রুবাই এর প্রকৃত উচ্চারণ রুবা’ঈ বহুবচনে রুবাইয়্যাত, এটা আরবি শব্দ, এর ফার্সি অর্থ তারানে বা চার পংক্তির কবিতা। এর স্তবকগুলোর প্রথম, দ্বিতীয়, এবং চতুর্থ লাইনের শেষে মিলযুক্ত, তৃতীয়টি ছাড়া। ‘রুবাই’ কে এক ধরণের চতুষ্পদী শ্লোক ও বলা হয়ে থাকে, যার মিল বিন্যাস হল ক-ক-খ-ক আর লয় থাকে দ্রুত। এটি বিশেষ ছোট আকৃতির স্বমিল সুরেলা ফার্সি কবিতা। সেই রুবাই এর রুপকার হচ্ছেন কবি ওমর খৈয়ম।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় রাজনীতিবিদ চার্চিল স্কেচ রচনায় হাত দিয়েছিলেন। আর ভাবুক ও চিন্তাবিদ ওমর খৈয়ম অবকাশ যাপনের উদ্দ্যেশ্যে ‘রুবাই’ রচনা শুরু করেছিলেন। ওমর খৈয়ম নামে পরিচিত হলেও তার পুরা নাম হল ‘গিয়াস উদ্দিন আবুল ফাতাহ ওমর ইবনে ইব্রাহিম আল খৈয়াম।’ তিনি প্রধানতঃ জ্যোর্তিবিজ্ঞান, অঙ্কশাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা, ভুগোল গবেষক হলেও, কবি হিসাবেই খৈয়ামের খ্যাতি বিশ্বব্যাপি। ইউরোপের সমাজ সাহিত্যে বিস্তর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয় ওমরের কাব্য যাদু। ওমরের কবিতা এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে রাতারাতি সেখানে গড়ে ওঠে খৈয়াম ফ্যান ক্লাব, খৈয়াম বার, খৈয়ম থিয়েটার ইত্যাদি। খৈয়মের দু-একটি বিখ্যাত উক্তি জানে না বা অন্তত তাঁর নাম শোনেনি এমন মানুষ পৃথিবীতে বিরল। কবির একটি বিখ্যত উক্তিতো মানুষের মুখে মুখে ফেরে-
রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে
প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে
বই, সেতো অনন্ত যৌবনা।
‘জন্ম হোক যথা তথা-কর্ম হোক ভাল’। এ প্রবাদের সফল রূপকার ওমর খৈয়াম। একজন অতি সাধারণ তাবু নির্মাতার ঔরসে জন্ম নিয়েও তিনি সর্বকালের অন্যতম সেরা জ্ঞানী, পন্ডিত ও মহামানবে পরিগণিত হন এবং নিজেকে সু-প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি বহু দেশে ভ্রমণ করেন। গণিত ও জ্যোতিষ শাস্ত্রের মত নিরস বিষয়ে মেতে থেকেও তিনি কাব্যের মতো রসাত্মক বিষয়েই বিশ্বখ্যাতি লাভ করেন। পৃথিবীতে তিনিই প্রথম রুবাই্ বা সনেট বা চতুস্পদী রচনা করেন। তার রুবাই চতুস্পদী ছন্দে লেখা কবিতা পাঠক হৃদয় দখল করে। অচিরেই তিনি খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। পবিত্র কোরআন শরীফেও ওমর খৈয়ামের অসাধারণ দখল ছিল। কোরআন শরীফের অনেক তর্জমা তিনি করেছেন।
মরুভূমির মধ্যে গিয়ে একটি যদি শহর গড়ো
একটি হৃদয় সুখী করা তার চাইতেও অনেক বড়,
যদি একটি ব্যর্থ জীবন তোমার প্রেমে ভেজে
শত বন্দি মুক্ত করার চেয়েও সেটা মহত্ত্বর।
এমনি সব খর্বাকৃতির রুবাইগুলোর মধ্য দিয়ে কবি তাঁর মৃন্ময় চিন্তা-ভাবনা, বিবিধ অনুভূতি ও দর্শন তীব্রতার সাথে সুতীক্ষ্ণ ভাবে প্রকাশ করতে সক্ষম হন। ওমর খৈয়াম এক হাজারেরও বেশী রুবাই রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়। দর্শন বা বিজ্ঞান দিয়ে যে ভাব তুলে ধরা যায় না, খৈয়াম তা রুবাইয়ের অবয়বে তুলে ধরতে চেয়েছেন। যুক্তি ও আবেগের করুণ রসের প্রভাবে তাঁর রুবাইগুলি হয়ে উঠেছে অনন্য। আর তাই মার্কিন কবি জেমস রাসেল লোয়েল খৈয়ামের রুবাই বা চতুষ্পদী কবিতাগুলোকে বলেছিলেন ‘চিন্তা-উদ্দীপক পারস্য উপসাগরের মণিমুক্তা’।
আরিফুর রহমান (সম্পাদক, অচিনপুর.কম)
…….::: চলবে :::……..