হয়ে তিনি এমন এক স্মৃতিসৌধ বানানোর ঘোষণা দিলেন, যা বিশ্বের কাছে এক অনন্য নজির হয়ে থাকবে। সেটাই হল আজকের ‘তাজমহল’।

শাশ্বত ভালবাসার এক অনন্য নিদর্শন ‘তাজমহল’। মোঘল স্থাপত্যের এই অনন্য শৈলীর মাধ্যমে মানব হৃদয়ের ভালবাসার যে বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। তাজমহল নিয়ে মুগ্ধতার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটেছে এক নারীর কথায়। প্রেমিকের সাথে তাজমহলে বেড়াতে গিয়ে তাজমহলের অপার সৌন্দর্য্য দেখে ঐ নারী নাকি তার প্রেমিককে বলেছিলেন, “আমি মারা গেলে তুমি যদি এমন একটা তাজমহল বানাতে পারতে, তাহলে আমি এখনই মারা যেতাম।”

বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের একটি অন্যতম আশ্চর্য হল ‘তাজমহল’। এই বৃহত্তম স্থাপনাটি তৈরী করতে নানা দেশ থেকে নানা ধরনের উপকরণ সংগ্রহ করা হয়েছিল, আর তা হল: রাজস্থান থেকে আনা হল মাখরান নামক আলো-প্রবাহী অস্বচ্ছ সাদা মার্বেল পাথর; পাঞ্জাব থেকে আনা হল লাল, হলুদ, বাদামী রঙের মধ্যম পাথর; চীন থেকে আনা হল ইয়াশ্ম্ নামক কঠিন, সাদা, সবুজ পাথর এবং স্ফটিক টুকরা; তিব্বত থেকে সবুজ-নীলাভ (ফিরোজা) রঙের বৈদূর্য রত্ন এবং আফগানিস্তান থেকে নীলকান্তমণি আনা হল; তাছাড়া শ্রীলঙ্কা থেকে নীলমণি (উজ্জ্বল নীল রত্ন) ও আনা হল।

তখনকার দুনিয়ার বাঘা বাঘা সব প্রকৌশলীদের একত্রিত করা হল সেরা স্থাপনাটি নির্মাণ করবার জন্য। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রকৌশলীদের যে তালিকা পাওয়া যায়, তা হলো: চত্বরের নকশার জন্য পারস্য স্থপতি ওস্তাদ ঈসা; অটোমান সাম্রাজ্য থেকে ইসমাইল খাঁ বড় গম্বুজটির নকশা করেন আর লাহোর থেকে কাজিম খাঁন বড় গম্বুজের চূড়ার স্বর্ণের দ-স্থাপন করেন; দিল্লীর চিরঞ্জিলাল ছিলেন প্রধান ভাস্কর ও মোজাইক-কারক; প্রধান চারুলিপিকর ছিলেন আমানত খাঁ, যার নাম তাজমহলের প্রবেশপথের দরজায় পাথরে খোদাই করে প্রত্যায়িত করা আছে; রাজমিস্ত্রিদের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন মোহাম্মদ হানিফ আর প্রধান ব্যবস্থাপক ছিলেন মীর আব্দুল করিম এবং মুক্কারিমাত খাঁন।

তাজমহলের উচ্চতা ১৭১ মিটার বা ৫৬১ ফুট দীর্ঘ যা কুতুবমিনারের চেয়েও বড়। ১৬৩২ থেকে ১৬৫৩, এই ২২ বছর ধরে ২২ হাজার শ্রমিক ও ১০০০ হাতির অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল এই ‘তাজমহল’। কথিত আছে, যে শিল্পীরা তাজমহল তৈরি করেছিল, শাহজাহান নাকি তাদের সকলের হাত কেটে দেন যাতে তারা আরেকটা দ্বিতীয় তাজমহল বানাতে না পারে। তবে ঘটনার সত্যতার কোন প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। তবে হাতিগুলোরও কি পা কেটে দিয়েছিলেন? দুঃখিত, সে সম্পর্কে কোন কাহিনী তৈরী হয়নি।

তাজমহল আবার বহুরুপী, থেকে থেকে রং বদলায়। সাদা মার্বেল ও প্রতিফলিত টাইলস্ দিয়ে তৈরি হওয়ায় ভবনটি বিভিন্ন আলোয় নিজের রঙ বদলাতে পারে। তাজমহল ভোরবেলায় গোলাপী, দিনের বেলায় সাদা ও সন্ধ্যায় সোনালী আভার মত, ভরা জ্যোৎস্নায় এক অসাধারন অনন্য রূপ হয় তার। তাজমহলের পিলারগুলি বাইরের দিকে হেলানো ভাবেই তৈরী করা যাতে করে ভূমিকম্প হলেও ভবনের পিলার সমাধির উপর ভেঙে পড়তে না পারে। তাজমহলের ভেতর ও বাহিরের চমৎকার ক্যালিগ্রাফির চমৎকার কাজ রয়েছে। মমতাজ মহলের সমাধি ক্ষেত্রেও তাঁর পরিচিতি ও প্রশংসার শিলালিপি দেখা যায়। সমাধিক্ষেত্রের একপাশে আল্লাহর ৯৯ নামের ক্যালিগ্রাফিক শিলালিপিতে অঙ্কিত আছে।

এতকিছুর পরও নানা প্রশ্নে জর্জরিত ইতিহাসে ভালবাসার প্রতীকখ্যাত পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি আশ্চর্য এই “তাজমহল”। শাহজাহান ও মমতাজের প্রেম কাহিনী যতটা আলোচিত ততটাই সমালোচিত। কেউ বলেন মমতাজের নাম থেকে তাজমহল নামটি আসেনি। কেউবা বলছেন মমতাজের প্রতি জাহাঙ্গীরে ভালবাসার স্মৃতিসৌধ হিসাবে তাজমহল তৈরী হয়নি, হয়েছে অনুশোচনা থেকে। কেউ বলার চেষ্টা করেন, শাহজাহান নিজের নাম পৃথিবীর বুকে চিরতরে প্রতিষ্ঠিত করবার লক্ষ্যে নির্মিত করেন তাজমহল। চলুন দেখি গবেষকরা বিষয়টিতে কি ব্যাখ্যা দিয়েছেন?

তাজমহলের ইতিহাসকে রীতিমত চ্যালেঞ্জ করে বসেন প্রফেসর পি.এন.অক (Professor P.N.Oak – Taj Mahal: The True Story) তার একটি গবেষণাধর্মী বইতে।

চলবে

Post navigation